• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

‘মেঘভোর’ উপন্যাসের ৬ষ্ঠ পর্ব

মেঘভোর

ধারাবাহিক

  রোকেয়া আশা

২১ নভেম্বর ২০১৮, ০৮:৩৯
উপন্যাস
ছবি : প্রতীকী

আপার মৃত্যুর শোক বেশীদিন স্থায়ী হয়নি আমাদের মধ্যে। এমনকি আপার সবচে কাছের মানুষ শাহীন ভাইয়েরও না। আপার চল্লিশার দিনে যখন আমরা সবাই ওই বাড়িতে যাই, তখন লোকটা আর তার মা আম্মাকে একটা প্রস্তাব দিয়েছিলো। আম্মার কাছ থেকে সেটা শুনে আমরা সবাই হতভম্ব হয়ে যাই।

ওরা আম্মাকে বলছিলো, স্বচ্ছ আর শুদ্ধের একজন মা দরকার। সৎমা আনার চাইতে ওদের আপন খালাকে মা করে নিয়ে আসাটাই বেশী ভালো হবে। আম্মার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিলো, আম্মার এই প্রস্তাবে তেমন আপত্তি নেই। শাহীন ভাই তখন কাছাকাছি ছিলো না। আমি বুঝতেও পারছিলাম না, এখন কি করবো আমি। এই লোকটাকে আমি ঘৃণা করি, অনেক, অনেক বেশী ঘৃণা করি। আমি যখন অবিশ্বাসের চোখে আম্মার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, তখন এক ফাঁকে মাহিন আমার কাছে এসে আস্তে করে বলে, ‘ছোটপু, তুই কিছু বলবি না?’ আমার তখন প্রথমবারের মত মনে হলো, আমি একাই হয়তো আমার জন্য অনেক। আমি হঠাৎ করেই আম্মার দিকে তাকিয়ে গলাটা শক্ত করে বললাম, ‘না আম্মা।’

আম্মা অবাক হয়ে তাকালো আমার দিকে, চোখে কিছু একটা ছিলো আম্মার। বিস্ময় বোধহয়। লোকটা, তার মা, সবাই কেমন অবিশ্বাস চোখে তাকিয়ে ছিলো আমার দিকে। আমি, মেঘনা; এত শক্ত গলায় কথা বলতে পারি, এটা হয়তো ওদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো।

আমি আর মাহিন তক্ষুনি বের হয়ে এসেছিলাম ওই বাড়িটা থেকে। ওদের বাড়ি থেকে মিনিট দশেক হাঁটলে মেইন রোড। সেখানে পৌঁছে রাস্তার সাইডের ফ্লেক্সিলোডের দোকানটা থেকে শাহীন ভাইকে ফোন করি আমরা। ভাই আব্বুর সাথে বাসায় থেকে গিয়েছিলো সেদিন। আমি ফোন করে ভাইকে শুধু বলেছিলাম এসে আমাকে নিয়ে যেতে। ভাই কিছু না বলেই ফোনটা রেখে দিয়েছিলো। আমরা কতক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম জানিনা। এটুকু মনে আছে, পুরো সময়টা মাহিন শক্ত করে আমার হাতটা ধরে রেখেছিলো।

শাহীন ভাই যখন এসে পৌঁছায় তখন খুব কড়া রোদ, সম্ভবত দুপুরের ঠিক মাঝামাঝি সময়। ভাই এসেও কোন প্রশ্ন করেনি। আমার অন্য হাতটা ধরে আমাদের নিয়ে অটোতে উঠে পড়লো শুধু। আমার দুপাশে আমার দুই ভাই ছিলো। আম্মা এই ঘটনা নিয়ে কেন জানি কিছু বলেনি। রূপু আপার ঘটনার পর থেকেই আম্মা অনেকটা পাল্টে গেছে, বড় আপার মৃত্যুতে পাল্টানোটা বোধহয় আরেকটু শুধু শেকড় গেড়ে নিলো। অদ্ভুত হচ্ছে, ওই দিনের পর থেকে মাহিন আম্মার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে একদম। ও এখন শাহীন ভাইয়ের ঘরেই থাকে। রাতের বেলা আর বালিশ নিয়ে আম্মার ঘরে যায়না। এত ছোট্ট সময়ে এত বড় একটা অভিমান কিভাবে হয় কে জানে!

আমাদের অনেক কিছুই বদলেছে। আম্মা এখন আর প্রাইভেট পড়ায় না, বলতে গেলে কেউ আসলে আম্মার কাছে পড়তে আসে না। তবে শাহীন ভাই এখন অনেকটা সামলে নিয়েছে। ভাই এরমধ্যে কিস্তিতে ল্যাপটপ কিনেছে একটা। বাসায় প্রায়ই ওটা নিয়ে পড়ে থাকে। আমাদের মোটামুটি চলে যায়। অন্তত দেখে তাই মনে হয়।

শাহীন ভাইয়ের ফাইনাল পরীক্ষা সামনে। ভাই আগের মত আমার সাথে তেমন গল্প করে না। বাসায় যতক্ষণ থাকে, হয়তো ল্যাপটপ আর নয়তো কোন বই সামনে নিয়ে চুপচাপ পড়ে থাকে। আমি আছি আমার মত। বই-টই পড়ি সারাদিন, আর নয়তো লিখি। আমার নিজের ডায়েরি আছে এখন একটা, ওটাতে তালা দেওয়া যায়। আমার খুব নিজস্ব কিছু বলতে শুধু ডায়েরীটা আছে। আমার পড়াশোনা নিয়েও কেউ খুব বেশী মাথা ঘামায় বলে মনে হয়না। এরমধ্যে শাহীন ভাই শুধু একদিন হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো, ‘তুই কি নিবি?’ আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি ভাই কি নেওয়ার কথা বলছে। ভাইও সেটা বুঝলো, আরেকটু খোলাসা করে প্রশ্ন করলো তখন, ‘তুই তো বোধহয় সায়েন্স নিবি, নাকি?’

আমি মাথা নেড়ে না করলাম। ভাই কিছুটা অবাক হলো মনে হয়। তারপর বললো, ‘তোর তো রেজাল্ট এত ভালো, তাও না?’

আমি হাসলাম শুধু । কিছু বললাম না। শাহীন ভাইও আর কিছু না বলে চলে গেলো তখন। কয়েকদিন আগের কথা। এরমধ্যেই আমি নিজে নিজেই আর্টস নিয়ে স্কুলে ক্লাস শুরু করেছি। আম্মার কাছে সবসময় টাকার হিসাবটা নিখুঁতভাবে দিই। আম্মা আমাকেও বোধহয় এখন একটু একটু ভয় পায়। আমাদের পরিবার এখন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতন। আমরা সবাই সবার মত আলাদা আলাদা পৃথিবীতে থাকি। অথচ প্রতিদিন ঠিকই রাতের বেলা সবাই একসাথে খেতে বসি। মাঝেমধ্যে কোন কোন শুক্রবার দুপুরে বাসায় এখনো পোলাও মুরগি রান্না হয়। তারপরও আমরা কেউ নিজের কথা কাউকে বলিনা। আমার ক্লাস শুরু হয়েছে দু’মাস হলো। আমাদের এদিকে এরমধ্যে একটা পাবলিক লাইব্রেরী হয়েছে। আমি সদস্য হয়ে রোজ স্কুল থেকে ফেরার সময় বই নিয়ে আসি একটা করে। সন্ধ্যার পর ঘরে কসমোলজির একটা বই পড়ছি, এমন সময় ভাই ঘরে ঢুকলো। আমি ভাইকে দেখে বইটা রাখতেই ভাই বইটা হাতে নিলো। নিয়ে বললো, ‘তুই এগুলো বুঝিস মেঘ?’ আমি কসমোলজি বুঝি কিনা জিজ্ঞেস করছে ভাই, বুঝলাম। কিন্তু প্রশ্নটা ভাবছি না আমি। আমার ভাই আজকে অনেক দিন পর আবার আমাকে আগের মত করে মেঘ বলে ডেকেছে। অনেকদিন পর আবার পুরনো স্নেহ। এতদিনের এতসব ধাক্কার পরও এখনো অকারণে কিংবা ছোট্ট কোন কারণেই চোখে পানি আসে আমার । কেন, জানি না। হাসলাম অল্প তারপর বললাম, ‘খুব বেশী বুঝি না, একটু একটু বুঝি।’

- তোর কসমোলজি পছন্দ?

আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলি। ভাই আবার প্রশ্ন করে, ‘তাহলে সায়েন্স নিলি না কেন?’

নবীন- প্রবীন লেখীয়োদের প্রতি আহ্বান: সাহিত্য সুহৃদ মানুষের কাছে ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, রম্য রচনা সহ সাহিত্য নির্ভর আপনার যেকোন লেখা পৌঁছে দিতে আমাদেরকে ই-মেইল করুন [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড