• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৬ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

গল্প : প্রথম মেঘের ধ্রুবতারা

  আ্যন্তনী সজিব কুলেন্তনু

১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১২:৪৪
গল্প
ছবি : প্রতীকী

ছোট থেকেই আকাশটাকে কেন যেন একটু বেশিই ভালোবাসতাম। ঋতুতে ঋতুতে তার স্বাভাবিক পালটে যাওয়া আমাকে অদ্ভুত ভিন্নরকম অনুভূতির জগতে নিয়ে যেত। কেন তা জানি না। মেঘ দেখে যেমন মুগ্ধ হতাম, বিজলি চমকালেও তেমন। পরের আলোটা আবার কখন আকাশ চিড়ে বেরিয়ে আসবে সেই আশায় চেয়ে থাকতাম। বৃষ্টি নামলে মানুষের হুড়োহুড়ি করার কারণ খুঁজে পেতাম না। আমার দৃষ্টি, দেহ, মন ও আত্মা সব চলে যেত ওই মেঘের মগডালে বা যদি ভেলা হয় তবে ভেলায়, ধূসর মেঘের কাছে। তখন বৃষ্টিজলে ভিজলে যেন একটা নেশা লাগতো। গ্রামে যে নদীর পাড়ে ছিপ ফেলে শৈশব-কৈশোরের অপার আনন্দের সময় কেটেছে, যার জলে সাতার কেটে চোখ লাল করে মায়ের হাজার পিটুনি খেয়েছি, সেই নদীও ভুলতে পারি না। আর ভুলতে পারি না মনের নরম উর্বর মাটিতে ফুটিয়ে তোলা একটি ফুলকে, যার নাম ‘তিথি’।

‘তিথি’ না ‘তিতলী’-প্রথমে সঠিক জানতাম না। আর জানতাম না বলেই প্যাঁচটা লেগেছিল। আমার কথা শুনে আপনাদেরও কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছ, তাই তো?? গল্পটাকে প্রথম থেকেই বলি তবে।

আমার তখন সবে এইচ এস সি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। হাতে অনেক অলস সময়। রবী ঠাকুরের মত বললে, ‘সামনে যত দূর পর্যন্ত দৃষ্টি চলে ছুটি ধূ ধূ করিতেছে; পরীক্ষা নাই, উমেদারি নাই, চাকরি নাই; নিজের বিষয় দেখিবার চিন্তাও নাই, শিক্ষাও নাই, ইচ্ছাও নাই’।

থাকবার মধ্যেও ভিতরে আছেন মা আর বাহিরে আছেন ২১ বছর ধরে নিষ্ঠার সাথে পুলিশের চাকরি করে আসা বাবা। আমিই একমাত্র সন্তান তাই ভাই বোন ও নাই। পূর্বপুরুষ সূত্রে পাওয়া দোতালা বাড়িটিতে (অবকাশের মরুভূমির মধ্যে)।

সাথী বলে আমার যা ছিল তা হলো ছাদের উপড় টবে লাগানো কিছু অর্কিড, আর একটা বনসাঁই বনে যাওয়া বটবৃক্ষ। দিন কাটতো এগুলোর সাথেই। কাটতো বললে নিজের প্রতি নিতান্তই অবিচার করা হবে, বলা উচিত কাটাতাম। বাধ্য হয়ে। বাইরে বাহির হওয়া প্রায় নিষেধ সমতুল্য। মায়ের ভয় পাছে আমি বখে যাই দুষ্ট বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে। তবে মায়ের ভয়টা অত্যন্ত যুক্তিসংগত। কারণ, যতগুলো বন্ধুর সাথে আমার হাঁটাচলা ছিল তাদের সবাই এদিক সেদিক, অকাজে কুকাজে জড়িয়ে গেছে। আর যে কজন বাকি আছে তাদেরও অন্যদের মতই অবস্থা। যাইহোক কথা বাড়িয়ে পাঠকের ঘড়ির কাটা বেশি ঘুরানো যুক্তিসংগত মনে করি না।

আমি তখন বন্দি জীবনটাতে প্রায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি, এমনই এক দিনে বাবা হাতে করে একটা খাম নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। সেটা ছিল বাবার বদলির নোটিশ। বাবাকে দেখে বিভ্রান্ত দেখাচ্ছিল আর মাকে দেখাচ্ছিল চুপসে যাওয়া বেলুনের মত। তবে বাবার বদলির নোটিশে আমি কিন্তু মনে মনে খুশিই হয়েছিলাম। যাক বাবা.. অন্তত এই বন্দিদশা থেকে বেরুতে তো পারবো! বাবা বদলি না করার ব্যাপারে উপরতলায় দরখাস্ত করতে পারতেন কিন্তু পেশাদারিত্ব তাকে তা করতে দেয়নি। দীর্ঘ ২১ বছরের চাকরি জীবনে কত মানুষের আদর্শ তিনি। তাই মনের কোন এক কোণে একটুকরো অতৃপ্তি নিয়ে হলেও উপরতলার আদেশের প্রতি শ্রদ্ধা জানালেন। আর ওদিকে ঠিক করা হল নতুন যায়গায় থাকবার বাড়ি। কিন্তু বদলি শহরে হল কেন মায়ের আপত্তি ছিল সেখানেই। শহর বললেও আবার ভুল, একদম পুরানো ঢাকায়। বংশাল থানা। আর থাকবার যায়গা থানার ঠিক উল্টোদিকের ৭ তালা বিল্ডিংয়ে। তবে আমার মন ভরেছিল এই জন্যে যে, বাড়ির সবার উপরের ছাদ সংলগ্ন রুমগুলোই আমাদের হবে। আমি যেন হাতে সোনার কাঠি রূপার কাঠি পেলাম। মনে মনে ঠিক করে ফেললাম কবে কয়টা কি কি এবং কোথায় কোথায় ফুলের গাছ লাগাবো। বাবাই সব ঠিক করে এসে আমাকে ছাদের বর্ণনা দিয়েছিলেন, তাতে আমার মন ভরেছিল।

উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া (বাবার) বাড়িটাকে ছেড়ে যাবার সময় আমার কষ্ট হচ্ছিল। বিশেষত ছাদে থাকা আমার সদ্য ফুল ফোটা অর্কিড গুলোর জন্য, যদিও নতুন ভাড়াটিয়া এক ছেলেকে সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে এসেছিলাম। তবে বনসাইটাকে ফেলে আসলাম না। বাবার শত বারণ উপেক্ষা করেও বট গাছটাকে সাথে নিয়ে নতুন বাড়িতে এসে উঠালাম।

বাবার বর্ণনায় ছাদটাকে যেমনটা কল্পনা করেছিলাম বস্তুত সেটা আরও বড় ও চওড়া ছিল। আমি সত্যি আনন্দিত হয়েছিলাম ছাদের জন্য। বলতে গেলে ছাদটি ছিল আমার রাজত্ব আর প্রজা হিসেবে ছিল কিছু নতুন নতুন অর্কিড, কিছু গাদা ফুলের গাছ, একটা মেহেদী গাছ যেটায় সাদা সাদা ফুলের ছড়াছড়ি ছিল, কিছু লাল গোলাপের চারা এবং দুটো সূর্যমুখী। আর মন্ত্রী হিসেবে ছিল আমার পুরনো সেই বনসাই বট। আমার কেটে যাচ্ছিল ভালোই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মত বললে: ‘মাথার উপড়ে শুধু আকাশ নীচে বিপুলা পৃথিবী।’

পুরানো ঢাকার মানুষগুলো কেউ বেশ ভাল লাগতো। ধর্মে ভিন্ন হলেও উৎসবে কেমন এক হয়ে যায় সবাই। দোলের দিনে রঙ মাখে, একসাথে সবাই ছাদে এসে ঘুড়ি উড়ায়, পূজোর দিনগুলোতে আতসবাজির ঝলমলানিতে আকাশ অচেনা হয়ে উঠে। সব মিলিয়ে বেশ চলছিল আমার।

আমার কাজ বলতে ছিল গাছ গুলোতে নিয়মিত পানি দেওয়া, গোড়ার মাটি আলগা করে দেওয়া কখনো বা সার দেওয়া আর হালকা বেগুনী, গোলাপী রাঙের অর্কিডগুলোর মধুর্যমন্ডিত রূপসৌন্দর্য্য উপভোগ করা। বিকেলে ছাদে দাঁড়িয়ে মেঘের চলাচল দেখতাম এবং নিবিড় গাম্ভীর্যে তাদের ভাষা বোঝার চেষ্টা করতাম।

তেমনই একদিন হঠাৎ আকাশে মেঘ করলো, বাতাস ছড়লো। মনে আছে নতুন বাসায় উঠার পর সেটাই ছিল প্রথম মেঘ করা এবং পরবর্তীতে বৃষ্টি। শুধুই কি বৃষ্টি, সাথে কি একেকটা বরফ শিলা!

সেই বাতাসে কি সুন্দর কালো মেঘ ভেসে আসছিল। জীবনানন্দ হয়তো বলতো 'সুন্দর করুণ '। আমি দৌড়ে ছাদে গেলাম। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে মেঘ দেখছি হঠাৎ পাশের বিল্ডিং এর ছাদে চোখ রাখতেই দৃষ্টি আটকে গেল। নীল সালোয়ার, বুকে হাল্কা মিহি সুতোয় বোনা বোধহয় রেশমি ওড়না, ঘন কালো অবাধ্য চুল নিজেদের উজাড় করে দক্ষিণা বাতাসে মেলে দিয়েছে, দু হাত প্রসারিত করে পাখির মতন নিজেকে বাতাসে এলিয়ে দিচ্ছে এক তরুণী। আমি কল্পনায় তাকে ছুঁয়ে গেলাম যেন। তার স্পর্শ আমায় শিহরিত করতে লাগলো। আমি তার অবাধ্য এলো চুলের গন্ধ পেলাম। সেই গন্ধ আমায় বিভোর করে তুললো। আমি কিছুতেই তার লাবন্য থেকে চোখ সরাতে পারছিলাম না। যেন আমি অসাড়। আমার দৃষ্টি শুধু তাকে দেখবার জন্য, আমরণ, অনন্ত কাল! আমি অচেতনের মত ছুটে গেলাম সেই বিল্ডিং এর দিকে। যেতে গিয়ে আমার গোলাপ গাছের আচড়ে পায়ের খানিকটা রক্তাক্ত হলো, আমি অনুভূতিহীন। দু-বিল্ডিং এর দূরত্ব খুব বেশি নয়। আমি যতদূর পারলাম কাছে গেলাম। তারপর জিজ্ঞাসা করলাম-

এই যে, শুনছো? কি নাম তোমার? মেয়েটি এবার আমায় দেখলো। তারপর একটু ভ্রু কুঁচকে আশে পাশে তাকালো। আমি আবার বললাম-

‘আমি অরূপ, তোমার নাম কি?’ (কিন্তু মনে মনে বললাম আমি তোমাকে ভালবাসি)

এবার সে নিশ্চিত হলো যে আমি তার সাথেই কথা বলছি। সে যেন একটু বিরক্ত হলো বা কিঞ্চিৎ ভয় পেয়ে অবাধ্য চুলগুলোকে সামাল দিতে দিতে চলে গেল। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। তবে কতক্ষণ সে হিসেব রাখিনি। বৃষ্টি নামলো তবুও আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। নেশার ঘোর কাটলো যখন মাথার উপড় ইটের খোয়ার সাইজের একটা বরফ এসে পড়লো তখন। যেন স্বয়ং বিধাতা উপড় থেকে পাটকেল মেরে আমার ঘোর ভাঙালেন। আমি বুঝলাম মাথার একপাশ ফুলে উঠেছে। সেই আঘাতে আমি তিন দিন ভুগলাম ঠিকই কিন্তু সেদিনের পর থেকে আমার ছাদে যাওয়া আসা গেল আরও বেড়ে। এখন মা তিন বেলাই আমাকে ডাকতে আসেন খাবার খাওয়ার জন্য। আমি প্রতীক্ষায় থাকি কখন আবার তার দেখা পাব। কখন তার ভ্রমর কালো চুলগুলো আবার নিজেদের দক্ষিণা বাতাসে এলিয়ে দেবে, তার পাতলা রেশমি উড়না ডানা মেলে উড়ার ব্যার্থ চেষ্টা চালাবে আর আমি সেই ডানা ঝাপটানোর দিকে অবিরত চেয়ে থাকবো।

একদিন বিকেলে আমার প্রতীক্ষার ফল মিললো। আমি গাছে জল দেবার ছলে তার আসার অপেক্ষাই করছিলাম। আড়চোখে দেখলাম সে রেলিং ধরে দাঁড়ালো। আমিও রেলিংএর দিকে এগিয়ে গেলাম। সেই আগের জায়গাতেই আমরা দুজনে দু বিল্ডিংয়ে। মাঝে নিচে থাকা অপরিচ্ছন্ন গলিটা সোজা চলে গেছে বুড়িগঙ্গা পর্যন্ত। আমি গলাটাকে একটু উঁচু করে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমার নামটা তো সেদিন বললে না।’ সে আমার কথায় একটু বিস্মিত হলো। প্রশ্নটা আমি ঠিক কাকে করেছি সেটা নিয়ে যেন দ্বিধায় পড়ে গেল। আমি এবার জোরে বলমাম, ‘হ্যাঁ, তোমাকেই বলছি। কই বললে নাতো তোমার নামটা কি?’

কি করবে ভেবে না পেয়ে সে ক্ষীণ স্বরে বললো, তিথি। তার গলার লজ্জ্বাস্নাত অত্যন্ত নরম ভেজা স্বর আমায় মুগ্ধ করলো। তবে তার কন্ঠে যেন মনের আস মিটলো না বরং শোনবার ইচ্ছা আরো বহুগুণ বেড়ে গেল। সেদিন এটুকু বলেই সে দৌঁড়ে চলে গেল ভেতরে পাছে যদি কেউ দেখে ফেলে, পাছে যদি কেউ কলঙ্কিত করে তার নাম। আমি মন্ত্রমুগ্ধ হলাম ওই ভাসা ভাসা কন্ঠস্বরে। এর পর থেকে প্রতিদিনই তিথি ছাদে আসতো। আমাদের দেখা হতো, লুকিয়ে লুকিয়ে কথাও হতো। তারপর একদিন ফোন নাম্বার দেওয়া নেওয়া এবং এরই সূত্র ধরে মন দেওয়া নেওয়ার কাজ সম্পন্ন হলো আমাদের।

প্রতিদিন আমাদের ছাদে দেখা হতো কথা হতো। সকালে ও যখন স্কুলে যেত তখন আমি ব্যালকুনিতে দাঁড়িয়ে দেখতাম। অনেক ইচ্ছা হতো তিথির সাথে সাথে ওর স্কুল পর্যন্ত গিয়ে এগিয়ে দিয়ে আসি অন্য দশজন প্রমিকের মত। কিন্তু আমার হাত পা প্রায় বাঁধাই ছিল। তাই তিথিকে নিয়ে এই নরম মনের কত কত রঙিন স্বপ্ন পরিণত হবার আগেই নিজেদের রঙ হারিয়ে শেষে আমার এই মনকেই রক্তাক্ত করেছে তার হিসেব আমি ছাড়া আর কেউ রাখেনি। ভেবেছিলাম কষ্টগুলোর কথা তিথিকে বলবো কিন্তু সেই সুযোগ উপরওয়ালা আমার কপালে জুটায়নি। একদিন মনের কষ্টকে আর চেপে রাখতে পারলাম না। তিথিকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিলাম যে আমি ওর সাথে স্কুল ছুটির পর দেখা করবো। আর পরের দিন ঠিকই বাড়িতে মিথ্যা কথা বলে অনেকটা মায়ের অবাধ্য হয়েই বাড়ি থেকে বের হোলাম। তিথির স্কুল ছুটি হয় ১২টায়। আমি স্কুলের কাছে পৌঁছলাম ঠিক ১১:৩০ মিনিটে। হাতে এখনো আধঘণ্টা সময়। কি করবো ভেবে পাচ্ছিলা না। এই সময় অভিভাবক ঢোকা নিষেধ তাই গেইট এর সামনে বেশখানিকটা জটলা। সামনে বাবুবাজার ব্রিজ। ব্রিজটার নাম আগে অনেক শুনেছি কিন্তু আজ দেখালাম প্রথম। সময় কাটানোর জন্য এক প্যাকেট বাদাম কিনলাম। বাদাম খেতে খেতে ব্রিজের উপর লেগে থাকা বিশাল জটলা দেখাছিলাম এমন সময় কেউ একজন পেছনথেকে আমার কাঁধে হাত রাখলো বুঝতে পারলাম। পেছন ফিরে তাকাতেই দেখি আমারই গ্রামের এক বন্ধু। ভাল নাম বাবুল কিন্তু আমারা ওকে বাবলা বলে ডাকতাম।

প্রায় আট দশ বছর হবে গ্রাম থেকে চলে আসছে ওরা। মাঝে মাঝে ছুটি ছাটায় গ্রামে বেড়াতে গেলে দেখা হয়ে যেত। বাবলাকে দেখে আমি একটু অবাক হলাম। এখানে এইভাবে ওর সাথে দেখা হবে ভাবতে পারিনি। ওর চেহারায়ও কিছুটা বিস্ময় কিছুটা আনন্দ আর মুখে মুচকি একটু হাসি। আমি বললাম-

- আরে বাবলা! আমি সত্যি দেখছি তো! - হুম, সত্যিই দেখছিস বন্ধু। আমি বাবলাই। তুই এখানে কি করে? - তুই তো জানিস না। গত মাসে আমরা গ্রাম থেকে শহরে চলে এসেছি। হঠাৎ করেই বাবার বংশালে পোস্টিং হলো। আর আমাদেরও আসতে হলো। - তোর বাবা, মাসিমা সবাই ভাল আছেন তো? হাতের বাদাম গুলো মুখে পুরে চিবুতে চিবুতে বললাম- - সবাই ভাল আছে। এতদিন বাদে বাল্য বন্ধুকে পেয়ে স্মৃতির স্রোত যেন বাঁধ ভেঙে গেল। বাদাম ততক্ষণে ভাগাভাগি হয়েগেছে। কত কথা চললো আমাদের মধ্যে হিসেব নেই। এর মধ্যে কখন যে স্কুল ছুটি হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। কথার এক সময় বাবলা জিজ্ঞাসা করলো- - কিন্তু এই গার্লস স্কুলের সামনে তোমার কি কাজ সেটা যে আমার কাছে পরিষ্কার হলো না বন্ধু। নাকি কাউকে মনে ধরেছে?' আমি একটু লজ্জা পেলাম ঠিকই কিন্তু মনের কথা চেপে রাখতে পারলাম না। বললাম- - শুধু মনে ধরেনিরে বন্ধু, বলতে পারিস সবই ঠিক হয়ে গেছে। আজ যখন তুই সময়মত এসেই গেছিস তখন তোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেব। - কি নাম বৌদির? আমি একটু হেসে বাবলার মুখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলাম-একদম - তিথি নামটা বলে পেছনে চোখ পড়তেই দেখি তিথি দাঁড়িয়ে আছে। কথা বলতে বলতে কখন যে স্কুল ছুটি হয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। আমি তিথিকে দেখে হাসতে হাসতে বললাম- এইতো তুমি চলে এসেছ। এসো পরিচয় করিয়ে দেই। বাবলাকে দেখিয়ে বললাম ও আমার গ্রামের বন্ধু বাবুল। আমরা একসাথে কত মজার সময় যেযে পার করেছি। কথাগুলো বলে তিথির দিকে এক ধাপ এগিয়ে যেতেই কি জানি কেন তিথি তার ডান হাতে আমার বা গালে সজোরে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিল। আর আমি কিছু বোঝা বা বলার আগেই কাঁদতে কাঁদতে দৌঁড়ে চলে গেল। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। পাশের টং থেকে কয়েকজন চা-কলা খাচ্ছিল। চড় মারার শব্দে তারা কিছুক্ষণ খাওয়া থামিয়ে আমাকে দেখলো। তারপর আবার আপন মনে খাওয়া শুরু করলো। বাবলার দৃষ্টিতে হাজারো প্রশ্ন আর বিস্ময়, বুঝতে পারলাম। কিন্তু আমি কোন সূত্রেই চড় মারার হিসেব মিলাতে পারছিলাম না। আমি কাঁদছিলাম না কিন্তু আমার চোখদিয়ে জল পড়ছিল। সেদিন বাড়ি এসে কেঁদেছিলাম অনেক। বার বার ফোন করছিলাম তিথির নাম্বারে কিন্তু ফোনে পাচ্ছিলাম না। সারাটা বিকেল ছাদে দাঁড়িয়ে থাকলাম কিন্তু তিথি ছাদেও এলো না। আমি রীতিমত অস্থির হয়ে উঠছিলাম। রাতে ঘুমাতে পারলাম না। গলাদিয়ে খাবার নামছিল না। পর দিন কিভাবে দেখা করবো ভাবছিলাম। ছাদে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছিলাম তিথি স্কুলে যায় কিনা সেটা দেখার জন্য। কিন্তু ওকে স্কুলেও যেতে দেখলাম না। অজানা কোন এক আশংকায় আমার দম যেন বন্ধ হয়ে আসছিল। তাই সরাসরি ওর বাসায় যাব বলেই ঠিক করলাম। সন্ধ্যায় বাবা বাসায় ফেরার আগেই বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম। মাকে কিছুই বললাম না। ফোনে তিথি বলেছিল ওরা পাঁচ তালায় থাকে। তাই ওদের এপার্টমেন্ট এ গিয়ে পাঁচ তলায় সরাসরি বেল বাজালাম। অনেক্ষণ বেল বাজানোর পরেও কেউ দরজা খুললো না। বুঝলাম কিছু একটা গড়বড় নিশ্চয়ই হয়েছে। তাই আমি একবুক সাহস সঞ্চার করে চলে গেলাম বাড়িওয়ালার কাছে। মনে মনে নিজেকে বলছিলাম 'কি ব্যাপার অরূপ, তোমার এত ভয় কিসের তুমি না পুলিশ অফিসারের ছেলে।' আবার পরক্ষণেই বাবার অগ্নিমূর্তি চোখে ভাসছিল। আমি এখানে কাউকে না জানিয়ে এসেছি জানতে পাড়লে আর রক্ষে থাকবে না। তখন আমাকেই না জেলে ঢুকিয়ে দেয় কে জানে। এইসব হাজারো অবান্তর চিন্তা ভাবনা মাথায় ঘোরপাক খাচ্ছিল। বাড়িওয়ার ফ্ল্যাটে গিয়ে বেল বাজালাম। একটু পড় হাজী টাইপের সাদা লম্বা দাড়িওয়ালা একজন দরজা খুললো। চেহারায়ই বলে দিচ্ছিল ইনি বাড়িওয়ালা। এক দম খাঁটি ঢাকাইয়া, কথা শুনেই বুঝেছিলাম।

আমি আমতা আমতা করে জিজ্ঞাসা করলা,‘আচ্ছা আপনাদের এখানে তিথি'রা থাকে না, আমাকে.....’

আমার মুখের কথা পুরটুকু শোনার কোন ইচ্ছাই দেখলাম না হাজীর মধ্যে। তার আগেই বলে উঠলো, ‘তিথি? তিথি আবার ক্যাডা? এইহানে কোন তিথি-ফিথি থাহে না। তুমি ক্যাডা?’

আমি একটু বুঝিয়ে বলার ছলে বললাম - ‘না মানে, এই বাসারই পাঁচ তলায় থাকতো ওরা।’ - ওহ, ওই মাইয়ার কথা কইতাছ? ওর নাম তো তিথি না বাবা। ওর নামতো 'তিতলী'। ওরাতো বাসা বদলাইছে। আজকেই দুপুরে চইলা গেছেগা।

আমার মাথায় যেন বাজ পড়লো। এক তিথিদের বাসা পাল্টানোর কথা শুনে আর দুই বাড়িওয়ালার মুখে ওর আসল নামটা শুনে। এবার আমার মাথায় লেগে থাকা সব প্যাঁচ জলের মত স্বচ্ছ পরিষ্কার হয়ে গেল। সেই সেদিন, যখন আমি ছাদে দাঁড়িয়ে নাম গিজ্ঞাসা করেছিলাম, সেদিন ও ভাসা ভাসা কন্ঠে নামটা তিতলীই বলেছিল। কিন্তু ওর গলার মিহি আওয়াজ বাতাসে ভেসে আমার কানে এসে ধরা দিয়েছিল তিথি হয়ে। ভুল আমারই হয়েছিল। সেই শুরুতেই। এর পরে আর কখনো আমি সেই নামে ওকে ডাকিনি, ডাকতাম "নীলা" বলে। এটা আমার ভালবাসার দেয়া নাম। ডাকলে অবশ্য এই ভুল কিছুতেই হতো না।

আমি এবার বুঝতে পারলাম যখন স্কুলের সামনে আমি বাবলাকে বলেছিলাম ওর নাম ‘তিথি’ তখন পেছনে দাঁড়িয়ে আমার নীলা সব শুনছিলো। নাম তিথি বলায় ও নিশ্চই ভেবেছে আমি অন্য কোন মেয়েকে ভালবাসি যার নাম তিথি আর ওর সাথে করছি প্রেমের খেলা। আমি ধীর পায়ে বাড়ি ফিরছিলাম। আর কিছু ভাবতে পারছিলাম না নিজেকে অপদার্থ ভাবা ছাড়া আর।

সেই ঘটনার পর বছরখানেক পার হয়ে গেছে আমি আর ছাদে আসিনি। আমার অর্কিডগুলো সব মরে গেছে শুনেছি তবে বনসাইটা নিশ্চই বেঁচে ছিল আমাকে শেষবার দেখবার আশায়। আজ এতদিন পরে আবার সেই পুরোনা রেলিং পুরোনো সব কিছু তিথিকেই বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছে। আমি আজও আশায় থাকি। তিথি নিশ্চয় আসবে, আর সেদিন আমি ওকে জড়িয়ে ধরে তিথি আর তিতলীর প্যাঁচ খুলবো।

নবীন- প্রবীন লেখীয়োদের প্রতি আহ্বান: সাহিত্য সুহৃদ মানুষের কাছে ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, রম্য রচনা সহ সাহিত্য নির্ভর আপনার যেকোন লেখা পৌঁছে দিতে আমাদেরকে ই-মেইল করুন [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড