• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

বই আলোচনা

ইউলিসিস : সর্বকালের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস

  মাসুদুজ্জামান

১৫ নভেম্বর ২০১৮, ১৮:১১
প্রচ্ছদ
প্রচ্ছদ : ইউলিসিস

ইউলিসিস, একটি উপন্যাস; কিন্তু প্রকাশের মুহূর্ত থেকেই এর অমোঘ অভিঘাতে সচকিত হয়ে উঠেছিল সাহিত্যবিশ্ব আর বিশ্বসাহিত্যের পাঠকেরা। এভাবেই কোনো কোনো রচনা– কবিতা, উপন্যাস কিংবা নাটক– বদলে দিতে পারে জাতীয় কিংবা বৈশ্বিক প্রচলিত সাহিত্যের মানচিত্র। দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়, এরই শীর্ষে ইউলিসিস-এর অবস্থান। প্রখ্যাত ফরাসি সাহিত্য সমালোচক পাসকেল কাসানোভা– যাঁর প্রবল অনুরাগী ছিলেন আরেক বিশ্বখ্যাত সাহিত্য সমালোচক ও ভাবুক এডওয়ার্ড সাঈদ– ইউলিসিস সম্পর্কে বলেছেন যে এই উপন্যাসের মাধ্যমেই সাহিত্যে আধুনিকতার সূত্রপাত ঘটে। এটি, সেদিক থেকে বিবেচনা করলে, সাহিত্যে আধুনিকতার ভিত্ তৈরি করে দিয়েছিল। বিশ্বের নানা স্থানে সারা বছর ধরে এই উপন্যাসটি প্রকাশের [১৯২২] নব্বই বছর পূর্তি উপলক্ষে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে, চলছে সেমিনার ও সিম্পোজিয়াম।

ঐতিহাসিকভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে, উপন্যাসটি যখন প্রকাশিত হয় তখনই নানা সাজে, নানা রূপবৈচিত্র্য নিয়ে সাহিত্যবিশ্বে সূচনাপর্বের আধুনিকতার বিস্তার ও প্রসারণ ঘটছিল। কিন্তু এটি প্রকাশের পর আধুনিকতা পেয়ে গেল সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রা। এখানে বলা প্রয়োজন, ইউলিসিস প্রথম ধারাবাহিকভাবে মার্কিন সাহিত্য সাময়িকী দ্য লিটল রিভিউতে মার্চ ১৯১৮ থেকে ডিসেম্বর ১৯২০ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯২২ সালে প্যারি থেকে গ্রন্থাকারে এর আত্মপ্রকাশ ঘটে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে, সমস্ত ইউরোপে যেভাবে উপন্যাসটি সমাদৃত হয় তাকে এককথায় বলা যায় অভূতপূর্ব। বিশশতকের শুরুতে যে আধুনিকতার উন্মেষ, নতুন কাল ও পটভূমিতে নতুন সংবেদনা নিয়ে যে-সাহিত্য রচিত হচ্ছিল, ইউলিসিস হয়ে উঠলো সেই সব লেখালেখির শীর্ষরচনা। কাসানোভা জানাচ্ছেন, এই উপন্যাসের মধ্য দিয়েই জেমস জয়েস বিশ্বসাহিত্যে বিপ্লবের সূচনা ঘটান; এটি শুধু আর আইরিশ সাহিত্য হয়ে থাকলো না। জয়েস ইঙ্গ-ফরাসি সাহিত্যভুবনে সমকালের সবচেয়ে খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেলেন। সময়টি আসলে কেমন ছিল, ইউলিসিস-এর সমকালীন ফরাসি অনুবাদক ও সাহিত্য-সমালোচক ভ্যালেরি লারবিউ সেই ছবিটি ১৯২১ সালে যেভাবে তুলে ধরেছেন সেটা লক্ষ করলেই বোঝা যাবে এটি কতটা প্রভাবসঞ্চারী হয়ে উঠেছিল : It must be remarked that in writing Dubliners, Portrait of the Artist, and Ulysses, [Joyce] has done as much as all the heroes of Irish nationalism to win Ireland the respect of intellectuals everywhere. His work gives back to Ireland, or rather gives to the young Ireland, an artistic physiognomy, an intellectual identity; it does for Ireland what Ibsen’s work did in its time for Norway, what Strindberg’s did for Sweden, what Nietzsche’s did for Germany at the end of the nineteenth century, and what the books of Gabriel Miró and Ramon Gómez de la Serna have just done for contemporary Spain…In short, it may be said that with the work of James Joyce, and in particular with Ulysses , which is soon to appear in Paris, Ireland makes a sensational entry into the first rank of European literature. (Larbaud, quoted in Casanova 2004: 129).

প্যারিতে ইউলিসিস-এর প্রকাশপূর্ব কালে লেখা লারবিউকৃত এই মূল্যায়ন, বলা বাহুল্য, শুধু ইঙ্গ-মার্কিন-ফরাসি বলয়ে নয়, ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র বিশ্বে। পৃথিবীর প্রধান প্রধান বিদ্যায়তনের ইংরেজি বিভাগে যেমন এটি অবশ্যপাঠ্য একটি উপন্যাস হিসেবে সমাদৃত হয়েছে, তেমনি তুলনামূলক সাহিত্য হিসেবেও এর পাঠপ্রসার ঘটে। এখনও, নব্বই বছর পরেও এই উপন্যাসটি নানা কারণে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ আধুনিক উপন্যাস হিসেবে পঠিত হয়। কিন্তু লোকপ্রিয় বলতে যা বুঝি, সেরকম নয় এই উপন্যাসটি। এ প্রসঙ্গে ইউলিসিস সম্পর্কে এই সময়ের একজন সমালোচকের খুবই সংক্ষিপ্ত কিন্তু অন্তরদর্শী বক্তব্যের চুম্বক অংশ উল্লেখ করছি : Epic in scope, encyclopedic in detail, and eclectic in narrative style, Ulysses is famous for overwhelming, offending, sidetracking, and disheartening its readers (Bulson 2006: 71).

বোঝাই যায়, কী কঠিন একটি উপন্যাস এটি। আঠারোটি বিভিন্ন উপশিরোনামে (অংশে) বিভক্ত উপন্যাসটি আকারেও বেশ বড়; ১৯৮৬ সালে ভিনটেজ বুক্স থেকে প্রকাশিত যে সংস্করটি আমি পড়েছি তার পৃষ্ঠা সংখ্যা সাড়ে ছ’শোর ওপরে। শুধু আকারের দিক থেকে নয়, যাদের হোমারের ওডেসি পড়া নেই, কিংবা স্মতিতে ধরা নেই এর সম্পূর্ণ কাহিনী, তাদের পক্ষে উপন্যাসটি বুঝে ওঠা নিঃসন্দেহে অসম্ভব। কেননা ওডেসির আঠারটি চরিত্রের নামানুসারে জয়েস পরিচ্ছেদগুলোর নামকরণ করেছেন। ওডেসিই হয়ে উঠেছে এই উপন্যাস সৃষ্টির উৎস। এভাবে ব্যাখ্যা করলে একে ওডেসির-ই পুনঃসৃজন বা নতুন সৃষ্টি বলা যায়। হোমারীয় মহাকাব্যিক চরিত্রের আধুনিকায়নের দিকেই জয়েসের ঝোঁক দেখা যায়, উপন্যাসটির বিশেষত্ব মূলত এইখানে। এ প্রসঙ্গে বন্ধু গেয়র্গ ব্রচকে জয়েস নিজেই বলেছেন :I was twelve years old when we dealt with the Trojan War at school. Only the Odyssey stuck in my memory. I want to be candid: at twelve I liked the mysticism in Ulysses. When I was writing Dubliners, I first wished to choose the title Ulysses in Dublin, but gave up the idea. In Rome, when I had finished about half of the Portrait, I realized the Odyssey had to be the sequel, and I began to write Ulysses (Bulson 2006: 71).

উপন্যাসটি এভাবেই লিখতে শুরু করেন জয়েস। তাঁর লক্ষ নিশ্চয়ই ছিল না ওডেসির কাহিনীর পুনরাবৃত্তি করা। কিন্তু হোমারের সমান্তরালে নির্মিত একটা শহর, হোমারীয় ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ, প্রায় একই ধরনের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল আর হোমারের অসংখ্য চরিত্রের সংশ্লেষে জয়েস ‘হেলেনীয়’ আয়ারল্যান্ডকে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, সেই নির্মিতিতেই তাঁর সৃষ্টিশীলতার শিখরস্পর্শী স্ফূরণ ঘটেছে। হোমারের অনুসরণেই এর শৈলীও পেয়ে গেছে ভিন্ন মাত্রা, উপন্যাসের প্রচলিত একস্তরিক বা একরৈখিক ন্যারেটিভের সঙ্গে যার মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। জয়েস এই ভাষাশৈলী বা নির্মাণের কথাও ব্যাখ্যা করেছেন এইভাবে : My intention is not only to render the myth sub specie temporis nostri but also to allow each adventure (that is, every hour, every organ, every art being interconnected and interrelated in the somatic scheme of the whole) to condition and even create its own technique. (Bulson 2006: 74)

সাহিত্যের ইতিহাস হচ্ছে টেকনিকের ইতিহাস, অর্থাৎ প্রায় একই ধরনের বিষয়আশয় নিয়ে লেখকেরা সাহিত্য রচনা করলেও, টেকনিকের কারণে তা নতুন হয়ে ওঠে; একরকম একটা কথা একবার বলেছিলেন লুই আরাগঁ। জয়েসের জবানিতে অনেক আগেই আমরা এই টেকনিকের সূত্রে নতুন কালের সাহিত্য কীভাবে নতুন হয়ে উঠছে তার ইঙ্গিত পাচ্ছি। উপন্যাসের ন্যারেটিভে, ভাষিক বর্ণনায় যে কত ধরনের বৈচিত্র্য থাকতে পারে, হোমারের অনুসরণে সেই ভাষাবৈচিত্র্য সৃষ্টির প্রতি ঝুঁকেছিলেন জয়েস। তার কথায় : Narration can get hungry, horny (Nausicaa), hallucinatory (Circe), drunk (Oxen), windy (Aeolus), gigantic (Cyclops), catechistic (Ithaca), sleepy (Eumaeus), and long-winded (Penelope).

ফলে, প্রথম পাঠের মুহূর্তে অনেক পাঠকের কাছে এর প্রকরণশৈলী ও ভাষাবয়ানের দিকটি যে দুর্বোধ্য মনে হবে সেটা অস্বাভাবিক নয়। তবে এখানেই শেষ নয়, উপন্যাসটি আবার কোথাও কোথাও হয়ে উঠেছে আত্মজৈবনিক। নিজের জীবনকেই তিনি উপন্যাসে মিশিয়ে দিয়ে রচনা করেছেন আধুনিক এপিক। কীভাবে সেটা ঘটেছিল, তারও উল্লেখ পাওয়া যাবে এই উদ্ধৃতিতে : By superimposing Homeric characters, plots, and geographical coordinates over the fictional lives of his Dubliners, Joyce was going ahead with his plan to ‘‘Hellenize’’ Ireland. The events of Ulysses take place on 16 June 1904 not because of any Homeric correspondence. This was the day he first walked with his future wife Nora Barnacle around Dublin, the same day that she ‘‘made [him] a man’’ (LII, 233) (Bulson 2006: 71).

এভাবেই নতুন ধরনের উপন্যাস হিসেবে, যে-উপন্যাসটিকে চিহ্নিত করা যায় নতুন ধরনের ভাষাশৈলী আর আধুনিক ব্যক্তিমানুষের ক্ষয়িষ্ণু, ভঙ্গুর, মানবিক অস্তিত্ব অন্বেষার ইতিবৃত্ত, স্বাভাবিকভাবেই প্রকাশের পরপরই বিশ্ব জুড়ে দারুণ সমাদৃত হয়েছিল। এমনকি এখনও দেশে দেশে জয়েস, বিশেষ করে ইউলিসিস নিয়ে পাঠকের উৎসাহ অনিঃশেষ। এর বিষয়বস্তু, শৈলী, প্রকরণভঙ্গি, ভাষা, চরিত্রায়ণ, প্রতিপাদ্য ও পরিবেশচিত্রণ এককথায় অনন্য। এসব কারণেই বৈশ্বিক স্তরে উপন্যাস হিসেবে এর গুরুত্ব ও প্রভাব একেবারে শিখরস্পর্শী। উপন্যাসটির একইসঙ্গে পাঠ ও শ্রুতিপাঠ শোনার পর– পড়তে/শুনতে অবশ্য বার বার হোঁচট খেতে হয়েছে; কেননা ইংরেজি আমার মাতৃভাষা নয়, তারপর আবার ব্রিটিশদের ইংরেজি নয়, যার সঙ্গে আমাদের আবাল্য পরিচয়; এটি লেখা হয়েছে আইরিশ ইংরেজিতে আর ডাবলিনের সাধারণ মানুষের লোকায়ত ইংরেজি বুলির ওপর ভর করে।১ ফলে, বাঙালি পাঠক শুধু নয়, ইঙ্গ-মার্কিন পাঠকদেরও পড়তে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়। ভাষার এই বাধা পেরিয়ে যেতে পারলে উপন্যাসটির শ্রেষ্ঠত্বের মহিমা যে-কোনো বোদ্ধা পাঠককে মুগ্ধ করার জন্যে যথেষ্ট। এখানে সেই বৈশিষ্ট্যের কথাই সংক্ষেপে উল্লেখ করছি।

প্রথমত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, জয়েস বেশ সাহসিকতার সঙ্গে এর কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন লিওপোল্ড ব্লুমের মতো একজন সাধারণ মানুষকে। ব্যক্তি হিসেবে তার ত্রুটি অনেক– খণ্ডিত, অসফল প্রান্তিক মানুষ সে। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা জুড়ে এই ব্লুমের কথাই জয়েস বলে গেছেন; উন্মোচন করেছেন তার খুটিনাটি, নানা দুর্বলতা আর ত্রুটিবিচ্যুতির কথা। তবে তার যে সমস্যাটি বিশেষভাবে আকর্ষক হয়ে ওঠে সেটি হলো ব্লুম তার স্ত্রীর সঙ্গে প্রায় কুড়ি বছর ধরে কখনই পরিপূর্ণ সফল যৌনজীবন যাপন করে না। ফলে তার স্ত্রী উপন্যাসের ঘটনাকালের দিনটিতেই পরকীয়া প্রেমে নিমজ্জিত থাকে। জয়েস ব্লুমকে দেখান আত্মরতিতে লিপ্ত একজন মানুষ হিসেবে যার মুখ বিবর্ণ, বিধুর। অন্য কোনো নায়ক– মহাকাব্যেরই হোক কিংবা সাধারণ– কোনো উপন্যাসে এইভাবে জীবনকে বহন করে চলেনি। কিন্তু জয়েস তার এই কেন্দ্রীয় চরিত্রটিকে গভীর মমত্ববোধ, সমীহা, সহানুভূতি এবং তীব্র সংবেদনা নিয়ে স্পর্শকাতর চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। ব্লুমকে ঘিরে মানবিক বৈশিষ্ট্যের উন্মোচনই হয়ে উঠেছে জয়েসের মূল লক্ষ্য। ব্লুম, একারণেই দেখা যায়, একজন সংবেদনশীল, সহনশীল মানুষ; বিভিন্ন বিষয়ে তার গভীর আগ্রহ, কৌতূহল, মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল– এককথায় একজন নির্বিবাদী ভালো মানুষ। একদিনের ঘটনাই এই উপন্যাসে উপস্থিত, তবে তার মন খুবই সক্রিয়; অর্থাৎ প্রধান চরিত্রের সক্রিয়তা খুব তীব্র। এই সক্রিয়তার সূত্রে সে যেসব মানুষের সংস্পর্শে এসেছে তাদেরকে গভীর কৌতূহল ও সহানুভূতি দিয়ে নিরীক্ষণ করেছে, নিজের স্বভাব দিয়ে বিচার-বিবেচনা করে দেখেছে, গভীরভাবে তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে। তীব্র মানবিক আবেগ ও ভালোবাসাই ব্লুমের চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। তবে তার এই মানবিক বোধ বা ক্রিয়াকর্ম সংগঠিত হয়েছে ছোট ছোট নানা ঘটনা ও বিষয়কে ঘিরে। একদিকে সে যেমন বাসনাসক্ত, অনুভূতিপ্রবণ মানুষ, অন্যদিকে তেমনি বিরূপ পরিস্থিতিতে ক্ষুব্ধ হতেও জানে।

জয়েস আরও একটি দিক থেকে তার নায়ককে মহিমা দিয়েছেন। সেটা হলো সে তার ডাবলিনের বন্ধুদের কাছ থেকেই বিচ্ছিন্ন, নিঃসঙ্গ এক মানুষ; প্রাথমিকভাবে ইহুদি হবার কারণে সে প্রান্তিক। বন্ধুদের সঙ্গে ঠাট্টা-তামাসায় সে মেতে ওঠে না, বরং কথায় ও আচরণে অনেকটাই সহজ-সরল-গ্রাম্য। জয়েস যদিও ট্র্যাজিক চরিত্র হিসেবে তাকে গড়ে তোলেননি তবে আরিস্তুতল তাঁর কাব্যতত্ত্বে যেমন বলেছেন, সেইরকমই সে একজন ভালো মানুষ কিন্তু নিখুঁত মানুষ নয়। সাহিত্য-শিল্পের যদি লক্ষ্য হয় মানবিক সংবেদনা ও সহানুভূতির উপস্থাপন, তাহলে নিঃসন্দেহে বলা যায় জয়েস সেই কৃতিত্ব অর্জন করতে পেরেছেন, যে-কিনা এই উপন্যাসে উপস্থিত অন্যান্য ডাবলিনবাসীর তুলনায় চরিত্র হিসেবে অনেক উজ্জ্বল।

বলা বাহুল্য, ব্লুমকে এভাবে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলায় এর স্রষ্টা জেমস জয়েসকেও উপেক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে। কী জীবনে কী উপন্যাসে– যত সাধারণই হোক, তাঁর দৃষ্টি দিয়ে আমরা অন্য এক অনালোকিত পৃথিবীকে দেখতে পাই, পরিচিত হই আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা সাধারণ সংবেদনশীল মানবিক চরিত্রের সঙ্গে। ইউলিসিস এভাবেই ব্লুমের সূত্রে অসাধারণ একটি উপন্যাস হয়ে উঠেছে।

এই উপন্যাসের দ্বিতীয় কৃতিত্ব হচ্ছে এটি ডাবলিন শহরের অনুপুঙ্খ, বিস্তৃত, খুঁটিনাটি চমকপ্রদ বিবরণে ভরা– এর রাজপথ, অলিগলি, দালানকোঠা, শব্দ, দৃশ্য, বাসিন্দা আর তাদের ভিন্ন ভিন্ন স্থানিক ভাষা (একই শহরের মধ্যে নানা বৈচিত্র্য), স্বর, ভঙ্গি অসাধারণ ন্যারেটিভের মধ্য দিয়ে উপস্থাপন করেছেন জয়েস। তুলনাসূত্রে এখানে উল্লেখ করা যায় টি এস এলিয়টের ওয়েস্টল্যান্ড বা পোড়োজমির কথা। ওই কাব্যগ্রন্থে বিবর্ণ, ধূসর, ক্ষয়িষ্ণু নগরের যে ছবি আমরা পাই, তাতে আধুনিকতারই প্রতিফলন ঘটেছে মাত্র; কিন্তু জয়েস জানেন প্রকৃত নগর বলতে কী বোঝায়, জানেন এর গুরুত্ব ও সৌন্দর্যের কথা। নেতিবাচক না হওয়ায় জয়েসের এই কৃতিত্বের দিকটি অনেক সমালোচকের তেমন একটা চোখে পড়েনি। লক্ষ করলে দেখা যাবে, পোড়োজমির নগর যেমন কবিকল্পিত, মানুষ এখানে খণ্ডিত, অন্যদিকে জয়েস প্রবেশ করেছেন একেবারে নগরের কেন্দ্রে, জনমানুষের গভীরে। তিনি ওপর থেকে নন, সবকিছু দেখেছেন ভেতরে প্রবেশ করে। মানুষ যে মানুষের জন্য তার সমবেদনার হাত প্রসারিত করে দিতে পারে, ম্যানহোলে আকস্মিকভাবে পতিত দুষিত গ্যাসে দমবন্ধ একজন মানুষের উদ্ধার পাওয়ার ঘটনা থেকেও তা বোঝা যায়।

তবে এই উপন্যাসের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে নাগরিক বুলি ও ভাষার জীবন্ত ব্যবহার। চরিত্রগুলো একারণেই মনে হয় যেন চোখের সামনে অভিনয় করে চলেছে, তারা যেন এই পৃথিবীরই স্পর্শময় সাধারণ বাসিন্দা। কোনো উৎসাহী পাঠক যদি এর শ্রুতিপাঠটি (অডিও গ্রন্থ, টীকায় আমি এরকম একটা ওয়েব সাইটের ঠিকানা দিয়েছি) শোনেন, তাহলে এর জীবন্ত সজীব ভাষার কিছুটা হলেও স্বাদ পাবেন। জয়েসের আগে কেউ এভাবে স্থানিক সংলাপের ওপর নির্ভর করে এমন বাস্তবোচিত চরিত্রের উপস্থাপন ঘটাননি, যেমনটা আমরা লক্ষ করি ইউলিসিস-এ। অন্তর্জালে এর শ্রুতিপাঠটি শুনে বারবারই আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন পুরানো ঢাকায় চলে এসেছি। ডাবলিনের কেন্দ্রে ছড়ানো সংলাপের কত বৈচিত্র্য, রঙ-রূপ-বাহার। পৃথিবীর অন্যতম একটা পৃথক জনগোষ্ঠীর ভাষা শুনতে শুনতে সত্যি অভিভূত হতে হয়। বাগ্ধারা, বুলি আর বিশেষ স্বরভঙ্গি বা টানের কী বিচিত্র ব্যবহারই না করেছেন জয়েস!

ইউলিসিস-এর তৃতীয় কৃতিত্ব হচ্ছে এই উপন্যাস আমাদের সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে এতটাই প্রসারিত করে দেয় যে আমরা অনুভব করতে পারি– প্রথাগতভাবে যেমনটা মনে করা হয়– শুধু উঁচু মাত্রার পরিশীলিত শিল্পই সংস্কৃতি, সেই ধারণা যথার্থ নয়। ছোট ছোট বস্তুপুঞ্জ, অপাংক্তেয় সংগীত, রসালো টুকরো ঘটনা– যার দ্বারা আমরা পরিবেষ্টিত কিংবা মজ্জমান থাকি– সেসবও হয়ে উঠতে পারে সংস্কৃতির অংশ। জয়েস মূলত এরকম পরিবেশই নির্মাণ করেছেন এই উপন্যাসে; ডাবলিনের দোকানপাট, শুঁড়িখানা, চার্চ ইত্যাদির প্রেক্ষাপটে উপন্যাসটি লেখা। সেই সঙ্গে ইউলিসিস-এর বর্ণনারীতিতে ঢুকিয়ে দিয়েছেন জনপ্রিয় গান, বিজ্ঞাপনের ভাষা, ক্রিস্টমাসের সময়ে সংঘটিত মুকাভিনয়ের রীতি। আমাদের জীবন যে কত চিত্ররূপময়, শব্দ ও ভাষার ঐশ্বর্য্যে উজ্জ্বল, ন্যারেটিভ ও নানা ধরনের ইমেজের মধ্য দিয়ে এই যে সংস্কৃতি আমরা নির্মাণ ও বহন করে চলি, ধৈর্য্য আর অভিনিবেশ সহকারে ইউলিসিস না পড়লে তা বোঝা যাবে না। জয়েস দেখিয়ে দেন সংস্কৃতি মানেই পরিশীলিত সংস্কৃতি নয়, নয় যাদুঘরে স্থান পাওয়া ভবিষ্যতের কোনো মৃত ডিসকোর্স বা সৃষ্টিশীল নিদর্শন, বরং আমাদের প্রতিদিনের পরিবেশ, চলমান মানুষজন ও তাদের জীবনপ্রবাহই হচ্ছে সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এদিক থেকে বিবেচনা করলে, ইউলিসিস-এ নিম্নবর্গীয় (সাবঅল্টার্ন) সংস্কৃতির চমৎকার উপস্থাপন ঘটেছে নিঃসন্দেহে। ভাবলে বিস্মিত হতে হয়, এর কৃতিত্ব আরও ছাড়িয়ে যায় যখন আমরা দেখি জননন্দিত সংস্কৃতিকে তিনি তাঁর উপন্যাসে সংস্কৃতির অংশ করে তুলছেন। বিস্ময় একারণেই যে হাল আমলে, অর্থাৎ আমাদের এই সময়ে, সংস্কৃতির সমীক্ষক ও গবেষকেরা জনপ্রিয় সংস্কৃতিকেই মনে করছেন প্রকৃত সংস্কৃতি। পৃথিবীর বিখ্যাত সব বিদ্যায়তন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি অধ্যয়নের এটাই হচ্ছে কেন্দ্রীয় বিষয়। জয়েস ঠিকই বুঝেছিলেন যে জনসংস্কৃতিই হচ্ছে প্রকৃত সংস্কৃতি।

চতুর্থ দিকটি হচ্ছে, যে-কোনো পাঠকের কাছেই এর নামটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় বলে বিবেচিত হয়ে থাকে– ইউলিসিস। সমগ্র উপন্যাসটির ঘটনাকাল মাত্র একদিনের– ১৯০৪ সালের ১৬ জুন। আগেই বলেছি, এখানে ঘটেছে সাধারণ কিছু মানুষের সাধারণ কিছু ঘটনার আবর্তন। এই নামকরণ, বলা বাহুল্য, বেশ দুঃসাহসী এক নির্বাচন। দুঃসাহসী এই কারণে যে, আগেই বলেছি, হোমারীয় এক মহাকাব্যিক চরিত্রের অনুকরণে এর নামায়ন হয়েছে। প্রাচীন ঐতিহ্যের পূর্বস্মৃতি যেন নতুন কালের প্রেক্ষাপটে উপস্থাপিত হয়েছে এই উপন্যাসে। জয়েসের সমকালীন প্রখ্যাত কবি, অনেকেই যার হাত ধরে আধুনিক কবিতার উন্মেষ ঘটেছিল বলে মনে করেন, সেই টি এস এলিয়ট একে ‘পৌরাণিক পদ্ধতি’ (মিথিক্যাল মেথড) বলে চিহ্নিত করেছেন। এই পদ্ধতি অনুসরণ করে বর্তমানের সাধারণ ডাবলিনবাসীদের অতীতের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে সমান্তরালভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে বলে ধারণা করেছেন তিনি। সেই সঙ্গে সাধারণ পৌরাণিক চরিত্র ইউলিসিস, টেলিমাকাস, পেনিলোপ অথবা হ্যামলেট, রাণী গারত্রুদ এবং ডন জিয়োভান্নির সমান্তরালে সৃষ্টি করা হয়েছে ডাবলিনের সাধারণ আইরিশ চরিত্রদের। কিন্তু ডাবলিনের চরিত্রগুলোর কেউ-ই বীর নয়, সাধারণ চরিত্রই — পৌরাণিক শৌর্য্য-বীর্যের দ্যুতি আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয় না। জয়েস বরং যে কাজটি করেছেন তা হলো পৌরাণিক চরিত্রের অনুষঙ্গে মানবিক মহিমার যে দ্যুতি আর বিচ্যুতি ঘটেছে, সেদিকটির প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। ডাবলিনের সাধারণ চরিত্রগুলো পেয়ে গেছে সময়হীন মাত্রা। উপন্যাসটিও হয়ে উঠেছে চিরায়ত রচনা।

জয়েস দেখিয়ে দিয়েছেন, প্রবহমান সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যধর্মী ন্যারেটিভ বা আখ্যান কীভাবে আমাদের জীবনকে আকার দেয়। কীভাবে আমাদের অভিজ্ঞতার পুনরুল্লেখ ও পুনর্ব্যবহার ঘটে। আমাদের আগে অনেকেই যেমন এই ভূমিকা পালন করে এসেছেন, তেমনি আমরাও করছি, ভবিষ্যতেও ঘটবে এর পুনরাভিনয়। এটাই হচ্ছে মানব প্রবাহমানতা, এলিয়টের কথা অনুসারে যাকে বলা যায় ‘পৌরাণিক পদ্ধতি’। এই পদ্ধতিটি পশ্চিমে নানা সময়ে অনুসৃত হয়েছে। টমাস মান এই পদ্ধতির যে বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা বিশেষভাবে লক্ষ করবার মতো : …[W]hile in the life of the human race the mythic is an early and primitive stage, in the life of the individual it is a late and mature one…What is gained [as the individual] is a …knowledge of the schema in which and according to which the supposed individual lives, unaware, in his naïve belief in himself as unique…of the extent to which his life is but formula and repetition and his path marked out for him by those who trod it before him…Actually, if [a person’s] existence consisted merely in the unique and the present, he would not know how to conduct himself at all: he would be confused, helpless, unstable in his own self-regard…His dignity and security lie all unconsciously in the fact that with him something timeless has once more emerged into the light of and become present; it is a mythic value added to the otherwise poor and valueless single character; it is native worth, because its origin lies in the unconscious. (Mann 1937: 31-32) উদ্ধৃতিটি একটু দীর্ঘ হয়ে গেল, তবু এর মাধ্যমে বোঝা যাবে, মানবিক জীবনের যে একধরনের অনন্ত প্যাটার্ন আছে, যে অনন্তের বোধটি সভ্যতার শুরু থেকেই উপস্থিত এবং উত্তরাধিকার সূত্রে মানুষ বহন করে চলেছে, জয়েস সেই দিকটিই চমকপ্রদভাবে ইউলিসিস উপন্যাসে উপজীব্য করেছেন। পরবর্তীকালে দেখা গেল, জয়েসের এই পৌরাণিক পদ্ধতিটিই গ্রহণ করছেন উত্তরকালের লেখকেরা, ফলে ইউলিসিস-এর কাছেই তাদের যত ঋণ।

ইউলিসিস-এর পঞ্চম উল্লেখযোগ্য দিকটি হচ্ছে এর চমৎকার ভাষাশৈলী ও প্রকরণ। ভাষিক সাফল্যের দিক থেকে বিবেচনা করলে ইংরেজি ভাষায় লেখা সাহিত্যের শীর্ষরচনা এটি। প্রতিভার যে নানন্দিক প্রকাশ এখানে ঘটেছে তা তুলনাহীন বলা যায়। ইংরেজি ভাষায় লেখা সাহিত্যের যে ঐতিহ্য– স্পেন্সার, মিলটন, শেক্সপীয়রের পাশাপাশি উচ্চারিত হয় জয়েসের নাম আর তা এই ইউলিসিস-এর সূত্রে। শুধু পরিমিতি বোধ বা নানা শব্দের বিচিত্র ব্যবহার নয়, যে-কোনো ধরনের যে-কোনো বিষয়কে জয়েস যে নিখুঁত ভাষায় ফুটিয়ে তুলতে পারতেন, এই উপন্যাসের মধ্য দিয়ে জয়েসের সেই প্রতিভাকে ছুঁয়ে দেওয়া যায়। উপন্যাসটির ভাষাশৈলীতে, সমালোচকের মতে জয়েজ অন্তত চার ধরনের বর্ণনারীতির ব্যবহার ঘটিয়েছেন : বহুল ব্যবহৃত তৃতীয় পুরুষের স্বর, অন্তর্গত স্বর, মুখের বুলি বা বাগ্বিধি, আর আছে মাইকেল সিডেলের কথায় ‘চতুর্থ স্বরে’র ব্যবহার। ফলে বর্ণনীয় প্রতিটি অনুসূক্ষ্ম পরিস্থিতি, অর্থাৎ কৌতুক কিংবা বিষাদ, নৈঃশব্দ্য কিংবা কলরোল, চোখে দেখা জগত কিংবা অন্তর্জগত– সবকিছুকেই তিনি যথাযথ শৈলীসহযোগে উপস্থিত করেছেন। এরই সূত্র ধরে জয়েস আবার ব্যবহার করেছেন চেতনাপ্রবাহরীতি (স্ট্রিম অফ কনসাসনেস), এই রীতিটিও উত্তরকালের লেখকেরা– কী কবিতায়, কী কথাসাহিত্যে– চরিত্রের মনোজগতকে ফুটিয়ে তোলার কাজে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছেন। জয়েসই আধুনিক মানুষ যে বাইরের জগতের তুলনায় নিজের মনোগহনেই নিমজ্জিত হতে ভালোবাসে, নিজেকেই নানাভাবে দেখতে চায়, ইউলিসিস-এর মাধ্যমে সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন সেই মনোবাস্তবময় জগতের। জয়েসের শৈলীগত বৈচিত্র্যও এখানে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। ভাষার সৌকর্য্যে যারা মুগ্ধ হন, ভাষানিরীক্ষাকে যারা গুরুত্ব দিয়ে থাকেন, জয়েসের রচনা তাদের কাছে যে সমাদৃত হবে, সেকথা বলা যায় নিঃসন্দেহে। জনজীবন ও ব্যক্তিজীবন, শরীর ও মন সমীকৃত হয়ে যে উপন্যাসে উপস্থাপিত হয়, ইউলিসিস-এর আগে সেকথা কেউ ভাবেননি। একারণেই যৌথনির্জ্ঞান-খ্যাত প্রখ্যাত মনোবিশ্লেষক কার্ল য়ুং বলেছিলেন, এই উপন্যাসটিকে পাঠক শুরু থেকে যেমন পড়তে পারেন, তেমনি শেষ থেকেও শুরু করে সামনের দিকে এগিয়ে এসে শেষ করতে পারেন।

ভাষাশৈলী ও অন্তর্গত জগতকে দেখার যে রীতি, অর্থাৎ জয়েস অনুসৃত মনোবিশ্লেষণী চেতনাপ্রবাহরীতিটি পরবর্তী কালের লেখকদের ন্যারেটিভকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। ভার্জিনিয়া উলফের মিসেস ডালোওয়ে, থমাস উলফের বাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখ, দেবদূত, ফকনারের শব্দ ও ক্রোধ এবং আবসালোম, আবসালোম এই রীতিরই কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। শুধু ইংরেজি সাহিত্য নয়, বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের লেখকদের বর্ণনারীতি এরপর থেকে চেতনাপ্রবাহরীতির আদলে একেবারে আমূল বদলে যায়। ব্যক্তিমানুষের অন্তর্লোকই হয়ে ওঠে কথাসাহিত্যের মূল কেন্দ্র। অন্ধকার মনোজগতের ওপর আলোকপাত করতে থাকেন কথাসাহিত্যিকেরা।

ইউলিসিস-এর ষষ্ঠ এবং খুবই উল্লেখযোগ্য আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আধুনিক সাহিত্যের শীর্ষআখ্যান বা উপন্যাস হিসেবে এর সর্বজনীন স্বীকৃতি। শিল্পের জন্য শিল্প বলে যারা সাহিত্যকে চিহ্নিত করতে বা চর্চা করতে শুরু করেছিলেন, ইউলিসিস-এর সূত্রে তারা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন যে প্রকৃত শিল্পসম্মত রচনা অনন্য হয়ে উঠবার মধ্য দিয়ে নিজেই নিজের দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে। অর্থাৎ প্রতিটি সাহিত্যসৃষ্টি হচ্ছে নতুন ও অভতূতপূর্ব, রচনাটি নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী। ইউলিসিসকে সহজেই এই ধরনের মহান সাহিত্য হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, যা এককথায় তুলনাহীন।

তবে একেবারেই কী ত্রুটিহীন এই রচনা? প্রত্যুত্তরে বলা যায়, অন্তত তিনটি দিক থেকে এর কিছুটা হলেও বিচ্যুতি ঘটেছে। প্রথমত, এর কোনো সুনির্দিষ্ট গল্পকাঠামো নেই। দ্বিতীয়ত, ভাষা বা শৈলীর দিক থেকে কিছুটা হলেও অতিরিক্ততা আছে। তৃতীয়ত, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তিক নিয়ন্ত্রণের অভাবে এর কোনো কোনো বর্ণনীয় অংশ দুর্বোধ্য থেকে গেছে, কিংবা কোনো কোনো চরিত্র ভীষণ জমকালো হয়ে উঠেছে। সচেতন থাকলে এই ত্রুটি হয়তো দূর হতে পারতো, কিন্তু জয়েস সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে নিজেকে বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম শীর্ষ লেখক হিসেবে ভাবতে শুরু করেছিলেন। নিজেকে ভার্জিল, দান্তে, স্পেন্সার, মিলটনের পঙ্ক্তিভুক্ত মানসম্পন্ন লেখক বলে মনে হতে থাকে তাঁর। এই সমীপবর্তিতা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। জয়েস সম্পর্কে ঔপন্যাসিক উইলিয়ম ফকনার যে কথা বলেছিলেন, এখানে তা উল্লেখ করা যেতে পারে। ফকনারকে এক সাক্ষাতপ্রার্থী প্রশ্ন করেছিলেন, জয়েস ও এলিয়ট যে নিজস্ব ভাষারীতি গড়ে তুলেছেন, সেই ভাষারীতি গড়ে তোলার অধিকার কী তাদের আছে? প্রত্যুত্তরে ফকনার বলেছিলেন : Well, [the writer,] actually, that’s an obligation that he [the writer] assumes with his vocation, that he’s going to write it in a way that people can understand it. He doesn’t have to write it in the way that every idiot can understand it – every imbecile in the third grade can understand it, but he’s got to use a language which accepted and in which words have specific meanings that everybody agrees on. I think that Finnegans Wake and Ulysses were justified, but then it’s hard to say on what terms they were justified. That [Joyce] was a case of genius who was electrocuted by the divine fire. (Faulkner 1965 52-53)

লক্ষণীয়, ফকনার ঔপন্যাসিকের অনন্য ভাষাসৃষ্টির প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করার পর ইউলিসিস যে ভাষিক দিক থেকে একটা অসাধারণ উপন্যাস হয়ে উঠেছে, সেকথা বলতে ভুল করেননি। শুধু ফকনার নন, হোর্হে লুইস বোর্হেসও ১৯২৫ সালে এই উপন্যাস সম্পর্কে ‘প্রোয়া’ শীর্ষক একটা পত্রিকায় প্রশংসাসূচক সমালোচনামূলক প্রবন্ধ লিখেছিলেন। জীবদ্দশায় যদিও বোর্হেস এই লেখাটি প্রকাশের অনুমতি আর দেননি, তবে ওই লেখাতেই জয়েসকে তিনি অগ্রগণ্য আধুনিক ঔপন্যাসিক হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। বলেছিলেন বিশ্বসাহিত্যে জয়েসের অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে আছে, বিশেষ করে তার ভাষারীতি ও বয়ানের ঐশ্বর্য আমাদের অভিভূত করে। শুধু তাই নয় পরবর্তীকালে জয়েসকে নিয়ে বোর্হেস লিখেছিলেন দু’টি কবিতা। এর একটিতে পরবর্তী প্রজন্মের ঔপন্যাসিকেরা যে জয়েসের কাছে নানাভাবে ঋণী সেকথা উল্লেখ করে নিজের অনুভবের কথা এইভাবে ব্যক্ত করেছেন : I am the others. I am all those / who have been rescued by your pains and care. / I am those unknown to you and saved by you. বোর্হেসের জন্য অভাবনীয় নয়, তবু তাঁর দু-তিনটি গল্প জয়েসের ইউলিসিস-এর অনুপ্রেরণায় লেখা। বোর্হেস তো বিশ্বসাহিত্যের নানা দিকপাল, অর্থাৎ পূর্বপ্রজন্মের লেখকদের অনুসৃতি হিসেবে অনেক লেখা লিখেছেন। ওইসব রচনা হয়ে উঠেছে তাঁর নিজেরই লেখা, পুনঃসৃজন। জয়েসের ইউলিসিস-এর অনুসৃতি হিসেবেই লেখা হয়েছে তার The Garden of Forking Paths এবং The Circular Ruins শীর্ষক দুটি গল্প। পরিশেষে বলা বাহুল্য, জয়েস ইউলিসিস-এর সূত্রে এভাবেই হয়ে উঠেছেন লেখকদের লেখক। একই সঙ্গে ব্যক্তির অন্তর্জগত ও আত্মসত্তার পাশাপাশি বাইরের পৃথিবী আর বাস্তবতাকে যে সমান নান্দনিক দক্ষতায় উপস্থাপন করা যায়, ইউলিসিস-এর বিষয়বস্তু, প্রকরণ ও ভাষারীতির অনন্য বুনটের সূত্রে তিনি ছুঁয়ে দিয়েছেন সাফল্যের সেই শীর্ষলোক।

শুধু কী কবি-প্রাবন্ধিক-কথাকার বোর্হেসের এই মুগ্ধতা? বিশশতকের শীর্ষস্থানীয় ভাবুক-দার্শনিক জাক দেরিদাও তাঁর ‘Ulysses Gramophone Hear Say Yes in Joyce’ শীর্ষক প্রবন্ধে অকুণ্ঠচিত্তে জয়েসের ইউলিসিস-এর কাছে তাঁর ঋণের কথা এইভাবে স্বীকার করেছেন : Everything that happened to me, including the narrative that I would attempt to make of it, was already pre-dicted and pre-narrated, in its dated singularity prescribed in a sequence of knowledge and narration: within Ulysses…Yes, everything has already to us within Ulysses and has been signed in advance by Joyce. (Derrida 1992: 281) দেরিদার কাছে মনে হয়েছে, ইউলিসিস আধুনিক মানুষের জীবনাভিজ্ঞতায় জারিত ‘সম্পূর্ণ’ একটি রচনা। সাহিত্য ও জীবনভাবনার এমন কোনো দিক নেই যা এই গ্রন্থে উল্লিখিত হয়নি। দেরিদা এ প্রসঙ্গে লিখেছেন : Once one recognizes that, in principle, in Ulysses the virtual totality of experience – of meaning, of history, of symbolic, of languages, and of writings, the great cycle and the great encyclopedia of cultures, scenes, and affects, in short, the sum total of all sum totals – tends to unfold itself and reconstituted itself by playing out all its possible combinations, with a writing that seeks to occupy virtually spaces, well, the totalizing hermeneutic that makes up the task of worldwide end eternal institution of Joyce studies. (Derrida 1992: 291)

ইউলিসিস-এর অসাধারণ শৈল্পিক, নান্দনিক, বিষয়বস্তুগত মহিমা, বলা নিষ্প্রোজন, দেরিদা যেভাবে উল্লেখ করেছেন, সেইভাবে বৈশ্বিক স্তরে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। উপন্যাসটি প্রকাশের পর ১৯২৩ সালে হিস্পানি দার্শনিক সাহিত্য সমালোচক হোসে অরতেগা ই গাসেত বলেছিলেন, জয়েস এই উপন্যাসে উপন্যাসের সবধরনের সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করেছেন। ‘ইউলিসিস প্রকাশিত হওয়ার পর উপন্যাস রচনার প্রয়োজন তাই ফুরিয়ে গেছে (অরতেগা ই গাসেত ১৯৪৮: ৫৭-৫৮)।’ উপন্যাসের সম্ভাবনাকে জয়েস কতটা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন এই কথা থেকে তার অনেকখানি ইঙ্গিত মেলে।

ফলে এই উপন্যাসটি শুধু আইরিশ বা ইংরেজি ভাষাভাষি পাঠক নয়, আমাদের জন্যও অবশ্যপাঠ্য একটা রচনা হয়ে ওঠে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, ইউলিসিস নিয়ে বাংলা ভাষায় লেখা কোনো উল্লেখযোগ্য রচনা আমার চোখে পড়েনি। আধুনিক অর্থে উপন্যাস বলতে কী বোঝায়, জয়েস যে এই উপন্যাসের সূত্রে সেকথা পাঠক এবং কথাকার সবার গোচরে আর বোধের সীমায় নিয়ে এসেছিলেন, সেকথা না বললেও চলে। বাংলা উপন্যাসেও তাই আমরা অস্তিত্বমোথিত যেসব উপন্যাস পেয়েছি, সেইসব উপন্যাসের অধিকাংশের কেন্দ্রে আছে ইউলিসিস-এর সেই নিঃসঙ্গ, বিবিক্ত, বিচ্ছিন্ন, সংবেদনশীল, কৌতূহলী, মানবিক চরিত্র ব্লুমের কোনো-না-কোনো প্রভাব; সেই সঙ্গে নতুন ভাষা এবং ন্যারেটিভের ছায়া। জয়েসের ইউলিসিস এভাবে যথার্থই হয়ে উঠেছে একটি বিশ্বউপন্যাস, সর্বকালের প্রভাবসঞ্চারী শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।

১৮০০ সালে জার্মান দার্শনিক ফ্রেডেরিক শ্লেগেল বলেছিলেন, আধুনিক সাহিত্যের একটা বড় সমস্যা হচ্ছে এর কোনো কেন্দ্র নেই, যেমনটা দেখা গেছে প্রাচীন সাহিত্যে। প্রাচীন সাহিত্যে আমরা পেয়েছি পুরাণকে, আলোকনপর্বে এই পুরাণকে মানুষ মানবীয় করে তুলেছে। কবি উইলিয়াম ব্লেক এসে শ্লেগেলের কথার সূত্র ধরে বললেন, আমি আমার নিজের পথ তৈরি করে নেব, আর যদি তা না পারি তাহলে অন্যের দাসত্ব মেনে নেব।’ কিন্তু সংবেদনশিলীত সৃষ্টিশীল মানুষকে এভাবে কারো দাস হতে হয়নি। মাত্র একশো বছর পরে ডব্লিউ বি ইয়েটসই বললেন সেই বীক্ষণের (ভিশন) কথা, যার ওপর ভর করে আধুনিক লেখকেরা মানবীয় পরিস্থিতিকে তুলে ধরবার অভিপ্রায়ে পুরাণকে আরও গভীর করে তুললেন। পুরাণ হয়ে উঠলো প্রতীক, সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতিবিম্ব, মানবীয় অভিজ্ঞানের শীর্ষবিন্দু। জয়েস ঠিক এভাবেই হোমারীয় পুরাণকে সমকালীন ব্যক্তিমানুষের জীবনযাপন ও অনুভবের কেন্দ্র করে তুলেছিলেন। বিশশতকের সাহিত্য এভাবেই হয়ে উঠেছিল আধুনিক, যার একদিকে আছে আত্মরতি ও পরাভবের কথা, অন্যদিকে পাওয়া যাবে তার মহিমাময় মানবিক জীবনের অপরাজেয় গল্প।

টীকা

১. এই উপন্যাসটির সম্পূর্ণ শ্রুতিপাঠ (অডিও বুক) এখন ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। এই শ্রুতিপাঠে আইরিশ ইংরেজির কিছুটা স্বাদ পাওয়া যায়। যারা শুনতে চান তাদের জন্য কপিরাইট নেই এমন একটা ওয়েব সাইটের ঠিকানা দিচ্ছি http://archive.org/details/Ulysses-Audiobook

তথ্যসূত্র Bulson, Eric (2006) The Cambridge Introduction to James Joyce, Cambridge: Cambridge University Press. Casanova, Pascale (2004) The World of Republic of Letters, Translated by M.B. DeBevoise, Cambridge and Massachusetts: Harvard University Press. Derrida, Jacques (1992) ‘Ulysses Gramophone Hear Say Yes in Joyce,’ Acts in Literature, ed. Derek Attridge, New York and London: Routledge. Faulkner, William (1965), Faulkner in the University: Class Conferences at the University of Virginia 1957-1958, ed. Frederick L, Gwyne, Joseph L. Blodnes, New York: Vintage Books. Mann, Thomas (1937) ‘Freud and the Future,’ in Freud, Goethe, Wagner, New York: Alfred A. Knopf. Ortega y Gasset, J. ([1925] 1948) The Dehumanization of Art and Ideas about the Novel, Princeton: Princeton University Press.

নবীন- প্রবীন লেখীয়োদের প্রতি আহ্বান: সাহিত্য সুহৃদ মানুষের কাছে ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, রম্য রচনা সহ সাহিত্য নির্ভর আপনার যেকোন লেখা পৌঁছে দিতে আমাদেরকে ই-মেইল করুন [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড