• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

স্মৃতি ও সত্ত্বায় সাংবাদিক ফখরে আলম

  তারিকুল ইসলাম মুকুল

০৪ জুন ২০২০, ১৭:৩৫
ফখরে আলম
ডান থেকে সাংবাদিক ফখরে আলম, গ্রামের কাগজ সম্পাদক মবিন ও লেখক তারিকুল ইসলাম মুকুল

ক্লান্ত-বিধ্বস্ত অনেকখানি। আইসিইউ আর এইচডিইউ মিলিয়ে ২২ দিনের হাসপাতালবাসে ছিলাম। ২৩ এপ্রিল ফজর নামাজের পর আমি জ্ঞান হারাই। আমার ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালান্স হয়ে গিয়েছিল। সাথে নিউমোনিয়া ও ডায়াবেটিস বেড়ে গিয়েছিল। এমনই এক সংকটজনক সময়ে ১৪ মে প্রিয়ভাই সাংবাদিক হারুন জামিল সেলফোনে আমার স্ত্রীকে জানালেন যশোরের কৃতি সাংবাদিক ফখরে আলম ভাই আর নেই।

পরিবেশ বুঝে আমার স্ত্রী খবরটি জানিয়েছিলেন। আমি তখনও বেশ অসুস্থ। সুতরাং প্রিয়জন ফখরে আলমের মৃত্যু সংবাদে পুণরায় নিস্তব্ধ হয়ে পড়ি। শারীরিকভাবে তখন কিছুটা সুস্থ থাকলেও মনের ভিতরে ঘুরপাক খেতে থাকে অনেক স্মৃতি।

অনেক কথা বারংবার উঁকি দিচ্ছিল মস্তিষ্কে। করোনাকাল না হলে হয়তো তাৎক্ষনিকভাবেই ছুটে যেতাম যশোরে। যেখানে তখন প্রিয় ফখরে ভাইয়ের নিথর দেহটি রাখা ছিল। যিনি আমার দীর্ঘদিনের আন্তরিক। সেইসব স্মৃতিকথা আমার মনকে ব্যাকুল করে তুলছিল। মাথার ভিতর সারাক্ষণ ঘুরপাক খাচ্ছিল তাকে নিয়ে কিছু লেখার। সেই ব্যকুলতা থেকেই এ প্রয়াস।

২০০০ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসের দিকে ফখরে আলম ভাইয়ের সাথে আমার সরাসরি প্রথম পরিচয় হয়। ওই বছর সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হওয়ার সময় আমি যশোরে ছিলাম। আমাদের প্রতিষ্ঠান আদ্-দ্বীন এবং আকিজ শিল্পগোষ্ঠী বন্যায় দুর্গত মানুষের জন্য যশোর, সাতক্ষীরা ও খুলনায় ব্যাপক ত্রাণ তৎপরতা চালায়। আমাদের প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক ও আকিজ শিল্পগোষ্ঠীর অন্যতম পরিচালক ডা: শেখ মহিউদ্দিন থেকে আদ্-দ্বীনের কর্মীরা রাত-দিন বন্যাপ্লাবিত দুর্গম এলাকার অসহায় মানুষের পাশে ছিলেন।

তখন থেকেই মূলত: ফখরে আলম ভাইয়ের সাথে গভীর সম্পর্ক হয়। আমি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নিয়মিত আমাদের সকল কার্যক্রম যশোরের সকল সাংবাদিকদের অবহিত করতাম। যশোরের প্রায় সব সাংবাদিকের সাথে আমার ছিল আন্তরিক সম্পর্ক এবং এখনও তা আছে। আমাকে সব সাংবাদিকই ভালোবাসতেন এবং সহযোগিতা করেছেন। আমি নিজে বন্যায় আমাদের সেবা সম্পর্কে লিখে সাংবাদিকদের দিতাম।

আজকের সাংবাদিক নেতা বাংলাদেশ প্রতিদিনের বিশেষ প্রতিনিধি শাবান মাহমুদ তৎকালীন যশোরের বিটিভি’র প্রতিনিধির মাধ্যমে যশোরের বহুল প্রচারিত দৈনিক গ্রামের কাগজের সম্পাদক মবিনুল ইসলাম মবিন ভাইয়ের মাধ্যমে আদ্-দ্বীন ও আকিজ শিল্প গোষ্ঠীর বন্যার্তদের সহযোগিতা সংক্রান্ত দারুন কাভারেজ দেন।

প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয় মবিন ভাই যশোরের সাংবাদিকদের সাথে পরিচয় করার ব্যাপারে অনেক সহযোগিতা করেছেন। তিনি নিজের গাড়িতে চড়িয়ে আমাকে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেতেন।

মবিন ভাইও আমার একজন আপনজন। তখন গ্রামের কাগজে আমার প্রচুর লেখা ছাপা হতো। বন্যা পরবর্তী আদ্-দ্বীন ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম নিয়ে ২০০০ সালের নভেম্বর মাসের শেষের দিকে যশোরের ১৫ রেলরোডে অবস্থিত আদ্-দ্বীন ট্রেনিং সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয়। এই প্রথম প্রায়ই সব মতের সাংবাদিককে এক জায়গায় করা হয়েছিল।

এ ব্যাপারে শ্রদ্ধাভাজন তৎকালীন ভোরের কাগজের ফখরে আলম, গ্রামের কাগজের সম্পাদক মবিনুল ইসলাম মবিন, ইত্তেফাকের ফারাজী আজমল হোসেন, ইনকিলাবের মিজানুর রহমান তোতা, দৈনিক সংবাদের রুকুনউদ্দৌলাহ, প্রথম আলোর অশোক সেন, যুগান্তরের কিরণ সাহা, দৈনিক রানারের আহসানুল কবির বাবু, দৈনিক রানারের আমিনুর রহমান মামুন, দৈনিক জনকণ্ঠের সাজেদ রহমান, মুক্তকন্ঠের এসএম তৌহিদুর রহমানসহ অনেকে সহযোগিতা করেছিলেন।

প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, যশোরের সাংবাদিকদের প্রতি আমার ছিল অন্যরকম টান ও আন্তরিক ভালোবাসা। আমি নিজেও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ৫/৬ বছর সাংবাদিকতা ও লেখালেখি করেছি। আমি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়ায় সাংবাদিক সমিতির ১৯৯৭ সালে সাধারণ সম্পাদক ও ১৯৯৮ সালে সভাপতির দায়িত্ব পালন করি। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করার পর ঢাকার পল্টনে অবস্থিত দৈনিক যায়যায়দিনের শিক্ষানবীস অর্থনৈতিক রিপোর্টার হিসেবে কাজ করি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় আমি ফখরে আলম ভাইয়ের নাম শুনেছি। ভোরের কাগজে ভাইয়ের অনেক লেখা আমি পড়েছি। ফখরে আলম ভাইয়ের লেখার স্টাইলটাই আলাদা ছিল। তার ব্যতিক্রমধর্মী অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় আমি মুগ্ধ ছিলাম। তিনি যেকোন ঘটনা ঘটলে সরেজমিনে দেখতেন, শুনতেন এবং তা নিজের মতো করে লিখতেন।

ভাইয়ের লেখায় আঞ্চলিক কথ্য ভাষার ব্যবহার বেশি ছিল। ফখরে আলম ভাইয়ের সাথে ২০০০ সালের পর থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত আমার সাথে ছিল গভীর আন্তরিক সম্পর্ক। প্রায় দিনই টেলিফোনে কথা বলতাম। ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসে আমাকে আদ্-দ্বীন ফাউন্ডেশনের কর্পোরেট অফিস ঢাকার মগবাজারে বদলী করা হয়। স্থানান্তর হলেও ফখরে আলম ভাইয়ের সাথে নিয়মিত ফোনে যোগাযোগ করতাম।

যশোরে অফিসের কাজে গেলে ভাইয়ের বাসায় যেতাম। বাসায় গেলে ভাই তার বাড়ীর ছাদে দীর্ঘদিন ধরে পরিচর্যাকৃত বনসাইগুলো দেখাতেন। ভাই ছিলেন প্রকৃতি প্রেমিক। গাছ লাগাতে খুব ভালোবাসতেন। তিনি ২০১৫ সালে একটি বনসাই বটগাছ আমাকে উপহার দেন। যা তার কাছে দীর্ঘ ২১ বছর ছিল। ভাইয়ের গ্রামের বাড়িতে আমবাগান আছে।

ঢাকায় আসার পরও তিনি প্রতিবছর আমার জন্য আম পাঠাতেন। বিশেষ করে ভাইয়ের বাগানের আম্রপালি ছিল খুবই মজাদার। উনি সাধারণত এসএ পরিবহনে আম পাঠাতেন এবং না পাওয়া পর্যন্ত বার বার রিং দিতেন। ফখরে আলম ভাই অসুস্থ হয়ে পড়লে ২০১৯ সালে তার যশোর চাঁচড়ায় নিজস্ব বাড়ির ছাদে পরিচর্যাকৃত সকল বনসাই যশোরের পুলেরহাটে অবস্থিত আদ্-দ্বীন সকিনা মেডিকেল কলেজকে উপহার দেন। মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে ‘ফখরে আলম বনসাই’ নামে এখন সকলগাছ পরিচর্যা করা হচ্ছে এবং একজন শিক্ষককে বনসাই বাগানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, আদ্-দ্বীন সকিনা মেডিকেল কলেজ, পুলেরহাট, যশোরের স্থায়ী ক্যাম্পাসে ‘সাংবাদিক ফখরে আলম’ নামে একটি লেকচার থিয়েটার আছে, যা ওই কলেজ ক্যাম্পাস উদ্বোধনের দিন ২০১৬সালের ১৪ এপ্রিল তিনিই আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এটি ছিল একজন গুণী সাংবাদিককে তাঁর জীবদ্দশায় সম্মানিত করার আদ্-দ্বীনের একটি প্রচেষ্টা।

অসুস্থতা ও আমাদের সম্পর্ক :

ফখরে আলম ভাই ব্লাড ক্যান্সারের রোগী তা ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে নিশ্চিত হয়। এব্যাপারে ভাই নিজে আমাকে জানিয়েছিলেন। দোয়া চেয়েছিলেন, আমি দোয়া করেছি আমাদের সৃষ্টিকর্তা দুনিয়া ও আসমানের মালিক রাব্বুল আলামিন আল্লাহর কাছে তার সুস্থতার জন্য। ভাই ক্যান্সারের জন্য মূলত: ভারতে চিকিৎসা নিতেন।

প্রথমদিকে তিনি কলকাতায় টাটা মেডিকেল সেন্টারে ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডা: মনি চান্দি’র কাছে চিকিৎসা নিয়েছেন। পরবর্তী থেকে শেষ পর্যন্ত কলকাতায় এ্যাপোলো হাসপাতালে ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ অনুপম চক্রপানী’র তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা নিয়েছেন। আল্লাহর রহমতে শেষের দিকে তার শরীরে ক্যান্সারের উপস্থিতি প্রায় শূন্যে পৌঁছেছিল বলে ফখরে আলম ভাই নিজে আমাকে জানিয়েছিলেন।

ফখরে আলম ভাই যতবার চিকিৎসা নিতে ভারতে গিয়েছিলেন তার আগে আমাকে জানাতেন এবং দোয়া করতে বলতেন। ভারতে পৌঁছে আমাকে নিয়মিত তার অবস্থা ফোনে অবহিত করতেন। ভাবী সবসময় সঙ্গে যেতেন। উনি কখনো আমাদের কাছ থেকে কোন ধরণের হেল্প চাইতেন না। বরং প্রতিবারই ভারত থেকে চিকিৎসা শেষে দেশে আসার সময় আমার জন্য এবং আদ্-দ্বীন-এর নির্বাহী পরিচালক ডা: শেখ মহিউদ্দিন স্যারের জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসতেন।

ফখরে আলম ভাই আমাদের এতোটাই ভালোবাসতেন মুখ দিয়ে কোন কিছু বললে উনি তা যেকোন মূল্যে পূরণ করার চেষ্টা করতেন। ২০১৪ থেকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত ঢাকা থেকে যতবারই যশোরে গিয়েছি প্রায় ততবারই ভাইয়ের বাসায় দাওয়াত খেতে হয়েছে। দুপুরে বেশীর ভাগ ভাইয়ের বাসায় দাওয়াত থাকতো।

যশোরে আমরা অফিসের কাজে বেশি ব্যস্ত থাকতাম। যেতে দেরি হতো। উনি অসুস্থ মানুষ না খেয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করতেন এবং বার বার ফোন দিতেন। খাবারের অনেক আয়োজন করতেন। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি ও আদ্-দ্বীন হাসপাতালের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা: নাহিদ ইয়াসমিন আপা দুপুর ৩টার দিকে ভাইয়ের বাসায় গেলাম। দেরী হওয়াতে ভাই একটু কষ্ট পেলেন একই সাথে অনেক খুশিও হয়েছিলেন। ভাই আসলে আমাকে অনেক স্নেহ করতেন এবং আদ্-দ্বীনকে অনেক ভালোবাসতেন।

মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে ফখরে আলম ভাই অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু ২০১৮ সালের ১ এপ্রিল হঠাৎ প্রচন্ড মাথা ব্যাথা শুরু হলে যশোরের কুইন্স হাসপাতালে ভর্তি হন। এসময় তিনি চোখে দেখতে পাচ্ছিলেন না। ফখরে ভাবী আমাকে ফোন দিলে আমাদের আদ্-দ্বীন হাসপাতালের ডা: মিনহাজ ভাইকে কুইন্স হাসপাতালে পাঠানো হয়। ডা: মিনহাজ ভাই ফখরে আলম ভাইয়ের ক্লাসমেটও।

পরে ডা: মিনহাজ ভাইয়ের সাথে কথা বলে জানা গেল উনার দুচোখের ‘ভিশন’ চলে গেছে । এখন থেকে আর চোখে দেখতে পাবেন না। ভিসা থাকায় পরের দিন ২ এপ্রিল ভারতের চেন্নাইয়ে অবস্থিত ‘শংকর নেত্রালয় চক্ষু হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য চলে যান। কিন্তু দু:খজনক হলেও ভাইয়ের অবস্থা দেখে হাসপাতালে চিকিৎসকরা নিরাশ হয়েছিলেন। চোখের ‘ভিশন’ আর তিনি ফিরে পাননি। মহান আল্লাহ হয়তো তার নিয়তি এসবই রেখেছিলেন।

ছাত্রজীবনে ফখরে আলম ভাই বামপন্থী আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তার চিন্তা চেতনায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। তিনি নিয়মিত নামাজ পড়তেন।

মহান আল্লাহ’র ওপর ভরসা করতেন এবং সুস্থতার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন। তিনি আমুল বদলে গিয়েছিলেন। মানুষের মৃত্যু আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত। আল্লাহই ভালো জানেন আমরা কে কবে মারা যাবো। ফখরে আলম ভাইয়ের নিজের সহযোগিতায় চাঁচড়ার ভাতুড়িয়া গ্রামের বাড়িতে তৈরি মসজিদে নিয়মিত জুমার নামাজ আদায় করতেন। ভাবীর মাধ্যমে জানা গেছে, মসজিদের সকল নির্মাণ কাজ ভাই নিজ হাতে তত্ত্বাবধান করতেন।

দোষে গুণে মানুষ। ফখরে আলম ভাই মানবদরদী ছিলেন। অসহায়, ছিন্নমূল, দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে ভাই সবসময় ছিলেন। তার সাংবাদিক জীবনের লেখালেখিতে এরাই ছিল অনেকাংশ জুড়ে। সমাজের অনেক অসংগতি নিয়মিত তিনি কাগজের পাতায় তুলে ধরতেন। সমাজের সুবিধাবঞ্চিতদের কিভাবে মানব সম্পদে পরিণত করা যায়, তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটানো যায় সেই চিন্তায় স্বউদ্যোগী হয়ে অনেক কাজ করেছেন এবং তাদের নিয়ে চিন্তা করতেন, স্বপ্ন দেখতেন। যারা সমাজের সুবিধাবঞ্চিতদের নিয়ে কাজ করতেন তাদের পাশে তিনি সবসময় ছিলেন। তিনি ছিলেন গরীবের বন্ধু। মানুষের সমস্যা দেখলে তিনি কষ্ট পেতেন।

আদ্-দ্বীন ফাউন্ডেশন ও আকিজ শিল্প গোষ্ঠীর সাথে পেশাগত সম্পর্ক :

বেসরকারী অলাভজনক প্রতিষ্ঠান আদ্-দ্বীন এবং আকিজ পরিবারের সাথে সাংবাদিক ফখরে আলম ভাইয়ের ছিল হৃদ্যতাপূর্ণ এক অনন্য সম্পর্ক। তিনি ছিলেন আদ্-দ্বীন ও আকিজ পরিবারের একজন। আদ্-দ্বীন ও আকিজ শিল্প পরিবারকে নিয়ে অসংখ্য সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। আদ্-দ্বীন আকিজ শিল্পগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা মরহুম সেখ আকিজ উদ্দিন-এবং বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ একুশে পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক শরীফ হোসেন প্রতিষ্ঠা করেন।

বর্তমানে আদ্-দ্বীন এর ঢাকা, যশোর, খুলনা ও কুষ্টিয়ায় ৮টি হাসপাতাল, ৪টি মেডিকেল কলেজ, ৩টি নার্সিং ইন্সটিটিউট, ১টি নার্সিং বিএসসি কলেজ, ১টি উইমেন্স মেডিকেল টেকনোলজি ইন্সটিটিউটএবং খুলনা ও রংপুর বিভাগে সমন্বিত স্বাস্থ্য ও বিনিয়োগ কার্যক্রম চালু রয়েছে। এছাড়া আদ্-দ্বীন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড এবং আদ্-দ্বীন মাদার কেয়ার লিমিটেড নামে দুটি কোম্পানী রয়েছে। আদ্-দ্বীন দেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে কাজ করে।

আদ্-দ্বীন ও আকিজ পরিবার নিয়ে সাংবাদিক ফখরে আলম ভাইয়ের প্রকাশিত কিছু সংবাদের শিরোনাম :

“আদ্-দ্বীন কাজ করছে মা ও শিশুর জন্য” (ভোরের কাগজ, ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৯৯); ব্যবসার “জাদুকর সেক আকিজ উদ্দিন” (বিজনেস ক্যারিয়ার ম্যাগাজিন, যায়যায় দিন, ১৯ নভেম্বর ২০০৬) নিউজটি প্রকাশ করতে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেছিলেন তৎকালীন যায়যায়দিনের অর্থনীতি পাতার প্রধান সাংবাদিক মাসুদ রুমী; “আদ্-দ্বীন ভ্রাম্যমান চক্ষু অপারেশন ক্লিনিক : ৫ বছরে লক্ষাধিক মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিয়েছে” (যায়যায়দিন, ৩ ফেব্রুয়ারী ২০০৮); “আদ্-দ্বীনের স্বাস্থ্যসেবা গরিবের মুখে হাসি ফুটিয়েছে”(দৈনিক যায়যায়দিন, ৬ জুলাই ২০০৮); “অন্যরকম এতিমখানা:আদ্-দ্বীন শিশু কিশোর নিকেতন” (কালের কণ্ঠ, ২৫ মে ২০১০); “যশোরের এস এ এফ চামড়া কারখানা, বছরে তৈরি হয় ১০ লাখ জোড়া জুতা” (কালের কণ্ঠ, ২৯ জুন ২০১১); “মাহিলা চোরাচালানিরা এখন পাটকল শ্রমিক (শার্শায় অবস্থিত আকিজ জুট মিল সংক্রান্ত)” (কালেরকণ্ঠ, ১ জুলাই ২০১৪);

“গোলাপী রঙে রঙিন হচ্ছে চৌগাছা (চৌগাছার শিল্পপতি হাসানুজ্জামান রাহিন-এর প্রকল্পটি আদ-দ্বীনের নির্বাহী পরিচালক ডা: শেখ মহিউদ্দিন ফখরে আলম ভাইকে অনুরোধ করেছিলেন পত্রিকায় প্রকাশের জন্য।

উল্লেখ্য, হাসানুজ্জামান রাহিন কয়েক কোটি টাকা খরচ করে চৌগাছার গ্রামে গ্রামে দরিদ্র মানুষের জন্য ৫১৯টি গোলাপি রঙের পাকা বাড়ি তৈরি করে দিয়েছেন)” (কালের কণ্ঠ, ১০ অক্টোবর ২০১৫); “পোশাক কারখানা ঢাকা ছেড়ে গ্রামে” (কালের কণ্ঠ, ১৫ নভেম্বর ২০১৫); “সাহসী আকিজ উদ্দিনের উত্থানপর্ব, ফেরিওয়ালা থেকে ব্যবসার জাদুকর”, বাবার মুখের কথাই ছিল ব্যাংকের চেক : ডা: শেখ মহিউদ্দিন” (কালের কণ্ঠ, ৩ জানুয়ারী ২০১৬); “আদ্-দ্বীন সকিনা মেডিকেল এর স্থায়ী ক্যাম্পাস উদ্বোধন” (কালের কণ্ঠ, ১৬ এপ্রিল ২০১৬); “আদ্-দ্বীন সকিনা মেডিকেল কলেজে ফখরে আলম লেকচার থিয়েটার”( কালের কণ্ঠ, ১৭ এপ্রিল ২০১৬); “যশোরে আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর পরিবেশ বান্ধব ভবন, মুক্তশ্বরীর পাড়ে গ্রীণ বিল্ডিং” (আদ্-দ্বীন সকিনা মেডিকেল কলেজের ভবন সংক্রান্ত লেখা) (কালের কণ্ঠ, ১০ জানুয়ারী ২০১৭); “মেধাবী সাধনার পাশে আদ্-দ্বীন” (কালের কণ্ঠ, ২ জানুয়ারী ২০১৮); “আদ্-দ্বীন হাসপাতালে জরায়ুর বাইরে বেড়ে ওঠা নবজাতকের নিরাপদ প্রসব” (কালের কণ্ঠ ২৯ জানুয়ারী ২০১৭); “জাতীয় শোক দিবসে আদ্-দ্বীন হাসপাতালে বিনামূল্যে ৫০৪২ জনের চিকিৎসা” (কালের কণ্ঠ, ১৭ আগষ্ট ২০১৭); “১০ হাজার মানুষের চোখের ছানি বিনামূল্যে অপারেশন করবে আদ্-দ্বীন” (কালের কণ্ঠ, ২১ জানুয়ারী ২০১৮); “আদ্-দ্বীনে বিনামূল্যে প্রস্টেট সেবা পেল ৩০০ রোগী” (কালের কণ্ঠ, ৭ মার্চ ২০১৮) ইত্যাদি।

ফখরে আলম শ্রমিক বান্ধব সাংবাদিক ছিলেন। তিনি শ্রমিকদের দু:খ কষ্ট তুলে ধরতেন। বাংলাদেশের কুটির শিল্প “বিড়ি শিল্প” নিয়ে অনেক লেখালেখি করেছেন। এ শিল্পের ভারত ও বাংলাদেশের রাজস্ব পলিসি তুলে ধরেছেন। এ সংক্রান্ত কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত কয়েকটি লেখার শিরোনাম তুলে ধরা হলো: “উচ্চ শুল্কেয় বন্ধ ১২৫ বিড়ি কারখানা: ২৩ লাখ বিড়ি শ্রমিক বেকার” (কালের কণ্ঠ, ২৫ এপ্রিল ২০১১); “ভারতে বিড়িকে কুটির শিল্প ঘোষণা, শ্রমিক সুরক্ষায় ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার: কলকাতার থেকে ফিরে” (কালের কণ্ঠ ২৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৮); “ভারতের চেয়ে শুল্ক ১৮ গু বেশি: দেশে বন্ধ ১২৮ বিড়ি কারখানা”, কালের কণ্ঠ ৪ মার্চ ২০১৮; পশ্চিম বঙ্গে বিড়িকে কুটির শিল্প ঘোষণা, দুই বাংলায় শুল্কহার ব্যবধান অনেক” (কালের কণ্ঠ ৪ জুন ২০১৯) ইত্যাদি।

উল্লেখ্য যে, ফখরে আলম ভাই আদ্-দ্বীন এবং আকিজ পরিবারের প্রাতিষ্ঠানিক ও পারিবারিক অনুষ্ঠানে প্রায়ই আসতেন। অনুষ্ঠানে উৎসাহ ও উদ্দীপনামূলক বক্তব্য দিতেন। তিনি খুব আবেগ আপ্রুত হয়ে কথা বলতেন। যা আমাদেরকে অনুপ্রেরণা জোগাতো।

ফখরে আলম ভাই ছিলেন বহুগুণের অধিকারী। তিনি একই সাথে কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক। তার ২১ টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তার মধ্যে “মা সকিনা” অন্যতম । বইটির প্রথম প্রকাশ ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর, পরিমার্জিত সংস্করণ ২০১৪ সালের এপ্রিল এবং পরিমার্জিত তৃতীয় সংস্করণ ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে। বইটি বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিল্পপতি আকিজ শিল্পগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা সেখ আকিজ উদ্দিনের নামে উৎসর্গ করা হয়। ‘সকিনা খাতুন’ হলেন সেখ আকিজ উদ্দিনের সহধর্মিনী এবং আদ্-দ্বীন ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ডা: শেখ মহিউদ্দিনের মা।

বইটির ভূমিকায় সাংবাদিক ফখরে আলম লিখেছেন : “বাংলাদেশের অন্যতম ধর্ণাঢ্য ব্যক্তি কিংবদন্তি শিল্পপতি সেখ আকিজ উদ্দিনের সহধর্মিনী সকিনা খাতুন। স্বশিক্ষিত সকিনা খাতুন রত্নগর্ভা। পিছিয়ে পড়া গ্রামে বসবাস করেও নানা প্রতিকুলতার মধ্যে তিনি সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন। মানুষ করেছেন। অভাবের ঝড়-ঝাপ্টা থেকে সন্তানদের রক্ষা করেছেন। গৃহস্থ বাড়িতে ঢেঁকি পাড় দিয়েছেন।

কঞ্চি কেটে কলম বানিয়ে সন্তানদের হাতে তুলে দিয়েছেন। অন্যের মুখাপেক্ষী না হয়ে শাক-সবজির চাষ করে, হাঁস-মুরগি পুষে স্বাবলম্বি হয়েছেন। নিজের পাঁয়ে দাড়িয়েছেন। ১৯৩৯ সালে খুলনার অজপাড়াগাঁ মধ্যডাঙ্গায় জন্ম নিয়ে এই মহীয়সী নিজের আলোয় আলোকিত হয়ে ৫ সন্তানকে উদ্ভাসিত করেছেন। দুটির বেশি তিনটি শাড়ি কোনদিন পরতে পারেননি। রঙিন ঝলমলে মালা শাড়ি, টিস্যু শাড়ি তিনি চোখে দেখেছেন। কিন্তু হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। প্রেম, ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা আর সাহসকে পুঁজি করে সংগ্রামী এই নারী তাঁর স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করেছেন। মা হয়েছেন। এমনকি ‘বড় মা’ হয়েছেন।

সেই ‘বড় মা’র উৎসাহ, উদ্দীপনা আর বুদ্ধি পরামর্শে সেখ আকিজ উদ্দিন একের পর এক শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে ব্যবসা-বাণিজ্যের নায়ক হয়েছেন। ফখরে আলম লিখেছেন, অসাধারণ গুণবতী এই মহিলাকে নিয়ে আকিজ পরিবারের পক্ষ থেকে আমাকে একটি বই লেখার দায়িত্ব দেয়া হয়। আমি সকিনা খাতুনের সঙ্গে দিনের পর দিন কথা বলেছি। মন্ত্রমুগ্ধের মত তাঁর কথামালাকে সাজিয়েছি। তাঁর জীবনের গল্পকে উপস্থাপন করেছি। সকিনা খাতুনের মধ্যডাঙ্গা গ্রামে গিয়েছি।

প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলেছি। কথা বলেছি, তাঁর সন্তানদের সঙ্গে, ভালবাসার মানুষদের সঙ্গে। এভাইবেই ‘মা সকিনা’ গ্রন্থটির আত্মপ্রকাশ।” বইটির কৃতজ্ঞতা স্বীকারে আদ্-দ্বীনের নির্বাহ পরিচালক ডা: শেখ মহিউদ্দিন লিখেছেন : “ফখরে আলম একজন খ্যাতিমান কবি, লেখক ও সাংবাদিক। তাঁর সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের পরিচয়। তিনি আমাদের একজন সুহৃদ। একদিন কথায় কথায় মাকে নিয়ে তাঁকে একটি বই লেখার জন্য বলেছিলাম। কাজটি খুব কঠিন। কিন্তু তিনি আমার মায়ের সঙ্গে গভীরভাবে মিশে মায়ের জীবনগাঁথা প্রাণবন্ত করে বইটিতে ফুটিয়ে তুলেছেন। বইটি পড়ে আমরা মাকে নতুনভাবে আবিস্কার করেছি। জানতে পেরেছি অনেক অজানা কাহিনী। জানতে পেরেছি আমার মা-বাবার এক সঙ্গে পথ পাড়ি দেওয়ার সংগ্রামের সেই গল্প। সবার মা একই রকম। মায়ের অনুভূতিও একই রকম। মায়ের স্নেহ, ভালোবাসাও একই রকম। মহান সৃষ্টিকর্তা প্রত্যেক মাকে মায়ের মতোনই মমতাময়ী করে সৃষ্টি করেন।

ফখরে আলম তিনিও আমার ভাই। মায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ট হওয়ার পর তিনি আমার মাকে মা বলেই ডাকেন। এজন্য আমি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ। সংগ্রামের আরেক নাম আমার মা। শিশুকাল থেকেই তিনি মাতৃহারা। সৎ মায়ের কাছে মানুষ। পোড় খাওয়া তাঁর জীবন। দারিদ্রতার যাতাকলে পিষ্ট হয়েও তিনি ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে, রাক্ষুসে অভাব কোন কিছুই মাকে দমাতে পারেনি। আমাদের পাঁচ ভাই বোনকে তিনি স্নেহ মমতায় যেমন আগলে রেখেছেন, তেমনি স্বপ্নও দেখাতে শিখিয়েছেন।

অন্ধকার এক গ্রামে বসবাস করে শত বাধা ডিঙিয়ে মা আমাদেরকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। প্রকৃত মানুষ হওয়ার দীক্ষা দিয়েছেন। এই বইটি পড়লে আমাদের দেশের মেয়েরা মায়ের প্রকৃত রূপ খুঁজে পাবেন। আমার মায়ের এই জীবন উপন্যাসের রচয়িতা ফখরে আলমের প্রতি আমি এবং আমাদের পরিবারের সবাই কৃতজ্ঞ।”

‘মা সকিনা’ বইটি ফখরে আলম ভাই ২০১৩ সালের জানুয়ারীতে লিখতে শুরু করেন। বইটি লিখতে তাকে ব্যতিক্রম কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়েছে। অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। সেখ আকিজ উদ্দিনের গ্রামের বাড়ি খুলনা জেলার ফুলতলা উপজেলার বেজেরডাঙ্গার মধ্যডাঙ্গা গ্রামে গিয়েছেন। একজন ক্যামেরাম্যান, একজন মহিলা সাংবাদিককে সাথে নিয়ে যেতেন। যতবার সকিনা খাতুনের কাছে গিয়েছেন, অনেক ফল-ফলাদি ও মিষ্টি নিয়ে যেতেন। বইটি পড়ে যশোর জেলার তৎকালীন জেলা প্রশাসক ডা. কবীরের সহধর্মিনী মিসেস রুনা লায়লা মা সকিনা খাতুরে যশোরের ক্যান্টনমেন্ট বাসায় গিয়ে তাঁকে ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। অনেক সময় তাঁর সাথে সময় কাটান।

সংক্ষিপ্ত জীবনি :

ফখরে আলম ১৯৬১ সালের ২১ জুন যশোরে জন্মগ্রহণ করেন। মা রওশনআরা বেগম গৃহিনী। বাবা শামসুল হুদা ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। ১৯৭৭ সালে যশোর জিলা স্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৭৯ সালে সরকারি এমএম কলেজ থেকে এইচএসসি, ১৯৮১ সালে ঐ কলেজ থেকে তিনি বিকম পাশ করেন। ১৯৮৩ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি হিসাব বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।

সাংবাদিকতা :

ছাত্রজীবনেই তিনি সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৮২-৮৩ সালে ইত্তেফাক গ্রুপের সাপ্তাহিক ‘রোববার’ পত্রিকায় প্রতিবেদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯১ সালে দৈনিক আজকের কাগজের যশোর জেলা প্রতিনিধি পদে যোগ দিয়ে পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাকে বেছে নেন।

এরপর দৈনিক ভোরের কাগজ, দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকা, দৈনিক মানবজমিন, দৈনিক জনকণ্ঠ, দৈনিক আমাদের সময়, দৈনিক যায়যায়দিন ও দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায় ১৯৯২ সাল থেকে স্টাফ রিপোর্টার, সিনিয়র রিপোর্টার, বিশেষ প্রতিনিধি পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। ফখরে আলম দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মানুষের সমস্যা-সম্ভাবনা নিয়ে দীর্ঘ ২৯ বছর ধরে কাজ করেছেন।

তিনি এই অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলির অনুসন্ধান করে সংবাদ পরিবেশন করেছেন। গড়ে প্রতিমাসে তার ৩০টির বেশি নিজস্ব প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। কৃষি বিষয়ক সাংবাদিকতা কৃষি বিষয়ক সাংবাদিকতায় ফখরে আলম বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তিনি দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের ধান, ফুল, ফল, মাছ চাষ নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করেছেন। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার মহেশ্বরচান্দা গ্রাম ও কৃষি বিপ্লবের নায়ক ওমর আলীকে নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লিখে দেশজুড়ে সাড়া জাগিয়েছেন।

তিনি গাইদঘাট কৃষি ক্লাব, বিষমুক্ত সবজি, কৃষক সংগঠক আইয়ুব হোসেনকে নিয়ে কাজ করেছেন। এই অঞ্চলের কৃষির সম্ভাবনা তার খবরের অন্যতম উপাদান। কৃষি বিষয়ক সাংবাদিকতায় তিনি ১৯৯৮ সালে বার্ক এর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। একই বছর তিনি কৃষি বিষয়ক সাংবাদিকতায় বিসিডিজেসি ও নোভার্টিজ এর ফেলোশিপ অর্জন করেন।

শিল্প সাহিত্য :

ফখরে আলম একজন কবি। স্কুল জীবন থেকেই তিনি কবিতা লিখছেন। দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব পত্র-পত্রিকায় তার কবিতা ছাপা হয়েছে। বাংলা একাডেমির উত্তরাধিকার ও পশ্চিমবঙ্গের শিব নারায়ন রায় সম্পাদিত জিজ্ঞাসা পত্রিকায় তার কবিতা স্থান পেয়েছে। ১৯৮০-৮১ সালে ফখরে আলম যশোর সরকারি এমএম কলেজের ছাত্র সংসদের সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হন। দায়িত্ব পালন কালে তিনি কলেজ বার্ষিকী সম্পাদনা করেন।

স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তার কবিতা দেশ জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। তিনি ১৯৯১ সালে যশোর সাহিত্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থাকার সময় দেশ বিদেশের খ্যাতিমান কবি, সাহিত্যিকদের নিয়ে একটি সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করেন। এরপর ২০০৫ সাল পর্যন্ত তিনি যশোর সাহিত্য পরিষদের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন।

পুরস্কার :

ফখরে আলম সাংবাদিকতা ও বৃক্ষ রোপনে দেশ বিদেশের অনেক পুরস্কার অর্জন করেছেন। ১৯৯৭ সালে মোনাজাতউদ্দিন স্মৃতি পুরস্কার, একই বছর এফপিএবি পুরস্কার, ২০০০ সালে মধুসূদন একাডেমী পুরস্কার, ঐ বছরই বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরাম পুরস্কার, ২০০২ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কারসহ আরও কয়েকটি পুরস্কার অর্জন করেন।

বৃক্ষ রোপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য ফখরে আলম ২০০৬ সালে কৃষি মন্ত্রণালয়ের জাতীয় পুরস্কার, ২০০৭ সালে প্রধান উপদেষ্টার জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেন। সাংবাদিকতায় ২০১১ সালে তিনি অশোক সেন স্মৃতি পুরস্কার পান। ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবা দিবস উপলক্ষে ফখরে আলমকে জেগে ওঠো ফাউন্ডেশন সম্মাননা স্মারক প্রদান করে। এছাড়া তিনি যশোরে অনুষ্ঠিত বৃক্ষ মেলায় কয়েকবার প্রথম হয়েছেন। তার নিজস্ব একটি ভিন্ন ধরনের গাছের জাদুঘর রয়েছে। তিনি বিভিন্ন কবরস্থান, বসতবাড়ির আঙ্গিনা, রাস্তার দুই ধারে বৃক্ষরোপন করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।

প্রকাশনা :

ফখরে আলমের ২১টি গ্রন্থ রয়েছে। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত ডাকে প্রেম তুষার চুম্বন, তুই কনেরে পাতাসী, ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত খুলে ফেলি নক্ষত্রের ছিপি, ২০১৪ সালে প্রকাশিত এ আমায় কনে নিয়ে আলি নামে চারটি কাব্যগ্রন্থ রয়েছে। এছাড়া শালপ্রাংশু (সম্পাদনা গ্রন্থ), এসএম সুলতান, দক্ষিণের জনপদ, আলোকিত নারী আঞ্জেলা গমেজ, দক্ষিণের মুক্তিযুদ্ধ, একজনই শরীফ হোসেন, রিপোর্টারের ডায়েরি, জানা অজানা রবীন্দ্রনাথ, হাতের মুঠোয় সাংবাদিকতা, মা সকিনা, মহর এবং অন্ধকার সোনাগাছিয়া, সাগরদাঁড়ি থেকে হায়দ্রাবাদ, মলাট কাহিনী, মুক্তিযুদ্ধের জানা-অজানা, ত্রাহী মধুসূদন, সুন্দরবনের মানুষ, পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রতিবেদন, নীলপদ্ম নামের কয়েকটি ভিন্ন ধরনের গ্রন্থ রয়েছে।

সংগঠন :

ফখরে আলম যশোরের চাঁচড়া কমিউনিটি ক্লিনিক ও কবরস্থানের প্রতিষ্ঠাতা। এছাড়া তিনি যশোর ইনস্টিটিউট, যশোর সাহিত্য পরিষদ, আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম যশোরের জীবন সদস্য। তিনি সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, উদীচী, জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মেলন পরিষদসহ আরও কয়েকটি সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলেন। তিনি দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরেছেন।

সাহসী যোদ্ধা, বীরঙ্গনা, মুজিব নগর ইনফরমার, বধ্যভূমিসহ মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লিখেছেন। যশোরের চাঁচড়া শংকরপুর এলাকার বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনসহ যশোরের সব সামাজিক আন্দোলনে তার সক্রিয় ভূমিকা আছে।

ফখরে আলম এক ছেলে এক মেয়ের বাবা। স্ত্রী নাসিমা আলম তার প্রেরণার উৎস ছিলেন। খুলনার খালিশপুরের মেয়ে, বিএল কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্রী নাসিমা’র সাথে পারিবারিকভাবে ১৯৯১ সালের ১৯ জানুয়ারী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। মেয়ে “মাটি” বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জার্নালিজমে অনার্স শেষ করেছে এবং ছেলে “ফাহমিদ হুদা বিজয়” ২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষার্থী।

ফখরে আলম ভাই ছিলেন পরিচ্ছন্ন সাংবাদিক ব্যক্তিত্ব। আর্থিকভাবে তিনি ছিলেন স্বচ্ছল। তিনি মানুষকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন। তিনি ছিলেন আদ্-দ্বীন ফাউন্ডেশন ও আকিজ পরিবারের আপনজন। তিনি বিভিন্ন সময়ে আমাকে চিঠিও লিখতেন। চিঠির ভাষাগুলো ছিল খুবই হৃদ্যতাপূর্ণ ও স্নেহে ভরা। ভাই জানতেন না আমি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে। আমি অসুস্থ থাকায় এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে ভাবী ও ভাইয়ের সাথে আমি কথা বলিনি। ২০২০ সালের ২৮ এপ্রিল মোবাইলে আমার কাছে পাঠানো তার শেষ এসএমএস ছিল এমন- মুকুল আমার শরীর খুব খারাপ দোয়া করো...। ফখরে ভাই অবশেষে দুনিয়া ছেড়ে চলে গিয়েছেন। রেখে গেলেন অনেক স্মৃতি।

উল্লেখ্য, ১৪ মে ২০২০, ২০ রমজান ১৪৪১ বৃহস্পতিবার সকালে তিনি যশোর শহরের চাঁচড়া ডালমিল এলাকায় নিজের বাড়ি হুদা কটেজ এ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে যশোর জেনারেল হাসপাতালের জরুরী বিভাগে নেওয়া হলে সকাল ৯ টা ৪০ মিনিটে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আমরা ফখরে আলম ভাইয়ের জন্য দোয়া করি মহান দয়ালু আল্লাহ তার ভালো কাজের বিনিময়ে তাকে যেন জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করেন। আর তাকে ক্ষমা করেন।

ফখরে আলম ভাইয়ের শেষ ইচ্ছা ছিল যশোরে একটি “ক্যান্সার হাসপাতাল” করা।

লেখক : উপমহাব্যবস্থাপক, প্রশাসন ও মানবসম্পদ বিভাগ এবং মিডিয়া অ্যাফেয়ার্স বিভাগের প্রধান, আদ্-দ্বীন ফাউন্ডেশন এবং সাবেক সভাপতি, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি।
নবীন- প্রবীন লেখীয়োদের প্রতি আহ্বান: সাহিত্য সুহৃদ মানুষের কাছে ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, রম্য রচনা সহ সাহিত্য নির্ভর আপনার যেকোন লেখা পৌঁছে দিতে আমাদেরকে ই-মেইল করুন [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড