রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ
মানুষের প্রিয় প্রিয় মানুষের প্রানে মানুষের হাড়ে রক্তে বানানো ঘর এই ঘর আজো আগুনে পোড়ে না কেন?
ঘুনপোকা কাটে সে-ঘরের মূল-খুঁটি আনাচে কানাচে পরগাছা ওঠে বেড়ে, সদর মহলে ডাকাত পড়েছে ভর দুপুরের বেলা প্রহরীরা কই? কোথায় পাহারাদার?
ছেনাল সময় উরুত দ্যাখায়ে নাচে নপুংশকেরা খুশিতে আত্মহারা ।
বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে রাজনীতিকের ধমনী শিরায় সুবিধাবাদের পাপ বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে বুদ্ধিজীবীর রক্তে স্নায়ুতে সচেতন অপরাধ বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে জাতির তরুন রক্তে পুষেছে নির্বীর্যের সাপ-
উদোম জীবন উল্টে রয়েছে মাঠে কাছিমের মতো।
২ কোনো কথা নেই- কেউ বলে না, কোন কথা নেই- কেউ চলে না, কোনো কথা নেই- কেউ টলে না, কোন কথা নেই- কেউ জ্বলে না- কেউ বলে না, কেউ চলে না, কেউ টলে না, কেউ জ্বলে না।
যেন অন্ধ, চোখ বন্ধ, যেন খঞ্জ, হাত বান্ধা, ভালবাসাহীন,বুক ঘৃনাহীন, ভয়াবহ ঋন ঘাড়ে চাপানো-শুধু হাঁপানো, শুধু ফাঁপানো কথা কপচায়- জলে হাতড়ায়, শোকে কাতরায় অতিমাত্রায় তবু জ্বলে না। লোহু ঝরাবে, সব হারাবে- জাল ছিঁড়বে না ষড়যন্ত্রের? বুক ফাটাবে, ক্ষত টাটাবে- জাল ছিঁড়বে না ষড়যন্ত্রের?
৩ আমি টের পাই, মাঝ রাত্তিরে আমাকে জাগায় স্মৃতি- নিরপরাধ শিশুটির মুখ আমাকে জাগায়ে রাখে নিরপরাধ বধুটির চোখ আমাকে জাগায়ে রাখে নিরপরাধ বৃদ্ধটি তার রেখাহীন করতর আমাকে জাগায়ে রাখে।
মনে পড়ে বট? রাজপথ. পিচ? মনে পড়ে ইতিহাস? যেন সাগরের উতলানো জল নেমেছে পিচের পথে মানুষের ঢেউ আছড়ে দোহাই কূলে? মনে কি পড়ে না, মনে কি পড়ে না, মনে কি পড়ে না কারো? কি বিশাল সেই তাজা তরুনের মুষ্ঠিবদ্ধ হাত যেন ছিঁড়ে নেবে গ্লোব থেকে তার নিজস্ব ভূমিটুকু!
মনে কি পড়ে না ঘন বটমূল, রমনার উদ্যান একটি কন্ঠে বেজে উঠেছিলো জাতির কন্ঠস্বর? শত বছরের কারাগার থেকে শত পরাধীন ভাষা একটি প্রতীক কন্ঠে সেদিন বেজেছিলো স্বাধীনতা। হাতিয়ারহীন, প্রস্তুতি নেই, এলো যুদ্ধের ডাক, এলো মৃত্যুর, এলো ধ্বংশের রক্ত মাখানো চিঠি। গ্রাম থেকে গ্রামে, মাঠ থেকে মাঠে গঞ্জের সুবাতাসে সে-চিঠি ছড়ায় রক্ত-খবর, সে-চিঠি ঝরায় খুন, স্বজনের হাড়ে করোটিতে জ্বলে সে-চিঠির সে আগুন।
৪ ভরা হাট ভেঙে গেল। মাই থেকে শিশু তুলে নিল মুখ সহসা সন্দিহান, থেমে গেল দূরে রাখালের বাঁশি, পাখিরা থামালো গান, শ্মশান নগরী, খাঁ-খাঁ রাজপথে কাকেরা ভুললো ডাক।
প'ড়ে রলো পাছে সাত পুরুষের শত স্মৃতিময় ভিটে, প'ড়ে রলো ঘর, স্বজনের লাশ, উনুনে ভাতের হাঁড়ি, ভেঙে প'ড়ে রলো জীবনের মানে জ্বলন্ত জনপদে- নাড়ি-ছেঁড়া উন্মুল মানুষের সন্ত্রাসে কাঁপা স্রোত জীবনের টানে পার হয়ে গেল মানচিত্রের সীমা।
৫ মনে কি পড়ে না, মনে কি পড়ে না, মনে কি পড়ে না তবু? গেরামের সেই শান্ত ছেলেটি কী রোষে পড়েছে ফেটে বন্ধুর লাশ কাঁধে নিয়ে ফেরা সেই বিভীষিকা রাত সেই ধর্ষিতা বোনের দেহটি শকুনে খেয়েছে ছিড়ে-
মনে কি পড়ে না হাতে গ্রেনেডের লুকোনো বিস্ফোরণ? তারও চেয়ে বেশি বিস্ফোরণের জ্বালা জ্বলন্ত বুকে গর্জে উঠেছে শত গ্রেনেডের শত শব্দের মতো।
গেরামের পর গেরাম উজাড় উঠোনে উঠেছে ঘাস। হাইত্ নের’ পরে ম’রে পড়ে আছে পালিত বিড়াল ছানা, কেউ নেই, শুধু তেমাথায় একা ব্যথিত কুকুর কাঁদে।
আর রাত্রির কালো মাটি খুঁড়ে আলোর গেরিলা আসে-
৬ ঝোপে জঙ্গলে আসে দঙ্গলে আসে গেরিলার দল, হাতিয়ার হাতে চমকায়। হাত ঝলসায় রোষ প্রতিশোধ। শোধ রক্তের নেবে তখতের নেবে অধিকার। নামে ঝনঝায়- যদি জান যায় যাক, ক্ষতি নেই; ওঠে গর্জন, করে অর্জন মহা ক্ষমতার, দিন আসবেই, দিন আসবেই, দিন সমতার।
৭ দিন তো এলো না ! পৃথিবীর মানচিত্র থেকে ছিঁড়ে নেয়া সেই ভূমি দূর্ভিক্ষের খরায় সেখানে মন্বন্তর এলো । হত্যায় আর সন্ত্রাসে আর দুঃশাসনের ঝড়ে উবে গেল সাধ বেওয়ারিশ লাশে শাদা কাফনের ভিড়ে, তীরের তরীকে ডুবালো নাবিক অচেতন ইচ্ছায়।
৮ আবার নামলো ঢল মানুষের আবার ডাকলো বান মানুষের আবার উঠলো ঝড় মানুষের
৯ গ্রাম থেকে উঠে এলো ক্ষেতের মানুষ খরায় চামড়া- পোড়া মাটির নাহান, গতরে ক্ষুধার চিন্ মলিন বেবাক, শিকড় শুদ্ধ গ্রাম উঠে এলো পথে।
অভাবের ঝড়ে-ভাঙা মানুষের গাছ আছড়ে পড়লো এসে পিচের শহরে ।
সোনার যৌবন ছিলো নওল শরীরে নওল ভাতার ঘরে হাউসের ঘর, আহারে নিঠুর বিধি কেড়ে নিলো সব- সোনার শরীরে বেচে সোনার দোসর ।
দারুন উজানি মাঝি বাঘের পাঞ্জা চওড়া সিনায় যেন ঠ্যাকাবে তুফান। আঁধার গতর জেলে, দরিয়ার পুত বুকের মধ্যে শোনে গাঙের উথাল ।
তাদের অচেনা লাশ চিনলো না কেউ ঝাঁক ঝাঁক মাছি শুধু জানালো খবর।
বেওয়ারিশ কাকে বলো, কার পরিচয় ? বাংলার আকাশ চেনে, চেনে ওই জল আমার সাকিন জানে নিশুতির তারা, চরের পাখিরা জানে পাড় ভাঙা নদী আমি এই খুনমাখা মাটির ওয়ারিশ ।
১০ স্বপ্ন হারানো মানুষের ঢল রাজপথে আসে নেমে স্বজন হারানো মানুষের ঢল রাজপথে আসে নেমে ক্ষুধায় কাতর মানুষের ঢল রাজপথে আসে নেমে পোড়ায় নগরী, ভাঙে ইমারত, মুখোসের মুখ ছেঁড়ে ছিঁড়ে নিতে চায় পরাধীন আলো প্রচন্ড আক্রোশে।
১১ আমি কি চেয়েছি এতো রক্তের দামে এতো কষ্টের, এত মৃত্যুর, এতো জখমের দামে বিভ্রান্তির অপচয়ে ভরা এই ভাঙা ঘরখানি? আমি কি চেয়েছি কুমির তাড়ায়ে বাঘের কবলে যেতে?
আর কতো চাস? আর কতো দেবো কতো রক্তের বলী? প্রতিটি ইঞ্চি মাটিতে কি তোর লাগেনি লোহুর তাপ? এখনো কি তোর পরান ভেজেনি নোনা রক্তের জলে?
ঝড়ে বন্যায় অনাহারে আর ক্ষুধা মন্বন্তরে পুষ্টিহীনতা, জুলুমে জখমে দিয়েছি তো কোটি প্রান- তবুও আসেনা মমতার দিন, সমতা আসেনা আজো।
১২ হাজার সিরাজ মরে হাজার মুজিব মরে হাজার তাহের মরে বেঁচে থাকে চাটুকর, পা-চাটা কুকুর বেঁচে থাকে ঘুনপোকা, বেঁচে থাকে সাপ।
১৩ খুনের দোহাই লাগে, দোহাই ধানের দোহাই মেঘের আর বৃষ্টির জলের দোহাই, গর্ভবতী নারীর দোহাই এ-মাটিতে মৃত্যুর অপচয় থামা
আসুক সরল আলো, আসুক জীবন চারিদিকে শত ফুল ফুটুক এবার।
১৪ জাতির রক্তে ফের অনাবিল মমতা আসুক জাতির রক্তে ফের সুকঠোর সসতা আসুক আসুক জাতির প্রানে সমতার সঠিক বাসনা।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড