• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩০ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

‘হঠাৎ পাওয়া’-এর ত্রয়োদশ পর্ব

ধারাবাহিক উপন্যাস : হঠাৎ পাওয়া

  শারমিন আক্তার সেজ্যোতি

১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৪:১১
ছবি
ছবি : শারমিন আক্তার সেজ্যোতি

তুষারের কথা মাথায় এলেই এমন হাজারো ছোটছোট স্মৃতি অবাধে দানা বাঁধে কণার মাথায়, আর সেসব স্মৃতি হাতড়াতেহাতড়াতেই তার মন এক অজানা বিষাদে ছেয়ে যায়। তুষার শব্দটি তার জীবনে এক অদৃশ্য ছায়ার নাম যাকে দেখা যায় না। ধরা যায় না। ছোঁয়া যায় না। যার সাথে সম্পর্কের কোনরকম বাড়াবাড়ি নেই তবুও এক বন্ধুত্ব শব্দের উপরে ভর করে যাকে অনুভবে মিশিয়ে নেওয়া যায় বারংবার।

একদিন তুষারের জীবনেও কোন এক মায়াবিনী, হরিণী কিংবা ডাগর চোখের কোন রূপসী কন্যা নীরবে, নিভৃতে এসে ধরা দেবে। ওর জীবনের উপর নিজের অধিকারের জায়গাটাকে সান দিয়ে পাকাপোক্ত ভাবে খুঁটি গেড়ে বসে যাবে। তুষার বুক উজাড় করে তাকে ভালোবাসায় রাঙিয়ে দিবে। জ্যোৎস্না-অমাবস্যায় ওদের ভালোবাসার মোহময় বাষ্পায়নে ঘরের প্রতিটি ইট, বালু, সিমেন্টকেও ওরা নিজেদের প্রেমের মাদকতায় দিনেদিনে মুড়িয়ে নেবে। ঘরের কোনে উঁকি দিলেও সে বেড়াজালে ভেঙ্গে কেউ ভিতরে প্রবেশ করতে পারবে না। এরপরে দুটিতে মিলে হেসে-খেলে জীবন পাড় করে দেবে।

তবে তুষারের বিয়েতে কণার কি যাওয়া উচিত? এত কাছের বন্ধুর বিয়েতে না গেলে ব্যাপারটা খাপছাড়া খাপছাড়া লাগবে। বিয়েতে তুষারের আড় চোখ হয় তো কণাকে খুঁজবে কিন্তু না তুষার বলেছিলো অন্যকিছু। সে খুব দ্বিধাহীন ভাবেই জানিয়ে ছিলো, ‘তোমাকে আমার বিয়েতে দাওয়াত দিবো না কণা, আর কেনো দিবো না সেটাও বলবো না’।

এ কথা শুনে কণা সেদিন রীতিমতো তাজ্জব বনে গিয়েছিলো। কি এমন কারণ থাকতে পারে যে কণা তুষারের বিয়েতে সামান্য নিমন্ত্রণ পেতে পারবে না? কি সেই কারণ তা জানতে কণার মন নিকষে উদ্বেলিত হয়েছে মুহূর্তেই। এরপরে কতশতো অযাচিত প্রশ্নের খেলা শেষে কণার নানারকম বাকবিতণ্ডায় চাপা পরে তুষার সেই কেনোর জবাব দিয়েছিলো সেদিন তবে তা নেহাত মজা করেই, বলেছিলো - ‘আমার বিয়েতে আসলে তোমার খুব জ্বলবে কণা, কারণ বিয়ের পরে আমার বউপাখির জন্য তোমাকে তো আর সেভাবে পাত্তা দিবো না আমি। বন্ধু হারানোর শোকে তাই তুমি পাগলপ্রায় হয়ে যেতে পারো। আবার বলা যায় না আমার বিয়েটা ভেঙ্গেও দিতে পারো। জয়মামা, সোহেল, অভি, মোমিন এরা প্রত্যেকে আমার বিয়ের ভাঙ্গানি দিবে ঠিক করে রেখেছে। আর ফেন্সি আপু তো সারাক্ষণ বলে, বিয়ের ব্যাপারে বন্ধুদের একদম বিশ্বাস করতে নেই। সেক্ষেত্রে মেয়ে বন্ধু হলে তো কথাই নেই। এই বুড়ো বয়সে এসে বিয়ে ভাঙ্গার রিস্ক একদম নেওয়া যাবে না। তবে নিমন্ত্রণ না দেওয়ার ঘাটতিটা আমি পুষিয়ে দেবো তোমাকে একটা রেডিমেড সারপ্রাইজ দিয়ে। বিয়ের কয়েক বছর পরে আমি আর আমার মিসেস তুষার নিজেদের ফুটবল টিম নিয়েই একেবারে হাজির হবো তোমার সামনে। আমার আণ্ডাবাচ্চাগুলো দৌড়ে গিয়ে খালামনি, খালামনি বলে তোমার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আর তুমি হতভম্ব কিম্ভুত হয়ে মাথা নাড়াবে। হবে না বিশাল সারপ্রাইজ? আর আমাদের সেই ব্যাটেলিয়ন বাহিনীর জ্বালাযন্ত্রণায় যখন সবাই অতিষ্ঠ হয়ে উঠবে তখন মিসেস তুষার সবার আড়ালে আমায় চিমটি কেটে বলবে -দেখতে হবে না কারণ ছেলেপেলে, সভ্য-ভদ্র, শান্ত হওয়া জিনের মধ্যেই নেই তো, হবে কি করে!’

তবে কণা তোমার কাছে অনুরোধ থাকবে সেই নাজেহাল বিষণ্ণ সময়টাতে তুমি একটু তুষারের হয়ে সাফাই গেয়ে দিও কেমন!

তুষারের সেসব কথা মনে হতেই হঠাৎ কোথা থেকে এক অপ্রতিভ মুচকি হাসি এসে ভর করলো কণার দু-ঠোঁটে, মনে হলো তুষারের মতো এমন অদ্ভুত, বেসামাল কথা বলার মতো লোক বুঝি দুনিয়াতে আর দ্বিতীয়টি নেই।

আজকের বিকেলটা অন্যদিন থেকে কিছুটা আলাদা। গতরাতের আকাশের বুকে জমে থাকা থমথমে মন খারাপের অবস্থাটা বেশ কেটে উঠেছে। খুব সকালেই একটা ফকফকে ঝকঝকা মিষ্টি রোদ দিয়ে দিনের সূচনা হয়েছিলো। ঝকঝকে রোদটা এখন স্তিমিত হয়ে তেজহীন রোদের একটা পড়ন্ত বিকেল বয়ে এনেছে। কিছুক্ষণ আগেই কণা রোজকার বিষণ্ণ মুখে একটু স্নো পাউডার মেখে, হাতের মধ্যে দুটো বই আর একটা খাতাসমেত কলম চিবুতে চিবুতে বেশ পরিপাটি ঢংয়ে লাইবার বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হয়েছে। ওদের বাড়ির খুব কাছে এসেই বাড়ির সামনের ভ্যানে সাজানো বাহারি সব আচার নিয়ে বসা দোকানটা থেকে কড়া ঝাল মাখানো চালতার আচার কিনে খেতে খেতে লাইবার ঘরে ঢুকেছে। স্যার এখনো আসেনি তাই দুবান্ধবী মিলে অহেতুক সব বিষয় নিয়ে জমিয়ে গল্প করে চলেছে। আসার পরেই লাইবা হুকুমের কণ্ঠে বলেছে, ‘ম্যাথ নিয়ে বেশি মাতামাতি করবি না কণা আর দুইটার বেশি প্রশ্ন করলে খবর আছে। এত জেনে কি করবি রে তুই? মাথা খারাপ করে দ্যাস আমার।’

উত্তরে কিছু বলেনি কণা শুধু হেসেছে আর হাতে মাখানো আচারের অংশটুকু আরো মনোযোগী হয়ে চেটেপুটে খেয়েছে। এর মধ্যে দরজার গায়ে আস্তে করে আঙুলের টোকা শোনা যাচ্ছে, স্যার এসেছে বুঝতে পেরে দুজনে নিজেদের গুছিয়ে মনোযোগী হয়ে টেবিলের দিকে ঝুঁকে বসলো।

ক্যালকুলাস এর শেষের চাপটারেই পড়া আটকে আছে, গত ২০মিনিট ধরে লাইবাকে একটা ম্যাথই কয়েকবার করে বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে শ্রাবণ। প্রথমবারেই কণা সেটা বুঝে গেছে তাই এখন আয়েসি ঢং এ শ্রাবণকে খুব সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণের কাজটি চালিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটা রাগে না একদম, এক পড়া একশ বার বুঝতে চাইলেও কোন রকম প্রতিক্রিয়া ছাড়াই বুঝিয়ে দেয়।

তবে সত্যিই সে খুব কম কথা বলে। আর কণার কিংবা লাইবা কারো দিকেই খুব একটা তাকায় না সে। বেশির ভাগ সময় নিচের দিকেই তাকিয়ে থাকে। এটা তার ইচ্ছাকৃত সাজানো লুক নাকি স্বভাবসুলভ আচরণ সেটা কণাকে ভাবাচ্ছে।

লাইবা কণাকে চিমটি কেটে খাতার এক কোনে ছোট্টছোট্ট করে নানারকম কথাবার্তা লিখে কণাকে পাস করছে, ‘কণা শ্রাবণ ভাই, কেমন বোকা বোকা না? বল।’

কণা লাইবার একের পর এক লেখা পড়ছে সাথে সতর্ক হয়ে স্যারের দিকে লক্ষ রাখছে, কোথাও শ্রাবণের এই স্বভাবসুলভ আচরণে কণার মনে কিঞ্চিত বিরক্তির আভা ভেসে উঠছে। লোকটা অদ্ভুত! এর ইন্দ্রিয় গুলো কম কাজ করে হয়তো, মানুষ এতো স্থির থাকে কি করে, কই কণা তো কোথাও পাঁচ মিনিট ও চুপ করে থাকতে পারে! নড়ানড়ি কণার সত্তা, লাইবা ও তেমন,বয়সে বড় বলে একটু ভাবগাম্ভীর্যের ছাপ থাকতেই পারে, কিন্তু এই লোকটা, চেয়ারের সাথে ঠেসে মেরুদণ্ডটা একবারে টানটান করে বসে টেবিলের খাতা কলমের দিকেই তাকিয়ে থাকে শুধু, রোবট নাকি? আজব, হ্যাঁ ইনি সত্যিই বোকা, হাবা নইলে জীবনটাকে এমন প্রাণহীন করে রাখার কি মানে?

তবুও কণার শ্রাবণের চেহারাটাকে চেনা চেনা লাগছে,মনে হচ্ছে কিছুটা হলেও পরিচিত মুখ কিন্তু ঠিক কোথায় দেখেছে মনে করতে পারছে না। যাকে বলে টেম্পোরারি মেমোরি লস্ট, কিছুক্ষেত্রে পার্মানেন্ট ও হতে পারে। এই বয়সেই ভুলে যাওয়ার এই রোগটি কণাকে বেশ পেয়ে বসেছে।

‘কণা তুমি বরং ক্যামেস্ট্রি ২য় পত্র বার করো। প্রথম দিকের তিনটে চাপটার বাদে চতুর্থ চ্যাপ্টারটা পড়া শুরু করো’

শ্রাবণের শান্ত গলায় কণা মাথা তুলে তাকালো। আড়ষ্ট গলায় জবাব দিলো, ‘জ্বী স্যার, সরি ভাইয়া স্যার।’

স্যার এবং ভাইয়ার গোলমেলে শব্দচয়নে শ্রাবণ অনুভূতিহীন একরোখা ভঙ্গিতে মুখ বাঁকালো, ‘কণা কিছুটা বিব্রত হয়ে উঠে সহসাই মনের মধ্যে চলতে থাকা প্রশ্ন,পাল্টা প্রশ্নের খেলাটাতে এক বালতি জল ঢেলে রসায়নের বইয়ের মধ্যে মাথা গুঁজলো।’

নবীন- প্রবীন লেখীয়োদের প্রতি আহ্বান: সাহিত্য সুহৃদ মানুষের কাছে ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, রম্য রচনা সহ সাহিত্য নির্ভর আপনার যেকোন লেখা পৌঁছে দিতে আমাদেরকে ই-মেইল করুন [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড