শব্দনীল
বেশ কিছু দিন ধরেই বার্ধক্যজনিত অসুখে ভুগে মঙ্গলবার (২৫ ডিসেম্বর) দুপুরে কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে মারা গেলেন কবি নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। তার বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর। সম্প্রতি শরীর খারাপ হওয়ায় কয়েক দিন আগে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, সোমবার সকালে তার হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাক হয়। সেই ধাক্কা আর কাটিয়ে উঠতে পারেননি নরেন্দ্রনাথ।
কিংবদন্তি সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী চলে যাওয়ার পর বলেছিলেন ‘আমারও আর দেরি নেই। রমাপদকে বেশি দিন একা থাকতে হবে না। ও খুব শিগগিরই কথা বলার লোক পেয়ে যাবে।’ কিন্তু এতদ্রুত চলে যাবেন ভাবা যায়নি। হয় তো তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তাই এই কথা বলেছিলেন। তিনি প্রস্থান করেছেন কিন্তু রেখে গেছেন তার সৃষ্টি। বাংলা সাহিত্যের কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর স্মরণে দৈনিক অধিকারে পাঠকদের সামনে তুলে ধরলাম তারই কিছু সৃষ্টি-
অমলকান্তি
অমলকান্তি আমার বন্ধু, ইস্কুলে আমরা একসঙ্গে পড়তাম। রোজ দেরি করে ক্লাসে আসতো, পড়া পারত না, শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলে এমন অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকতো যে, দেখে ভারী কষ্ট হত আমাদের।
আমরা কেউ মাষ্টার হতে চেয়েছিলাম, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল। অমলকান্তি সে-সব কিছু হতে চায়নি। সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল! ক্ষান্তবর্ষণ কাক-ডাকা বিকেলের সেই লাজুক রোদ্দুর, জাম আর জামরুলের পাতায় যা নাকি অল্প-একটু হাসির মতন লেগে থাকে।
আমরা কেউ মাষ্টার হয়েছি, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল। অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি। সে এখন অন্ধকার একটা ছাপাখানায় কাজ করে। মাঝে মধ্যে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে; চা খায়, এটা-ওটা গল্প করে, তারপর বলে, “উঠি তাহলে।” আমি ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।
আমাদের মধ্যে যে এখন মাষ্টারি করে, অনায়াসে সে ডাক্তার হতে পারত, যে ডাক্তার হতে চেয়েছিল, উকিল হলে তার এমন কিছু ক্ষতি হত না। অথচ, সকলেরই ইচ্ছেপূরণ হল, এক অমলকান্তি ছাড়া। অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি। সেই অমলকান্তি–রোদ্দুরের কথা ভাবতে-ভাবতে ভাবতে-ভাবতে যে একদিন রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।
হলুদ আলোর কবিতা
দুয়ারে হলুদ পর্দা। পর্দার বাহিরে ধুধু মাঠ আকাশে গৈরিক আলো জ্বলে। পৃথিবী কাঞ্চনপ্রভ রৌদ্রের অনলে শুদ্ধ হয়। কারা যেন সংসারের মায়াবী কপাট খুলে দিয়ে ঘাস, লতা, পাখির স্বভাবে সানন্দ সুস্থির চিত্তে মিশে গেছে। শান্ত দশ দিক। দুয়ারে হলুদ পর্দা। আকাশে গৈরিক আলো কাঁপে। সারাদিন কাঁপে।
আকাশে গৈরিক আলো। হেমন্ত-দিনের মৃদু হাওয়া কৌতুকে আঙুল রাখে ঘরের কপাটে, জানালায়। পশ্চিমের মাঠে মানুষের স্নিগ্ধ কণ্ঠ। কে জানে মানুষ আজও মেঘ হতে গিয়ে স্বর্ণাভ মেঘের স্থির ছায়া হয়ে যায় কি না। তার সমস্ত আবেগ হয়তো সংহত হয় রোদ্দুরের হলুদ উত্তাপে।
আলো কাঁপে। সারাদিন কাঁপে।
একটাই মোমবাতি
একটাই মোমবাতি, তুমি তাকে কেন দু’দিকে জ্বেলেছ? খুব অহঙ্কারী হলে তবেই এমন কাণ্ড করা যায়। তুমি এত অহঙ্কারী কেন? চোখে চোখ রাখতে গেলে অন্য দিকে চেয়ে থাকো, হাতে হাত রাখলে গেলে ঠেলে দাও, হাতের আমলকী-মালা হঠাৎ টান মেরে তুমি ফেলে দাও, অথচ তারপরে এত শান্ত স্বরে কথা বলো, যেন কিছুই হয়নি, যেন যা কিছু যেমন ছিল, ঠিক তেমনি আছে। খুব অহঙ্কারী হলে তবেই এমন কাণ্ড করা যায়।
অথচ এমন কাণ্ড করবার এখনই কোনো দরকার ছিল না। অন্য কিছু না থাক, তোমার স্মৃতি ছিল; স্মৃতির ভিতরে ভুবন-ভাসানো একটা নদী ছিল; তুমি নদীর ভিতরে ফের ডুবে গিয়ে কয়েকটা বছর অনায়াসে কাটাতে পারতে। কিন্তু কাটালে না; এখনই দপ করে তুমি জ্বলে উঠলে ব্রাউজের হলুদে।
খুব অহঙ্কারী হলে তবেই এমন কাণ্ড করা যায়। তুমি এত অহঙ্কারী কেন? একটি মোমবাতি, তবু অহঙ্কারে তাকে তুমি দু’দিকে জ্বেলেছ।
মিলিত মৃত্যু
বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখ দ্বিতীয় বিদ্যায়। বরং বিক্ষত হও প্রশ্নের পাথরে। বরং বুদ্ধির নখে শান দাও, প্রতিবাদ করো। অন্তত আর যাই করো, সমস্ত কথায় অনায়াসে সম্মতি দিও না। কেননা, সমস্ত কথা যারা অনায়াসে মেনে নেয়, তারা আর কিছুই করে না, তারা আত্মবিনাশের পথ পরিস্কার করে।
প্রসঙ্গত, শুভেন্দুর কথা বলা যাক। শুভেন্দু এবং সুধা কায়মনোবাক্যে এক হতে গিয়েছিল। তারা বেঁচে নেই। অথবা মৃন্ময় পাকড়াশি। মৃন্ময় এবং মায়া নিজেদের মধ্যে কোনো বিভেদ রাখেনি। তারা বেঁচে নেই। চিন্তায় একান্নবর্তী হতে গিয়ে কেউই বাঁচে না।
যে যার আপন রঙ্গে বেঁচে থাকা ভাল, এই জেনে- মিলিত মৃত্যুর থেকে বেঁচে থাকা ভাল, এই জেনে- তা হলে দ্বিমত হওঁ। আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়। তা হলে বিক্ষত হও তর্কের পাথরে। তা হলে শানিত করো বুদ্ধির নখর। প্রতিবাদ করো।
ঐ দ্যাখো কয়েকটি অতিবাদী স্থির অভিন্নকল্পনাবুদ্ধি যুবক-যুবতী হেঁটে যায়। পরস্পরের সব ইচ্ছায় সহজে ওরা দিয়েছে সম্মতি। ওরা আর তাকাবে না ফিরে! ওরা একমত হবে, ওরা একমত হবে, ওরা একমত হতে-হতে কুতুবের সিঁড়ি বেয়ে উর্ধ্বে উঠে যাবে, লাফ দেবে শূন্যের শরীরে।
দুপুরবেলা বিকেলবেলা
১ কথা ছিল, ঘরে যাব; ‘ঘর হৈল পর্বত প্রমাণ’। চেয়ে দেখি দিগন্ত অবধি দুপুরেই এঁকে দিচ্ছ সমস্ত স্বপ্নের অবসান।
বয়সের নদী– আঁজলায় সামান্য জল তুলে ধরে। বুকের ভিতরে যতখানি জল, তার চতুর্গুণ নুড়ির ছলনা। খরায় শুকিয়ে ওঠে ধান।
২ সারা দুপুর খরায় তোমার ধান পুড়েছে। বিকেলবেলা হঠাৎ শুরু উথালপাতাল জলের খেলা। জল ঘুরে যায়, জল ঘুরে যায় নিখিলবিশ্বচরাচরে– আমার ঘরে, তোমার ঘরে!
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড