• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৪ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ইতিহাস চর্চার প্রতিষ্ঠান অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন

  ইমাম মেহেদী

২৪ মে ২০২০, ১৭:১৯
মুনতাসীর মামুন
মুনতাসীর মামুন

দুই হাজার বিশ ও একুশ সাল আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ সাল আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ। একুশ সাল আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি অর্থাৎ সুবর্ণজয়ন্তী।

সরকারি-বেসরকারি এবং ব্যক্তি উদ্যোগেও এই সাল দুটি উদযাপনের জন্য বিশেষ প্রস্তুতি ছিলো। উদযাপন শুরুও হয়েছিলো। অনকেটা বড় পরিসরে গত ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো আমাদের অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০। হঠাৎ ভয়াবহ করোনা ভাইরাস পৃথিবীকে এলোমেলো করে দিলো। বাংলাদেশেও এর প্রভাব ভয়াবহ আকার ধারণ করলো।

২০২০ সালের ২৮ এপ্রিল আমরা হারালাম গুণী মানুষ শ্রদ্ধাভাজন জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারকে। তাঁকে হারানোর শোক কাটতে না কাটতেই জাতীয় অধ্যাপক আমাদের বাতিঘর ড. আনিসুজ্জামান স্যার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন।

এদিকে মমতাময়ী মায়ের সান্নিধ্যে থাকার কারণে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলেন বাংলাদেশের বরেণ্য ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। মা সুস্থ হয়ে উঠলেও তিনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উপরিউক্ত সবার চিকিৎসার বিষয়ে নিজে দেখভাল করেছেন। মুনতাসীর মামুন স্যার কিছুটা সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরলেন কিন্ত আমরা হারিয়ে ফেললাম আমাদের সর্বজনীন শ্রদ্ধাভাজন ড. আনিসুজ্জামান স্যারকে।

গত ১৪ মে বিকেলে তিনি না ফেরার দেশে চলে গেলেন। মৃত্যুর পর জানতে পারলাম স্যারের দেহে করোনা ভাইরাস পজেটিভ ছিলো। দুই জাতীয় অধ্যাপকের মৃত্যুতে আমরা হারালাম অভিভাবককে। ১৪ মে রাতে না ফেরার দেশে চলে গেলেন উপন্যাসিক দেবেশ রায়। এ যেন শুন্যতার পর রিক্ততা।

কিছু কিছু মানুষ তার জীবন ও কর্ম দিয়ে বেঁচে থাকেন আজীবন। ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠানে রুপান্তরিত হয়। তেমনি ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী এবং ড. আনিসুজ্জামান। দুই জাতীয় অধ্যাপকের আত্মার শান্তি কামনা করছি। বাংলাদেশের ইতিহাস চর্চায় আরেক প্রতিষ্ঠান অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। যিনি একাধারে শিক্ষক, গবেষক, সাহিত্যিক, সংগঠক এবং বিশ্লেষক। তিনি এখনও অসুস্থ। মুনতাসীর মামুনের কথা বলতে ও জানতে হলে তার কর্মময় জীবনের পুনর্পাঠ আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরী।

বাংলাদেশের ইতিহাস, রাজনীতির ইতিহাস, ঢাকার ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, গণহত্যার ইতিহাস ছাড়াও অনেক বিষয়ে রয়েছে তার পান্ডিত্য। ইতিহাস চর্চায় তার অসাম্য মুন্সিয়ানা রয়েছে সে কথা ভাবা ও বলার অবকাশ রাখে না। সমসাময়িক বিষয় ও ইতিহাস নিয়ে লিখে যাচ্ছেন প্রায় পাঁচ দশক ধরে।

প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিনশো’র মতো। এর মধ্যে মৌলিক ও সম্পাদিত গ্রন্থও রয়েছে। বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ, বাংলাদেশের ইতিহাস, ভাষার ইতিহাস, সাময়িকপত্রের ইতিহাস, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ইতিহাস চর্চায় মুনতাসীর মামুনের অবদান অসামান্য। রাজধানী ঢাকার ইতিহাস চর্চায় তিনি নগর গবেষক হিসেবেও পরিচিত।

২৪ মে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের ৬৯তম জন্মবার্ষিকী। ১৯৫১ সালের ২৪ মে ঢাকার ইসলামপুরে নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলার গুলবাহার গ্রামে। পিতার নাম মেজবাহ উদ্দিন খান এবং মায়ের নাম জাহানারা খান। শৈশব-কৈশোর কেটেছে চট্টগ্রামের চাঁটগায়।

চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্ট প্রাইমারি ও হাইস্কুল এবং চট্টগ্রাম কলেজে তিনি পড়াশোনা করেন। শৈশবেই তাঁর লেখালেখির হাতে খড়ি। ১৯৬৩ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে অর্জন করেছেন প্রেসিডেন্ট পুরস্কার। সেটা ছিল তৎকালীন পাকিস্তানে বাংলা ভাষায় সেরা শিশু-লেখক হিসেবে স্বীকৃতি। এরপর গল্প শুধু এগিয়ে যাওয়ার।

১৯৬৮ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। ১৯৭২ সালে তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন এবং একই বিভাগ থেকে ১৯৮৩ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। স্বাধীনতার পর ইতিহাস বিভাগ থেকে তিনিই প্রথম পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।

ছাত্রজীবনে জড়িত ছিলেন ছাত্র আন্দোলনে। ১৯৬৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত অংশগ্রহণ করেছেন প্রতিটি সাংস্কৃতিক ও গণআন্দোলনে। স্বাধীন বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত প্রথম ডাকসু নির্বাচনে তিনি নির্বাচিত হন সম্পাদক। একই সময়ে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সংসদের সভাপতি। তাঁর সম্পাদনায় প্রথম প্রকাশিত হয় ডাকসুর মুখপত্র ‘ছাত্রবার্তা’।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই ‘দৈনিক বাংলা বিচিত্রায়’ সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন মুনতাসীর মামুন। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদেন শিক্ষকতা পেশায়। তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ গবেষণা ইন্সটিটিউটে’ সম্মানিত প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসেবে ১৯৯৯-২০০২ সাল পযর্ন্ত দায়িত্ব পালন করেন।

ঢাকা নগর জাদুঘরের তিনি অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তিনি বঙ্গবন্ধু জাদুঘরেরও অন্যতম উদ্যোক্তা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন, ঢাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষায়, ঢাকার নদী রক্ষায়, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সৌন্দর্যহানির বিষয়ে, শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি আদায়ের আন্দোলনে, যুদ্ধাপরাধীদের নামে নানা প্রতিষ্ঠান ও সড়কের নামকরণ বাতিলের দাবিতে নেমে এসেছেন রাজপথে। নানা জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নির্দেশনা চেয়ে হয়েছেন উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ। লেখালেখি ও সাংগঠনিক কার্যক্রমের মাধ্যমে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম করার কারণে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে গ্রেপ্তার হয়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তারপরও সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থেকে কলম সৈনিক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত।

বহুমাত্রিক মুনতাসীর মামুনের বিভিন্ন বিষয়ে প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিনশো’র মতো। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১৪ খন্ডে উনিশ শতকে বাংলাদেশের সংবাদ সাময়িকপত্র, উনিশ শতকে পূর্ববঙ্গের সমাজ, উনিশ শতকে পূর্ববঙ্গের মুদ্রণ ও প্রকাশনা, ঢাকার স্মৃতি : স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী, পাকিস্তানি জেনারেলদের মন, রাজাকারের মন, ১২ খন্ডে মুক্তিযুদ্ধ কোষ, বঙ্গবন্ধু কোষ (সম্পাদিত) ইত্যাদি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসরদের গণহত্যা ও নির্যাতনের কথা সাধারণ মানুষকে জানাতে তিনি খুলনায় প্রতিষ্ঠা করেছেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম গণহত্যা জাদুঘর। বর্তমানে তিনি এই জাদুঘরের ট্রাস্টিবোর্ডের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।

বর্তমানেও তিনি লিখে যাচ্ছেন তড়িৎ গতিতে। শিক্ষকতা ও সাংগঠনিক জীবনে তিনি তৈরি করেছেন একঝাঁক তরুণ ইতিহাস গবেষক। যারা প্রতিনিয়ত ছুঁটে চলেছেন দেশে বিদেশের বিভিন্ন এলাকায় নিত্য নতুন ইতিহাসের সন্ধ্যানে। আর তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। প্রতিটি জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে গণহত্যা, নির্যাতন, বধ্যভূমি, গণকবরের অনালোচিত ইতিহাস জনসমুক্ষে তুলে আনছেন এবং তা গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে ইতিহাসে সংযোজন করছেন তিনি এবং তাঁর একদল গবেষক বৃন্দ।

কর্মময় বর্ণাঢ্য একজীবনে তিনি অর্জন করেছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, সিটি আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার, নুরুলকাদের ফাউন্ডেশন পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক পুরস্কার, মার্কেন্টাইল ব্যাংক স্বর্ণপদক, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ কর্তৃক প্রদত্ত ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কারসহ বহু পুরস্কার ও সম্মাননা।

গবেষণা ও শিক্ষকতার বর্ণাঢ্য এক কর্মজীবন শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে ২০১৬ সালে অবসর গ্রহণ করেন গুণী অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। তারপর ২০১৭-২০১৮ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’ পদেও দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। অসাম্প্রদায়িক ইতিহাস চর্চার অন্যতম প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনীর সভাপতি ছিলেন দীর্ঘদিন।

বর্তমানে তিনি উপদেষ্টামন্ডলীর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার নিজ সংগ্রহে ও লাইব্রেরিতেও রয়েছে প্রায় দশ হাজারের বেশি গ্রন্থ।

উপমহাদেশরে প্রখ্যাত এই ইতিহাসবিদ তাঁর ইতিহাস চর্চা ও গবেষণার যে ভান্ডার ইতোমধ্যে আমাদের উপহার দিয়েছেন গ্রন্থাকারে তা প্রকৃতপক্ষেই ইতিহাস হয়ে রবে চিরদিন। স্মৃতিময় হয়ে চিরদিন বেঁচে থাকবেন তিনি ও তার গবেষণা এবং একজন মুনতাসীর মামুন হয়ে।

যিনি বহু আগেই ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠানে রুপান্তরিত হয়েছেন। স্যার আপনার এই জন্মদিনে দোয়াকরি আপনি দ্রুত সুস্থ হয়ে ফিরে আসুন আমাদের মাঝে। এখনো ইতিহাসের অনেক কাজ বাঁকি। সেদিন বেশি দূরে নয়, আগামী দিনগুলোতে আরো পেতে চাই ঠিক ‘চেরি ফোটার দিন’ ও ‘বৃষ্টিভেজা স্মৃতির গান’ এর মতো মন জুড়ানো প্রাণ জুড়ানো সুখপাঠ্যের গ্রন্থ।

লেখক : সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন গবেষক।
নবীন- প্রবীন লেখীয়োদের প্রতি আহ্বান: সাহিত্য সুহৃদ মানুষের কাছে ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, রম্য রচনা সহ সাহিত্য নির্ভর আপনার যেকোন লেখা পৌঁছে দিতে আমাদেরকে ই-মেইল করুন [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড