শব্দনীল
নির্জন পাহাড়ের শব্দ অথবা পুঁটি মাছের হইচই শুনতে চাইলে, আপনাকে পাহাড় বা পুঁটির ঝাঁকের কাছে যেতে হবে না। শুধু নিজের যাপিত জীবনের দিকে একটু সময় করে লক্ষ্য করুন। তাহলেই শুনতে পাবেন। অনুভবের মাধ্যমে খুব সহজেই জেনে যাবেন শব্দরা কী বলতে চায় বা কেন তার উৎপত্তি?
কবি মাহবুব মিত্র। যার কবিতায় পাওয়া যায় এমনই অনেক নান্দনিকতার মিশ্রণ। শুধু তা-ই নয়, কাব্য ভাবনায় ছন্দিত ঝঙ্কারের সাথে দেশ, মাটি ও সাধারণ মানুষের কথা বলে। নিজস্ব ঢং ও নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপট ধরে। তিনি ১৯৮১ সালের ১ ডিসেম্বর নেত্রকোনা জেলার মদন উপজেলার কদমশ্রীতে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মতিউর রহমান চৌধুরী ও মা জয়গুননেসা বেগম চৌধুরী দম্পতির নয় সন্তানের ভেতর তিনি অষ্টম।
মাহবুব মিত্র ইংরেজি সাহিত্যে সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক ও নর্দান ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর সম্পূর্ণ করেন। তিনি খুব ছোটবেলা থেকেই লেখা-লেখি করেন। এপর্যন্ত তার ৬টি একক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
মাহবুব মিত্রের প্রকাশিত কব্যগ্রন্থ : জননীর করতলে কবিতার মিছিল, অমীমাংসিত কবিতার রক্তাক্ত সংলাপ, আমি নীল পাহাড়ের গান, ভালো থেকো নীল আকাশ, শাদা কফিনে মেঘের শব্দ। টুকরো কথামালা : আমার বিশ্বাস আমার অবিশ্বাস
২০১৯ সালের একুশে বইমেলায় বেহুলাবাংলা প্রকাশনী থেকে প্রকাশ হতে যাচ্ছে কবির দুটি কাব্য গ্রন্থ ও দুটি টুকরো কথামালা।
কাব্যগ্রন্থ : মার্বেল পাথরের গহীন ছায়া, জলের নিচে অনন্ত দুপুর
টুকরো কথামালা : টুকরো কথা সত্য সংলাপ, আমার কথা উড়াল পাখি
চলুন পড়ে নেওয়া যাক মাহবুব মিত্রের কয়েকটি কবিতা-
ফালুদার মেলোড্রামা
আইসক্রিমের মতো ঠাণ্ডা তোমার মুখ তোমার চুলে কৃত্রিম বাতাসের সংসার, তুমি আগের চেয়ে মসৃণ-মনোলোভা হয়েছো কিন্তু ভিজে গেছে তোমার একাকী বালিশ;
ছেলেটি আগুনের ঢেউ---মেয়েটি বৃষ্টির ছোঁয়া তুমি কি নির্জন পাহাড়ের শব্দ শুনতে পাও! আমি বাঁশি হয়েছি তোমার সিথানে, আমরা ‘তুমি’ হবো সমুদ্র-স্নানে;
তোমার যাপিত জীবনে পুঁটি মাছের হইচই তুমি কি কখনো স্বপ্নে সূর্যসন্তান দেখেছো! ফালুদার বাটিটি এখনো তোমার অপেক্ষা করছে তোমার নামে গেঁথে আছে মেরি ওলস্টোনক্রাফট;
অংকটা এখানেই শেষ না---মেলোড্রামা চলছে তুমি রেগে গেলে জাহাজের ডেকে রাত্রি নামে, বলটি ঘুরছে সারা মাঠজুড়ে--নির্বোধ দর্শকের হাততালি তোমার নির্মিলিত চোখে থোকা-থোকা কাজলফুল;
তোমার মৌন কপালজুড়ে দীর্ঘ কথোপকথন বাম হাতের ঘড়িটি টাইম স্কয়ারের জীবন, তুমি যা নিয়ে এতো ব্যস্ত আছো---উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী তা কোনোদিন শুনতে পাবে না; আমার করতলে তোমার চড়ুইভাতি খেলা।
রাজঘাটে সোনালি নৌকা
নৌকার গলুইয়ে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করছে অচেনা ঈশ্বর। যাত্রীরা চোখ বন্ধ করে শুনছে ঢেউয়ের কান্না; মাস্তুল ভেঙে ফেলেছে বাতাসের ইবলিশ। কুয়াশায় ঢেকে আছে বিস্তর পথরেখা, সামনে শুধু বরফের ঘনঘন পাহাড়; তলদেশে গড়িয়ে যাচ্ছে নাবিকের দীর্ঘশ্বাস। ঝরনার রেখাগুলো রক্তে-রক্তে রঞ্জিত রানীমাছের পোনার ঝাঁক।
রান্নাঘরে উড়ছে শয়তানের খোয়াবনামা; হস্তরেখাবিদ টিয়াপাখির গলায় পরিয়েছে ভালোবাসার মণিহার। হাতের তালুতে নেমে আসে রাজনীতির ভূগোল। দরবেশের সালু কাপড়ে লেগে আছে বেগানা নারীর বাসি লালা। তবুও আলো জ্বলছে আলো নিভছে সংবিধানের শিখায়; মাননীয় বিচারক এজলাসে দাঁড়িয়ে খুনির সাফাই গাইছে। বারান্দায় ঝিমুচ্ছে নিরীহ টিয়াপাখি।
নৌকা কি এলোমেলো চলছে, নাবিক কি ঘুমিয়ে গেছে, নাকি নদী আঁকাবাঁকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে! ঝড় উঠলে পাল-হাল ধরতে হয় কঠিন হাতে; নড়ে উঠুক কেঁপে উঠুক রান্নাঘর থেকে জমিনের বুদবুদ। টিয়াপাখি, পোনাশিশু, নাবিক আর আমার সোনালি পালের নৌকা ঠিকই একদিন পৌঁছে যাবে রাজার রুপালি শানাইবাঁধা ঘাটে।
প্রত্যাশিত গন্তব্যবিলাস
পথে-পথে পথজুড়ে পথের সন্ধান, বাঁকানো লেনে ধারালো বালির ওড়াউড়ি; গাড়ির ভেঁপু অনায়াসে ঢুকে যায় বাতাসের ঘরে। চারদিকে কুয়াশার শরীর ঘেঁষে উড়ছে রাজহংসী গোলাপ, খয়েরী পায়রার যুগল হাসি, কদর্য নারীর উদাসীনতার খেরোখাতা, ঈশ্বরের নামে শাদা শঙ্খের চিরুনি বিলাপ; এই দিকে শিশুটি শুনছে রক সংগীত---আমার মুখে সবুজসুন্দরী গুঁজে দিচ্ছে স্টার শিপ প্রেম।
তোমার চোখের জল ছুঁয়েছে কুয়াশাবাড়ি, মিশেছে মিরিন্ডার জলজ ভোরে। রাতের নীরবতায় ছলাৎছলাৎ গড়িয়ে পড়ছে খনিজলবন, বাঁশিওয়ালা ও দূত ঘুরছে অরণ্যবিলাসে; আমাদের চেতনার কোষগুলো উড়ছে এক-একটি পাখির মতো মৃত্যু ছুঁয়ে-ছুঁয়ে---চোখের ভিতরে খেলা করে অচেনা বাগানের ফুল।
রাস্তায়-রাস্তায় ফেরি করি বেলুনমুখ, একুরিয়ামের রঙিন মাছ, কনডমের ভিতর যে-সন্তান নড়ে ওঠে তা বিলি করি গবেষণাগারে। মঞ্চে-মঞ্চে ক্রীতদাসের হাঁকডাক, পাখনাহীন বেলুন মানুষগুলো কনডম সাগরে সাঁতরাচ্ছে অবিরত প্রত্যাশিত গন্তব্যবিলাসে...
আগুনছায়ার শিশুর হাসি
কাওরান বাজারের বিচ্ছিন্ন মানুষগুলো পৃথিবীর দীর্ঘতম সাঁকো, তারা সাম্যের ঐক্যের মিলনের সমাবেশ---শুনি বিগত সময়ের প্রতিধ্বনি আমি চলমান পথ যেতে-যেতে শামিল হই পাখির মিছিলে, ঘর হতে বের হয়েই দেখি যে-কুকুরগুলো শুয়ে আছে বালির বালিশে তারা আমাদেরই যমজ ভগ্নাংশ---প্রতিবেশীর উদ্বেলিত চোখ, আঁকাবাঁকা পথ ধরে পাড় হয়েছি আমাদের স্বর্গলেন যেখানে প্রাণীরা জন্মের ইতিহাস খুঁজে মাতৃভূমির ছায়ায়;
ফাঁকা-ফাঁকা রাস্তায় বাতাসের স্রোতে প্রজাপতির সাঁতার উদ্বাস্তু রাস্তায় শুয়ে আছে ঝাঁক-ঝাঁক শিশুর দল আমি বাতাস কেটে-কেটে যাচ্ছি শ্মশানের প্রভুর দরোজায় অতিক্রান্ত পাহাড়ের চূড়ায় আমি পুঁতে রাখতে চাই ইলিশের নাভি আমি যেখানে যাচ্ছি সেখানে আমার প্রতীক্ষায় আগুনদেবী জলের ভিতর খেলছে পাখি যেনো আগুনছায়া শিশুর হাসি;
চোখের তারায়-তারায় ভেসে যায় কলের ধোঁয়া কালের কণ্ঠে অনাগত যীশুপাখির আগমনী গান, আমাদের শিয়রের পাশে বসে প্রতিনিয়ত ডাকে মুক্তবাজার আকাশের প্রতিটি সীমানায় গড়েছে পরমাণু-চুল্লি বাতাসের ডানায় কাঁত হয়ে আছে আমাদের শিশুপৃথিবী।
ইমকনের ভিতর কফিনঘর
ঘুরন্ত পাখার স্তন চুঁয়ে-চুঁয়ে পড়ছে রক্তের লালিমা বিধ্বস্ত নীলিমায় নুলো ভিখিরির মতো পড়ে আছি তোমার স্তনের ধুলোয়, বারান্দায় চেয়ে আছে ইমকন শিশু;
শাদা দুপুর গড়িয়ে-গড়িয়ে নামছে গিরগিটির মতো অনাগত শিশুটি খেলা করছে জরায়ুর স্বাধীনতায়, ইমকনের ভিতর ঘুমিয়ে আছে কফিনঘর;
আমাদের পাশাপাশি বসে আছে জলের পাখি নারিকেল-সুপুরির শাখায়-শাখায় উড়ে যাচ্ছে সাগরের কোলাহল, আমাদের চোখে-চোখে প্রতিনিয়ত ভাসে জননীর হাসি;
তোমার বুক থেকে নাভিমূল---ঊরুসন্ধি অবধি বিস্তৃত কামের ধনুক; অনাথ-নিঃসঙ্গ বাঁশির সুর বিচ্ছিন্ন পাহারাদারের ধোঁয়ার মতো পড়ে আছে---বেওয়ারিশ ঢেউ-চূড়ায় খেলছে বোবা পাখি আর শিশ্ন।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড