খোরশেদ মুকুল
‘ছড়া মানেই ধ্বনিময়তা ও সুরঝংকার, অর্থময়তা নয়’ এই নীতি থেকে বেরিয়ে আসার যে ধারা প্রবহমান, তাকে আরও বেগবান করবে ‘বেলা তখন তিনটা’ ছড়াগ্রন্থটি। একসময় ছড়াকে শিশুসাহিত্য হিসেবে ধরে নিয়ে মূল সাহিত্য থেকে আলাদা করার যে প্রবণতা ছিল তাও আজ অনেকটা দূরীভূত। এর কারণ মূলত অর্থময় ছড়ার ছড়াছড়ি। যাকে সার্থক করতে এগিয়ে এসেছে ফরহাদ আরিফদের মতো প্রতিশ্রুতিশীল-নিরলস লেখকরা।
‘বেলা তখন তিনটা’ লেখকের প্রথম ছড়াগ্রন্থ । নামের মধ্যেই এক ধরনের টান অনুভূত হয়। দুপুর এবং বিকেলের মোহনা। অদ্ভুত সময়। প্রশান্তির প্রথম পরশ। যদিও লেখক শীতের দিনে সূয্যিমামার দেরিতে উঠার লগ্নকে বেলা তখন তিনটা বলেছেন। তবুও এসবকিছু ছাপিয়ে পুরো গ্রন্থটা পড়লে সামগ্রিক যে একটা অর্থ দাঁড়ায় তা একজন সচেতন পাঠক মাত্রই বুঝতে পারবে। প্রকৃতি, প্রেম-ভালোবাসা, দেশপ্রেম, সামাজিক অসংগতি, জাতীয় উন্নয়নের জন্য আহবান এবং কিছুটা বিপ্লব পরিলক্ষিত হয় বেলা তখন তিনটা'য়। ছড়াকে মাধ্যম ধরে তিনি কিছু ছন্দিত ছবি এঁকেছেন৷যা আমাদের বাস্তব জীবনেরই প্রতিচ্ছবি।
মানুষের মূল্যবোধ হারিয়ে যাওয়ার কারণে অবিশ্বাসের বিষ-বাষ্প ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। এতে নষ্ট হচ্ছে ভ্রাতৃত্ব৷ উঠে যাচ্ছে পরস্পরের প্রতি পরস্পরের বিশ্বাস। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে সবাইকে এক স্বপ্নজালে আবদ্ধ হবার আহবান জানান প্রথমেই-
‘এক হবো আজ স্বপ্নজালে কতই রঙিন আশা, বিশ্বটাকে গড়বো তুলে শান্তি-সুখের বাসা।’ (এক হয়ে যাই)
দ্বিতীয় ছড়াটির নাম আমার গ্রাম। প্রথম আর দ্বিতীয় ছড়ার নাম মিলিয়ে পড়লে হয় -এক হয়ে যাই আমার গ্রাম। গ্রামের যে অপরূপ সৌন্দর্য উঠে এসেছে তাকে যদি শান্তির প্রতীক হিসেবে ধরি তাহলে একটি সার্থক ছড়াক্রম দাঁড়িয়ে যায় এখানে। সবাই এক হয়ে শান্তিতে বসবাস করি। যা লেখকের দূরদৃষ্টির পরিচয় বহন করে। লেখকের ভাষায়-
‘আমার গ্রামে মুক্ত পাখির নীরব পরিবেশ, দূর করে দেয় এক নিমিষে মনের সকল রেশ।’ (আমার গ্রাম)
বায়ান্ন এবং একাত্তর আমাদের প্রাণের আবেগ। যা যেকোনো লেখককেই আন্দোলিত করে। মনের সমস্ত আবেগ জড়িয়ে রচনা করে ভাষা এবং বিজয় নিয়ে । বাংলা ভাষা এবং বিজয় সুবাস ছড়া দু'টি তারই পরিচয় বহন করে। বাংলা ভাষার স্তুতি গাইলেন এভাবে-
‘এমন মধুর বাংলা ভাষা হৃদয় কাছে টানে, সত্যিই মহান ভাষা পেলাম মহান রবের দানে।’ (বাংলা ভাষা)
খাতা-কলমে উন্নয়নের ধোঁয়াশা ছড়িয়ে পড়লেও সচেতন চোখ তা কখনও এড়ায় না। ঘরে ঘরে হাহাকার শুধু একটা চাকরির জন্য যাতে কোনোরকমে জীবনযাপন করা যায়। কিন্তু চাকরি নাই, মেধাবীদের চাকরি নাই। অনেকেই এই বেকার জীবন সইতে না পেরে আত্মহননের পথও বেঁচে নেয়। বেকারদের জীবন সত্যিই দুর্বিষহ। বেকার জীবনের করুণচিত্র-
‘বেকার মানে ফাইলটা হাতে এদিক-ওদিক ছুটা, বেকার মানেই মনের জ্বালায় মুখটা ধুলায় লুটা।’ (বেকার জীবন)
প্রেম ভালোবাসা মানুষের সহজাত প্রভৃতি। আমরা চাইলেও এটাকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারি না। হয়তো ধরনে-করনে ভিন্নতা থাকতে পারে। কিন্তু বাদ দেয়া যায় না। কাব্যগ্রন্থ কিংবা ছড়াগ্রন্থ প্রকাশ হবে তাতে প্রেম-ভালোবাসা থাকবে না তা কি করে হয়? লেখক তো প্রেমেরই আধার। মানব-মানবীর প্রেম, স্রষ্টা-সৃষ্টির প্রেম থাকবেই। তুমি আমার ছড়ায় ছড়াকার প্রেয়সীর টোলপড়া হাসিতে মুগ্ধ হয়ে লেখেন-
‘তুমি আমার প্রেম-সোহাগী টোলপড়া এক হাসি, তুমি আমার ময়না পাখি তোমায় ভালোবাসি’
এছাড়া এই গ্রন্থে একটি ব্যতিক্রমী ছড়া হচ্ছে হচ্ছে মদিনার ফুল। যেখানে প্রিয়নবী (সা:) এর গুণগান গাওয়া হয়েছে, অনেকটা না'ত-ই বলা যায়। তিনি ছিলেন সমগ্র মানবজাতির জন্য আলোর দিশা। ধনী-গরীব কোনো ভেদাভেদ ছিল না তাঁর কাছে। লেখকের ভাষায়-
‘গরিব-ধনী সবার পাশে সদা ছিলেন যিনি, মানবজাতির সঠিক দিশা নিয়ে এলেন যিনি।’ (মদিনার ফুল)
পরিচ্ছন্ন প্রচ্ছদ, মার্জিত মুদ্রণ আর বত্রিশ পাতার বুক সাইজ ছড়াগ্রন্থ ‘বেলা তখন তিনটা’। ছন্দের বিনির্মাণ এবং সহজ শব্দের সার্থক প্রয়োগে ছড়াগ্রন্থটি ছড়াপ্রেমিদের মনের খোরাক মেটাতে সক্ষম হবে বলে মনে করি। এছাড়া চটুল তালের ভাষা এবং শব্দের ব্যবহারে গ্রন্থটি ছড়া জগতে নতুন ঢেউ তুলবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
ছড়াগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে দাঁড়িকমা প্রকাশন থেকে। একুশে বইমেলা-২০১৮। প্রচ্ছদ করেছেন ফকির আল মামুন। মুদ্রিত মূল্য ১৩৫ টাকা।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড