রবিউল করিম মৃদুল
সিরাজ মিয়াকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। বিরাট আয়োজন। ইশকুলের মাঠে বিশাল মঞ্চ প্রস্তুত করা হয়েছে। হাজার লোকের বসার ব্যবস্থা। চার পেয়ার সাউন্ড আনা হয়েছে শহর থেকে। সে কি আওয়াজ। কথা বললে গমগম করে ওঠে। বক্তৃতা মঞ্চের একপাশে ফাঁকা জায়গায় বসেছে মেলা। গরম গরম জিলাপি ভাজা হচ্ছে। বসেছে মুড়ি-মুড়কির দোকান। খাগড়াই-বাতাসা, চিনির হাতিঘোড়া কি নেই সেখানে। রঙ-বেরঙের মনোহারী জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসে গেছে ভ্রাম্যমান দোকানীরা। আশপাশের দুই-চার-দশ গ্রাম থেকে ঢল ভেঙে এসেছে লোক। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের পর কনসার্ট। ঢাকা থেকে শিল্পী আনা হয়েছে। আগে হবে গান, এরপর ডানাকাটা পরীদের ঝুমুর ঝুমুর নাচ। লোকজন ঘরে বসে থাকে কি করে! ছেলে ছোকরা দল, কী জোয়ান, কী বুড়ো সকলেই উপস্থিত হয়ে গেছে ইশকুলের মাঠে। প্রধান অতিথি এরই মধ্যে এসে গেছেন। তিনি বসেছেন হেডমাস্টার সাহেবের রুমে। একটুপরই মূল অনুষ্ঠান শুরু। এরই মধ্যে কা- একটা ঘটে গেল। সিরাজ মিয়াকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! একটু আগেই তাকে দেখা গেছিল সাদা পাজামা পাঞ্জাবী পরে কি সুন্দর হাসিহাসি মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছিল ইশকুলের মাঠে। সেই মানুষটা হঠাৎ উধাও। উধাও মানে একেবারে উধাও। কেউ তার ব্যাপারে কিছু বলতে পারে না। তার মোবাইল নেই যে কল দিয়ে খুঁজে বের করা হবে।
আয়োজকদের টেনশনের শেষ নেই। সিরাজ মিয়া গেলটা কোথায়? ছোটখাটো অনুষ্ঠান হলে একটা কথা ছিল। বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান। এই উপলক্ষে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। এই গ্রামের একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা ওই সিরাজ মিয়া। সে ছাড়া যে দু’জন ছিল, তারা এরইমধ্যে গত হয়ে গেছে। আজকের এই অনুষ্ঠানে কথা ছিল সিরাজ মিয়ার হাতে নগদ টাকা ও ক্রেস্ট তুলে দিবেন স্বয়ং এমপি সাহেব। মুক্তিযোদ্ধার সম্মান হলো সবার আগে। তার জন্য সিরাজ মিয়াকে দুই তিনবার রিহার্সালও করানো হয়েছে। কিন্তু এই লোকটা শেষকালে এসে এভাবে পল্টি মারলো! আয়োজন সব সম্পন্ন। এখন সিরাজ মিয়া বিনে অনুষ্ঠান শুরু হয় কেমনে! আয়োজকরা হন্নে হয়ে খুঁজতে লাগলো তাকে। মকিমপুর গ্রামের সেই অনুষ্ঠানে কোনো বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল কি না তা ধর্তব্য নয়। তবে অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্ব হয়েছিল জম্পেশ। ধাই ধাই গান, ঝুমুর ঝুমুর নাচ সবই হয়েছিল। স্বয়ং এমপি সাহেব সাধারণের কাতারে এসে শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে নৃত্য করেছিলেন। গাঁয়ের লোকেরা বহুদিন পর বুঝতে পেরেছি তাদের এমপি সাহেবের দিলটা কত বড়। এভাবে আম জনতার কাতারে এসে মিশে যাওয়া চাট্টিখানি কথা না। মকিমপুর গ্রামের লোকেরা গভীর রাতে অনুষ্ঠান শেষে ক্লান্ত-শ্রান্ত দেহে আয়োজকদের বাহবা দিতে দিতে ঘরে ফিরেছিল। কেবল একজন দেয় নাই। সে হলো ওই সিরাজ মিয়া।
অনুষ্ঠানস্থল থেকে উধাও হয়ে সে চলে গেছিল নওপাড়া, তার ভায়রার বাড়িতে। সেখানেই রাতটা কাটিয়ে পরদিন সন্ধ্যার আগে আগে হাজির হয়েছিল মকিমপুর বাজারে। তাকে দেখে বাজারের লোকেরা হায় হায় করে উঠেছিল, আহা সিরাজ মিয়া, তুমি আছিলা কই? এমন সুযোগ কেউ ছাইড় দেয়? এমপিসাব টেকা দিছে পঞ্চাশ হাজার। লগে একটা ক্রেস্ট। টেকাটা পাইলে তোমার আর ইশকুলে ইশকুলে ঝালমুড়ি বেচন লাগে? দোকান দিতে পারতা একখান মুদিখানার!
সিরাজ মিয়া একদলা থুতু ফেলেছিল সকলের সামনে, ‘ওই টেকার উপ্রে থু! রাজাকারের বাচ্চার হাত থিকা টেকা নিমু আমি? তা সে এমপিই হোক আর মিনিস্টারই হোক। এর লাইগা যুদ্ধ করি নাই! আল্লাহয় হাত দিছে দুইখান, কাম কইরা খামু!
পাড়ার লোকের কাছে সিরাজ মিয়ার কথা পাগলামিই ঠেকেছিল। এমন বোকামি কেউ করে?
সিরাজ মিয়ারা করে। এই বোকা লোকগুলোর কাছে দেশটা মা! মা’কে বাঁচাতেই যুদ্ধে গেছিল নির্লোভ। আদৌ বাঁচাইতে পারছে কি না, বোকা সিরাজ মিয়ার মাথায় ঢোকে না মাঝেমাঝে!
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড