• বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ছোট গল্প : জীবনচক্র

  ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস

১৫ নভেম্বর ২০১৮, ২১:১৬
গল্প
ছবি : প্রতীকী

মেয়েদের জীবনের সার্থকতা কিসে? দেখতে ভালো, পড়াশোনায় ভালো, দারুণ ক্যারিয়ার, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, প্রয়োজন মত সন্তান উৎপাদন, তাদের সফল মানুষ হিসাবে গড়ে তোলা। আর তারপর কোন ঝামেলা ছাড়া টুপ করে মরে যাওয়া। কি চমৎকার উপমা দেওয়ার মতো জীবনচক্র তাই না? কোথাও কোন ধাপে কাউকে ঝামেলায় না ফেলা বরং জীবনের সব ধাপে পজিটিভ রোল পালন করে যাওয়া। এর একটাতেও কম বেশী হলেই কিন্তু ঐ মেয়েটার জীবন পরে যায় বিপাকে।

আমি সুপ্তি। ছোটবেলা থেকে বাবা মায়ের দারুণ আদরে বড় হওয়া আমি। যখন যা চেয়েছি পেয়েছি। সেই বয়সের লক্ষ্মীমন্ত মেয়ের সব গুণই যে আমার ছিলো। দেখতে ভালো হওয়ার পাশাপাশি আমি দারুণ পড়ুয়া ছিলাম। অন্যান্য গুণাবলী যেমন গান, নাচ, আবৃত্তি সব ক্ষেত্রেই ছিলো অবাধ কৃতিত্বপূর্ণ বিচরণ। স্কুল কলেজে পরীক্ষাগুলো পার হয়েছি শুধু নিত্য নতুন কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেই। পুরো পাড়ায় আমি ছিলাম উদাহরণ দেয়ার মতো। যার যার বাবা মায়েরা শুধুমাত্র আমার উদাহরণ টানতো বলেই পাড়ার কতজনের যে বিরাগভাজন ছিলাম আমি সে কথা আর নাই বা বলি।

আর দশটা মেয়ের মতো কৈশোর বেলায় নানা পদের প্রেমপত্র আমিও পেয়েছি। কিন্তু পড়ালেখা আর জীবন লক্ষ্যে ছুটে চলা এই আমাকে সেই কৈশোরের বসন্ত বাতাসে দুলতে দেয়নি মোটেও। অথবা বলা যায় নিজেকে নিজে শৃঙ্খলবন্দী রেখেছিলাম লক্ষ্যে পৌঁছার নিমিত্তে। কথায় বলে যে মানুষ তার স্বপ্নকে তাড়া করতে জানে সে দিনশেষে তার লক্ষ্যে পৌঁছাবেই; শুধু সময়ের দূরত্বটুকু পেরোতেই যা বাঁধা। আমি ও তাই নিজের অক্লান্ত পরিশ্রম, খানিকটা মেধা আর ভাগ্যের জোরে নির্ধারিত সময়ে ডাক্তার হয়ে বের হলাম দেশের সেরা মেডিকেল থেকে।

সেই কৈশোর কালের শুভাকাঙ্ক্ষীদের একজন ছিলো দীপ্ত। আমি যখন আমার লক্ষ্যে দৌড়াচ্ছিলাম সে ও তখন পাশাপাশি নিজের লক্ষ্যে আগাচ্ছিল।আমাকে জীবনে নিজের করে পাওয়া ছিলো নাকি তার একমাত্র স্বপ্ন। সেজন্য মনের লাগাম টেনে ক্যারিয়ারের পিছে দৌড়ে গেছে অনেকটা সময়। আমার পরিবার থেকে হ্যাঁ বলার মত সব গুণই দীপ্তর ছিল। আর তাই বিয়েটা হয়ে যায় ধুমধাম করেই। আনন্দ উল্লাস, নিজেদের ক্যারিয়ার গুছানোর মধ্য দিয়ে কয়েকটা বছর চোখের নিমিষেই চলে যায়। তাতে দুজনের কারোই আপত্তি ছিলোনা।

সুখের পাশাপাশি দুঃখ আসে বলেই মানুষ বোধহয় জীবনকে সংজ্ঞায়িত করে সুখদুঃখের মিলন মেলা বলে। এতদিন পর্যন্ত উদাহরণ দেয়ার মত জীবন চক্রে দিন কাটলেও আমার বিপাকের শুরু হয়ে যায় যখন বাচ্চা নিতে চাই। কোন এক অজানা কারণে কিছুতেই আমি কনসিভ করতে পারছিলাম না। বছরের পর বছর চেষ্টা করলাম দেশে বিদেশে নানা জায়গায়। এতো বছর ধরে জানা শুভাকাঙ্ক্ষীদের কথার দাপটে আর খোঁচায় আমার এতদিনের সব প্রাপ্তি যেন সহসাই মিথ্যে হয়ে গেলো। যেন একটা মেয়ে বাচ্চা জন্ম দিতে অক্ষম মানেই সে কোন মানুষের পর্যায়েই পরে না। আর আমাকে কথার বানে জর্জরিত করে যত কাবু করে দেয়া যায় ততই যেন তাদের সুখ।

খুব ভেঙে পরেছিলাম। চাকুরী, সংসার উচ্ছন্নে যাওয়ার যোগাড়। নিজেকে মনে হচ্ছিলো একজন পরিপূর্ণ ব্যর্থ মানুষ। শুধু আমার বাবা মা আর দীপ্ত শক্ত হাতে আমাকে ধরে রেখেছিল বিধায় আমি আবার ফিরে এসেছিলাম আমার ট্র্যাকে। জীবনের নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজ আমার দুই মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার।

আঠারো বছর পর

আমার দুই মেয়ে অজন্তা, ইলোরা আজ ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে। ওদেরকে জড়িয়ে ধরে অনেকদিন পর অনেক কাঁদলাম। সুখের কান্না। জড়িয়ে ধরে শুধু বলতে পারলাম, ‘মা অনেক বড় মানুষ হ, যাতে ঘুণে ধরা সমাজব্যবস্থা তোদের হাত ধরে বদলে দিতে পারিস।’

আঠারো বছর আগে রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটতে গিয়ে রিকশার ধাক্কায় ছিটকে পড়েছিলাম। রিকশাটিকে ধাক্কা দেয়া অটোরিকশাটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাশের এক পরিত্যক্ত ডোবায় পরে যায়। গাড়িটির ভেতর এক ভদ্রমহিলা আর তার স্বামী নিজেদের সদ্যপ্রসূত দুটো বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন যারা ঘটনাস্থলেই মারা যান।

বিধাতা বোধহয় মানুষের জীবনের সুনসানগুলো এভাবেই পূরণ করে দেন ভালোবাসার মায়ায়। নিজের পেটে না ধরেও দুটো মেয়েকে গভীর মমতায় বড় করে তুলে আমি ঐ নিম্ন মানসিকতার সমাজের মানুষগুলোকে কতটা বৃদ্ধাঙুলি দেখাতে পেরেছি জানিনা, তবে মানুষ হিসাবে নিজের জীবনচক্রটাকে সার্থক করতে পেরেছি বলেই আমার বিশ্বাস।

নবীন- প্রবীন লেখীয়োদের প্রতি আহ্বান: সাহিত্য সুহৃদ মানুষের কাছে ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, রম্য রচনা সহ সাহিত্য নির্ভর আপনার যেকোন লেখা পৌঁছে দিতে আমাদেরকে ই-মেইল করুন [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড