• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৫ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

প্রবন্ধ

যখন এসেছিলে অন্ধকারে : অভিজাত প্রেম

  কুমার চক্রবর্তী

০৮ নভেম্বর ২০১৮, ২২:২৯
প্রবন্ধ
ছবি : প্রতীকী

ফ্রান্সের প্রভাঁস নগরীতে, দ্বাদশ শতাব্দে, অপূর্ণ বাসনাজাত এক বিশেষ ধরনের গীতিকবিতার জন্ম হয়। যার কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল প্রেমের কাব্যময় উদ্ভাসন, যা সভ্যতার ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য। পরিবর্তনের সূচনা করে। প্রাচীনকালেও প্রেমের বেদনাময় গীতি রচিত হয়েছিল, কিন্তু সুখান্বেষণজাত অভীপ্সা বা দুঃখজাত বিষাদের যে করুণ ছবি এবার ফুটে উঠল তা আগে কখনও ঘটেনি। প্রেম যেন এখন হয়ে উঠল সকল নৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিপূর্ণতার ফুলবাগান। আর এই প্রেমের কারণেই বিনয়ী প্রেমিক যেন হয়ে গেল নিষ্পাপ এবং পবিত্র। [মধ্যযুগের অবক্ষয়: দ্য ওয়েনিং অফ মিডল এজেস: ইয়োহান হাইজিংজা ]

প্রেমমাত্রই কাম থেকে উদ্ভূত কিন্তু কিছু প্রেমধারণা আছে যা কামকে পরিহার করে, অন্তত আচরণগতভাবে। এই বিষয়টি প্রাচীন নয়জ্জপ্রাচীন গ্রিক, রোমক বা ভারতীয় পুরাণ বা দর্শনে এর নজির দেখা যায় না, বরং সেখানে দেখা মেলে নানা যৌনপ্রতীকের যা কামকেই অগ্রবর্তী করে। ভারতীয় ও গ্রিক, উভয়েরই প্রেমদেবতা কামের ধনুর্ধারী। প্রাচীন ভারতে প্রেমধারণা আসলে কামধারণা। যৌনমিলনের অনেক স্থূলচিন্তা রয়েছে ভারতীয় পুরাণে। বড়ো প্রমাণ গৌরীপট্ট ও শিবলিঙ্গ। এখনও এই প্রতীক ব্যবহৃত হচ্ছে বামাচারী, তান্ত্রিক ও বাউলদের মধ্যে। কাম থেকে মুক্তির জন্য এরা কামকেই ব্যবহার করছে। তাছাড়া যাকে আমরা বলি প্লেটোনিক লাভ তা-ও মূলত কাম থেকে জন্ম নিয়ে একটি অবস্থাকে বোঝায় যা বর্ণিত সিম্পোজিয়াম-এ দাইআতাইমার বাচনে, যদিও মধ্যযুগে এই ধারণাকে নবরূপ দিয়ে তাকে অযৌন রং দেওয়া হয়েছে। প্রেম অবশ্যই কামসংশ্লিষ্ট কিন্তু তা তাতেই সীমাবদ্ধ থাকে না। কামের নদীর পারে সে গড়ে তোলে প্রেমের নন্দনকানন। বাট্রান্ড রাসেল বলেছেন, প্রেম হলো বৃক্ষ যার শিকড় মাটিতে প্রোথিত আর শাখাপ্রশাখাগুলো ছড়িয়ে আছে স্বর্গে। রাসেলের এ কথায় রয়েছে কামবাস্তবতা ও কাম-অবাস্তবতা; প্রেমে কামকে ছাড়িয়ে যাওয়ার কথাই বুঝিয়েছেন রাসেল।

কিন্তু কোর্টলি লাভ (courtly love) নামে এক দরবারি প্রেমের জন্ম হয় ফ্রান্সে, দ্বাদশ শতাব্দীতে, যার স্রষ্ট্রা ছিলেন দক্ষিণ ফ্রান্সের ত্রুবাদুরেরা যদিও এর গরিমা এসেছে কিছুসংখ্যক গীতিকবিদের মাধ্যমে। কোর্টলি লাভ শব্দবন্ধটি মধ্যযুগীয় দরবার ও শহর-এর মধ্যে পার্থক্যকে প্রকাশ করে। অক্তাবিয়ো পাস এ বিষয়ে বলছেন, ‘‘ সঙ্গম বা প্রজননবিষয়ক কোনো অশোভন প্রেম নয়, বরং এক উচ্চাভিলাষী অনুভূতি এই আদর্শ দরবারের বৈশিষ্ট্য। কবিরা একে বলত না দরবারি প্রেম; তাঁরা অন্য একটি শব্দ ফাঁ’মুর (fin’amors) দ্বারা একে অভিহিত করত যা বোঝায় বিশুদ্ধ, পরিশীলিত প্রেম। এমন এক প্রেম যার উদ্দেশ্য নয় ইন্দ্রিয় সুখপ্রাপ্তি বা প্রজনন। এক তপশ্চর্যা ও নান্দনিকতা।’’ এই প্রেম কোনো ভ্রম বা মায়াবাদী কিছু নয়, এটা জীবনের এক উন্নত আদর্শ। এ ধরনের প্রেম যেমন রহস্যজনক তেমনি এর সৃষ্টিও রহস্যজনক, কারণ এর সাথে কোনো ধর্মীয় উপদেশ বা দার্শনিক মতবাদ জড়িত ছিল না, এটা ছিল একেবারেই নতুন ও অনুপম মানসিক এক অবস্থা যা তাকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। প্রাচীন গল এলাকার দক্ষিণাংশ প্রভাঁসে অনেকটা রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থায় সামন্ততান্ত্রিক আভিজাত্যে এর জন্ম। বিশাল কোনো সাম্রাজ্যে এর জন্ম নয় বা সভ্যতার সুখদ ফল হিসেবেও এর আবির্ভাব হয়নি, রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে কিন্তু ব্যাপক আধ্যাত্মিক ফলপ্রসূতায় এক স্বাধীন অভিজাত রাজ্যশাসনমূলক এলাকায় জন্ম হয়েছিল এই নিকষিত প্রেমের। বাট্রান্ড রাসেল তাঁর বিয়ে ও নৈতিকতা গ্রন্থে এই প্রেমের স্বরূপ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছেন, পুরুষ যখন কোনো নারীকে গভীরভাবে ভালোবাসে তখন তার সাথে যৌনমিলনের চিন্তা করা তার কাছে অনৈতিক মনে হয় কেননা যৌনতা কিছু না কিছু মাত্রায় অপবিত্র, আর এ অবস্থায় পুরুষের প্রেমটি অন্যভাবে প্রবাহিত হয়ে কাব্য বা ভাবনার সৌন্দর্যে পরিণত হয়। রাসেল আরও বললেন, এভাবেই প্রেমটি প্রতীকে রূপান্তরিত হয় যার ফল হিসেবে সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রিডরিখের রাজসভায় প্রেমের কাব্যের আবির্ভাব ঘটে যা চলতে থাকে রেনেসাঁসের সময় পর্যন্ত। ডাচ ইতিহাসবিদ ইয়োহান হাইজিংজা ১৯১৯ সালে প্রকাশিত (ইংরেজি অনুবাদ ১৯২৪ সাল) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ মধ্যযুগের অবক্ষয়দ্য ওয়েনিং অফ মিডল এজেস-এ শেষ মধ্যযুগকে ক্লান্তিকর, নৈরাশ্যময় এবং অবক্ষয়ী বলে অবহিত করে দ্বাদশ শতাব্দে ফ্রান্সের প্রভাঁস এলাকায় রচিত গীতিকবিতাকে সম্পূর্ণ আলাদা মাত্রার বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, তখন সব ধরনের কাব্যিক পরিপ্লুতির নন্দনকানন হয়ে উঠেছিল নতুন ধরনের সেই প্রেম যার ভিত্তি ছিল প্রবৃত্তিরহিত এবং অশরীরী। রাসেল এই অভিজাত প্রেমকে বলেছেন সৌরভের মতো যা বীরের প্রেমকে শ্রদ্ধা করত কিন্তু তা ফলাফলহীন অপূর্ণ সমাপ্তির জন্য যাতনায় ভুগত না। রাসেল একে বলেছেন, গির্জার বিরুদ্ধে জীবনের ক্ষেত্রে প্রেমের প্রকৃত অবস্থার পৌত্তলিক স্বীকৃতি। ইয়োহান হাইজিংজা তাঁর মনীষাদীপ্ত গ্রন্থে আরও বলেন, ত্রয়োদশ শতাব্দের শেষদিকে এ জাতীয় প্রেমধারণায় আধ্যাত্মিক অনুষঙ্গও যুক্ত হতে থাকে যার ফল হিসেবে দান্তে ও তাঁর সমকালীন কবিদের মধ্যে প্রেমকে পবিত্র ও স্বর্গীয় উপহার হিসেবে ভাবার প্রবণতা দৃঢ় হয়ে যায়। দান্তের নবীন জীবন-এও আমরা এই ভাবনার বীজ দেখতে পাই:

‘এই সব চিন্তা আর যত শ্বাস দূরে পাঠালাম, এত বেদনার্ত তারা হয়েছে হৃদয়ে পরিণত, প্রেম হয় মরোমরো, ধরে সে তাদের এত ব্যথা;

কারণ ওদের মাঝে ধরেছিল তারা, শোকাহত, লিপিতে অঙ্কিত রাখা আমার সে ঈশ্বরীর নাম, আর তার মরণের বিষয়ে জানানো বহু কথা।’ [ অনুবাদ: শ্যামলকুমার গঙ্গোপাধ্যায়]

দ্বাদশ শতাব্দীকে ধরা হয় আধুনিক ইউরোপের সূচনাকাল যার থেকেই সৃষ্টি হয়েছিল আধুনিক সভ্যতার, এবং এ সময়েই এক জীবনপদ্ধতি হিসেবে আবির্ভূত হয় গীতিকবিতা আর কোর্টলি লাভ। আর এর পর রচিত তাবৎ সাহিত্যে চলে এই কোর্টলি লাভের দৌরাত্ম্য। বিশেষত কবিতা ও উপন্যাসে চলে এই প্রেমের অসম্ভব বিস্তার। পাশ্চাত্যে আমরা এর বড়ো প্রমাণ পাই দান্তে এবং ইসপানিঞল বারোক গীতিকবিদের লেখায়। দান্তে তাঁর প্রণয়িনী বেয়াত্রিচেকে এতটাই স্বর্গীয় ভাবতেন যে বেয়াত্রিচেকে সম্বোধনেও তিনি সম্মানসূচক ‘‘আপনি’’ ব্যবহার করেছেন। যেহেতু এ ধরনের সাহিত্য বিকশিত হয়েছিল ফ্রান্সের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল প্রভাঁস ও তার আশেপাশের এলাকায় সেই অঞ্চলের ভাষায়, এগারোশ থেকে চোদ্দো-শ শতাব্দীতে, তাই এই ধরনের সাহিত্যকে অনেক সময় এলাকার নামানুযায়ী প্রভাঁসীঁয় সাহিত্য বা ইংরেজিতে প্রভেনকাল সাহিত্যও বলা হয়। কোর্টলি লাভ শব্দবন্ধে ব্যবহৃত কোর্ট শব্দটি বোঝায় অন্দরমহল বা রাজপ্রাসাদ। শারীরিক সংসর্গ বা প্রজননের উদ্দেশ্যসাধনে কোনো স্থূল প্রেম নয়, বরং আভিজাত্যময় উচ্চাকাক্সক্ষী অন্দরমহলকেন্দ্রিক প্রেমবাসনা যেখানে রাজত্ব করে মন ও রোম্যান্টিকতা। আরও মোটাদাগে বললে, নাইটদের সাথে কোনো বিবাহিতা সামন্ত-নারীর মানসিক প্রেম যা বিশুদ্ধ বা নিকষিত, যাকে ফরাসি ভাষায় বলা হয় ‘‘ফাঁ’মুর’’, যা প্রেমবন্দনায় মুখরিত এক হৃদয়াচার। যে কবিদের হাতে বিকশিত হয়েছে এ ধরনের প্রেমের কাব্য তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন: প্রথম প্রভাঁসীঁয় কবি ৯ম গিলেম দ্য পোচিয়ে, জোফা রুদেল, মারকাবুই, বের্নাহ দ্য ভোতাঁদুর, আর্নু দানিয়েল, বেথ্রোঁ দ্য বরঁ, পিয়েরে ভিদাল, পিয়েরে কার্দিনাল, দিয়ে-র কাউন্টপতœী (বেয়াত্রিজ নাকি ইজোয়ারদা?)। এসব কবিদের মধ্যে মাত্রাগত ভিন্নতা রয়েছে কিন্তু তাঁদের লেখার কেন্দ্রীয় ভাব একটিই। দু-শ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে এসব কবিরা সক্ষম হয়েছিলেন প্রেমের এক ধরনের সংহিতা তৈরিতে যার কিছু বৈশিষ্ট্য এখনও প্রাসঙ্গিক এবং যা মৌলিক ভিত্তি দিয়েছিল পরবর্তী সময়ের গীতিকবিতার সৃষ্টিতে। তাঁদের কবিতার বিষয় হচ্ছে নারী ও পুরুষের প্রেম আর তা লেখা হয়েছে কথ্যভাষায়। লা ভিতা নুওভাতে দান্তে কথ্যভাষায় প্রেমের গীতিকবিতা লেখার কারণ ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন:

‘প্রাচীনকালে আমাদের সাধারণ কথ্যভাষায় প্রেমের পদাবলি রচনা করত কিছু কবিকুল। বলছি, আমাদের মধ্যে সাধারণ কথ্যভাষায় নয়, কেবল (লাতিনে) শিক্ষিত কবিরা এ ধরনের বিষয়ে চর্চা করত। অবশ্য, অন্য জাতিদের মধ্যেও এমন ঘটে থাকতে পারে, বা ঠিক গ্রীসের ধারায়, এখনও ঘটছে। বেশি বছর আগে ঘটেনি কথ্যভাষার এই কবিদের প্রথম আবির্ভাব, কারণ কথ্যভাষায় ছন্দোবদ্ধ পদ গড়া লাতিনে মাত্রানুযায়ী কবিতা রচনারই সমান। অল্পকালই যে কেটেছে, তার প্রমাণ হল, আমরা যদি ‘‘অকো’’র ভাষায় (প্রভাঁসীয় ভাষায়) বা ‘‘সি’’-এর ভাষায় (ইতালীয় ভাষায়) খোঁজ নিতে যাই, তাহলে এখন থেকে দেড়শো বছর আগে এই বিষয়ে লেখা কোনো কবিতা পাব না। আর (কথ্যভাষায়) পদরচনার জন্য কিছু অমার্জিত লোক খ্যাতিমান হয়, কারণ তারা ‘‘সি’’-এর ভাষায় প্রায় আদি পদকর্তা। যে জন প্রথম কথ্য ভাষায় কবিতা লেখে, নারীকে নিজের কথা বোঝানোর আকাক্সক্ষাই তাকে প্রেরণা দিয়েছিল, কারণ লাতিন কবিতা দুর্বোধ্য ছিল রমণীর কাছে। যারা প্রেম ছাড়া অন্য বিষয়ে পদরচনায় ব্যাপৃত থাকে, এইটি তাদের বিপরীতপন্থী, কারণ গোড়া থেকেই পদরচনার এই প্রণালী প্রেমের কথা বলার জন্য উদ্ভাবিত। তাই, যেহেতু গদ্য লেখকদের চেয়ে কবিদের বেশি বাক্স্বাধীনতা দেওয়া হয়, এবং এই পদকর্তারা কথ্যভাষার সুযোগ্য এবং যুক্তিবহ কবি ছাড়া অন্য কেউ নয়, তাই কথ্যভাষার অন্য লেখকদের চেয়ে তাদের জন্য কথা বলার বেশি স্বাধীনতা প্রদত্ত। অতএব, কোনো প্রতিমানির্মাণ বা অলঙ্করণ যদি (লাতিন) কবিদের প্রতি মঞ্জুর থাকে, তা কথ্যভাষার কবিদের প্রতিও মঞ্জুর হবে। তাই যদি দেখি (লাতিন) কবিরা কোনো চৈতন্যহীন বিষয়কে সজীব এবং যুক্তিধারী সত্তারূপে সম্বোধন করে আলাপ জুড়েছে, তাদের পরস্পরের সঙ্গে একত্রে কথা বলিয়েছে, শুধু সত্যপ্রসঙ্গে নয়, কিন্তু অলীক প্রসঙ্গেও, অর্থাৎ তারা বলেছে বস্তুরূপে অস্তিত্বহীন সত্তারা কথা কয়, আর বলেছে অনেক আপতিক গুণ বাস্তব ও মানবিক সত্তার মতো বাক্যালাপ করে, তাহলে কথ্যভাষার কবিও একইভাবে তা করবার যোগ্যতাধারী।’ [ অনুবাদ: শ্যামলকুমার গঙ্গোপাধ্যায়]

দান্তে স্পষ্টতই নারীর হৃদয়ঙ্গমের জন্য লাতিনের ওপর কথ্যভাষার প্রাধান্য দিয়েছেন। বলা প্রাসঙ্গিক যে, দান্তে নিজেও প্রভাঁসীয় ত্র“বাদুরদের গীতিকাব্য দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন। এসব কবিতা আদতে সামন্তপ্রভুদের অন্দরমহলে যন্ত্রানুষঙ্গ সহযোগে গীত হতো। এসব পরিবেশনা তৃপ্ত করত অভিজাত রমণীদের যারা এর থেকে পেত বিশুদ্ধ প্রেমের বার্তা, মনে মনে যা অনুরণিত হতো তাদের ভেতরে।

কিন্তু কীভাবে উদ্ভব হলো এই প্রেমের এবং কেনই বা তা দেখা দিল প্রভাঁসে? আমরা জানি, সময়টা ছিল সামন্ততন্ত্রের যুগ আর সেখানটায় ছিল স্বাধীন সামস্তপ্রভুদের বিচরণস্থল। দ্বাদশ শতাব্দী ছিল ইউরোপের জন্য বৈভবকাল: শস্য উৎপাদন ছিল প্রতুল, আবির্ভূত হচ্ছিল নগরকেন্দ্রিক অর্থনীতি, ইউরোপ ছাড়িয়ে প্রাচ্যেও সম্প্রসারিত হচ্ছিল বানিজ্য। শতাব্দটি ছিল সত্যিকারের এক বিকাশমান কাল যখন তা প্রসারিত হচ্ছিল বাইরের দিকে, অর্থাৎ ঔপনিবেশিকতার ইঙ্গিত দিচ্ছিল তা। শুধু কৃষি বা অর্থনীতির দিকে থেকেই নয়, ভূ-রাজনৈতিক মিথস্ক্রিয়ার জায়গা থেকেও। ক্রুসেডের কারণে ইউরোপীয়রা পরিচিত হচ্ছিল মধ্যপ্রাচ্যের সাথে, তাদের বিজ্ঞান, দর্শন এবং প্রাচুর্যের সাথে। আরবদের মাধ্যমেই তারা পরিচিত হচ্ছিল প্রাচীন গ্রিক চিন্তা, চিকিৎসা ও বিজ্ঞানের সাথে। বেশ কয়েকজন প্রভাঁসঁীঁয় লেখকও যোগ দিয়েছিলেন ক্রুসেডে, যেমন প্রভাঁসীয় মতবাদের জনক আকুয়াতানের ডিউক উইলিয়াম গিয়েছিলেন সিরিয়া ও স্পেনে। মুর অধ্যুষিত স্পেন, যাকে বলা হতো আন্দালুস, তার রাজনীতি, বাণিজ্য ও রীতিনীতির সাথে পরিচয় এক্ষেত্রে সুফল বয়ে এনেছিল ইউরোপীয়দের জন্য। হয়তো সেখানকার সম্রাট বা জমিদারদের দেওয়ানে-খাস-এ, বা জলসাঘরে, নর্তকী ও গায়িকাদের উপস্থিতির সাথেও পরিচিত হয়েছিল তারা। এছাড়াও ওই সময়ে দ্বাদশ শতাব্দীতে প্রভাঁস এলাকা ছিল ভূপ্রাকৃতিকভাবে অনেক জাতির সম্মিলনস্থল, বিশেষত, নর্ডিক ও মধ্যপ্রাচ্যীয় জাতিদের। বহুল উৎপাদন, বাণিজ্যিক কাজকারবার, উন্নত মানের ফল ও তা থেকে উৎপন্ন মদিরা, উৎকৃষ্ট সুগন্ধী ইত্যাদির নানাবিধ প্রাচুর্য ও বহুমুখিতা সেখানে এমন এক ব্যতিক্রমী সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছিল যে নির্দ্বিধায় তাকে বলা যায় প্রথম ইউরোপীয় সংস্কৃতি। এমন একটি উপযোগী অবস্থায় অনুভূতিজাত কোনো অসাধারত্বের বিকাশ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক।

কিন্তু এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, এই সংস্কৃতি নিশ্চয় নারীদের সামাজিক অবস্থান ও মূল্যবোধেরও পরিবর্তন এনেছিল, কেননা নারীদের জীবন ও মানের উন্নয়ন ছাড়া এমন ধরনের নিষ্কাম প্রেমের ধারণা অসম্ভব। ওই সময়ের ও স্থানের অভিজাত নারীদের মর্যাদা ছিল উঁচু স্তরের, যেখানে তারা শুধু সৌন্দর্যপ্রতিভূ হিসেবেই প্রতিভাত হতো না বরং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রকের ভূমিকাও পালন করত যা আগে দেখা যায়নি। নারীদের এ জাতীয় মর্যাদাবৃদ্ধির পেছনে আরও ছিল খ্রিস্টান ধর্মের কিছুটা মাহাত্ম্য। পেগান যুগের নারী-মর্যাদার অস্থিরতা ও অভাবের জায়গায় খ্রিস্টান ধর্ম এ মর্যাদার প্রথাবিনির্মাণে কিছুটা সফল হয়েছিল বলে মনে করা যায়, কেননা মা মেরির ধারণা এই উন্নমনে ভূমিকা রেখেছিল বলে ধরে নেওয়া খুবই স্বাভাবিক। এছাড়াও ছিল নারী মুক্তি বিষয়ে জার্মানীয় উত্তরাধিকার। তাসিতুস অনেক আগেই অনেকটা আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলে গেছেন যে, রোমের তুলনায় জার্মানির নারীরা ছিল অধিক স্বাধীন। আর এসবের বাইরে যেটা প্রধান বিবেচনা তা হলো, সামন্ততান্ত্রিক নিয়মকানুন। এ জাতীয় অভিজাত সমাজে পারস্পরিক বিয়ে সাধারণত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ দ্বারা নির্ধারিত হতো। সে-সময়টাও ছিল অনবরত যুদ্ধের আর এ যুদ্ধগুলো সংঘটিত হতো দূর ভূমিতে, আর যুদ্ধে অংশগ্রহণের কারণে প্রায়শই রাজ্য থেকে বাইরে থাকতে হতো সামন্তপ্রভুদের। এই অনুপস্থিতিকালে রাজ্য সামলানোর দায়িত্ব থাকত তাদের রাজমহিষীদের ওপর। সে-সময়ে বৈবাহিক বিশ্বস্ততাও ছিল না অতটা নিবিড়, আর বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কও ঘটত আকছার। পরকিয়া সম্পর্কের নানা গপ্পো তখন রগড় তুলত সমাজে, যেমন রানি গিনভের ও লাসঁলো-র পরকীয়ার কাহিনি চারিদিকে শোরগোল ফেলেছিল, যেমন ফেলেছিল ত্রি— ও ইজোলডে-র ভাগ্যাহত কাহিনি। একটা কথা মনে রাখা জরুরি, অভিজাত এসব স্ত্রীরাও আসত অন্য অভিজাত ঘর থেকে, ফলে তাদের ক্ষমতা ও অভিজ্ঞতাও ছিল অনেক বেশি, রাজ্য পরিচালনার পারঙ্গমতাও ছিল তাদের সহজাত। এসব শক্তিশালী সম্ভ্রান্ত নারীরা অনেক সময় তাদের স্বামীদের সাথেও দ্বৈরথে অবতীর্ণ হতো। আকিতানের উইলিয়ামও তার দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে এমন সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিলেন এবং এই সংঘর্ষের জের হিসেবে তার স্ত্রী এক গির্জায় আশ্রয় নিয়ে সেখানকার যাজকের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তিনি তার সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন যতদিন না তিনি তার স্বামীকে খ্রিস্টীয় সমাজ থেকে বহিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এসব সম্ভ্রান্ত নারীদের মধ্যে স্বতন্ত্র ছিলেন আকিতানের ডিউক দ্বিতীয় উইলিয়ামের নাতনি এলিয়েনর, যিনি ছিলেন দুই জন রাজার স্ত্রী, ছিলেন সিংহহৃদয় রিচার্ডের মাতা আর কবিদের পৃষ্ঠপোষিকা। ১১২২ সালে রানি হওয়ার পর এলিয়েনর প্রেমের গুণগান শুরু করেন এবং তাঁর দরবার থেকে প্রেমের শর্ত নামে একটি পুস্তিকাও প্রকাশিত হয়। যা-ই হোক, এই অভিজাত নারীদের কিছু-সংখ্যক ছিলেন ত্র“বাদুর। ওই সামন্ততান্ত্রিক সময়ে নারীরা ভোগ করত স্বাধীনতা যা পরবর্তী সময়ে গির্জা ও স্বেচ্ছাচারী রাজশাসনের যৌথ পীড়নে হারিয়ে যায়। আবার ঘটে আলেকজান্দ্রিয়া ও রোমের ঘটনার প্রত্যাবর্তন। সত্যিকার অর্থে প্রেমের ইতিহাস আর নারী স্বাধীনতার ইতিহাস অচ্ছেদ্য। প্রেমই নারীকে প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ দিয়েছিল।

যত ব্যাখ্যাই আমরা দিই না কেন এই কোর্টলি লাভ বা নিষ্কাম প্রেমের উৎপত্তির পেছনের চিন্তাগুলোকে চিহ্নিত করা কিছুটা দুষ্কর। যে প্রভাঁসীয় কবিতার কথা আমরা বললাম, তার উৎপত্তি খ্রিস্টীয় সমাজে যখন ইউরোপে এই ধর্ম বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। এই প্রভাঁসীয় সাহিত্যের বিষয়-আশয় খ্রিস্টীয় শিক্ষার সাথে সংগতিপূর্ণ ছিল, বা সহায়ক ছিল তা মনে করা যথাযথ না-ও হতে পারে। এসব কবিদের কৃষ্টি, বিশ্বাস ও শিক্ষাদীক্ষা খ্রিস্টীয় আবহাওয়ায় হলেও মনে করার কোনো কারণ নেই যে খ্রিস্টানত্বের সাথে তাদের কোনো সংঘর্ষ ছিল না বিশেষত রোমান ক্যাথোলিকবাদের সাথে। খ্রিস্টীয় বিশ্বাসী হলেও একই সাথে এসব লেখক অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করতেন যা রোমান খ্রিস্টীয়বাদের মধ্যে ছিল না।

ধর্মের বাইরেও এক ধরনের চিন্তার বিনির্মাণ তাদের মধ্যে দানা বেঁধেছিল যা প্রথম দিকে তাদের সমস্যায় না ফেললেও পরে এর জন্য ধর্মের কোপানলে তাদের পড়তে হয়েছিল, ফলে এই কোর্টলি লাভ বা নিষ্কাম প্রেম গির্জার অনুমোদন পায়নি। ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় হেনরি রানি এলিয়েনরের এই দরবারি প্রেমধারার সমাপ্তি টেনে দেন। গির্জাও এই প্রেমচিন্তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ধর্মীয় বিচারালয় গঠন করল, নারীর প্রতি যে-কোনো ধরনের আচরণ বা প্রকাশকে পাপ বলে ঘোষণা দিয়ে বসল। এটাও প্রতীয়মান হয় যে প্রাচীন গ্রেকো-রোমক সাহিত্য ও চিন্তা দ্বারা প্রভাঁসীয় কবিরা প্রভাবিত হয়েছিল, প্রভাবিত হয়েছিল নব্য-লাতিন সাহিত্য দ্বারাও। অনেকে মনে করে থাকেন, প্রভাঁসীয় গীতিকবিতার ওপর লাতিন প্রার্থনাকাব্যের মাত্রা এবং লয়ের প্রভাব ছিল কিন্তু এসব ধর্মীয় কবিতা প্রভাঁসীয় ত্র“ুবাদুরদের কামনাময় কবিতার বিষয়কে বদলাতে পারেনি। এসব ছাড়াও প্লাতোনীয় ধারণারও ছিল প্রভাব তাঁদের ওপর যা আরবদের মাধ্যমে পৌঁছেছিল তাঁদের কাছে।

আগেই বলেছি, আরবদের প্রভাবের কথা, যা এসেছিল ক্রুসেডের মাধ্যমে। অনেকে বলে থাকেন, ক্রুসেডে মুসলিম স্পেনের কাছ থেকে দক্ষিণ ফ্রান্সের ব্যারনরা যা শিখেছিল, তা ছিল ক্রুসেডের সামগ্রিক প্রাপ্তির চেয়ে বেশি। প্রভাঁসীয় কবিরা এই প্রভাবের ফল হিসেবেই আন্দালুশীয়-আরবীয়দের কাছ থেকে পেয়েছিল দুটো মূল্যবান কাব্যিক ধারা : গজল ও জারকা, দুটোই ছন্দোবদ্ধ নারীপ্রেম-বন্দনা। অন্য একটি আচারও তারা অবগত হয়েছিল, তা হলো প্রেমিক-প্রেমিকার অবস্থার স্থানান্তর-চেতনা। সামন্ততান্ত্রিক সমাজে মানবিক সম্পর্কের ক্ষমতার রূপ উচ্চ-নিু ধরনের, মনিব-গোলামকেন্দ্রিক। কিন্তু আন্দালুসে আমিরেরা বলতেন, যে তারা হলেন তাদের প্রিয়তমার সেবক বা দাস। প্রভাঁসীয় কবিরা আরবদের প্রেমবিষয়ক এই অসাধারণ চিন্তাকেই গ্রহণ করলেন যাতে ছিল প্রথাগত যৌন-সম্পর্কীয় ধারণার অপনোদন যেখানে প্রেয়সীই প্রভু আর পুরুষটি তার সেবক।

পরবর্তীকালে শেক্সপিয়রের কবিতায়ও এই প্রয়োগের দেখা মেলে: ৫৭-সংখ্যক চতুর্দশপদীটি শুরুই হয় এভাবে যে, যেহেতু তোমার ক্রীতদাস (Being your slave),তাই তোমার ইচ্ছার সময়, ঘণ্টা, তামিল না-করে পারি না। পরে আবার এসেছে ‘স্যাড স্লেভ’ বা ‘বিষণ্ন ক্রীতদাস’ শব্দবন্ধটি। মনে করা যায়, শেক্সপিয়র মোহিত হলেও হয়ে থাকতে পারেন প্রভাঁসীয় কবিদের এই উপমা দ্বারা। মুসলিম শাসনে এ ধরনের ধারণা ছিল বিপ্লবাত্মক। পুরুষদের ভাবমূর্তি অবদমিত হলো, দেখা দিল নারীর নতুন ভাবমূর্তি। সৃষ্টি হলো নতুন বিষয়, যাতে ভাষাও হলো সমৃদ্ধ, এবং তা ঋদ্ধ করল সাহিত্যকে। আল আন্দালুসের কবিরা তাদের প্রেমিকা বা প্রেয়সীকে বলত সাইয়েদি ও মাওলাঙ্গা যার অর্থ যথাক্রমে ‘আমার মালিক’ ও ‘আমার প্রভু’, প্রভাঁসীয় কবিরা এর অনুকরণে প্রেয়সীকে ডাকতে শুরু করলেন মিডনস যার অর্থ মেউস দোমিনুস বা ‘আমার শাসক’। নারী হলো মালিক আর তার প্রেমিক পুরুষ হলো তার গোলাম। সত্যিই প্রমাণিত হলো প্রেম ধ্বংসাত্মক। কারণ নিয়ন্ত্রণের পুরো ধাপকেই তা বদলে দিল অন্তত প্রেমের ক্ষেত্রে হলেও।

আমরা দেখেছি, প্লাতোনের মতবাদে প্রেম শারীরিক থেকে আত্মিক অবস্থায় উন্নীত। প্লাতোনের এই ধারণাই আরব বিশ্বে সংক্রামিত হলো, এবং তারাও ভাবতে শুরু করল যে সর্বোচ্চ প্রেম বিশুদ্ধতম, এবং স্বর্গীয়। আমরা জানি, আরবদের ওপর গ্রিক দর্শনের প্রভাব, ফিলোসোফি শব্দটি এসেছে আরবি ফালাসিফোস থেকে যার ভিত্তি ছিল গ্রিক ফিলোসোফিয়া। সুতরাং নব্য-প্লাতোনবাদের বিষয়ে আরবদের আগ্রহ স্বাভাবিক। প্রেম যে আত্মিক এই ধারণা আরবে নতুন দর্শনের সূত্রপাত করল যাকে বলা হয় সুফি মতবাদ।

এই মতবাদে প্রেমকে স্রষ্টার দিকে পরিচালিত করা হলো এবং বলা হলো আচার-অনুষ্ঠান নয়, প্রেমই স্রষ্টাকে পাওয়ার একমাত্র পথ। আরও বলা হলো, আত্মা ও পরমাত্মার সম্পর্কটি হলো এমন যা একে অপরকে পরস্পর টেনে কাছে নিয়ে যায়। আচার-পদ্ধতিকে বাদ দিয়ে তারা জোর দিল আত্মা-পরমাত্মার মিলনের ওপর। গোড়া মুসলিমদের কাছে তারা ঈশ্বরদ্রোহী বলে চিহ্নিত হলো। অনেক সুফি কবি-সাধক-দার্শনিকদের হত্যা করা হলো। বাগদাদের বিচারক ও কবি মোহাম্মেদ ইবনে দাউদ ছিলেন গোড়াদের দলভুক্ত, তিনি একটি বই লিখেছিলেন কিতাব-আল-জাহরা (পুষ্পপুস্তক) নামে যা ছিল সিম্পোজিয়াম ও ফায়েদ্রুস-এর দ্বারা প্রভাবিত; সেখানে তিনি লেখেন, সুন্দর দেহের অবলোকন মাত্রই জন্ম হয় প্রেমের, তারপর এই প্রেম, এই দৈহিক প্রেম আত্মিক প্রেমে উন্নীত হয়, পুরুষ প্রেমিকের সৌন্দর্য হলো পরমার্থিক অনুধ্যানের মার্গ। কিন্তু ইবনে দাউদ ছিলেন মৌলপন্থার প্রতি অনুগত, তাই তিনি আত্মা-পরমাত্মার মিলনের ব্যাপারটিকে অস্বীকার করেন, কারণ ধর্মমতে স্রষ্টা ও সৃষ্টির দূরত্ব অনতিক্রমণীয়।

এক শতাব্দী পর উমাইয়া আমলে কর্দোভার কবি ও দার্শনিক ইবনে হাজাম, যিনি ছিলেন আল আন্দালুসের অন্যতম আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, লেখেন দ্য নেকলেস অব দ্য ডাভ নামে ছোটো একটি নিবন্ধ যা অনূদিত হয়েছে প্রধান প্রধান ভাষায়। প্লাতোনের মতোই ইবনে হাজাম মনে করতেন, শারীরিক সৌন্দর্যদর্শনেই জন্ম হয় প্রেমের। কিছুটা কম সুসম্বন্ধভাবে হলেও তিনিও বলেছেন প্রেমের সিঁড়ির কথা যা শারীরিক থেকে আত্মিক পর্যায়ে উপনীত হয়। ইবনে হাজাম ইবনে দাউদ থেকে একটি স্তবক উদ্ধৃত করেন যা প্লাতোনের সিম্পোজিয়াম-এর মতোই প্রতিধ্বনিত হয়: ‘(প্রেমের প্রকৃতি সম্পর্কে) আমার ধারণা এই, তা প্রারম্ভিক পর্যায়ে যেভাবে এক উৎকর্ষিত সারাৎসার ছিল তা অপেক্ষা ভেঙে যেতে উন্মুখ আত্মার অংশবিশেষ, যা তার নিজের মধ্যে মিলনে নিহিত থাকে, তা এরূপ নয় যেভাবে ইবনে দাউদ ( স্রষ্টা তাঁর ওপর শান্তি বর্ষিত করুন!) একজন দার্শনিকের ওপর নির্ভর করে বলেন যে আত্মা ‘দুই ভাগে বিভক্ত নিরেট গোলাকার পদার্থ’ যা তাদের আগের উচ্চতম সম্পর্কের মতো সম্পর্কিত হতে চায়…।’ বোঝাই যায় দার্শনিকটি হলেন প্লাতোন আর বিভক্ত গোলক হলো সিম্পোজিয়াম-এর উভলৈঙ্গিক সত্তা যা চতুর্থ বক্তা আরিস্তোফেনিসের মুখ দিয়ে বলানো হয়েছে। ধারণাটি হলো, আত্মা পৃথিবীতে আসার আগে তাদের পূর্ব সম্পর্কের কারণে এ জগতে একে অপরকে খোঁজে আর দেহধারী হয় যা প্লাতোনের ধারণায় চিহ্নিত, যা হলো স্মরণের মতবাদ।

হাজামের দ্য নেকলেস অব দ্য ডাভ-এ ফায়েদ্রুস-এর প্রতিধ্বনিও রয়েছে:‘‘আমি দেখি এক মানবীয় রূপ, কিন্তু যখন আমি আরও সবিস্তারে ধ্যান করি, আমার মনে হয় তাতে আমি এক শরীর দেখি যা গোলাকার স্বর্গীয় জগৎ থেকে আবির্ভূত।’ সৌন্দর্যের অনুধ্যান হলো এক উন্মীলন। ইবনে হাজামের প্রতিধ্বনির নজির মেলে দান্তেও। দ্য নেকলেস অব দ্য ডাভ-এর প্রথম অধ্যায় ‘প্রেমের মর্ম’-এ আমরা পাই এই কথা: প্রেম অন্তর্জাতভাবে এক আকস্মিকতা, অতএব অন্য কোনো আকস্মিকতার ভিত্তি হতে পারে না তা। দান্তের নবীন জীবন-এর পঁচিশতম অধ্যায়ে আমরা পাই একই ধরনের কথা: প্রেম অন্তর্জাত বস্তু হিসেবে অস্তিত্বশীল নয়, তা বস্তুর এক আকস্মিকতা। দুটো ক্ষেত্রেই বলা হয়েছে যে, প্রেম না দেবদূতীয় ( এক বৌদ্ধিক অশরীরী বস্তু) না মানবীয় সত্তা (এক বৌদ্ধিক শারীরিক বস্তু), বরং মানুষের ভেতরে ঘটে যাওয়া এক বিশেষানুভূতি বা আকস্মিকতা যা তাকে ভিন্নতর একটি অবস্থায় নিয়ে যায়, অনিশ্চিত হলেও যা কাক্সিক্ষত।

প্রভাঁসীয় কবিরা ইবনে হাজামের লেখার সাথে পরিচিত ছিলেন কি না তা আজ আর স্পষ্ট নয় কিন্তু দেখা যায় প্রায় একশ পঞ্চাশের বেশি সময় পরে আঁদ্রে লু শাপলাঁ (আদ্রিয়াস কাপেল্লানাস) শাম্পেনের মারি-র অনুরোধে লেখেন প্রেমবিষয়ক নিবন্ধ দ্য আর্তে ওনেসতা আমাদিঁ যাতে ইবনে হাজামের দ্য নেকলেস অব দ্য ডাভ-এর কথার প্রতিধ্বনি খুঁজে পাওয়া যায়। ১১৮৫ খ্রিস্টাব্দে আঁদ্রে লু শাপলাঁ-র গ্রন্থটি লেখার আগেই আরবীয় কামভাবনার এবং কাব্যআঙ্গিকের সাথে প্রভাঁসীয় কবিরা বিক্ষিপ্তভাবে হলেও পরিচিত ছিলেন। শারীরিক সৌন্দর্যস্তুতি, প্রেমের স্বর্গসিঁড়ি এবং সতীত্ববন্দনার ধারণার বিষয়ে মানবীয় ব্যাপ্তির প্রভাব তাই মনে করিয়ে দেয় প্রভাঁসীয় কবিদের ওপর আরবীয় কবিদের প্রভাব যা ছিল না ঈশ্বরপ্রাপ্তির কোনো পথ। একটা বিষয় পরিষ্কার যে ইবনে হাজামের কামবাদ বা সম্ভ্রান্ত প্রেম কোনোটাই ছিল না রহস্যময়। উভয় ক্ষেত্রেই প্রেম মানবিক, একান্তই মানবিক, যদিও তাতে অন্য বাস্তবতার প্রতিফলন ছিল।

এই গৌরবময় প্রেম অভিজাত নিয়মনীতিরও ছিল পরিপন্থি, কারণ এক্ষেত্রে নারীটিকে হতে হতো বিবাহিতা আর ত্র“বাদুর প্রেমিকটিকে হতে হতো সামাজিকভাবে নিু মর্যাদার একজন। এই প্রেম ছিল অসমবংশ ও দাম্পত্যমর্যাদা, উভয় বিবেচনায়। সুতরাং তা ছিল এক অর্থে সংস্কারমুখী এবং নাশকতাপন্থিও। এই কোর্টলি লাভ বা অভিজাত প্রেমের বিপরীত সাযুজ্যে অন্য একধরনের প্রেম দেখা দিয়েছিল স্পেন এবং মেক্সিকো ও পেরুর ঔপনিবেশিক প্রশাসনিক এলাকাগুলোয়, সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে, যা ছিল কৌতূহলোদ্দীপক এক প্রণয়প্রথা, যাকে বলা হতো দরবারি প্রেম বা প্যালেস কোর্টিং। মাদ্রিদে যখন রাজদরবার প্রতিষ্ঠিত হলো তখন অভিজাত ঘরের কন্যাদের পাঠিয়ে দেওয়া হতো দরবারে, রাজমহিষীদের সহায়তা করার জন্য। এসব তরুণীদের বলা হতো ‘‘অপেক্ষারত তরুণীরা’’ বা ‘‘লেডিস-ইন-ওয়েটিং’’। এসব তরুণী রাজদরবারে কিছুকাল বসবাস করত আর নানা উৎসব-অনুষ্ঠানাদিতে অংশগ্রহণ করত। তাদের সাথে অমাত্য-রাজপুরুষদের যৌনসম্পর্ক স্থাপিত হতো অবলীলায়। রাজপুরুষেরা ছিল বিবাহিত, সুতরাং এই কামানুরাগ ছিল স্বল্পস্থায়ী, ও অবৈধও। এই তরুণীদের (লেডিস-ইন-ওয়েটিং) জন্য দরবারি প্রণয় ছিল অনেকটা প্রেমের শিক্ষানবিশি। ‘‘প্যালেস কোর্টিং’’ ছিল অনানুষ্ঠানিক এক শারীরিক যৌনতা আর কোর্টলি লাভ ছিল মানসিক যৌনতা।

যা-ই হোক, আলোচ্য প্রভাঁসীয় এই অভিজাত প্রেমের সমাপ্তি হয়েছিল প্রভাঁসীয় সভ্যতার সমাপ্তির সাথে সাথেই। শেষ সময়ের কবিরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছিলেন, কেউবা আশ্রয় নিয়েছিলেন স্পেন বা কাতালোনিয়ায়, কেউবা সিসিলি এবং উত্তর ইতালিতে। তবে নিভে যাবার আগে প্রভাঁসীয় কবিতা অবশিষ্ট ইউরোপকে সমৃদ্ধ করেছিল। এর প্রভাবেই আন্দালুসীয় অঞ্চলে কেলটিক কাহিনি জনপ্রিয় হয়েছিল। এ সময়েই অবৈধ প্রণয়সম্পর্ক নিয়ে বর্ণনাত্মক কবিতা লেখা হয়েছিল, বিশেষত লাঞ্চলোতে এবং রাজা আর্থারের মহিষী গুইনেভেরে-র অসামাজিক প্রেম নিয়ে। দান্তের লা দিভিনা কোম্মেদিয়ায়ও মানব মনের ওপর এ ধরনের প্রেমের প্রভাবের ঘটনা পাওয়া যায়। ইনফের্নোর দ্বিতীয় বৃত্তে দেখা যায়, অধোলোকের বিচারক দানবাকৃতি মিনসকে পেরিয়ে দান্তে ও ভার্জিল পৌঁছলেন কামনার কালো হাওয়ার মধ্যে। তাঁরা দেখলেন, এখানের কালো হাওয়ার স্রোতে ঘুরছে সেই সব আত্মা যারা পার্থিব জীবনে কামনা-বাসনার কাছে নিজেদের বিসর্জন দিয়েছিল। এই কালো হাওয়ার প্রবাহের মধ্যেই দান্তের আহ্বানে তাঁদের কাছে ভেসে এল অবৈধ প্রেমিক-যুগল পাওলো এবং ফ্রান্সেসকার আলিঙ্গনাবদ্ধ আত্মাযুগল। দান্তের জিজ্ঞাসার উত্তরে ফ্রান্সেসকা বলে যে, সে ছিল পোলেস্তার বয়োজ্যষ্ঠ সামন্ত গুইদো-র মেয়ে। রাজনৈতিক কারণে রিমিনির বিকৃতদর্শন ভূস্বামীর ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। কিন্তু সে স্বামীকে ভালোবাসতে না পেরে সুদর্শন দেবর পাওলোর আকর্ষণে তার সাথে অবৈধ প্রেমে লিপ্ত হয়। তার স্বামী হাতেনাতে একদিন তাদের ধরে ফেলে দুজনকে একসাথে হত্যা করে। ফ্রান্সেসকা বলতে থাকে কীভাবে তারা একদিন নির্জনে একসাথে বসে লাঞ্চলোতে ও গুইনেভেরের অবৈধ প্রেমকাহিনি পড়তে পড়তে নিজেদের প্রেমকে আবিষ্কার করে বসে। পড়তে পড়তে তারা যখন বইটির সেই জায়গায় পৌঁছাল যখন লাঞ্চলোত ও গুইনেভের আবেগে এক অপরকে জড়িয়ে ধরে প্রথমবারের মতো একে অপরকে চুমো খেল, তখন তারা পড়া বন্ধ করল, একে অপরের দিকে চেয়ে থাকল এবং লজ্জায় ফ্যাকাসে হয়ে গেল তাদের মুখমণ্ডল। ফ্রান্সেসকা বলল:

‘প্ররোচিত হই চোখে-চোখ রাখতে অনেকবার সেই পাঠে পাঠে, বদলে যায় মুখের আভা, কিন্তু একটি নিমিষই শুধু গেল জয়ী হয়ে আমাদের নিয়ে। যখন আমরা পাঠ করছি কীভাবে সে কাক্সিক্ষত আর উদ্বিগ্ন হাসি প্রেমিকের চুম্বনে হয়েছে অমন রাঙা ; কোনোদিন বিচ্ছিন্ন হবে না সেই পুরুষ আমার কাছ থেকে, তখনই আমার চুম্বনে চুম্বনে পুরো কেঁপে হলো একাকার।’

ফ্র্রান্সেসকা আরও বলল, ‘সেদিন আর তাদের পড়া এগোয়নি। দান্তে নিজেও ছিলেন প্রেমের পাপী। বেয়াত্রিচেও একাধিকবার তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন দান্তেকে। সম্ভবত এ কারণেই এবং ফ্রান্সেসকার প্রতি সহানুভূতি বশতই দান্তে কাহিনিটিকে একটু পরিবর্তন করেন এভাবে যে, প্রণয়কালে গুইনেভের প্রথমে লাঞ্চলোতেকে চুম্বন দিয়েছিল। দান্তে আসলে চেয়েছিলেন কবিতা ও ধর্মতত্ত্বকে মেলাতে। দান্তে প্রভাঁসীঁয় কবিদের ভক্ত ছিলেন। পাউলো ও ফ্রান্সেসকার কাহিনির অধ্যায়ে তিনি দুইবার কোর্টলি লাভ বা মর্যাদাময় প্রেম সম্পর্কে বলেছেন।’

প্রথমটি অনেকটা তাঁর গুরু বোলোনিয়ার কবি গুইদো গুইনিচেল্লির (১২৪০-৭৬ খ্রি.) কথার প্রতিধ্বনি, যিনি মনে করতেন যে প্রেম হলো হৃদয়ের আভিজাত্য। দান্তে বলছেন:‘‘প্রেম, সুকুমার হৃদয়ে দ্রুত হয় উদ্দীপ্ত’, আর গুইনিচেল্লি তাঁর একটি গানে বলছেন: ‘সুধীর হৃদয়ে সততই প্রেম পায় তার আশ্রয়।’ প্রেম হলো আধ্যাত্মিক ভ্রাতৃত্ব আর কেবল যথার্থ সুধীর প্রকৃতির মানুষই ভালোবাসার উপযুক্ত।

দান্তের দ্বিতীয় উদাহরণটি আঁদ্রে লু শাপলাঁ-র একটি প্রবাদের অনুরণন, দান্তে বলেন: ‘প্রেম ছাড়ে না প্রেমের রেহাই এমনকি প্রেমিক মজনুর প্রতিও।’ প্রেম প্ররোচিত করে, এমনকি মৃত্যুতেও, অব্যাহতি দেয় না, তার আনন্দে নিমজ্জিত করে। তাকে অস্বীকার করা উদার মনের পক্ষে অসম্ভব। ফ্রান্সেসকার কথা শুনে ও তাদের সাধু প্রেমের পরিণতি দেখে দান্তের মন বিষাদাক্রান্ত হয়ে ওঠে, তিনি বলেন, ‘হে ফ্রান্সেসকা, তোমার করুণ দশায় সমবেদনাতে ঝরছে আমার চোখের জল।’ এরপর তাদের প্রেমের স্বরূপ সম্বন্ধে ফ্রান্সেসকার মুখে বিস্তারিত শুনে দান্তে হয়ে পড়লেন অজ্ঞান। প্রেমের প্রতি দান্তে সহানুভূতিশীল ছিলেন বলেই তাকে খ্রিস্টীয় মাহাত্ম্য দিয়েছিলেন তিনি, সহানুভূতি দেখানোর জন্যই এই ঘটনার অবতারণা করেছেন।

দান্তে প্রভাবিত হয়েছিলেন প্রভাঁসীঁয় সাহিত্যে, এবং সম্ভ্রান্ত প্রেমধারণায়। চারণিক ত্র’বাদুর কবিদের প্রভাঁসীয় কথ্যভাষায় লেখা পদাবলি বিষয়ে জ্ঞানার্জন করেন তিনি। ফরাসি ভাষায়ও অধিকার ছিল তাঁর। তাঁর আরেক গুরু ছিলেন সুপণ্ডিত ও রাজপুরুষ ব্র’নেত্তো লাতিনি যিনি একসময় স্পেনে কাস্তিলেন দরবারে রাষ্ট্রদূত ছিলেন। সেখানে থাকাকালে মুর সভ্যতা ও আন্দালুস রচনা-বিষয়ে তিনি জ্ঞানার্জন করেন এবং তাঁর মাধ্যমেই হয়তো প্রেমের শরীরী ও আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে দান্তে অবহিত হন। প্লাতোনের সিম্পোজিয়াম-এ শরীরী সৌন্দর্য থেকে প্রেমের উৎপত্তিবিষয়ক ধারণা তার নতুন জীবন রচনায়ও পরিলক্ষিত হয়। আমরা আগে উল্লেখ করেছি, তিনি বলেছেন, প্রেমকে তিনি দেহী, প্রেমিকাকে শরীরী, এমনকি মানুষের মতোই মনে করেন। শরীরী ভাবাতেই প্রেমিকাকে নিজের কথা ঠিকভাবে বোধগম্য করার আকাক্সক্ষাতে নিজ মাতৃভাষায় পদরচনার কথা তিনি বলেন, কারণ লাতিন কবিতা নারীদের কাছে দুর্বোধ্য ছিল আর তা দিয়ে আর যা-ই হোক প্রেমের কথা বলা যায় না। এবং পরে যখন তিনি পরিত্রাণের উপায় হিসেবে বেয়াত্রিচে নামক মাতৃমূর্তির আবিষ্কার করেন তখন প্রেমিক ও সুভদ্রা নারীর সম্পর্কের প্রকৃতিকে পরিবর্তন করে ফেলেন তিনি। বেয়াত্রিচে হলো প্রেম এবং মহানুভবতা। একাধারে আদর্শিক ও স্বর্গীয়। বেয়াত্রিচে প্রেমিকা থেকে পরিণত হন সাধ্বীতে। এটা আধুনিক নয়, যেহেতু তা স্বর্গীয়, তা মাতা মেরির প্রতীকী ব্যঞ্জনায় পরিণত। কারণ বেয়াত্রিচেকে বোঝাতে দান্তে ‘আমার নারী’ শব্দটি ব্যবহার করতেন যা অবশেষে ‘আমার দেবী’ বা ‘আমার ঈশ্বরী’ হিসেবে দেখা দেয়।

নবীন- প্রবীন লেখীয়োদের প্রতি আহ্বান: সাহিত্য সুহৃদ মানুষের কাছে ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, রম্য রচনা সহ সাহিত্য নির্ভর আপনার যেকোন লেখা পৌঁছে দিতে আমাদেরকে ই-মেইল করুন [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড