শওকত সমুদ্র
বীরাঙ্গনা
সাতচলি’শে দেশ ভাগ হয়ে গেলো, জন্ম নিলো দু’টি দেশ। আমি বীরাঙ্গনা বলছি, আমিই ছিলাম স্বাধীন বাংলাদেশ।
সকাল সন্ধ্যাগুলো কেটে যাচ্ছিল নির্বিবাদে, ওড়নায় তখনো কারো ভালোবাসা জমেনি। ঘুরে বেড়াতাম প্রজাপতির মত ব্যালকনিতে, ছাদে, বড় হওয়ার তীব্র বাসনা ঋতু বেদনায় কখনো কমেনি।
চারিদিকে শোরগোল পড়ে যায়, মুহুর্মুহু গুলি, দূর হতে ভেসে আসা ভয়ার্ত সারমেয় সাইরেন। খটাখট বুটের হায়েনার মত শব্দ, দিন তখনো চুকায়নি রাতের লেনদেন।
স্তব্ধ হয়ে দেখি বাবার রক্তাক্ত লাশ, বুলেটের গর্জনে কাঁপতে থাকা আলমারির কবাট, ছেঁচড়ে যাওয়া অচেতন পাজামার ফাঁস, আর দরিদ্র, নিঃস্ব দেহে ব্যথার জমাট।
সাতচল্লিশে দেশ ভাগ হয়ে গেলো, জন্ম নিলো দুটি দেশ। আমি বীরাঙ্গনা বলছি, আমিই ছিলাম স্বাধীন বাংলাদেশ।
দিনগুলো বেশ ছিলো কলসি কাঁখে নিয়ে, সময়াবর্তে কত সময় গেছে বয়ে। এইতো সেদিন পুতুলের সাথে বিয়ে, চলছে যুদ্ধ, সময় গেছে ক্ষয়ে।
সকালে চারিদিকে মাতম শুরু হয়, পশ্চিমের স্কুল থেকে রাইফেলের আওয়াজে কেঁপে ওঠে বাতাস। কিছু কুমিরের মত নিঃশব্দ পায়ের চলাচল রয়, ঈশানকোণে ঝুলে থাকে মৃত্যুর পূর্বাভাস।
আমি মৃত বাচ্চাটিকে দেখি, বেয়নেটে ক্ষতবিক্ষত স্বামীর কাঁপতে থাকা কায়া, গীতার পুণ্য কিংবা ওদের কুরআনের নেকী, অবহেলায় নিক্ষিপ্ত শাড়ি আর অবিন্যস্ত ছায়া।
এরপর কত দিন আর রাতের হিসেবে গণ্ডগোল হয়, কত সময় বয়ে যায় অত্যাচারের গর্ভে। কত চোখের জল ঝরে যায় মরে যাওয়ার শর্তে, স্বপ্ন তবু বাঁচিয়ে রাখে সোনার বাংলা গড়তে।
ডিসেম্বরে দেশ স্বাধীন হলো, জন্ম নিলো ঝলমলে শিশু, কোমল দেশ। বাংলাদেশ, বাংলাদেশ।
শকুনের আর্তনাদ
সাতচলি'শে দেশ ভাগ হলো যে, আমরা মুসলমান। ধর্ম নামের দোহাই দিয়ে- উর্দু দেশের প্রাণ।
বাংলা হলো মাতৃভাষা, শুয়োর কি আওলাদ! বায়ান্নতে আমজনতা- উর্দু দিল দিল বাদ!
লুটেতরাজে চলছিল বেশ, পাকিদের আমদানি। বাদ সাধে ঐ দেশদ্রোহী- মুজিব আর ভাসানী।
ছেষট্টিতে জোট করে লীগ, একি অরাজক! ওদের মাথায় শয়তান দেয়- ছয় দফারই পোক।
ছয়নয়* সালে বলে দেয়, ‘শালা, দেশ ছাড়, দেশ ছাড়।’ পাকি জিন্দাবাদ,পাকি জিন্দাবাদ,- দেশটা কি তোর বাবার!
সত্তরেতে নাটক সাজাই, জিতবো তো আমরাই। ফল পেলে'খন দেখবি পরে, কোথাও মুজিব নাই।
লীগ জিতে যায় নির্বাচনে, হিসেবের হেরফের। দেখে নেব তোকে,বুঝিয়ে দেব- টানতে হবে জের।
মানতে নারাজ,আমজনতা, সহায় হিন্দুজাতে। এমন চালে ফেলবো প্যাঁচে, আন্ধার প্রভাতে।
একাত্তরে সাত তারিখে, মুজিব দিল ভাষণ। তলপেটে আজ প্রবল চাপ, নড়ে গেল আসন।
পঁচিশ তারিখ,মনে পড়ে, আলো ঝলমলে রাত? বেয়নেট আর বারুদ মেশানো, রক্তাক্ত প্রভাত।
জিন্দাবাদ পাকিস্তান, মুসলিম হোক দেশ। নারী পুরুষ নির্বিশেষে, হোক না সকল শেষ।
নয়মাসের ঐ গণ্ডগোলে, মাত্র তিরিশ লাখ। একটুখানি সময় পেলে, দেশ হতো না ভাগ।
ষোলো তারিখে হারিয়ে দিলি, সাজ সাজ ঐ রব এ। হাভাতের দল, বাঁচবি না কেউ- জান্নামে যাবি কবে!
আজ তোরা সব পতাকা তুলিস, জয় বাংলার জয়ে। তোদের উল্লাস কষ্ট দেয় বড়, ভিতরটা যায় ক্ষয়ে।
শকুনের দল পুড়ে যাক সব, বাংলার বিজয়ে। সহস্রাব্দী বেজে যাক সুর, জয় বাংলার জয়।
আমি যোদ্ধা
সাত চলি’শে দেশ ভাগ হলো যে, আমরা সাধারণ। ইংরেজরা পালিয়ে গেলো, এলো বিভীষণ।
জাতের নামে ধোঁয়া তুলে, শুরু হল শোষণ। জীবনযুদ্ধে মাত্রা পেল, পাকিস্তানি পেষণ।
এক নামেতে দুইটি দেশ, ভারত দেশের পরে। শিয়াল বনে তাড়িয়ে দিয়ে, সর্প এলো ঘরে।
দেশের টাকায় উন্নতি হয়, হাজার যোজন দূরে। সাহেব হল পশ্চিমা-রা, শ্রমিক আস্তাকুঁড়ে।
ভাষায় এলো ঝড়ের মাতম, কেড়ে নিতে চায়। আমজনতা মানতে নারাজ, বিরুদ্ধে যায় রায়।
সালাম রফিক রাস্তা রাঙায়, মাতৃভাষার তরে। হাকিম কাঁপে থরো থরো, ভাষার হুকুম নড়ে।
আটকে রাখে মেধাসকল, নিজের বক্ষে ধরে। পশ্চিমা-রা ভোগ দখলে, ফুলে ফেঁপে বাড়ে।
ফজলুল আর ভাসানীরা গড়ে প্রতিরোধ। মুসলিম লীগ কর্ম দিয়ে, জাগায় জাতির বোধ।
নির্বাচনে যায় হেরে যায়, পাকিস্তানি শাসক। মরণ ছোবল হানবে ভেবে, বাড়িয়ে তোলে শোক।
একাত্তরের কালরাত্রে, সার্চলাইটের আঁধার, বাংলার বুকে জন্ম দিল, হাজার লাশের পাহাড়।
মুজিব আটক পাকিস্তানে, বাংলা হবে শেষ। গড়বে কে আর সাধের জাতি, সোনার বাংলাদেশ!
আমরা সেদিন ঝাঁপিয়ে পড়ি, দুক্ষু বুকে বেঁধে। পিছন ফিরে তাকাইনি আর, দেশ স্বাধীনের জেদে।
সাঁতরে গেছি ঠাণ্ডা জলে, ভুলে কাঁথার সুখ। বুকে গুলি নিয়ে ভাবি, প্রিয় শিশুর মুখ।
কত মায়ের বুক খালি আজ, কত বোনের জল। কত বধূ একলা কাঁদে, নিশ্চুপ অবিরল।
হাতের মেশিন গর্জে ওঠে, পিশাচভেদ্য গুলি। কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করি, উকিল মুচি কুলি।
দিন ক্ষণ মাস হারিয়ে ফেলি, রক্তে আসে বান। জীবন গেলেও রইবে বেঁচে, আমার মায়ের প্রাণ।
হাত হারালাম, পায়ে গুলি, মাথায় কাঁটা দাগ। আমার শ্রমে ফলবে ফসল, কেউ পাবে না ভাগ।
ডিসেম্বরের ষোল তারিখ, এখন পড়ে মনে। লাল সবুজের কাপড়খানি, উড়ছে ঈশান কোণে।
আজো আছি স্বাধীন বেঁচে, মাথায় বেঁধে শান। জীবন গেলেও বাজতে থাকুক, জয় বাংলার গান।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড