রোকেয়া আশা
আমি আর থাকতে না পেরে আব্বু আম্মার ঘরে যাই। স্পষ্ট করেই বলি, ‘ফুফুকে খবর দিতে হবে।’ আব্বু এবারে আর কোন কথা বলে না। মানুষ নির্বাক হয়ে যায়, কেন হয় তার কোন ব্যাখ্যা আমার জানা নেই। আম্মা শুধু খুব অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। বরাবরই মুখচোরা থাকা মেঘনা কবে কখন এত স্পষ্ট কথা বলতে শিখলো, বোধহয় তাই ভাবছে। আমি শাহীন ভাইকে ডাকি, ভাইকে নিয়ে ওঘর থেকে বের হয়ে আসি। বাহিরে এসে দাদাকে বললাম, ‘রূপু আপাকেও একটা খবর দেওয়া উচিত ভাই।’ আমার কাছ থেকে ভাই এই কথাটা হয়তো আশা করেনি । ভ্রু দুটো কুঁচকে তাকিয়ে আছে। আমি আবার বলি, ‘ও একটা ভুল করেছে সত্যি, কিন্তু পরিবারের একটা মানুষকে শেষবারের মত দেখবে না?’
ভাই কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, ‘এসব সেন্টিমেন্ট কি আসলেই জীবনে কোন কাজে লাগে মেঘ? রূপসার খোঁজ আমরা যেকোনো ভাবেই হোক জেনে গেছি এটা ঠিক। কিন্তু আর কেউ তো জানে না। আব্বুকে রূপসার মুখোমুখি করা কি খুব ভালো হবে মনে হয় তোর?’
আমার ভেতর রাগ চেপে যায় হঠাৎ, অনেকটা মরিয়া হয়ে বলে ফেলি, ‘তাহলে ফুফুকে কেন আনতে চাইছো?’ ভাই ছোট একটা শ্বাস ফেলে বলে, ‘তুই বয়সের তুলনায় অনেক ম্যাচিউরড, এটা আমি জানি। কিন্তু এখনো এতটাও বড় হয়ে যাসনি। এই ব্যাপারগুলো পরে বুঝবি দেখিস একদিন।’
আমি আর কথা বাড়াই না, বলা ভালো বাড়াতে পারি না। আমার ভেতরে কি একটা আটকে থাকে। আমরা সবসময় নিজের দুঃখগুলোকে এত বড় করে দেখি। আশেপাশের মানুষগুলোর দুঃখ বোঝার সময়ই হয় না আর। ঠিক যেমন শাহীন ভাইয়ের দুঃখ কখনো বুঝি না আমি। ভাই রাতে ঘুমায় কিনা তাও জানি না। আমাদের তিন ভাইবোনের থেকে একদম বিচ্ছিন্ন আম্মার কথাও আমি জানি না।
ফুফু এলো দুপুরের ঠিক পরে। বাড়িতে তখন অনেক মানুষ। আমি ফুফুকে হঠাৎ দেখে চিনতে পারি না। মাথার একটা চুল পাকেনি। মুখের চামড়া এখনো কেমন টানটান। সুন্দরী আছে এখনো। দেখে কেউই বিশ্বাস করবেনা এই মহিলার দুটো বিয়ে হয়েছে। আগের পক্ষের ছেলের বয়স ষোল। ঋদ্ধ ভাইয়াই প্রথমে এগিয়ে এসে কথা বললো আমার আর মাহিনের সাথে। আমাকে দেকে বললো, ‘এই তুই মেঘনা না?’ আমি প্রথমে চিনতে না পেরে তাকিয়ে থাকি কিছুক্ষণ। ভাইয়াই একটা শ্বাস ফেলে নাম বলে, ‘আমি ঋদ্ধ। তুই যখন ক্লাস ফোরে পড়তি, তারপর থেকে আমার সাথে তোর আর দেখা হয়নি। এজন্যে মনে হয় চিনতে পারছিস না’
আমি তখনই চিনে ফেলি। এটাই ফুফুর বড় ছেলে। আমার আর মাহিনের ঋদ্ধ ভাইয়া। এমন কিছু মুখের আদল বদলায়নি ভাইয়ার। শুধু লম্বায় বেড়েছে আগের চেয়ে অনেকটা। আমি হাসার চেষ্টা করলাম একটু ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে।তারপরে বললাম, ‘ফুফু কই?’
আমার প্রশ্নের উত্তরে ভাইয়া কিছু বললো না। শুধু হাত তুলে দেখালো। তখনই আমি ফুফুকে দেখি। পাঁচ বছর পর। এখনো আগের মতই আছে দেখতে। ফুফুর কাছে তিন কি চার বছরের পুতুল পুতুল একটা মেয়ে বাচ্চা ঘোরাঘুরি করছে বারবার। ফুফু কাঁদছে খুব, পুতুলটা অবাক হয়ে সেটাই দেখছে।
এই সময় ঋদ্ধ ভাইয়া বললো, ‘আমার বোন আনিসা। এই কথা শুনে আমি ঋদ্ধ ভাইয়ার দিকে তাকালাম। এর পরেই মনে হলো, স্বাভাবিক। এই পাঁচ বছরে কি হয়েছে, আমরা কেউই খোঁজ রাখিনি। এরমধ্যে ফুফুর একটা মেয়েও হয়েছে, জানার কথা না আমাদের। আনিসা বোধহয় এত মানুষ আর এত কান্নাকাটি দেখে ভড়কে গেছে। দুপুর পার হয়ে গেছে বেশ অনেক্ষণ আগেই। আসরের নামাজের পর জানাজা হবে। আমি ফুফুর কাছে এগোই, ফুফু আসার পর থেকে আব্বু বা আম্মা কেউই ফুফুর সাথে কোন কথা বলেনি। আমি শুধু ফুফুকে ডেকে একবার বললাম, ‘ফুফু, আনিসা তো মনে হয় কিছু খায়নি এখনো?’
ফুফু চমকে উঠে তাকায় আমার দিকে। আমি সেদিকে মনোযোগ দিই নাই। হাঁটু গেড়ে বসে আনিসাকে কাছে টেনে নিয়েছি। তারপর ওকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়াই।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড