• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

অনুবাদ কবিতা

শা্র্ল বোদলেয়ারের ‘নৌ-যাত্রা’

  অনুবাদক : মোস্তফা তোফায়েল

২৭ ডিসেম্বর ২০১৮, ১২:৪৩
কবিতা
ছবি : প্রতীকী

ভাবে শিশু ভূগোল, রঙিন ছবি দেখে, ভূধর দেখার সাধ মেটানো সহজ! নক্ষত্ররাজির আলো বিভাসিত পৃথিবীর রূপ কী বিশাল উজ্জ্বল আজ! দিবসের ব্যবধানে সেই রূপ ক্ষুদ্র এক ফোঁটা শুষ্ক আলোক শুধু!

একদা সকাল বেলা, তুলে পাল ধরে হাল সাহসে উথাল নৌকো ভাসিয়ে দেই বিশ্বাসের সরল সাগরে। ঢেউয়ের মখ্মল ফেনা উচ্ছল ফোলে ; সাগর বিশাল, ভারী ! আমাদের অকুল ভাবনা দোল-খায় দোলনার তালে।

সস্তা স্বগৃহবাস সহজ, সেকেলে, অলস। এটাকে পেছনে ফেলে নৌ-যানে পাখা মেলে উড়ে যেতে চায় কেউ কেউ; শিশুতোষ আদুরে জীবন ঝেড়ে ফেলে, দেয় দৌড় দূর দেশে। উর্বশী, ললনা বুকের সূচালো শিখর দেশে বায়নোকুলার তাক্ করা, আদি ও আসল পটভূমি। আহা ! সেই রমণীরা কী চটুল নর্তন কুর্দনে !

একদা সরীসৃপ ছিল কি মানুষ! সে-জীবনে ফিরে যাওয়া কী যে দুঃসহ! না! সে হবে না। আকাশে উড়োবে ওরা, জ্বল্জ্বলে আলোকের দেশে। সরীসৃপী শীতলতা আর নয়, অলস, প্যাঁচানো, যৌনতাও নয়! সূর্যের আতপ্ত রেখা দিক্ পুড়ে কঠিন সময়, দেহ হোক্ তামা-জ্বলা। প্রকৃত অভিযাত্রী ওরাই কেবল- যারা বলে, “দূরে, বহু দূরে ভেসে যাবো, নিঃসীম বেলুন হয়ে আকাশে উড়াবো ; আকাশের বুকে আছে আমাদের চিরচেনা দাগ কাটাপথ।”

দাগী বাজিকর ওরা, অভ্যস্ত কামান দাগাতে। হিসাব নিকাশ নয়, বিজ্ঞানের ছক-কাটা নয় ; কেবলই স্বপ্নের গ্রিজে কল্পচাকা রোমাঞ্চে ভিজিয়ে ঘুরায় আকাশে ওরা।

যে তালে অপ্সরী নাচে ম্যারাথন বেগে, সেই তালে আমরাও নাচি রাতভর। লাফাই ওপর নিচ, আহা! কী চমক! দারুণ লাটিম নাচ। নাচের তুঙ্গ আবেগ বেত্রাঘাতে ঘুমকে তাড়ায় বে-রসিক সূর্যদেব উঁকি দিলে, চাবুকের ঘায়ে কৃষ্ণমূর্তি দেবদূত দেয় তাকে ঝটিতি চালান। আচানক খেলোয়াড়ী। নাম নিশানাহীন লক্ষ্যবিন্দু। মানুষের দুর্গমপ্রীতি, অসীমের পথে ছুটে চলা; উন্মাদের মতো তার অথৈ পাতালে ডুব দেওয়া; অভিযানে তৃপ্তি খুঁজে ফেরা!

আমাদের আত্মার পূজ্য বন্দরের ত্রি-মূর্তি প্রভু: নর্তকী, সুরা ও সাকী। পাটাতনে লাফ দিয়ে কেউ জোর চিৎকারে বলে: “এইতো পৌঁছেছি ঘাটে!” আরো জোর উল্লাসে কেউ ফেটে পড়ে: “এসো খেলি ফুটবল, এ যে এক বিস্তীর্ণ টিলা!”

বায়নোকুলার হাতে, অতি উৎসাহী চোখ তুলে, কেউ দেখে এল্ডোরাডো- বিগত রাতের স্বপ্ন হাতের মুঠিতে! তন্দ্রালু চোখ ঘষে কল্পনার মোহন নয়নে ভোরের অরুণালোকে কেউ দেখে পর্বতের চূড়া, স্বচ্ছ পানির ওপর ধীরে ধীরে মাথা তুলে চায়! ভারতীয় দ্বীপ এসে ধরা দেবে- হায় রে স্বপ্নালু বন্ধুগণ! দড়ি বেঁধে ফেলে দেবো তোমাদের, এখনি সময়! নাবিকের দল যারা অ্যামেরিকা আবিষ্কার করে, মিছে আশা কুহকের গভীর হতাশে তারা সলিল সমাধি খুঁজে পায়।

যারা চলে কাদা ঠেলে, বস্তির জঞ্জাল ভেঙে ভেঙে, সেই বুড়ো বাউণ্ডেলেরা বাতিওয়ালা ঘর খুঁজে পেলে গন্ধ পায় হুইস্কির, স্বর্গের, মুক্তির- আমাদের অভিলাষী চোখের তারায় ভাসে ছবি নন্দনের, স্বর্গবাসী সিজার-ক্যাপ্রির।

৩ সরল রোমাঞ্চভরা যাত্রীগণ অশ্র“গাঁথায় লেখা তোমাদের অশ্র“ত কাহিনি! স্মৃতির জানালা খুলে দাও- নক্ষত্রের মনিহার, নীলিমার নীলকান্ত,মুকুতা কিঙ্কিনী হরণ করেছো কত শত শত অভিযাত্রা কালে?

আমরা সাগরে যাবো, বিনা পালে, বাতাসবিহীন, বুকচাপা বন্দিশ্বাস কারামুক্ত হবে আমাদের। আত্মারা স্বপ্নঋদ্ধ বলাকা পাখায় উড়ে যাবে আকাশের আদিগন্ত নীলিমায় ভেসে।

কী কী দেখেছো তোমরা, অভিযাত্রা কালে, বলো দেখি!

৪ “তারকা তরঙ্গরেখা দেখেছি আকাশে, একটি অথবা দু’টি। দেখেছি বালুকাবেলা তটরেখা জুড়ে ; যদিও আমরা দেখি, মাস্তুল ও দূরবিন সহযোগে- আমাদের বিরক্তি একই প্রকার, তোমাদেরই মতো। উদার সাগর জলে সৃর্যটা কেমন বেগুনি ! কিনারে নগরীগুলো কেমন গর্জে সন্ধ্যাকালে ! আমাদের হদয়ের নবতর অবিশ্রান্ত তেজ ওরাই যোগান দেয়। ভারত মহাসাগর আমাদের চির পূজনীয়- মরি যদি নিমজ্জনে, তবু !

প্রাচীন সামন্ত সৌধ, পুণ্যলোভী জনতা মাজার, অথবা, অবসন্ন তীর্থঘেরা কথার ফোয়ারা আমাদের আত্মাকে, পারে না অনল-ক্ষুধা উপহার দিতে; যে-পারে সে বজ্রানল মেঘের প্রদেশে, অজানা ঘটনা দূর আকাশের নীলে। আমাদের আত্মাগুলো, এমনই প্রচণ্ড ক্ষুধাতুর!

তরুণ মৃণাল বাহু কাছে টানে সূর্য আলোক। বয়সের বল্কল যখন শীতের মেদে ঢাকে, তখন মুক্ত আকাশ দেয় তাকে উষ্ণ আমেজ। কাম-তাপ রসায়নে, দেবদারু, বাড়ে টগ্বগ। বৃক্ষরা! তোমরা কেন লক্লকে বেড়ে যাচ্ছো শুধু, সাইপ্রেসেরও চেয়ে দীর্ঘতর? হয়তো ছবির বইয়ে তোমাদের ছবি আঁকা হবে। আমরা আত্মিক সত্তা, বস্তু-সত্তা বুঝিনা কখনো; নব নব অভিযান, দূরত্বমুগ্ধতায় আমাদের আত্মা মূল্য পায়।

একাধিক শিঙওয়ালা দেবমূর্তি সালাম করেছি; সারিবদ্ধ বুদ্ধমূর্তি মন্দিরেও প্রবেশ করেছি; স্লাভ সন্ন্যাসদের সাক্ষাতের চেষ্টা করেছি; এক-শিঙওয়ালা সিংহ তাকেও দেখেছি। আমাদের অভিজ্ঞান, নিঃসন্দেহে, ধনপতি রথচাইল্ড্কে দেউলিয়ার লজ্জায় ডুবাবে!

স্বর্ণরেণুসমৃদ্ধ পশমী পোশাক পরা পীর, দেখেছি অনেক দেশে, অনেক আবেশে! দেখেছি নর্তকীদের, অপ্সরী সাজে- নানা রঙ উল্কি আঁকা উদ্ভিন্ন তলপেট, নিতম্বপ্রদেশ।

৫ এর চেয়ে চম্কানো, গা শিউরে-ওঠা আর কী কী দেখেছেন?

৬ অবোধ, অবুঝ শিশু, শোনো তবে!

আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই কিছু বিষয় জানতে বাধ্য হয়েছি । জীবনের সিঁড়িটার ওপর-নিচ, এমাথা ওমাথা ওঠানামা করে করে জানাজানি বাকি নেই আর; অমর পাপিষ্ঠদের প্রভাতফেরির মঞ্চ জগৎ সংসার!

এখানে রমণীগণ ময়ূরপুচ্ছধারী, অপচিত্র, দাস্যবশীভূত; অর্থলোলুপ তারা; কষ্টকর রতিশ্রমশীলা; লম্পট পুরুষ ওদের অত্যাচারে নেয় প্রতিশোধ; দাসীদেরও দাসী হয় রমণীরা, স্নান করে নর্দমা ফেনায়। বয়েসী দুহিতাগণ কান্নাকাতর; বালকেরা ভোগতৃপ্ত জীবনের প্রতিটি প্রহর; রাষ্ট্রীয় ভোজসভা ঝাঁঝালো ব্যঞ্জন আর রক্তহোলি ভরা; মন্ত্রীগণ আচ্ছন্ন ক্ষমতার মোহে; কষাঘাত অপেক্ষায় রাত জাগে শিল্প-শ্রমিক। পৃথিবীর সর্বত্র ধর্মগুলি স্বর্গ অভিমুখী, আমাদের ধর্মও তেমন। সাধুসন্ত শু’য়ে থাকে পাখির পালকতুল্য রম্য বিছানায় ভোগসর্বস্ব সব, উন্মত্ত বন্য কামাতুর।

আপন প্রতিভামগ্ন অনেকেই নিজ নিজ ধী-শক্তির আঠালো কাদায় শু’য়ে আছে; পাগল আখ্যায় তারা আখ্যায়িত, মানসিক যন্ত্রণায় দাঁত-কামড়ে, সমস্ত জীবন গড়িয়ে গড়িয়ে তারা পথ চলে, ঈশ্বরের দিকে, বলে শেষে: “হে প্রভু, এসেছি কাছে, প্রতিবিম্ব আমি যে তোমার, অভিশপ্ত আত্মা আমার! অভিশাপ ছাড়া আর কী-ই বা তোমাকে দিতে পারি!” আনন্দলোক দিলে মঙ্গলালোক তুমি পেতে।

আর কিছু লোক আছে শিল্প ও কবিত্বময়, আপন আপন বিশ্বে তালাবদ্ধ। স্বীয় উচ্চতায় জাড্যপ্রেমিক তারা। অদৃষ্টের বেড়িমুক্ত: নৈরাশ্যে, সংশয়ে থাকেন; সাধারণ কাতারের বাইরেই সাধনা জপেন; দর্শন অথবা পদ্য মাদক তাদের।

বাছাধন, শুনে নাও, জগতের এটাই খবর!

৭ অভিযাত্রীদল, লাভ করে যে-অভিজ্ঞান তা অতি গরল ও তিক্ত; সারাৎসার তার: জগৎ-সংসার অতি ক্ষুদ্রকায়, একঘেঁয়ে। আমরা তো নিজেরাই পর্যটন করেছি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত: ভীতিকর আতংকের মরুভূমি মানব জীবন, নির্বেদের লোকসানী পথ।

আমরা কি অভিযানে থেকে যাবো? বিরতিবিহীন? যদি পারো, বিশ্রামে যাও। অভিযান পরিব্রজ্যে কেউ থাকে: থাকে ঘাপ্টি মেরে বসে; সতর্ক শত্র“র চোখে ধুলো দিয়ে, সংহারে তাকে কুপোকাত করে ফেলে। কাল ধাবিত হয় দ্রুতগামী ডাক হরকরা; অবসরে অক্ষম সে, অস্থির ইহুদি কিংবা ক্রাইস্টের অনুগ্রামী দল। কালের পাঁজর ফুটো করে দেয় তলোয়ার ঘায়ে, এমন ঘাতক কেউ নেই এই সংসার জালে। মৃত্যু যদি আসে ধেয়ে মৃত্যুবান হাতে, ঘেরাটোপে থাকলেও নিরাপত্তা ছিন্ন হয়ে যাবে! পায়ের গোড়ালি, কালের, যখন ধরবে এসে কণ্ঠনালি চেপে, তখনও আশান্বিত,চিৎকারে বলে যাবো, ‘চলো, চলো’ বেয়ে চলো’। যেমন একদা নৌকা ভাসিয়েছিলাম চীন দেশ অভিমুখে, কম্পমান বুকে।

অতএব, আবারও পাল তুলে দেই মরণ সাগর বুকে, উচ্ছাসে আবেগে ভাসা তারুণ্যের পুলকে উধাও। যদি পারো, তাকাও সাগর অভিমুখে, একটুখানি, দেখো, কে যেন তোমাকে ডাকে অলৌকিক ছায়ামূর্তি ক্ষীণ, বলে সে, “দাঁড়াও তুমি, খেয়ে যাও গন্ধ কমল, আমার দোকানে বসো। ডালপালা সবগুলো ফলভারে নত, ক্ষুধিত হৃদয় ভরে খাও যতো পারো। ‘সময়’ ‘সময়’ আর বলিও না, না হও অধীর; ওটার লাগাম ধরা আছে এই হাতে। যাবে না সময় আর, ফুরোবে না কাল।” ছায়ামূর্তি গায় যেই গান, সেই সুর চিনি। ওপার সাগর থেকে বন্ধু বাড়িয়ে দেয় হাত; বলে, ‘চলো, চলো তুমি অরিস্টিজ, পাল তোলো, সাধ পুরে নাও, ক্লাইটেমনেস্ত্রা দেখো, দেবীরূপে, দেহরতœ সমগ্র উজার! আকাক্সক্ষায় একদিন চুমেছিলে তুমি, জানুতট যার’।

৮. প্রবীন কাপ্তেন, তোল নোঙর, রাত্রি অভিমুখে, যাত্রা হবে দুর্বার। বাঁধো হে কোমর, পুঁতিগন্ধময় দেশ করো ত্যাগ! আকাশ কৃষ্ণ কালো হয় যদি, সমুদ্র দোয়াতল কালির নিশ্চিত জেনে রেখো, আলো আছে অন্তর তলে। আমরা যখন করি বিষ পান, উজ্জীবন আসে। সমুদ্রের দূরতম অন্ধকার গভীরের আলো,

আমাদের ধী-মত্তায় স্ফুলিঙ্গ ঢালে। আকাশ পাতাল কিংবা স্বর্গ-নরকে অবস্থান, আমরা নতুন যারা, তাদেরই আবাহনে বিভাদীপ্ত সমান সমান।

নবীন- প্রবীন লেখীয়োদের প্রতি আহ্বান: সাহিত্য সুহৃদ মানুষের কাছে ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, রম্য রচনা সহ সাহিত্য নির্ভর আপনার যেকোন লেখা পৌঁছে দিতে আমাদেরকে ই-মেইল করুন [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড