• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩০ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

গল্প : জেগে উঠবো কোন অন্ধকারে

  প্রকাশ বিশ্বাস

১৫ নভেম্বর ২০১৮, ২১:০৩
গল্প
ছবি : প্রতীকী

বসন্ত বাউরির বাতাসে কোন লেবুফুলের গন্ধ ভেসে আসে। ভেসে আসে আমের বোল আর কাঁঠাল মুচির সুবাস ।সবুজ নরম এই ঘাসের বন, আর বহু প্রাচীন, বুড়িয়ে যাওয়া ছাল বাকলের বৃকোদর আম,কড়ই, শিমূল, নারকেল বৃক্ষের সারি। পলাশ আর পারিজাত গাছও চেখে পড়লো। এর পাশে কাজল পড়া অতি শান্ত ধীর স্রোতস্বিনী। এ নদীর পাড়ে ভুট্টা, গম আর যবের ক্ষেতনীচ থেকে উপরে উঠে গেছে।

আমি কেন এখানে এই পরিপাটি করে সাজানো ঘাস আর লতা গাছের বাগানে পড়ে আছি? আমায় এখনে নিয়ে এলো কে? শেষ বিকেলের নরম রোদ। এই রোদে গাছপালার ছায়া পড়েছে তির্যক আর লম্বা হয়ে।

জায়গাটি কোথায় আর কেনই বা আমি এখানে আমি জানি না। আর কে আমাকে কেন কিভাবে নিয়ে এসেছে তাও জানি না।

কিন্তু এ জায়গা যেন অমরাবতী অথবা ইডেন গার্ডেন।

একি একটি কাঠবেড়ালি আমার পাতলুনের পকেটে মুখ ঢুকিয়ে দিচ্ছে কেন? মনে পড়ছে যে আমার পকেটে রয়েছে চিনাবাদামের ঠোঙ্গা। স্মৃতির আবছা অস্পষ্ট আলোছায়ায় মনে পড়ছে আমাকে যে ঘোড়ার গাড়িতে করে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে সেখানে এক সহযাত্রী আমাকে জল খাবারের জন্য এ ঠোঙ্গা উপহার দিয়েছিল।

মিহি বাতাসে ঘুঘুর ডাকে করুণ মূর্ছনা, হঠাৎ নারকেল গাছের শীর্ষদেশের পাতার আন্দোলনে চোখ আটকে গেল। সাদা ওড়না জাতীয় কাপড়ে মোড়ানো একটি আবছায় মূর্তি । ভালো করে দেখার পর মনে হলো ওটা আমার মনের ভুল।

অনবরত ঘুঘু পাখিদের আর্তনাদ, কোকিলের করুণ ক্রন্দন। এর মধ্যে এই বৃক্ষ ও ফুল শোভিত বাগান থেকে হাঁটতে শুরু করলাম জায়গাটা ঠিকমতো চেনা জানার জন্য। এ সময় দূর থেকে কুকুরের ঘেউ ঘেউ ডাক চিৎকার শুনতে পেলাম। কুকুর এত জোরে কাকে দেখে অথবা কিসের জন্য এভাবে ডাকছে বুঝে উঠে পারছিলাম না।

ফাল্গুনের এই বিকেলে এ রকম নিসর্গ নিবিড় আয়োজনে কোন মহাকর্ষীয় কালে আমি দাঁড়িয়েছি। আমি কে তাতো আমি বুঝে উঠতে পারছি না। মহাকালের কোন আচ্ছন্ন শ্রাবস্তী অথবা উজ্জয়িনীপুরে কোন জন্মে আমি জেগে উঠলাম। আমি কি নিদ্রায় না জাগরণে? সবুজ তৃণের এই আশ্রয় ছেড়ে আমি উঠে পড়লাম।

চোখে আটকালো একটি সাদা রংয়ের বাড়ির নিশানায়। চারদিকে গোল বারান্দা দেয়া একতলা বাড়িটি আমার সামনে যেন কাজলা নদীর বুক থেকে ভেসে উঠেছে। এ বাড়িটি কার? এটি কি কারো কোন কর্মালয় না আবাসন বুঝতে পারছিলাম না।

কোন জনমনুষ্যের দেখা মেলে কিনা জানার জন্য ব্যকুল হলেও কাউকে দেখতে পাচ্ছিনা।

অকস্মাৎ মনুষ্য কণ্ঠের হাঁক শুনি। কই হ্যায়…

খাকি পোষাকে হাতে বন্দুক এক প্রহরীমতো লোকের অস্পষ্ট ছায়া আমার দিকে এগিয়ে আসছে যেন।

ভয় ও কৌতূহলে আমি পিছিয়ে যেয়ে গাছের আড়ালে চলে গেলাম। কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম যে এই প্রহরী কারো অস্তিত্বের বিষয় টের পেয়েই এখানে এসেছে। শিকারি কুকুরের মতো ঘ্রাণ শুঁকে এগিয়ে আসছে সে। কিন্তু হলুদ সবুজ গিরগিটি রংয়ের পোশাকের আড়ালে আমি খুব সহজেই ক্যামোফ্লাজ করে কোমর সমান উঁচু অর্কিড, পাতাবাহার আর নীল গাছের আচ্ছাদনে শুয়ে পড়লাম।

কাউকে না দেখে না পেয়ে ফিরে গেল সে। সাময়িক মুক্তির নিশ্বাস আমার বুক চেপে বেরিয়ে আসলেও বরফ ঠাণ্ডা ভয়ের স্রোত ঠিকই আমার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে এলো। ভয়ের অনুভূতি তাহলে আমার রয়েছে। আমি একটু আশ্বস্ত হলাম আর কি। আমি গায়ে চিমটি কেটে দেখলাম। আমার মধ্যে আমি রয়েছি কিনা তা জানার জন্য। এভাবে কোটে যায় বেশ কিছুক্ষণ।

অকস্মাৎ ভেসে আসে গিটারের সুর। ভালো করে খেয়াল করে দেখি সামনের এ সুরের উৎসভূমি। তাহলে একজন দুজন নয়। অনেক লোকজনই আছে এখানে, আশেপাশে, যা আমি এতক্ষণ বুঝতে পারছিলাম না, ধরতেও পরছিলাম না।

আমি সে যন্ত্র সঙ্গীতের সুর ধরে এগোতে থাকি এই বাগানের মাঝ দিয়ে ইট সুরকি বিছানো পথ ধরে।

নারকেল গাছের সারির আড়াল ধরে ঐ দুধসাদা ভবনের দিকে এগিয়ে যাই। এবার ভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের অবিরল সুরের ধারা গলে আসছে ভেতর থেকে। হারমোনিয়াম,তবলা, বেহালা, সেতারের সুর মূর্ছনা ঝঙ্কারের সঙ্গে নাচের শব্দ আসে। পায়ে মল পড়া কেউ নাচছে। সাবধানে জানালার খড়খড়ির ফাঁকায় চোখ রাখি।

ভেতরে হাতে পানীয় গ্লাস, মুখে তামাকের পাইপ,হ্যাট কোট পড়া সাদা চামড়ার দুই ইংরেজ সাহেব বসে আছে নরম আসনের গদিতে। পাশে এ দেশীয় পারিষদ বর্গ। নাচ চলছে ঝড়ের মতো। ‘লাইক এ গ্লিটজ… ব্র্যাভো… হুররে’ বলে চিৎকার করে উঠলো এক সাহেব।

উপলব্ধি সঞ্জাত ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আমায় জানান দিলো যে এ বাড়িটি আদতে একটি নীলকুঠি।

এ ঘরটার দেয়ালের শীর্ষে জানালা দিয়ে গোধূলির আলো পিছলে পড়েছে মসৃণ মেঝেতে। আস্তে ধীরে অন্ধকার নেমে আসছে চারপাশে।

পাশের ঘর থেকে ছিটকে আসছে কুৎসিত উল্লাস ধ্বনি।

আমি এ কামরার জানালা থেকে একটু সরে পাশের ঘরের জানলায় চলে যাই। এ ঘরটি অন্ধকার। এ ঘরে গুমরে ওঠা চাপা কান্নার শব্দ কনে আসে। কে যেন কাঁদছে। কালো মতন একটি অবয়ব একটি সেঁকলে বাধা আবছা দেহ কাঠামো নজরে আসলো। শরীর শিউরে উঠলো।

যুগপৎ ভয় আর বিমিশ্র উদ্রেকে আমি ক্লান্ত বোধ করতে থাকি। আমি উপলব্ধি করতে পারছি যে এখান থেকে আমার চলে যাওয় উচিৎ।

কিন্তু আমি কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছি । পা সরছিল না এ সব দৃশ্যের আবহ দেখে। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আমাকে জানান দিচ্ছিল যে আমি এখানে মোটেও নিরাপদ নই। এখান থেকে আমার পালিয়ে যাওয়া উচিৎ। এরা আমার কেউ বন্ধু বা মিত্র তো নয়ই বরং ভীষণ রকমের শত্রু। আমার জীবন হানিও ঘটাতে পারে এরা। মুহূর্ত দণ্ড পল সরে সরে যাচ্ছিল। কিন্তু নড়তে পারছিলাম না আমি। এ স্থানটিতে কি যাদু রয়েছে? আমি কি চেতনায় না অবচেতনায় রয়েছি। আমি কি নিদ্রায় রয়েছি না জাগরণে?

হঠাৎ পেছন থেকে শক্ত একটি হাত সাঁড়াশির মতো আমার ঘাড় চেপে ধরলো। আমি তার হাত থেকে ছুটতে চাইলাম। অমোঘ নিয়তির মতো মনে হচ্ছিল সবকিছু। আর কিছু আর মনে করতে পারছি না।

কখন কতক্ষণ পর আমি আবার আবছা অস্পষ্ট চৈতন্যে ফিরে আসি বলতে পারবো না। আমাকে তোলা হয়েছে একটি চলন্ত কোন গাড়িতে, সেটি গরু না ঘোড়ার গাড়ি বুঝা যাচ্ছিল না।

বুকের ছাতি ব্যথায় ছিঁড়ে পড়ছে। গলা শুকিয়ে গেছে, দম নিতে কষ্ট। শরীরে ভীষণ রকম ব্যথা অনুভব করছিলাম।

ওদের কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছিলাম। বুঝতে পারছিলাম ওরা আমাকে ভেবে নিয়েছে নীলচাষের বিরোধীপক্ষ হিসাবে। এদের একজন আমাকে বিশে ডাকাতের দলে ফেলে দিয়েছে। এবার প্রচণ্ড লাথি এসে পড়লো শরীরে।

আবার চেতন অচিনের বুদবুদ উঠে মিলিয়ে গেল। কিছু মনে পড়ছে না আর। শুধু ভাবছি ঘুম ভেঙ্গে গেলে আমি আবার কোন অন্ধকারে জেগে উঠবো।

নবীন- প্রবীন লেখীয়োদের প্রতি আহ্বান: সাহিত্য সুহৃদ মানুষের কাছে ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, রম্য রচনা সহ সাহিত্য নির্ভর আপনার যেকোন লেখা পৌঁছে দিতে আমাদেরকে ই-মেইল করুন [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড