প্রদীপ কর
কবি তাপস গায়েনের কবিতার বই সময়ব্যূহে অভিমন্যু পড়বার পর নেশাগ্রস্তের মতো আচ্ছন্ন ছিলাম। ধীরে ধীরে বোধিতে চৈতন্য ফিরে এলে বুঝতে চেষ্টা করেছি এই আবিষ্ট শক্তির রহস্যটি ঠিক কী?
সমসময়ের কবিতা নিয়ে নানা ধরনের সাধারণ প্রথানুগমনকারী কথাবার্তার অপর মেরুতেই অবস্থান করে এই বই।
যে কবিতা আমার মেধাকে আক্রান্ত করতে পারে না, মননকে মগ্নতা দেয়না, বহুদূরের সময়কে হাতের তালুর মধ্যে নান্দনিকতায় উপস্থাপন করতে পারে না, সে রকম কবিতা সুখপাঠ্য হলেও আত্মায় আন্দোলনের মতো নিবিড়পাঠ্য নয়।
কবি তাপস গায়েনের সময়ব্যূহে অভিমন্যু তৃতীয় কাব্যগ্রন্থটির প্রকাশকাল ২০১৭ । এর আগে সাঁকোশূন্য মহাদেশ (২০০১) এবং একলব্য নিঃসীম নগরে (২০১০) প্রকাশিত হয়েছে।
বোঝাই যায়, একটি গ্রন্থ নির্মাণের জন্য কবি যথেষ্ট সময় নিয়েছেন। প্রগলভ-বহুপ্রসবী নন। এই স্থিতধী নির্মাণের জন্য যে অনুধ্যান প্রয়োজন তাতে একটি গ্রন্থ থেকে পরবর্তী গ্রন্থে যেতে এরকম সময় সত্যিই অপরিহার্য ছিল।
বইটির ব্লার্বে লেখা আছে: ‘পাথরে প্রহৃত জল’ নামে তার পংক্তির অসূর্য-স্পর্শা কবিতামালার নিঃশব্দ অন্তরাল ভেঙে, পরিভ্রমণের পথে কবি তাপস গায়েন ‘সাঁকোশূন্য মহাদেশ’ পাড়ি দিয়ে ক্রমাগত প্রসারিত হতে থাকেন গদ্যপ্রসারী কবিতার টানা অবয়বে- একলব্য নিঃসীম নগরে কাব্যগ্রন্থে, যার পূর্ণপরিব্যাপ্তী নিয়ে এবার প্রকাশিত হল সময়ব্যূহে অভিমন্যু। আপাত অন্তর্মুখী ও নির্বিরোধ, কিন্তু ভেতরে গভীর রক্তক্ষরণে সিক্তমানুষ ও সভ্যতার ক্রান্তিদশা নিয়ে কবি নিবিড় আশ্রয় খোঁজেন দর্শন ইতিহাস বিজ্ঞান ও সাহিত্যের আলোকিত পাঠে, মহামানবদের চৈতন্যধামে; প্রেম ও প্রজ্ঞার ফোটন ভরে দেন পংক্তিমালায়, যখন নিশ্চিত জানেন এমন কালের মুখোমুখি তিনি, যখন তার সময়ের নায়কেরা চক্রবূহ্যে বন্দি পৌরাণিক বীরযোদ্ধা অভিমন্যুর মতো।’
টানা গদ্যে লেখা ৩৪টি কবিতার সংকলন। চারটি সিরিজ-কবিতা ছাড়া কীর্ণকবিতা রয়েছে নয়টি। কবি, কবিতা নির্বাচনের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট সংযমী।
বইটি উৎসর্গ করেছেন, ‘আত্মার মাধুর্যের কবি শ্রীচৈতন্য ও আল-হাল্লাজকে’।
বাংলা কবিতার আবহমান চরণধ্বনি এই গ্রন্থের চরণে চরণে চিহ্নিত। চিরন্তন বাঙালির সত্তা কখনো প্রচ্ছন্ন কখনো স্পষ্ট প্রতীয়মান। গীতিকবিতার প্রবহমান ধারায় সরাসরি না হেঁটেও তিনি প্রবেশ করেছেন বাঙালি সত্ত্বার নান্দনিক মানসভূমিতে।
আবার একইসঙ্গে আবহমান বাংলার পরম্পরায় মিলে গিয়েছে পাশ্চাত্য চিন্তাচেতনা। যদিও পরিবেশনের ভঙ্গিতে রয়েছে একান্তই দেশজ মনন। তথাগত, চৈতন্য, লালনের সঙ্গে নীৎশের কথারূপ চিন্তার প্রবাহ কোথাও অসামঞ্জস্য মনে হয়নি।
সময়ের গতিশীল নানান পরিবর্তনের বাতাসে নিশ্চল হয়ে থাকেনি বাংলা কবিতা, নানান ভাবে ভঙ্গিতে সেই ভাঙচুর চিত্রিত হয়েছে, হচ্ছে। বাইরের অস্থিতিশীলতার সঙ্গে অন্তরের ধ্যানী দর্শনকে খুব অনায়াস সুন্দরভাবে মেলাতে পেরেছেন কবি। এখানেই কবির অনন্যতা। এই কারণেই এই গ্রন্থও চিরন্তন বাংলা কবিতার প্রবাহে প্রবাহিত।
সময়ব্যূহে অভিমন্যু সিরিজে ১২টি কবিতা আছে। প্রথম কবিতার প্রথম স্তবকটি উদ্ধৃত করেই বোঝাতে চাই রচনার ধরন:
‘পিতৃদেব, এই দেহভস্ম, যা আপনার দেহের শেষ আকৃতি, এখন ভেসে যাচ্ছে এই ক্ষীণতোয়া জলে আর আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি নির্বাক। জানিনা কোথায় চলেছেন আপনি। আমাদের অস্তিত্বের কোনো এক শর্তে আপনি আজও শুয়ে আছেন আপনার শৈশবের স্নিগ্ধভূমিতে। এই তো আপনি চেয়েছিলেন। মানুষের কলস্বরে আপনার আত্মা ছিল স্নিগ্ধ, এখনো এই গ্রামের নির্জনে গৃহবধূদের খুনসুটি, শিশুদের দৌরাত্ম, আর বালকের চপলতা জাগে আপনার স্তুপ ঘিরে। সন্ধ্যায় নারীদের উলুধ্বনি বোধ করি প্রকৃতিকে আশ্বস্ত করেছে, দিন ও রাত্রির মধ্যে যেন তেমন কোনো বিভাজন নেই। তবু দেবতাদের হাতে এই পৃথিবীকে ন্যস্ত করে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি। শীতের রাতে, রাতব্যাপী, খেজুরের রস জমে ওঠে মাটির হাঁড়িতে, আর অতিভোরে জেগে ওঠে দীর্ঘপথ, পিপীলিকাদের! এইসব জীবনেরই কলস্বর, আত্মার অনন্ত বুদ্বুদ।’
এ যেন এক প্রকার অলস মায়া। টানা গদ্যে লেখা হলেও কবিতার নিভৃতপ্রবাহ অক্ষরের স্পন্দনে অনুরণিত। একটি শব্দের সঙ্গে আরেকটি শব্দ পিতাপুত্রের আত্মীয়তার মতোই ছন্দস্পন্দের ধারাবাহিকতায় প্রবাহিত।
কবিতার অবয়ব এখন অগুরুত্বপূর্ণ নয়। এই বইয়ে তো নয়ই। কখনো পড়তে পড়তে মনে হয়েছে এ কবিতা একান্তই নিভৃতির সঙ্গোপনে রচিত। যেন পত্র, একক সময় থেকে বহু প্রসারিত সময়ের দিকে ধাবমান। রূপ অরূপের জগৎ মায়ায় মুকুরে কবি যেভাবে দেখেছেন তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ যেভাবে দেখাতে চেয়েছেন। দর্শন সন্তর্পনে তিনি প্রোথিত করেছেন পাঠকের মগজে হৃদয়ে অস্তিত্বে।
মহাভারতের বহু পরিচিত অভিমন্যুর আখ্যানকেই মিথ হিসেবে নিজস্ব সময়ে ধারণ করেছেন। বীর কিন্তু অর্ধপ্রশিক্ষিত অভিমন্যু সদর্পে সপ্তমহারথীর চক্রবূহ্যে অনায়াসে প্রবেশ করে গেলেও নির্গমণের পথ তিনি জানতেন না, ফলে বীরের মৃত্যু। কবি এই গ্রন্থে চেনাচ্ছেন সপ্তরথীর চক্রবূহ্য যেন এই সময়। আমাদের অতীত সমৃদ্ধির অভিজ্ঞতায় সময়ের মুখোমুখি বুক চিতিয়ে দাঁড়াই ঠিকই, কিন্তু ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে জ্ঞানহীনতা আমাদের অভিমন্যুর মতোই পরাজিত করে কখনো কখনো।
এই কবিতা বইয়ে কবি সেই অন্বেষণে সচেষ্ট, যে, কীরকম আক্রমণে আমরা পরাজিত হই? কীভাবে? কোন চেহারায় আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায় আমাদের পরাজয়! পরাজয় কীভাবে পরাজিত হবে? কোন অস্ত্রে?
তৃতীয় কবিতায় দেখি:
‘আকাঙ্ক্ষাকে শূন্য করে আমি কি চেয়েছি ইচ্ছামৃত্যু, যেখানে নেই সময়ের দ্রুতি কিংবা মন্দন। জেনেছি, মহাকাল, সেও ঈশ্বরের মতো এক বিভ্রম!’
কিংবা সময়ব্যূহে অভিমন্যু সিরিজের দ্বিতীয় কবিতা:
‘সময়ের অনুধাবন, সে তো অন্বেষাময় এক অশেষ ভ্রান্তি, যেন শূন্যতায় বিদ্ধ সর্পতান্ত্রিকের বিভ্রম।’
এই যাপনসময়ে ‘ভ্রান্তি’ আর ‘বিভ্রম’ কি নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠছে আমাদের? আর যদি তা হয় ‘সর্পতান্ত্রিকের ভ্রান্তি’? তবে তো মৃত্যু নিশ্চিত।
সপ্তম কবিতায় রচিত হয়েছে এক অসহায় রোদন চিত্র। নাগরিক সমাজের নিঃসঙ্গতার অভিশাপ আমরা সকলেই হয়তো সঙ্গোপনে বহন করে চলেছি:
‘বর্ষণ মুখর রাতে যখন ফুটেছে কদম, তখন পিতার কাঁধে চলেছে শিশুর নিথর শরীর। এই দৃশ্যে পিতার ক্রন্দন মাতার বিলাপের সমাঙ্গ নয়। তবু ফুল ফোটে, তারা ওঠে, হঠাৎ থেমে যাওয়া সাবওয়ে ট্রেনে জোয়ার-ভাটার মতো আমরা দুলতে থাকি, আমাদের উত্তেজনা শশব্যস্ত ইঁদুরের মতো, যেন ভারত-পাকিস্তানের ক্রিকেট ম্যাচের জয় পরাজয় আমাদের সত্তারই অংশ, যেন পৃথিবীর কোনো উন্মেষ বিন্দু ছিল না, যেন তার নেই কোনো নাস্তি।…’
এই মগ্নচৈতন্যের চক্রব্যূহ থেকে নিস্তার নেই। শুধু সময়ের অদৃশ্য আড়ালে যেন ‘হঠাৎ থেমে যাওয়া সাবওয়ে ট্রেনে জোয়ার-ভাটার মতো আমরা দুলতে থাকি’। উপযুক্ত কবিতাংশতে যদি খানিক ভাটার টান লেগে থাকে তো, এবার জোয়ারের আনন্দগান শোনাই:
‘দেখিনি ঈশ্বর, তবে প্রতিফলিত রোদ এসে ভরে দেয় আমের বাগান’
বা,
‘দূরাগত মানুষ বহুদূর থেকে আসা প্রবাহিত বাতাসের মতো অপসৃয়মান’
কিংবা,
‘প্রকৃতির সকল প্রবাহের সাথে আমি হয়ে আছি লম্বমান, আমি আমার কাছেই হয়ে উঠি ফুল আর দীর্ঘ বল্লমের মতো অনির্দিষ্ট সময়!’
এরকম অসংখ্য অসাধারণ পংক্তিঐশ্বর্যে বইটি উজ্জ্বল। শুধু ‘চক্রব্যূহে অভিমন্যু’ সিরিজিটিতেই নয়, প্রায় সমগ্র রচনায় দেখি, কবির বোধ হাঁটতে চেয়েছে পৃথিবীর সেই সমস্ত উজ্জ্বল মানুষগুলির আলোকিত পথেই।
নানা সময়ে যখনই উন্মত্ত হয়েছে পৃথ্বী আর বিভ্রান্ত হয়েছে সমাজ তখন এই অনির্বাণ বোধ, মনন পথ দেখিযে নিয়ে গেছে শান্তির অভিমুখে।
বর্তমান আদর্শহীন ভোগবাদে নিমজ্জিত সময়ে আমাদের আত্মা যখন ক্রন্দন করে তখন তাদের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা ছাড়া উপায় কী?
তাদেরকেই তো প্রশ্ন করা উচিত। সন্ধান করা উচিত বর্হিগমনের পথ।
‘এই সময় যদি হয় সর্পের চন্দ্রভক্ষণ, তবে একদিন সাপের লেজে উদ্গত হবে কি পূর্ণ চাঁদ?’ (ক্রন্দন)
‘দিনান্তে যুদ্ধ শেষে পৃথিবীর কোন দ্রাঘিমায় জেগেছে আমার পানশালা, আমার নিভৃতি?’
কী আশ্চর্য শান্ত শীতল নির্মোহ দৃষ্টিতে আর কঠোর ভাষায় এই কবিতাবইয়ে কবি ধীরে ধীরে বুনেছেন অসহায় আত্মার শিউরে ওঠার মতো গ্লানি। দংশন করে। ছোবল মারে নির্লিপ্তির মুখে:
‘কোথাও ক্রন্দন নেই। অনতিদূরে বরফের পাহাড় ভেঙে পড়ে আর পাহাড়ে বনস্থলী জুড়ে পাখি ওড়ে আর্তনাদের। কোথাও ক্রন্দন নেই, কেবলই রক্তগঙ্গা বয়ে চলে!’
পড়তে পড়তে চৈতন্য নিথর করে বসে থাকি ক্রন্দনের গভীর ক্ষরণে। ‘দ্রৌপদীর বিলাপ’ কবিতায় পড়ি:
‘আমার সকল শরীর কেবল ক্রন্দন হয়ে জেগে ওঠে, কিন্তু আমি তার অর্থ বুঝিনা। নশ্বর ফুলের মতো এই জীবন, তাই হৃদয় ঈশ্বর-মুখ-দর্শন-অভিলাষী! বনবাসী প্রান্তিক মানুষ আমি। রাতের গভীরে উনুনের আগুনের দিকে তাকিযে থাকি; দেখি আগুন গভীরতর ঐক্যে বাঁধছে এই আকাশ আর এই মাটিকে।’
গদ্যভঙ্গিতে লেখা এই কবিতাগুলিকে আপাত অলসদৃষ্টিতে গদ্য বলে বিভ্রান্ত হতে পারে। কাব্যময় আলেখ্য কিংবা মুক্তগদ্য বলে আকৃতিগত সাদৃশ্যে ভুল করলেও ধীরে ধীরে যখন আচ্ছন্নতা বয়ে যাবে অন্তর্গত শোণিতে, আপনি তখন টের পাবেন, বোধের অভিমানে কীভাবে সময়ের ক্ষতরূপ আপনাকে নিরবচ্ছিন্ন রক্তাক্ত ক্ষত বিক্ষত করে চলেছে।
আপনি টের পাবেন বূহ্যচক্রে প্রবেশ করেছেন। তখনই শিউরে উঠবেন। এই টের পাওয়াও কিন্তু সামান্য নয়। আত্মানুসন্ধান। দর্শণের চেতন আলোকে ভবিষ্যপথ নির্গমনের অনুসন্ধান।
সময়ব্যূহে অভিমন্যু লেখক: তাপস গায়েন প্রকাশক: জেব্রাক্রসিং প্রথম প্রকাশ: ডিসেম্বর ২০১৭ প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: তুষার গায়েন মূল্য: ১২০টাকা
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড