• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৬ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

'চিত্রপ্রাণন'-এর চ্যাম্পিয়ন রাবেয়া রেহনুমা স্বর্ণার গল্প : বিভ্রম!

  সাহিত্য ডেস্ক

০১ ডিসেম্বর ২০২০, ২০:৪৯
'চিত্রপ্রাণন'-এর চ্যাম্পিয়ন রাবেয়া রেহনুমা স্বর্ণার গল্প : বিভ্রম!
'চিত্রপ্রাণন'-এর চ্যাম্পিয়ন রাবেয়া রেহনুমা স্বর্ণার গল্প : বিভ্রম!
নটরডেম নাট্যদলের আয়োজনে অনুষ্ঠিতব্য ফিফথ ন্যাশনাল আর্ট অ্যান্ড লিটারেচার কম্পিটিশনের স্টোরি-রাইটিং ইভেন্ট 'চিত্রপ্রাণন'-এর চ্যাম্পিয়ন হয়েছে হলিক্রস কলেজের রাবেয়া রেহনুমা স্বর্ণা। তার গল্প বিভ্রম জিতে নিয়েছে 'চিত্রপ্রাণন' প্রতিযোগিতার প্রথম পুরস্কারটি। এ আয়োজনের মিডিয়া পার্টনার ছিল দৈনিক অধিকার এবং অধিকার ডট নিউজ।
গল্পটি অধিকারের পাঠকদের জন্য পরিবেশন করা হলো...

বিভ্রম! আরেকটু বেঁচে থাকার জন্য নেয়া প্রতিটি নিঃশ্বাসের সাথেই দ্রুত গতিতে নাক মুখ দিয়ে পানি ঢুকে যাচ্ছে আরফান সাহেবের। মধ্যবয়স্ক মানুষটির মাথা কেউ যেনো বাথটাবের পানিতে চেপে ধরে, মেরে ফেলতে চাইছে। তবে কি অবসর জীবনের জন্য করা এতো দিনের সব কষ্ট বিফল হতে চলেছে? সম্পত্তির জন্যই কি এমন করছে কেউ? কে হতে পারে? দূর সম্পর্কের ফুফুর মাতাল ছেলে? আরফান সাহেবকে অনেক আদরে ফুফু লালন করেছিলেন বলে যাকে ঠাঁই দিয়েছেন? নাকি সদ্য প্রাক্তন স্ত্রী এত দিনের একসাথে থাকার সব স্মৃতি ভুলে শুধুমাত্র প্রতিশোধের জন্য তাকে মারতে চাচ্ছে? এতো এতো সম্পত্তি তবে কার হবে? নিঃসন্তান তিনি বংশহীন হয়েই মারা যাবেন? জীবনের শেষ মুহুর্তেগুলোও সম্পদ ও শত্রু নিয়ে ভেবেই যে তিনি হারিয়ে ফেলছেন সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। আসলে যার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য এগুলোকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে সে আর কি নিয়েই বা ভাববে মৃত্যুর আগে। তিনি শুনেছেন মৃত্যুর আগে নাকি পুরো জীবন চোখের সামনে একবার ভেসে ওঠে। তার জীবনে সম্পত্তি অর্জনের জন্য কষ্ট ছাড়া আর আছেই বা কি। বাকি যা আছে তা তিনি নিজেও মনে করতে চান না। কিন্তু এই মুহুর্তের স্মৃতির সাথে যে তার বড্ড মিল.....! এগুলো ভাবতে ভাবতেই শেষ নিঃশ্বাসের আগে টের পেলেন মাথার পেছনে হাতটির চাপ কমে আসছে। এতক্ষণ বহু চেষ্টা করেও পানি থেকে মাথা না বের করতে পারলেও শেষ জীবনী শক্তি দিয়ে এবার মাথা বের করতে সক্ষম হলেন। খুব জোরে ফুসফুসে হাওয়া ঢোকানোর চেষ্টা করতে করতেই নাক মুখ দিয়ে পানি পরতে লাগলো। ভয়াল জন্তুর ধাওয়া খেয়ে যেভাবে মানুষ নিঃশ্বাস নেয় সেভাবে প্রকান্ড নিঃশ্বাস নিচ্ছেন তিনি। নিঃশ্বাসের গতি খানিকটা স্বাভাবিক হয়ে আসলেই অপ্রকৃতস্থের মতো চারপাশে তাকাতে শুরু করলেন কে তাকে মারতে চাচ্ছিলো দেখতে। কিন্তু আশেপাশে কেউ নেই। এরমধ্যেই মনে পরলো বাথরুমে আসার সময় তো দরজা লক করে ঢুকেছিলেন তিনি। ছুটে গিয়ে দেখলেন দরজা এখনো বন্ধ। তারমানে ভেতরে আসা কারো পক্ষে সম্ভব না। তাহলে তার মাথা চেপে ধরলো কোন শক্তি? তিনি কি নিজেই ভুল ভাবছিলেন? তবে কি নিজে নিজেকে মেরে ফেলার মতো বিভ্রম হচ্ছে তার?!

অজস্র প্রশ্ন নিয়ে বাথরুম থেকে বের হলেন তিনি। বের হয়ে জামা বদল করে খাবার রুমে যেতেই দেখলেন তার পিএ নাফিস বসে আছে। অল্পবয়স্ক কিন্তু কর্মঠ এই ছেলেটিকে তার বেশ ভালো লাগে। স্বল্পভাষী, বিনয়ী, কাজে পটু এমন একজন মানুষ সাথে থাকলে কাজ বহুগুণ সহজ হয়ে যায়। প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে বিশ্বস্ত হয়ে উঠেছে সে। এই যুগে কাকেই বা সম্পত্তির বেলায় বিশ্বাস করা যায়। নাফিসকে তিনি এমন ভাবে বিশ্বাস করবেন নিজেও ভাবেন নি। প্রথম যেদিন ছেলেটা ইন্টারভিউ দিতে আসলো, কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া এতো বড় শিল্পপতির পিএর কাজ করতে পারবে কিনা বেশ সন্দেহ হচ্ছিল। কিন্তু ছেলেটার সাথে নিজের একটা অদ্ভুত মিল অনুভব হচ্ছিল তার। সেই টানেই চাকরিটা দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন কাজ না পারলে ছেঁটে ফেলবেন। কিন্তু ছেলেটি নিষ্ঠতা দিয়ে নিজের জায়গা করে নিলো। ঠিক যেভাবে এই বিশাল শহরে কষ্ট অর্জিত একটি জায়গা আরফান সাহেন তৈরি করে নিয়েছেন। নাফিসকে দেখলেই তাই নিজের প্রতিচ্ছবি মনে হয়। মনে মনে বললেন তিনি প্রায়ই ভাবেন, একদিন এই ছেলে অনেক উন্নতি করবে। নাফিস টেবিলে বসে ল্যাপটপে কাজ করছিলো, ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলতেই আরফান সাহেবকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিগ্যেস করলো, "স্যার, আপনাকে এমন বিপর্যস্ত লাগছে কেনো? গতকালও ঘুম হয় নি?" আরফান সাহেব বললেন, "না গতকাল রাতে ওষুধ খেয়ে বেশ ভালো ঘুম হয়েছে।" নাফিস আবার জিগ্যেস করলো, "তাহলে কি আবার ভোরে দুঃস্বপ্ন দেখেছেন?" তার কন্ঠে মিশে আছে উদ্বিগ্নতা। আরফান সাহেব উত্তর করলেন, "দুঃস্বপ্ন তেমন দেখিনি। কিন্তু মাত্র যা ঘটলো তার কোনো ব্যাখ্যা পাচ্ছি না।" "স্যার কি হয়েছে? মরিয়ম বললো আপনি বাথরুমে ছিলেন। কোনো খারাপ খবর এসেছে?" "না তেমন কিছুই হয় নি। কিন্তু...." আবার চিন্তায় হারিয়ে গেলেন আরফান সাহেব। নাফিস আবার জিগ্যেস করলো, "স্যার, আপনি ঠিক আছেন তো?" আরফান সাহেব নাফিসের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলেন অন্য কাউকে আজকের কথাগুলো বিশ্বাস করে বলা না গেলেও নাফিসকে বলা যায়। গত আট মাসের প্রায় সবই নাফিস জানে। তিনি বললেন, "মাত্র খুব অদ্ভুত একটা কান্ড ঘটলো। নতুন থেরাপিস্টের বলা 'ওয়াটার থেরাপি' নিচ্ছিলাম বুঝলে, এর মধ্যে কে যেনো আমার মাথা বাথটাবের পানিতে চেপে ধরলো। ভেবেছিলাম মরে যাচ্ছি। কিন্তু শেষ মুহূর্তে রেহাই পেলাম কিভাবে যেনো। অথচ ধাতস্থ হতেই দেখি বাথরুমে আমি একা, দরজাও ভেতর থেকে দেয়া। কি যে হলো বুঝলাম না।" নাফিস অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে জিগ্যেস করলো, "স্যার আবার বিভ্রম হচ্ছে আপনার? বাসায় তো মিরাজ, মরিয়ম, সাদেক চাচা, ফুলির মা ছাড়া বাইরের কেউ নেই। আমি তো এখানে বসে কাজ করছিলাম।" আরফান সাহেব ভাবতে লাগলেন আসলেই তো। মিরাজ রাতে মদ্যপান করে নির্ঘাত এখন মাতাল হয়ে ঘুমাচ্ছে। মরিয়ম সেদিনের মেয়ে এতো শক্তি ওর গায়ে থাকবে না। ফুলির মায়ের মতো ভীতু মানুষ তল্লাটে দুটো পাওয়া যাবে না। আর সাদেক চাচাকে তিনি ছোটো থেকে চেনেন, তিনি এমন কাজ কোনো ভাবেই করবেন না। রইলো নাফিস, নাফিস না থাকলে গত আট মাসের অস্বাভাবিক ঘটনা গুলোয় তিনি কখনোই একা সামলাতে পারতেন না। নাফিস ছিলো বলেই সম্ভব হয়েছে। এমনকি কাজের আয়ত্তের বাইরে গিয়ে দিনরাত তার যত্ন করেছে, থেরাপিস্ট, ডাক্তার কোনো কিছু বাদ রাখে নি। গত পরশু তার নতুন খোঁজা থেরাপিস্টই এই 'ওয়াটার থেরাপি' নিতে বলেছেন। প্রতিদিন সকালে উঠেই হালকা ঠান্ডা পানিতে মাথা ডুবিয়ে রেখে সকল চিন্তা ভাবনা ভুলে শান্ত হওয়ার জন্য। গতকাল এই থেরাপিতে বেশ শান্তিও পেয়েছিলেন। কিন্তু একদিন না যেতেই আবার এমন কান্ড। নাফিস আবার বলে উঠলো, "স্যার তাহলে নতুন থেরাপিস্ট দেখবো?" গত দেড় মাসে পাঁচজন থেরাপিস্টের তিনি বদলেছেন। তিনি জানেন তার প্রাক্তন স্ত্রী প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ইচ্ছে করে তাকে কষ্ট দিচ্ছে। শুধু প্রমাণ পাচ্ছেন না। নাহলে কোর্টের নোটিশ পাঠিয়ে দিতেন কবেই। কিন্তু এই থেরাপিস্টকে তার বেশ ভালো লেগেছে। আর নাফিসই বা কয়জনকে খুঁজবে। আরফান সাহেব তাই বললেন, "এখনই না। আর কিছু দিন চেষ্টা করে দেখি এই থেরাপিতে কিছু হয় কিনা।" নাফিস হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে চুপ হয়ে গেলো। এই ছেলেটি তাকে বেশ শ্রদ্ধা করে এবং তাকে নিয়ে অনেক চিন্তাও করে। গত আটমাসের ঘটনায় সবাই তাকে ভুল বুঝে দূরে সরলেও নাফিস এক মুহুর্তের জন্যও অবিশ্বাস করে নি। রাতের ঘুমের সময় বাদে সর্বক্ষণ সাথে ছিলো। এর মধ্যেই মরিয়ম টেবিলে সকালের নাস্তা রেখে গেলে দুজন নিঃশব্দে নাস্তা করে নিলো।

নাস্তা শেষে আরফান সাহেব তৈরি হয়ে নাফিসকে নিয়ে চললেন অফিসে। যদিও তার মাথায় সর্বক্ষণ শুধু সকালের ঘটনাটাই ঘুরছে। সারাদিন তাই কাজে মন দিতে পারলেন না তিনি। এই আট মাসে তার কাজের বেশ ক্ষতি হয়েছে। সমস্যাটার শুরু হয় দুঃস্বপ্ন দিয়ে। প্রতি রাতে অতীত নিয়ে দেখা স্বপ্নগুলোর জন্য তিনি ঘুমাতে পারতেন না। রাতে জেগে বসে থাকতেন। কখনো ঘুমের মধ্যে চিৎকার করে উঠতেন। এরপর শুরু হলো বিভ্রম হওয়া। রাতের অন্ধকারে কারো ছায়া দেখতে পেতেন। কখনো আয়নায় বিভৎস কথা লেখা থাকতো, কিন্তু কাউকে ডেকে দেখাতে গেলে লেখা গায়েব হয়ে যেতো। একবার তার মদের গ্লাসে রক্ত লাগানো ছিলো। স্ত্রীকে দেখানোর জন্য ডেকে আনতে গেলেন। এসে দেখলেন গ্লাস একদম পরিস্কার হয়ে আছে। নিজেকে পাগল মনে হওয়ায় তার আচরণ রূঢ় হয়ে উঠতে লাগলো। তার স্ত্রী প্রথম প্রথম তাকে শান্ত করার চেষ্টা করতেন কিন্তু তার দুর্ব্যবহারের কারণে স্ত্রী সহমর্মিতা দেখানো ছেড়ে দিলো। প্রথম চারমাসের পর স্ত্রী তাকে পাগল বলে ডিভোর্স নেয়ার চেষ্টা করে। তার ধারণা, বাজে ব্যবহার এবং মহিলা ব্যবসায়িক অংশীদারের প্রতি দুর্বলতার প্রতিশোধ নিতেই তার স্ত্রী পরিকল্পনা করে তাকে পাগল প্রমাণ করার চেষ্টা করছে। তার এ পরিকল্পনা কোনো ভাবেই তিনি সফল হতে দেবেন না। সন্ধ্যায় বাসায় পৌঁছে আরেকবার ওয়াটার থেরাপি নিতে বাথরুমে ঢুকলেন তিনি। ভেতর থেকে দরজা আটকিয়ে ভালো করে দেখে নিলেন। ভাবলেন এখন আর কিছু হওয়ার সুযোগ নেই। বাথটাবে ধীরে ধীরে পানি ভরতে লাগলো। শুধু মাথা ডুবিয়ে রাখার বদলে তিনি পুরো শরীরে বাথটাবে নেমে গেলেন৷ শুধু মাথা বাইরে রেখে গা এলিয়ে শরীরকে শিথিল করার চেষ্টা করতে লাগলেন। সারাদিনের চাপের পর তার শরীর ও মন শান্ত হয়ে আসতে লাগলো৷ চোখ বন্ধ করেছিলেন তিনি। পরের নিশ্বাস নিতে গিয়েই তার নাক মুখ দিয়ে পানি ঢুকতে শুরু করলো। আবার কেউ তার মাথা পানিতে চেপে ধরেছে। সকালের মতোই কেউ তাকে মেরে ফেলতে চাইছে৷ গত আট মাসে অসংখ্য অস্বাভাবিক কান্ড ঘটলেও কেউ তাকে মারতে চায় নি। তিনি সর্বশক্তি দিয়ে উপরে উঠে আসার চেষ্টা করলেও পারছেন না। যখন শেষ নিঃশ্বাসটা ফেলবেন ঠিক তখনই সেই হাত তার মাথা ছেড়ে দিলো। তিনি আরেকদফা বেঁচে গেলেন। শুধু মাথাটা ভাসিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলেন। শ্বাস প্রশ্বাস খানিকটা ঠিক হতেই দ্রুত বাথটাব থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে পরে গেলেন। তাও পানি থেকে দূরে সরে আসতে পেরেছেন বলে ভয় খানিকটা কমে আসলে আশেপাশে তাকিয়ে কে তাকে মারতে চাইছে দেখতে চাইলেন। কিন্তু না কেউ নেই। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলেন দরজা দেয়া। তবে কি আবার বিভ্রম হচ্ছে? অতীত কি তাকে বেঁচে থাকতে দেবে না? তিনি নিজেই কি নিজেকে মারছেন? না এবার কোনোভাবেই বিভ্রম হতে পারে না। আর কয়েক সেকেন্ড পর তিনি মারা যেতেন৷ এগুলো কখনোই বিভ্রম না। কেউ একজন তাকে নিয়ে খেলছে। কিন্তু কে এবং কেনো?!

সারারাত প্রাণভয়ে নির্ঘুম কাটালেন তিনি। সকাল হতেই নাফিসকে কল দিয়ে দ্রুত আসতে বললেন। আধ ঘন্টার মধ্যে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলো নাফিস, "স্যার এতো জরুরী বলে ডেকেছেন, কিছু হয় নি তো? আপনি সুস্থ আছেন?" আরফান সাহেব উত্তেজিত হয়ে বললেন, "নাফিস এটা বিভ্রম না। কোনো ভাবেই বিভ্রম হতে পারে না। কেউ একজন আমাকে মেরে ফেলতে চাইছে। তোমাকে আমাকে বিশ্বাস করতেই হবে। সবাই আমাকে পাগল ভাববে কিন্তু আমি জানি তুমি আমাকে অবিশ্বাস করবে না। গতকাল রাতেও সকালের মতো হয়েছে। আমি জানি এটা অসম্ভব দরজা বন্ধ রুমে কারো ঢোকা। কিন্তু এমন হচ্ছে। বাথরুমে থেকে এসে বিছানায় এই নোটটা পেয়েছি দেখো।" চিরকুটটিতে লেখা রয়েছে "সময় শেষ!" আরফান সাহেব ভয়ার্ত গলায় আবার বলে উঠলেন, "নাফিস তুমি আমার ছেলের মতো। আমার সাথেই থাকবে এখন থেকে এ বাড়িতে। সারা বাড়িতে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানোর ব্যবস্থা করো। আমি যে পাগল না তোমার ম্যাম যে ইচ্ছে করে এটা করছে সবাইকে তার প্রমাণ দিবো আমি।" নাফিস উত্তরে বললো, "স্যার আপনি আগে শান্ত হয়ে বসুন। আমি আপনার সাথেই থাকছি। আজ রাতেই সবাই বুঝবে আপনি বিভ্রমে নেই।" "ঠিক তো নাফিস? আমি বেঁচে থাকতে পারবো?" নাফিস উত্তর না দিয়ে মরিয়মকে ডেকে আরফান সাহেবকে চা দিতে বললো। "স্যার আপনি একটু বিশ্রাম নিন, পারলে একটু ঘুমিয়ে উঠুন। আমি সবকিছুর বন্দোবস্ত করে আসি।" আরফান সাহেব কোনো কথা না বলে চায়ের কাপ হাতে নিলেন। চায়ের স্বাদ কেমন তেঁতো ঠেকলো। গত কদিনে কিছুই আসলে ভালো লাগছে না। তেঁতো চা টুকুই খেয়ে নিলেন। বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতেই পরম আরামে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসলো। ঘুম ভাঙলে তিনি নিজেকে খুঁজে পেলেন একটা স্যাতস্যাতে নোংরা রুমে একটা চেয়ারের সাথে বাঁধা অবস্থায়!

আধাঘন্টা ধরে চেয়ার থেকে নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেও না পেরে নিস্তেজ হয়ে বসে আছেন এখন। হঠাৎ করে ক্যাচক্যাচ করে দরজা খোলার শব্দ হলো। বোঝাই যাচ্ছে বহুদিন ধরে অব্যবহৃত বলে দরজায় জং পরে গেছে। তারমানে এ রুমটিও খুব বেশি ব্যবহার হয় না। তাই এমন বোটকা গন্ধ। দরজা খোলার শব্দ হলো যেদিক থেকে আরফান সাহেব সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। দীর্ঘক্ষণ অন্ধকারে থাকায় দরজা খোলায় বাইরে থেকে আসা আলোয় চোখে সইতে সময় লাগছে। তিনি দেখলেন দরজা দিয়ে একজন মানুষ ঢুকছে। ছিমছাম অবয়ব। মানুষটি ভেতরে ঢুকে দরজা আটকে দিলো। তারপর ধীরে পায়ে হেঁটে সামনে এগোতে লাগলো। কাছে আসতে আরফান সাহেব দেখতে পেলেন মানুষটি মুখে মুখোশ পরা। লোকটি কাছে এসে আরফান সাহেবের মুখে বাঁধা কাপড়টি খুলে দিতে যাচ্ছিলো। কাপড় নামানো মাত্র তিনি জোরে বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার করতে শুরু করলেন। সামনে থাকা মানুষটি তার চিৎকার শুনে হাসতে শুরু করলো। হাসতে হাসতে বললো, "এখানে হাজার চিৎকার দিলেও কেউ শুনতে পারবে না।" লোকটির কন্ঠ আরফান সাহেবের খুব চেনা লাগলো। এতক্ষণ ভাবছিলেন তার প্রাক্তন স্ত্রী কোনো গুন্ডা ভাড়া করেছে। কিন্তু এ তো অতি চেনা কন্ঠ। তবে কি মিরাজ? তিনি বলে উঠলেন, "মিরাজ এটা কি তুমি? কিসের জন্য এমন করছো তুমি? সম্পত্তি? আমি সব লিখে দিচ্ছি আমাকে ছেড়ে দাও।" লোকটি বলে উঠলো, "আমি কে বাদ দিন। আমাকে নিয়ে মাথা বা ঘামালেও চলবে। বলুন তো, আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরি, সাথি মোদের ফুল পরি।" আরফান সাহেব তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, "তুমি কি আমার সাথে ফাজলামো করছো? বেঁধে রেখে গান গাইতে বলছো?" লোকটি আবার বলে উঠলো, "আহা বলুনই না। পরি তো আপনার খুব পছন্দ। আমি জানি, তাই না? পরির কথা মনে আছে তো?" হঠাৎ করে আরফান সাহেব একটা ধাক্কা খেলেন পরির নাম শুনে। তার অতীত জীবনের সবথেকে বড় কিন্তু গোপন অংশ সেটি। মিরাজের তো এটা জানার কথা না, তার স্ত্রীও জানেন না। তাহলে মিরাজ পরির কথা বলছে কিভাবে? তিনি ভয় লুকানোর চেষ্টা করতে করতে বললেন, "পরি? কে পরি? আমি কোনো পরিকে চিনি না।" লোকটি প্রতিত্তোরে বললো, "কি বলেন পরিকে চেনেন না? পরিকে ভুলে যাওয়া কি এতো সহজ? আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি।" বলে রুমে বাতি জ্বালিয়ে দিলো। পুরো রুমটি হঠাৎ আসা আলোয় উজ্জ্বল হয়ে গেছে। কিন্তু এ রুমের সাথে যে লুকিয়ে আছে এক বিভৎস অন্ধকার।

আরফান সাহেব ইলেকট্রিক বাতির জমাট বাঁধা আলোয় রুমটি বিস্ফোরিত চোখে দেখছেন। এই তো সেই রুম যেখানে তিনি....... তাকে চুপ করে থাকতে দেখে লোকটি আবার বলে উঠলো, "এখন মনে পরছে পরির কথা? নাকি আরো কিছু দেখাতে হবে?" আরফান সাহেব হতবুদ্ধি হয়ে লোকটির দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। লোকটি বললো, "মনে করতে এতোই কষ্ট হলে আমি একটু সাহায্য করি। ১২ বছর আগের কথা। আপনি তখন থাকেন আপনার ফুফুর বাসায়। আপনার ফুফু আপনাকে অতি স্নেহে রাখতেন। তাদের বাসায় কাজ করার জন্য পেছনে ছোট্টো টিনের ঘরে থাকতো একটি পরিবার। দুই ছেলে-মেয়ে, মা-বাবা। বাবা কেয়ারটেকার আর মা রাঁধুনির কাজ করতো আপনার ফুফুর বাসায়। ছেলে-মেয়ে দুটিকে মানুষ করাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো। ১৫ বছরের ভাই এবং ১৪ বছরের পিঠেপিঠি বোনের সম্পর্ক ছিলো প্রচন্ড দৃঢ়। বাবা-মায়ের কষ্ট কমাতে প্রায়ই বাবা-মাকে কাজে সাহায্য করতো তারা। মেয়েটির নাম ছিলো পরি৷ জন্মের সময় পরির মতো ফুটফুটে চেহারা দেখে বাবা-মা নাম রেখেছিলো পরি। সেই পরি প্রায়ই আপনার ফুফুর বাসায় কাজ করে দিতে যেতো। তখনই আপনার নজর পরে ছোট্ট মেয়েটির দিকে। পরির দিকে আপনার কুৎসিত ভাবে তাকানোর কথা পরি বলেছিলো তার ভাইকে। তার ভাই কথা দিয়েছিলো দু-একদিনের মধ্যে মাকে জানাবে সে কথা। কিন্তু তার আগেই পরি হঠাৎ হারিয়ে গেলো। বলুন তো পরি কোথায় গেলো?" আরফান সাহেব অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে বললেন, " তুমি মিরাজ না। মিরাজ তখন অনেক ছোটো, পরির কথা ওর মনে থাকবে না। কে তুমি? পরির কথা জানো কিভাবে?" লোকটি কোনো জবাব না দিয়ে আবার বলতে শুরু করলো, "পরি হারিয়ে যাওয়ার পর তাকে অনেক খোঁজা হলো। কিন্তু কোথাও তাকে পাওয়া গেলো না। খুব তোরজোর করে খোঁজার মতো ক্ষমতা বা টাকাও পরির বাবার ছিলো না। তাই মালিককে যখন অনুরোধ করতে গিয়েছিলো খোঁজ বাড়ানোর জন্য তখন আপনি পাশে বসে বলেছিলেন, "গরীব ঘরের মেয়ে। কোন ছেলের সাথে পালিয়ে গিয়েছে। ওকে খোঁজার দরকার নেই।" কিন্তু পরির ভাই পাশে থেকেই সব শুনছিলো। সে জানতো পরি কখনো এমন করতে পারে না। আপনার ফুফুর বাড়ির পেছনের বিশাল জংলা জায়গাটায় সে দ্বিতীয় দিন বোনকে খুঁজতে গেলো। অর্ধেক যেতে আপনার সাথে দেখা হতেই আপনি জন্তু আছে বলে তাকে জোর করে নিয়ে আসলেন। কিন্তু সে জানতো আপনি কিছু লুকাতে চাচ্ছেন। পরদিন কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে জংলা জায়গার শেষমাথায় জলাশয়ের পাশের ছোট্ট ঘরটা সে দেখতে পেলো। বাইরে থেকে দেয়া দরজাটা খোলার পর কি দেখলো জানেন?" বলে আরফানে সাহেবের দিকে তাকিয়ে দেখলো একবার। জবাবের অপেক্ষা না করেই বলতে লাগলো, "দেখতে পেলো তার আদরের ছোটো বোনটি বিবস্ত্র অবস্থায় একটা পুরোনো বালতিতে পানির মধ্যে উল্টে পরে আছে। কাছে গিয়ে বোনকে জাগাতে নাড়া দিতেই পরি মাটিতে পরে গেলো। বালতিতে থাকা পানি গড়িয়ে ঘরের মেঝে ভিজিয়ে দিচ্ছিলো। তার মধ্যেই ভাই দেখলো তার পরির নাক মুখ থেতলে আছে৷ রক্ত জমে আছে কপালে। সারা শরীরে অসংখ্য ক্ষত। অনেকবার ডাকার পরও সাড়া দিচ্ছিলো না পরি।" বলে একটু থামলো লোকটি, গলা যেনো কেঁপে উঠলো। সম্বিত ফিরে পেয়ে আবার বলতে লাগলো, "ছেলেটি তার বাবাকে ডেকে নিয়ে আসলো ঐ ঘরটায়। কিন্তু পরি আরো অনেক আগেই সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে। পরি কিছু না বলতে পারলেও, তাকে কে কেড়ে নিয়েছে জানার পরও ছেলেটি কিছু করতে পারছিলো না। আপনার ফুফুরা ঘটনা ধামাচাপা দিতে বললেন। পুলিশি খরচ গরিব বাবা পোষাতে পারবে না বলে। পরির বাবা এরপরও শেষ চেষ্টা করতে চাইলে আপনারা তাকে চোর বানিয়ে পুলিশে দিয়ে দিলেন। পরিবারটিকে শেষ আশ্রয় থেকে তাড়িয়ে দিলেন। কি আরফান সাহেব এবার পরির কথা মনে পরলো তো?" আরফান সাহেব প্রচন্ড ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে লোকটির দিকে। লোকটি আবার বলে উঠলো, "এই ঘরটা চিনতে পারছেন তো? এটা সেই ঘর যেখানে ৩ দিন ধরে পরিকে আপনি একটু একটু করে মেরেছিলেন। গত ৩ দিনে পানিতে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার অনুভূতি কেমন লাগছিলো বলুন তো? পরির কি এমনই মনে হচ্ছিলো?" তারপর একটা বালতি উঠিয়ে দেখালো এমন বালতিতেই ওকে ডুবিয়ে মেরেছিলেন না?" আরফান সাহেব এই ঘটনা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন। আট মাস আগে থেকে ঘটনা গুলোর জন্যই মনে পরছিলো। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও টের পান নি অন্য কেউ জানতে পারে। তিনি এতো বড় ধাক্কা নিতে পারছিলেন না। কাঁপা কাঁপা গলায় জিগ্যেস করলেন, "তুমি কে? এসব কিছু জানো কিভাবে?" লোকটি উত্তরে বললো, "আপনারা তাড়িয়ে দেয়ার পর পরিবারটিট কি হলো আপনারা অবশ্য খবর রাখেন নি৷ রাখবেন ই বা কেনো?! তা যাই হোক, জেল থেকে বের হয়ে মেয়ের শোকে পাগল হয়ে যাওয়া বাবা কোথায় গেলো কেউ বলতে পারে না। ছেলেটি মাকে নিয়ে আশ্রয় নিলো বস্তিতে। মেয়ে ও স্বামী হারানোর শোকে মা বেঁচে থাকার ইচ্ছা হারিয়ে ফেললেন। দুই বছরের মাথায় মারা গেলেন তিনিও। একটা খুব সুন্দর পরিবার নিঃশেষ হয়ে গেলো। বাবা-মা, আদরের বোন কেউই থাকলো না ছেলেটির। সেই ছেলেটি আমি," বলে মুখোশটি খুলে ফেললো লোকটি। "নাফিস!!!" বলে চিৎকার করে উঠলেন লোকটি। অত্যন্ত বিশ্বস্ত, তার প্রতিদিনের সঙ্গীই যে তাকে পাগল করে তুলছে টেরই পান নি তিনি। আরফান সাহেবকে বলতে না দিয়ে একনাগাড়ে বলতে লাগলো, "সব হারানো ছেলেটা একটু একটু করে নিজেকে গড়ে তুলেছে আজকের দিনের জন্য। গত সাড়ে তিন বছরে আপনার বিশ্বাস অর্জন, গত আট মাসে আপনাকে পাগল করে তোলা, খাবারে ওষুধ মিশিয়ে বিভ্রম তৈরি করা, থেরাপিস্টকে ওয়াটার থেরাপির কথা বলা প্রতিটা পদক্ষেপ বহু আগে থেকে ভেবে রাখা। জীবনের একমাত্র লক্ষ ছিলো একটি। আপনার বাথরুম সহ প্রতিটি রুমের চাবিই যে আমার কাছে এক কপি করে আছে ভুলে গেছেন আপনি। আমাকে ছাড়া সবাইকে সন্দেহ করেছেন। অবশ্য চায়ে ওষুধ মেশানোটা মরিয়ম করেছিলো স্বেচ্ছায়। আপনার জঘন্য দৃষ্টি থেকে বোবা মেয়েটিও ছাড় পায় নি বলে।" একটু বিরতি নিয়ে বললো, "আজকের তারিখটা আপনার মনে আছে? ১২ বছর আগে এই ৩ টে দিন পরি ঘুমোতে পারে নি, কষ্টে কষ্টে মরেছে। আপনাকেও এই ৩ দিন আমি ঘুমোতে দেই নি, মানসিজ কষ্টে আধমরা করে ফেলেছি। এবার শেষ ধাপ।" কথা শেষ করে বালতিটিতে আস্তে আস্তে পানি ভরতে শুরু করে নাফিস। তাকে পানি ভরতে দেখে ভয়ে চিৎকার করতে শুরু করে আরফান সাহেব। মৃত্যু ভয় তাকে পাগল করে ফেলেছে। আসন্ন সময়ের জন্য নিজেকে কোনো ভাবেই প্রস্তুত করতে পারছেন না। বালতিতে পানি ভরতে ভরতে হাত পা বাঁধা অবস্থায় চেয়ার থেকে ছাড়িয়ে মাটিতে ফেলে দিলো তাকে। ময়লা মেঝেতে গড়িয়ে তিনি দূরে সরতে চাইলেও তার যাওয়ার কোনো উপায় ছিলো না। নাফিস অত্যন্ত ধীর গতিতে আরফান সাহেবের মাথা বালতির পানিতে চেপে ধরলেন। তিনি সর্বশক্তি দিয়ে ওঠার চেষ্টা করলেও এবার আর রেহাই নেই। আরফান সাহেবের জীবনের শেষ মুহুর্তগুলোয় বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা নয় নাফিস তখন অন্য কিছু দেখছে। হঠাৎ তার কেনে বেজে উঠেছে খুব সুন্দর হাসির শব্দ। ঘরের কোণায় তাকিয়ে সে দেখতে পায়, ছোট্টো পরি খিলখিল করে হাসছে। নাফিস কি পরিকে দেখছে নাকি এ ও বিভ্রম!

'চিত্রপ্রাণন'-এর চ্যাম্পিয়ন রাবেয়া রেহনুমা স্বর্ণা
নবীন- প্রবীন লেখীয়োদের প্রতি আহ্বান: সাহিত্য সুহৃদ মানুষের কাছে ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, রম্য রচনা সহ সাহিত্য নির্ভর আপনার যেকোন লেখা পৌঁছে দিতে আমাদেরকে ই-মেইল করুন [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড