• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

শেকড় কোথায় ?

  সোহেলী জান্নাত

১৭ নভেম্বর ২০১৮, ১২:৫১
যোদ্ধা
মুক্তিযোদ্ধা (ছবি : প্রতীকী)

শাহবাগে যখন কাদের মোল্লাসহ কুখ্যাত সব রাজাকারের ফাঁসির দাবিতে উচ্চকিত আওয়াজ তোলা হলো, সেই উত্তাল জনতার মিছিলে আমিও ছিলাম। যদিও আমি সরকারি মাঝারি ধরনের একটা চাকুরি করি, পেশাগত ব্যস্ততা সীমাহীন তবুও গিয়েছিলাম সেই জনস্রোতের জোয়ারে সামিল হতে। আমিও স্লোগান দিয়েছিলাম এবং অন্যদের তুলনায় একটু উঁচু গলাতেই বলেছিলাম-‘ক তে কাদের মোল্লা... খ তে খাইছি তোরে! গ তে গু আজম, ঘ তে ঘৃণা তোরে!’

ভাবছেন এ আর নতুন কী- বিবেকবান দেশপ্রেমী প্রতিটি তারুণ্যইতো সে জনসংঘে যোগ দিয়েছিল। এটা বলে এত গুরুত্ব বাড়ানোর কী আছে! বাঙ্গালির যদি তিন বেলা ভাত খেয়ে বলতে হয় আমি ভাত খেয়েছি.. তাহলেতো কথা থাকে না।

বিষয়টা আসলে ঠিক তা না। আমার প্রতিবাদের মিছিলে যোগদানের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ভিন্ন এবং স্বাতন্ত্র্যও বটে। আমি একজন ১০০% বিশুদ্ধ রাজকারের নাতি! আমার মায়ের পরম শ্রদ্ধেয় আব্বাজান ছিলেন ৭১ এর কুখ্যাত রাজাকার; যিনি একাধিক মানুষ খুন না করে একবেলা ভাত খেতেন না এবং যুদ্ধে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের অসহায় সন্তান আর বিপন্ন স্ত্রীদের ধরে এনে তাদের পেট থেকে কুপিয়ে ভুড়ি বের করে সেই মৃতপ্রায় মানুষটির হাতে লাঠি ধরিয়ে দিয়ে বলতেন - ‘নে! আগে তুই তোর ভুড়ি রক্ষা কর দেখি! দেশ রক্ষা দেশ গড়া পরে করিস!’ শুনেছি সে সময় নাকি কিছু পীর পাকিদের অপকর্ম আড়াল করতে ধর্মকে ঢাল বানিয়ে বঙ্গবন্ধুর নামে ওয়াজের মাঠে অপপ্রচার চালাতেন “ইয়ে মুজিবর নেহি... ইয়ে মুছিবত হ্যায়।’ আমার নানা পরম ভক্তিভরে সে কথা বিশ্বাস করতেন; আর তাই মুসলিম উম্মার ঐক্য সাধনে নির্বিবাদে করতেন হত্যা, করতেন লুঠ!

তো আমি সেই কুখ্যাত রাজাকারের দ্বিতীয় ঘরের মেয়ের পক্ষের নাতী। যদি কোনো কারণে মুক্তিযুদ্ধে যোদ্ধারা ব্যর্থ হতেন তবে ঘটনা অন্যরকমও হতে পারতো। আমি হয়তো নানার খাটিঁ রাজাকারি সূত্রে চাকুরি ক্ষেত্রে নাতী কোটা পেতাম! কিন্তু মজার ব্যাপার হলো বর্তমান চাকুরিটি আমার মুক্তিযোদ্ধা কোটার বদৌলতে প্রাপ্ত! আপনারা নিশ্চয়ই এতক্ষণে দ্বিধাদ্বন্ধে পড়ে গেছেন। এ আবার কেমন হলো? মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অথচ রাজাকারের নাতী! তেলে জলে মিশ খেলো কী করে!

বস্তুত এর পেছনেও আছে লজ্জাস্কর এক মজার ইতিহাস! আসলে এটি আমাদের জানবার কথা ছিল না; এমনকি কারোরই জানার কথা ছিলো না, যদি না একদিন আমার বাবা-মায়ের মধ্যে মর্যাদার প্রশ্নে তীব্র চুলোচুলি বাঁধতো।

ছোটবেলা থেকেই আমার বাবাকে আমরা শ্রদ্ধা করতাম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। সত্যকথা বলতে কি মুক্তিযোদ্ধা কি জিনিস সেটি ঐ অত শৈশবে, অত প্রত্যন্ত গ্রামে থেকে বোঝার কথা নয়। কিন্তু বিভিন্ন দিনে যখন এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি আমার বাবাকে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে অথবা ভাষার মাসে শহীদ বেদীতে ফুল দিতে ডাকতেন তখন আমাদের খুব ভালো লাগতো। বুঝে যেতাম আমাদের ঘর ভাঙ্গা টিনের হলেও আমার বাবা সমাজের বিশেষ কেউ! স্কুলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণীর অনুষ্ঠানে আর পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার দিন আমার বাবা যখন তাচ্ছিল্ল ভরে মৃদু হেসে প্রধান অতিথির পদ অলংকৃত করতেন তখন আমি পাশে দণ্ডয়মান বন্ধুকে আঙ্গুলের খোঁচায় তা দেখাতাম! নিজের অজান্তেই একটু সবার সঙ্গে স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে বৃদ্ধাঙ্গুলিতে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে দাঁড়াতাম! ভাবখানা এই যে, দেখ ঐ চেয়ারে বসা লোকটিকেই আমি বাবা বলে ডাকি..এর সঙ্গেই সন্ধ্যেবেলা আমি ঝোল মেখে ভাত খাবো!

আর অন্যদিকে, মায়ের প্রতি আমাদের ভাবনাটা ছিল অন্যরকম। বাবার মুখে শুনে শুনেইে জেনেছি মা ‘রাজাকারের বাচ্চা’। এমনিতে মায়ের উত্তুঙ্গু মেজাজ আর কটু কথার কারণে মাকে আমরা ঘাটাতাম কম। দাঁড়ান, মায়ের কটু কথার একটা উদাহরণ দেই। মাকে গিয়ে যদি আপনি অতি সাধারণ কথা - এই যেমন ধরেন বলেন যদি - ‘চাচী আজ তো খুব সুন্দর রোদ উঠেছে’! তো মায়ের ঝঁঝালো কণ্ঠের উত্তর পাবেন- ‘রৈদ ওটফেনা তো কি বিস্টি ওটফে নাকি! যতসব আজাইরে কতা কতি কোয়ান্দে আইছ বাফু- ভাগোদি এয়েন্দে! ফাগল ছাগলের মরণ! নিজি বাচতিছিনা নিজির জালায়-কুহুর উঠিছে দোতলায়!’ বাবার মতে মাকে তাই যতটা সম্ভব এড়ানো ভালো।

বাবার চোখে মা যতখানি না আমাদের মা, তার থেকেও বেশি ছিল রাজাকারের মেয়ে! অবশ্য রাজাকার কী জিনিস তাও বুঝতাম না তখন। বাবার কথা শুনে বুঝে নিতাম রাজাকার খুব খারাপ লোক। ঐ যেমন শুক্রবারের বিকালে টিভিতে দেখা বাংলা ছবির মিশা সওদ্গার কিংবা হুমায়ুন ফরিদীর মতো কেউ! সবাইকে মারে-সব লুটে পুটে খায়।

কিন্তু মায়ের বক্তব্য মতে শিখেছি রাজাকারি গর্ব করে বেড়াবার মতো কোনো বস্তু। যারা রাজাকার হয় তারা এলাকার মেম্বার চেয়ারম্যান থাকে, আর তাদের থাকে একাধিক বউ, ডজনখানেক ছেলেমেয়ে, আর থাকে অঘাত সম্পত্তি। লোকে সম্মান না করুক ভয় করে। বাবার মতে দু’চারটা গরীব জামাই পোষা তাদের কাছে হাতের ময়লা। তাছাড়া মা যুক্তি দিতেন ‘রাজাকার’ শব্দের মানে তো দেশপ্রেমিক,– রাজাকারি তবে খারাপ হবে কেন?

মা এক প্রকার গর্বই বোধ করতেন এই বলে যে- ‘আমার বাফ ছেলো রাজাকার’ এবং বাবার নিষেধ অমান্য করেই পাশের বাড়ির চাচি খালাদের মজলিসে নিজের রাজাকার বাবার অঢেল সম্পত্তির বর্ণনা দিয়ে সুখের স্মৃতি হাতড়ে আপাত দারিদ্রের দুঃখ ভুলতে চাইতেন। বাবা তাকে যতই বোঝাতেন তোমার বাবার ইতিহাস কাউকে বলে বেড়িওনা। আমার অসুবিধা হবে সামাজিকভাবে নিগৃহীত হব আমি, ছেলে পিলের ভবিষ্যতে ভালো চাকুরি হবে না, প্রতি পদে পদে হেয় হবে তারা। কিন্তু কে শোনে কার কথা! মা তার বড়লোক বাবার তুলনায় গরীব স্বামীর উপদেশ থোরাই কেয়ার করতেন। তো যাই হোক আমাদের চোখের সামনে ঘটলো সেই নিদারুণ ঘটনা।

একদিন ঝাঁঝালো রোদে ভরা শ্রান্ত, নিশ্চুপ দুপুরে মা যথারীতি গর্বভরে তার রাজাকার বাবার সম্পত্তির হিসেব আর জামাইয়ের সংসারে তার অবদানের ফিরিস্তি তুলে আমার অর্কমণ্য আলস প্রিয় ঝিম ধরা বাবাকে তুলোধুনো করছিলেন। এমনিতে বাবা মায়ের এমন কটুকথার ছোবলে অভ্যস্ত ছিলেন। কিন্তু সেদিন যেন কেমন পৌরষের ভুত ভর করলো তার ওপর! হয়ত দমবন্ধ হাওয়া আর ভ্যাপসা গরমের প্রভাবেই মায়ের অগোছালো চুলের খোঁপাটি ধরে তিনি বলে বসলেন রাজাকেরর বাচ্চা! তোর বাফের কুকীত্তির জন্যি সমাজে আমার মুক দেহানোই দায়.. খেতাপুরি তোর বাফের টাহায়.. তোর বাফের মুক ভইরে আমি.. এহোনও টাইম আছে চুপ যা..! কয়ে দিলাম কিন্তুক’

আর যাবে কোথায়! জোকের মুখে নুন পড়ার বদলে ঢিল পড়লো ভীমরুলের চাকে! অভাবী সংসারের চাপে পরিশ্রান্ত আমার যুদ্ধংদেহী মাও শুরু করলেন ‘কী! আমি রাজাকারের মাইয়ে! ওরে আমার মুক্তিযুদ্দরে হারামী! গণ্ডগোলের সুমা তুই কোয়ানে ছিলি তা বুঝি আমি জানি না? রাঙ্গা পাঠা! তুই যুদ্দ করিছিস না আমার বাফের মাচায় বইসে লুটির টাহায় গোস্ত পুলাউ গিলিছিস! এন্নে সাট্টিফিয়েট গুছায়ে সাধু সাজিছ! হারামির বাচ্চা হারামি-আমারে মাত্তি আসে-কত বড় সাওস! তোর চৌদ্দগুস্টির মুহি আমি.. করি, ওরে-! আমার বাফের তাও রাজকাকারি করার সাওস ছিল, আর তুইতো মাইয়া মাইনসির মতো মেলেটারির ভয়তে বোরোকা পইড়ে পলাইয়ে রইছ! ...’ মা যথারীতি বিলাপ শুরু করে দিলেন।

ইতোমধ্যে বাবা -মায়ের উত্তপ্ত বাক্যালাপ উপভোগের নিমিত্তে উপস্থিত দর্শক শুনে গেলো এই কাহিনী। আর একটু বেশি করে শুনলাম আমরা ছ- ভাইবোন। নিশ্চুপ হয়ে গেলেন আমার বাবা। তিনি হয়তো ঘটনার গভীরতা এতটা আশা করেন নি। এরপর থেকে কেন জানি বাবার চোখের দিকে তাকাতে পারতাম না। মনে হতো আমি তাকালেই বুঝি বাবা লজ্জা পাবেন। কেমন যে হতো মনের ভেতর! বাবা সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকতেন, আমার অন্তরেও ঢুকে গেল ভয়। কেন কিসের জন্য জানি না।

এরপর বড় হলাম। মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট দরকার হলো কোটা সুবিধার প্রয়োজনে। অবশ্য এতদিনে জেনে গিয়েছিলাম প্রকৃত ইতিহাস। যুদ্ধের শুরুতেই যখন আমাদের এলাকায় মিলিটারি ক্যাম্প বসলো তখন এলাকার অধিকাংশ যুবা-বয়স্ক পুরুষ যোগ দিল রাজাকারের দলে। সবাই-ই খান সেনাদের তুষ্ট রাখতে মহাব্যস্ত। কেউ গরীবের একমাত্র অবলম্বন ছাগল ধরে আনে, কেউ বা আনে গর্ভবতী গাভী, গর্ভবতী স্ত্রীও আসে পাকি পিশাচদের লালসার শিকার হতে। মানুষের মধ্যের মানবিকতা লোপ পেল, ভর করলো পশুত্ব- অথবা তার থেকেও নিকৃষ্ট কিছু। অবশ্য এদের সবাই যে পাকিস্তানকে ভালোবেসে রাজাকার হয়েছে তা নয়। কেউ রাজাকার হয়েছে আত্মস্বার্থ রক্ষার্থে; সুবিধাবাদী চরিত্রের কারণে। আবার কারো রাজাকারির উদ্দেশ্য অন্যের সম্পত্তি লুণ্ঠণ।

কিন্তু আমার বাবা ছিলেন বরাবরের ভীতু প্রকৃতির মানুষ। একাট তুচ্ছ, প্রায় না বলার মতো সরকারি চাকুরি ছিল তার। কিন্তু যুদ্ধ প্রবল আকার ধারণ করলে বাবা আর প্রাণ ভয়ে অফিস যেতেন না। সারাক্ষণ আমাদের ঘরের মাচায় নিশ্চুপ মেরে ঝিমুতেন। বাবা এই ডামাডোলে না গেলেন যুদ্ধে না হলেন রাজাকার।

তো বাবার এ অবস্থা দেখে মা তাকে চালান করে দিয়েছিলেন আমার তখনকার প্রতাপশালী নানার কাছে। অনেকে ভাবলো বাবা হয়তো মুক্তিযুদ্ধে গেছে কিন্তু আমার রাজাকার নানার প্রভাবে মাকে ঘাটাতে সাহস পেল না। যুদ্ধের বাকি কয় মাস, অর্থাৎ নানার মৃত্যুর আগপর্যন্ত বাবা সেখানেই ছিলেন জামাই আদরে।

ভাগ্যিস এই সময়ে আমার নানা বেঁচে নেই! তাই তার ফাঁসীর দাবিও নেই! শুনেছি যুদ্ধে মুাক্তযোদ্ধারা জয়ী হয়েছে জেনে তিনি সে রাতেই নিজ আঙুলের হীরের আংটি চুষে আত্মহত্যা করেছিলেন। ফ্যাসিস্ট হিটলার মরেছিলো নিজ হাতের গুলি খেয়ে আর নানা মরলেন হীরে খেয়ে। অবশ্য তাতেও মুক্তিযোদ্ধাদের ঘৃণার হাত থেকে তিনি রেহাই পান নি। মুক্তিযোদ্ধারা নানাকে বিবস্ত্র করে পশ্চাতদেশে বাঁশ ঢুকিয়ে, হাতে হারিকেন ঝুলিয়ে গ্রামের চৌরাস্তার মোড়ে পুতে রেখে আক্ষরিক অর্থেই গ্রাম্য প্রবাদ ‘হাতে হেরিকেন পাছায় বাঁশে’র সত্যতা চিত্রিত করেছিল। নানার এ অবস্থার এক খানা ছবি মায়ের টাকা রাখার কৌটোতে আছে। আমি একদিন লুকিয়ে দেখেছিলাম! মা হয়তো কোনো পত্রিকার পাতা থেকে কেটে পরম ভালোবাসায় আগলে রেখেছেন।

যাইহোক দেশ স্বাধীন হবার পর আমার বাবা কী জানি কী বুদ্ধি করে নানার একখানা পরিত্যাক্ত রাইফেল নিয়ে হাজির হলেন গ্রামের মুক্তিযুদ্ধ ক্লাবে। মুখে ছিল প্রকৃত যোদ্ধার মতোই জয় বাংলা স্লোগান, ব্যাস! রাজাকারের গ্রামে রাজাকারি না করা বাবাকে সবাই সহযোদ্ধা হিসেবে বুকে জড়িয়ে নিলেন। সময়টি ছিল তখন আবেগে ভেসে যাওয়ার, সময়টি ছিল তখন হারিয়ে পাওয়ার। তাই কারো মনে প্রশ্ন জাগেনি এ কোথায় ছিল, কোন সেক্টরে যুদ্ধ করেছে। রাজাকারের গ্রামে বাবা হলেন সবেধন নীলমনি মুক্তিযোদ্ধা। পরে অবশ্য যোদ্ধা সনদ বানাতে গিয়ে তিনি একটু ঝামেলাতেই পড়েছিলেন। তবে দীর্ঘ নয় মাস সরকারি চাকুরিতে অনুপস্থিতি সরকার দ্রোহেরই নামান্তর! আর ছিল বাবার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুর সাক্ষ্য। তিনি বাবাকে বিশ্বাস করেছিলেন, বাবাকে ভালোবেসে সত্য-মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে তিনি দ্বিধা করেন নি। বাবা হলেন সনদধারী মুক্তিযোদ্ধা। আমরা তার গর্বিত সন্তান।

কিন্তু আমি তো জানি আমি একজন খাঁটি রাজাকারের নাতী। আমার রক্তেই প্রবহমান বিশ্বাসঘাতক বিভীষণ, মীরজাফর আর খুনী নানার রক্ত। আমি একজন ভণ্ড মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। আমার রক্তে লালন করছি অলস, অকর্মণ্য, ভীরু-কাপুরুষতার জিন। তাই কেউ না জানুক আমি তো জানি আমার শেকড় কোথায়; দেশপ্রেমের ছদ্দবেশে দেশদ্রোহের উৎসটাকে আমি ভালোভাবেই জানি।

আমার ভেতরেও আছে হিংস্রতা। আমার ভেতরকার পিশাচ-সত্তা উঁকি দেয় মেয়েদের সাথে শরীরী খেলায়। আমি তাদের ভালোবাসার ফাঁদে ফেলে সম্ভোগে-উপভোগে কাঁদিয়ে অতঃপর ঠকিয়ে বিকৃত আনন্দ পেতে ভালোবাসি। মৃত প্রায় বিপন্ন ইদুর ছানাকে নিয়ে হুলো বেড়াল যেমন অহমের খেলায় মেতে ওঠে; কিশোরী মেয়েদের সঙ্গে আমার সম্পর্কটাও তদ্রুপ। এই পৈশাচিক আনন্দ পাওয়া স্বভাবটা আমি আমার মায়ের মধ্যেও দেখেছি। আমার মা মুরগী জবেহ করতে কারও সাহায্য নেন না। একাই একহাতে মুরগীর পা,পাখা চেপে ধরে অন্যহাতে গলাটিকে সুবিধামতো টেনে নিয়ে পাতা বটির একপোচে দেহ থেকে মাথা আলাদা করেন; এবং মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করা মুরগীটিকে ততক্ষণ পর্যন্ত প্রসন্ন মনে দেখতে থাকেন যতক্ষণ না রক্ত ক্ষয়ে ক্ষয়ে সেটির দেহ নিথর হয়ে যায়।

কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি এমনটা হতে চাই না। খুব করে চাই আমার ভেতরকার এই অপবিত্র রত্তগুলোকে কেউ চুষে নিক। আমার হৃদয়ে ঘাপটি মেরে থাকা ভীতু, কাপুরুষ জান্তব সত্তা সত্যের উত্তাপে গলে গলে ক্ষয়ে যাক রাজপথে। তাইতো শত ব্যস্ততাতেও আসি এই শাহাবাগে। প্রকৃত যোদ্ধার সঙ্গে কণ্ঠ মেলাই, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের সঙ্গে মশাল মিছিলে কাধে কাধ মিলিয়ে দূর করতে চাই সব আধাঁর মুছে যায় না। আমি কিছুতেই আমার এই দ্বৈতসত্তাকে অস্বীকার করতে পারি না। প্রতিনিয়ত দ্বগ্ধ হই-বিবেকের দংশনে ক্ষতবিক্ষত হই, কেন এমন হয়? কেন? কেন?

জানেন, বাংলাদেশ যখন বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারিয়ে দিয়েছিল তখন আমিও সবার মতো ঢোল তবলা বাজিয়ে আনন্দ করেছিলাম, অফুরন্ত উল্লাস নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলাম বিজয় মিছিলে। নেচে গেয়ে জানান দিয়েছিলাম আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। কিন্তু দিনশেষে আমার কেবল পরাজিত আফ্রিদি আর বিমর্ষ রমিজ রাজার মুখটাই মনে পড়ছিলো। কেবলি মনে হচ্ছিল ওরা জিতলেই ভালো হতো। আমি যে সেই শৈশব থেকেই দেখে আসছি পাকিস্তানের খেলা হলেই মায়ের হাতে তসবিহ! পাকিস্তানের বিজয়ের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করছেন, এমনকি দু’রাকাত শোকরানা নামাজও আদায় করতেন পাকিদের বিজয়ে।

কিস্তিতে কেনা সাদাকালো সিঙ্গার টিভিতে খেলা দেখার সময় মাকে অনুরোধ করতাম- ‘‘মা বাংলাদেশের জন্যি দোয়া করো। আমরা য্যান এইবার ঠিক জিতে যাই!’ ‘বাফ তুই ফাকিস্তানের জন্যি দুয়া কর; ওরা য্যান জিতে যায়।’ মা ব্যাখ্যা করতেন- ‘ওরা অলো গিয়ে তোর মোসোলমানের জাইত। মোসলমান মোসলমান ভাই ভাই।’ ‘কেন মা বাংলাদেশীরা কি ইন্দু? আমরাও কি তালি ফরে ইন্দু! কি কও যে তুমি! তোমার মাতা মুণ্ডু রানতি রানতি এহেবারে গেইছে!’ আমি হাসতাম।

‘চুপ কর দেহি এট্টু। খেলা দেকতি বইছিস খেলা দ্যাক। খালি বগর বগর ফটর ফটর!’ মা বিরক্ত হতেন; যুত্তিতে হেরে গিয়ে তাই ধমকের আশ্রয় নিতেন। বাবাও কিছু কম যেতেন না। এমনিতে তিনি বিভিন্ন সভা সমাবেশে বঙ্গবন্ধুকে ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি’, ‘জাতির জনক’, সপ্নদ্রষ্টা ইত্যাদি বলে বলে কণ্ঠের ভঙ্গুর দশা করে ফেলতেন; কিন্তু ভেতরে ভেতরে তিনিও মোশতাক অনুসারীদের মতো বিশ্বাস করতেন- ‘বঙ্গবন্ধু ভালো নেতা হলেও ভালো শাসক ছিলেন না, আওয়ামিলীগ মানেই অতিরিক্ত ভারতপ্রীতি-হিন্দুপ্রীতি। শুনতাম আর অবাক হতাম এই ভেবে যে, ‘এই মীরজাফরীর শেষ কোথায়!’

বিশ্বাস করুণ আমি এর শেষ চাই বলেই এত বেশি বেশি শাহবাগে আসি। তুলনামূলক উঁচু গলায় স্লোগান দেই- রাজাকারের ঠাঁই নাই, রাজাকারের ফাঁসি চাই। আর প্রবলভাবে আশা করি বাবা মা হৃদয় থেকে একদিন হলেও বলবে- ‘পাকিস্তান মুর্দাবাদ’। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

নবীন- প্রবীন লেখীয়োদের প্রতি আহ্বান: সাহিত্য সুহৃদ মানুষের কাছে ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, রম্য রচনা সহ সাহিত্য নির্ভর আপনার যেকোন লেখা পৌঁছে দিতে আমাদেরকে ই-মেইল করুন [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড