সাহিত্য ডেস্ক
অনেক বছর পর হ্যাঁ অর্ধযুগ পেরিয়েছে বটেই আবার এলাম বন্ধুদের সঙ্গে সেই শালবনে পিকনিকে, না কাউকে বুঝতে দেয়নি এখানে আমি আরো এসেছিলাম একবার... দুইবার... অনেকবার...
ঢাকায় বাসা থেকে বেরুবার সময় বউ বলেছিলো- শালবনে পৌঁছেই কিন্তু ফোন দিও... আমিও বলেছিলাম আচ্ছা দেবো ক্ষণ। তথ্য প্রযুক্তির এই এক বিড়ম্বনা সবাই সব খবর গরম-গরম পেতে চায়... আমার এখন আর বাসায় ফোনটা দিতে মন চাইছে না!
বন্ধুরা হৈ-হুল্লোড় করতে-করতে রিসোর্টের দিকে... আর আমার মনটা হঠাৎ নেচে উঠলো-মনে হলো- উদাম বুকে জেনো রঙিন প্রজাপতিরা নাচানাচি করেই যাচ্ছে... চিত্তের সেই এক অদ্ভুত সুড়সুড়িতে আমি পা বাড়ালাম শালবনে, স্মৃতির রোমন্থনে...
আমি খুঁজতে লাগলাম সমুদ্র সেচে মুক্তা আহরণকারী ডুবুরির মতো...পাচ্ছিলাম না... এক...দুই... দশ...পঞ্চাশ... একশ’ পেরিয়েও পাচ্ছিলাম না! আমার আচরণে অন্য পর্যটকরা কি ভাবছে সেদিকে আমার ভ্রুক্ষেপ নেই... আমি খুঁজছি...
কয়েকটা ড্রিংসের বোতল হাতে নিয়ে এসে একটা বালক শুধালো- স্যার ঠাণ্ডা খাবেন? যা, ভাগ বলে ওকে ধমকে উঠলাম ছেলেটা ভড়কে যেতেই তারপাশে থাকা অন্য একটা চকোলেট বিক্রেতা ফিসফিস করে ওকে বলছে- ‘দেখছসনা হালায় একখান পাগল, কি জানি খুঁজতাছে !’
তারপরও আমার বিরামহীন খুঁজে চলা... পাচ্ছি না, পাচ্ছি না কেন? দেখেতো মনে হয় না জায়গাটার বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়েছে! যা একটু বদলেছে সেতো শালগাছগুলো একটু লম্বা হয়েছে মাত্র ! আরে লম্বা হলেতো ওটা উপরে চলে যাওয়ার কথা... ঠিক তাইতো, তাহলে আবার পেছনের দিকে যাই, উপরের দিকে খুঁজলে ঠিক পেয়ে যাবো... যাই আবার পেছনের দিকেই যাই...
(রিং টোন)
না ফোনটা আর বেজে উঠার সময় পেলো না... বউয়ের ফোন বলে কথা, ধরি... হ্যাঁ, বলো মিতু, হ্যাঁ একটু আগে এসে নামলাম, ও সরি, এইতো এখনই তোমাকে ফোন দিতে যাচ্ছিলাম, ঠিক আছে সময় মতো খেয়ে নেবো... আচ্ছা রাখি।
আবার দেখিতো অনেকেরগুলোই পাচ্ছি... শুধু আমাদেরটা পাচ্ছি না! আমাদের বলতে আমার আর পরীরটা... তবে কি পরী তোমার মতো করেই, এখানে রেখে যাওয়া আমাদের স্মৃতিটুকুও হারিয়ে গেছে?
তা কি করে হয়... দেখি, আরেকটু খুঁজে দেখি... আরে ওইতো, এইতো সেই শালগাছ যার বুক চিঁড়ে লিখেছিলাম আমরা ‘অভি প্লাস পরী’! আমি পেয়েছি, হ্যাঁ পেয়েছি পরী, তোমার-আমার স্মৃতিটুকু পেয়ে গেছি... অনেকটা চওড়া হয়ে গেছে গাছের লেখাটা, সবাই পড়তে না পারলেও আন্দাজ করেই আমি খুব পড়ে নিতে পারছি... পারবো না কেন এই শালগাছটাতো এখন আমার কাছে স্মৃতিসৌধের মতো...
আমি স্মৃতি রোমন্থনে হারিয়ে গেলাম সেই অর্ধযুগ আগে... যখন শালগাছটার বুক ছিরে পরী, তুমি আমার নাম লিখলে, আর আমি লিখলাম তোমার নাম, তখন আমি আমাদের নামের মধ্যিখানে প্লাস চিহ্নটা লিখে শেষ করতেই বন বিভাগের এক কর্মী এসে কি নাজেহালটাই না করলো আমাদের, তখন তুমি কেঁদেই দিয়েছিলে!
অপমানের চেয়েও তোমার চোখে পানি দেখে তখন আমার খুনি হতে মন চেয়েছিলো, মন চেয়েছিলো লোকটাকে খুন করে ফেলি... তুমিতো আমার রগচটা স্বভাবটা তো জানতে, আমি কি করে বসি, ওটা ভেবেই আমাকে টেনে নিয়ে কেটে পড়লে ওখান থেকে।
জানো পরী, সেদিনের পরে আমি আর আসিনি এখানে... আজ অর্ধযুগ পরে এলাম অথচ, এসে বুঝতে পারছিনা কেমন লাগছে... হঠাৎ কেমন জেনো ভালো-মন্দের মিশ্রানুভূতি... একটু আগে যেমন উদাম বুকে প্রজাপতির উড়ো-উড়ি ছিলো ওটা এখন আর নেই, গায়েব হয়ে গেলো বেমালুম!
অভিমান হচ্ছে খুব, অনেক অভিমান... তুমি তো সিগারেট খাওয়া পছন্দ করতেনা, তাই ওটা ছেড়েছিলাম, আজ অভিমানী মনটা বড্ড সিগারেট খেতে চাচ্ছে... এই সিগারেটওয়ালা... এদিকে এসোতো দাও একটা সিগারেট, আরে যে কোনো ব্রান্ডের হলেই চলবে... দাওতো একটা সিগারেট...!
আমি সিগারেট জ্বালিয়ে একটা টান দিতেই খুশ-খুশ করে কেশে উঠলাম। আমার চোখে পানি এসে গেলো, দম বন্ধ হওয়া কাশির মধ্যে তোর মুখটা সামনে পরিষ্কার হয়ে জেনো ভেসে উঠলো- মনে পড়ে গেলো সেই রাগান্বিত চেহারাটা আর কানে বাজতে লাগলো তোর রণ হুংকার : ‘খবরদার একদম ধূমপান করবেনা। কি বিশ্রী গন্ধ রে বাবা! ফেলে দিয়ে মুখটা ভালো করে ধুয়ে এসো...’ আমি শুধালাম- কেনো? মুখ ধুতে যাবো কেনো? তুইতো আর আমাকে চুমু খাবি না, যে মুখ ধুতে হবে! দৃঢ়চেতার মতো পরী বললো- এখন চুমু খাইনা তাতে কি, একদিন যখন আমাদের ঘর হবে-সংসার হবে তখন...? আমি দুষ্টুমি করে বললাম তখন কী...? তুই বলেছিলি- ‘তখন মানে... তখন বুঝবে...।’
সিগারেটটা জ্বলতে-জ্বলতে হঠাৎ আঙ্গুলের কাছে এসে গেলো, আগুনের উত্তাপে আমি সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বুকের এক অজানা কোন থেকে দীর্ঘশ্বাস হয়ে মুখ ফুটে যে শব্দটি বেরুলো আমার সেটি হলো- ‘সংসার...’!
জানিস পরী, আমার এখন সংসার আছে, স্ত্রী আছে, আছে ফুটফুটে এক রাজকন্যা ! এক কথায় আমার দারুণ সুখি একটা পরিবার আছে।
তুই যদি দেখতিস আমাদের প্রেম-আস্থা-আর বিশ্বাস তাহলে রাগে আর হিংসায় তোর পিত্তি জ্বলে যেতো! জ্বলতই আমি নিশ্চিত... তুই যে কি পরিমাণ স্বার্থপর, অন্তত: আমার সেটি ভালো করেই জানা !
মনে আছে পরী? ওই যে- আমাদের দলে একটা নতুন মেয়ে এসেছিলো? সেই মেয়েটি, আরে আমাদের নাটকের দলের মেয়েটির কথা বলছি, যে খুব আহ্লাদী টাইপের ছিলো, কি জানি নাম ছিলো? ও হ্যাঁ, ‘তমা’। তমা’র কথা মনে নেই তোর? আমি একদিন তমা’কে তার নাক’টা খুব সুন্দর বলার পরে তুই রেগে গিয়ে ওর নাকটাই টিপে দিলি...! তারপর এ নিয়ে কতো কেলেঙ্কারি...
মনে আছে? আর সেই তুই যদি দেখতিস আমাদের এই সুখের সংসার-আমাদের প্রেম তাহলে...? পরী, তুই আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর খুব কষ্টকর ছিলো আমার দিনগুলো... তোর কথা তোর কবিতা তোর গান তোর আদেশ-উপদেশ এই সব স্মৃতি আমাকে কষ্ট দিতো... ভীষণ কষ্ট। তারপর সময়ের ব্যবধানে আমি প্রেমিক থেকে মানুষ হয়ে উঠলাম! জানিস, মানুষ হওয়ার প্রথম মন্ত্র দীক্ষাতেই তোর স্মৃতিগুলো ক্রমশ ঝাপসা করতে শিখে গেলাম!! বদলে গেলো আমার যাপিত জীবনের ধারা... সংসারি হলাম আমি বাস্তবেই সুখে আছি আজকাল আমি নিজেকেই বিশ্বাস করতে অবাক হয়ে যাই যে- আমি এক শুখি মানুষ ! মানুষ হলেই কষ্ট ভুলেই বেঁচে থাকা যায়! সত্যি কি যায়? তাহলে আজ এই শালবনে কেন আমি ফের রোমন্থনে? তোর স্মৃতিচারণে?
উফ এখানে কি মশা... আগে-তো এতো মশা দেখিনি জানিস পরী, মশাকে এখন আমার অনেক ভয়... অনেক বিষাক্ত গোখরা কিংবা পাগলা কুকুরের চেয়েও অনেক বেশি... না এখানে থাকা যাবে না দেখছি।
পরী, আমাদের শালগাছের এই স্মৃতিসৌধ ছেড়ে যেতে আমার মন চাইছে না। কিন্তু যেতে যে হবে, ওখানে রিসোর্টে যে শ্যামল, সবুজ, বিপুল আর হৃদয়েরা অপেক্ষা করছে... তারপর ঢাকায় ফিরে যাবো, ডুবে যাবো ফের নিত্য ছকে... আবার ভুলে যাবো, নইলে ভুলে থাকবো তোকে...
আচ্ছা পরী, তোর ওখানে কি আমাকে মনে রাখা কিংবা ভুলে থাকার কোনও সুযোগ আছে? নাকি বড্ড কড়াকড়ি ওদের? ফুঁসত পাস কি বিরহ বিলাসের? এই যে এখন আমি যেমন পাচ্ছি?
পরী, তুই ওখানে নিশ্চয়ই খুব ভালো আছিস? যদি ভালোই থেকে থাকিস তাহলে তোর গাওয়া সেই গানটি কি মিথ্যে হয়ে যাবে না? আরে ওই যে সেই গানটির কথা বলছি, গানের মুখটা হচ্ছে-
‘বন্ধু ওগো কি করে ভাবলে/ তুমি দূরে চলে গেলে আমি সুখে থাকবো?/’
পরী, বল না- ওখানে কি তুই খুব ভালো আছিস?
জানিস, তোকে নিয়ে আমার গাওয়া গানটাও আজ বড্ড ভুল প্রমাণিত হচ্ছেরে, আরে যে গানটি তোকে বার-বার শোনাতাম, বুঝতে পারছিস না কোন গান? দেখ আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি গানটির কয়েকটি লাইন-
‘ ও... যেটুকু সময় তুমি থাকো পাশে/ মনে হয় এ দেহে প্রাণ আছে/ বাকিটা সময় জেনো মরণ আমার / হৃদয় জুড়েই নামে অথই আঁধার.../’
আজকের বাস্তবতায় আমার নিজেকে বড্ড ভণ্ড মনে হচ্ছে, তা না হলে বেঁচে আছি কি করে...? তোর নিজেকে কি আমার মতোই মনে হচ্ছে... বল না? নাকি সুখেই আছিস? ওরা বুঝি তোকে এতটাই সুখে রেখেছে, যার জন্যে আমাকে ভাববার সময় টুকুও পাসনি এতকাল? আরে পাগলি, আমিতো চাই তুই ওখানে ভালো থাক, অনেক ভালো... কঠিন ভালো থাকিসরে। তোকে মনে না পড়লে আমিও ভালো থাকি ! আবার আমার তুমুল কষ্ট হয় তোর চলে যাওয়ার কথা মনে পড়তেই...
তখন দিন তিনেক আগেই টের পাচ্ছিলাম তুই হয়তো চলে যাবি... ভয়ে রক্তগুলো হিম-শীতল হয়ে যাচ্ছিলো আমার, কি যে করি, কার কাছে যাই...!
আজ থেকে বছর পাঁচেক আগেতো এখনকার মতো এতো বন্ধু ছিলো না আমার ! তাই সহযোগিতার জন্য তেমন কাউকে কাছে পেতে অনেকটা সময় লেগেছে...।
পরী জানিস, আজকালকার বন্ধুরা অনেকটাই গোছানো... তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে এদের যোগাযোগ অনেকটা সহজ বলতে পারিস!
অথচ, সেদিন আমাকে কি ভয়ঙ্কর ভাবেইনা আত্মসমর্পণ করতে হয়েছিলো মিরাকলের আশায়! যদি ফিরে আসিস...!
সেই তিনটে দিন নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে চেনা-স্বল্প-চেনা কতজনের কাছেইনা গেলাম একটু সাহায্যের আশায়... অনেকেই বিমুখ করেনি! বিমুখ করেছে শুধু সময়... সময়টাই আমাকে সময় দেয়নি তোকে ধরে রাখার !
আরে তুইতো জানিস না, সেদিন কাছের ও দূরের ছয়জন মানবিক মানুষের সঙ্গে মিলে ছিলো তোর ব্লাডগ্রুপ, একথা জানার পরে আমার যে কি আনন্দ হয়েছিলো যদি দেখতিস!
আমিতো জানতাম নারে পাগলি- একদিকে ডোনাররা ব্লাড দিচ্ছে তোর জন্য, অপরদিকে সুপার সনিক গতিতে পড়ে যাচ্ছে তোর ব্লাড প্লাটিলেট!
আমিতো এও জানতাম না যে, এডিস মশা কামড়ালে ডেঙ্গু জ্বর হয়, এতে ব্লাডপ্লাটিলেট কমে যায়, এসময় রোগীকে রক্তের এ অনুচক্র দিতে হয়!
আমরা সেদিন, ছয়-ব্যাগ রক্ত থেকে সাড়ে তিনঘণ্টা মধ্যে পেয়ে গেলাম এক-ব্যাগ অনুচক্র... ব্লাড ব্যাংক থেকে চিতার ক্ষিপ্রটায় মাত্র আধা ঘণ্টায় আমি এক-ব্যাগ অনুচক্র নিয়ে হাজির হলাম সেই ক্লিনিকে যেখানে তুই ছিলি, হয়তো আমার আশায় ছিলি...
আমিতো এসে ছিলামরে পাগলী, কিন্তু... ডাক্তার আমার মুখের ওপর বলে দিলো– ‘সো সরি, ইউ আর সো লেইট...’
জানিস পরী, সেই থেকে এখনো মাঝে-মাঝে আমার মস্তিষ্কে অনুরণন হয়- ‘সো সরি, ইউ আর সো লেইট...’ ‘সো সরি, ইউ আর সো লেইট...’ ‘সো সরি, ইউ আর সো লেইট...’
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড