• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৬ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

গল্প : লাশ...

  ফাহমিদা ফারুক

১৫ এপ্রিল ২০২০, ১৮:৪০
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী

বাসা থেকে রাগ করে বের হয়ে গেছি। আনার মত কেবল একটা ব্যাগ নিয়ে এসেছি। সে ব্যাগে আবার এক সেট কাপড় আর একটা রুমাল ছাড়া কিছুই নেই। কোথায় যাবো বুঝতে পারছি না। আত্মীয়দের বাসায় যাওয়া বোকামি। সেরকম কোন বন্ধুর বাসাও চিনি না। রাস্তায় একা হাঁটছি। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ আমার হাতটা টেনে ধরল। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা হাত। চমকে উঠে পেছনে তাকিয়ে দেখি রত্না।

আমরা স্কুল কলেজ একসাথেই পার করেছি। তারপর আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেলাম কিন্তু রত্না পেলো না। ব্যাস তারপর থেকেই রত্না একেবারে লাপাত্তা। এতদিন পর ওকে দেখে বেশ ভালো লাগছে। আগের চেয়ে সুন্দর হয়েছে সে। আমার হাত ধরে রেখেই বলল,

বান্ধবীকে মনেও পড়ে না একদম? কোথায় যাচ্ছিস এত বড় ব্যাগ নিয়ে?

এতদিন পর দেখা, কত সুখ দুঃখের আলাপ করব! কিন্তু আমি কিছুই বলতে পারছিলাম না। কারণ আমি এখন বাড়িছাড়া। মনটা ভীষণ খারাপ। থাকার জায়গা খুঁজে না পেলে হয়ত গাছতলায় কাটাতে হবে। আর এই শহরে মেয়েদের জন্য সেটা একেবারেই অনিরাপদ। তাছাড়া রত্না নিজেই লাপাত্তা হয়ে আমাকে উল্টো জিজ্ঞেস করছে, কেন মনে পড়ে না! কি বিপদ! রত্না এবার আমাকে ধাক্কা দিলো। কিরে কি ভাবিস?

আমি স্তম্ভিত ফিরে পেতেই ওর কথার জবাব দেয়া শুরু করলাম। দোস্ত তোকে ভুলিনি। তুইই হাওয়া হয়ে গিয়েছিলি। ফোন নাম্বারও বন্ধ পেতাম। কোথায় পড়িস এখন? এখন পড়ি একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে। হোস্টেলে থাকি। তুই ব্যস্ত নাকি? চল আমার হোস্টেলে। আরামসে বসে গল্প করা যাবে।

বাড়িছাড়া এই আমি ওর আমন্ত্রণ না করতে পারলাম না। এক কথায় সায় দিলাম।

বিশাল এক বিল্ডিংয়ের কাছে এসে থামল রত্না। ঠিক বিশাল নয় মাত্র ছয় তলা। রত্নার কাছে জানলাম এখানে চার তলা থেকে ছয় তলা পর্যন্ত হোস্টেল। বাকিটা নাকি একটা হসপিটাল। অবশ্য আমি হসপিটালে কোন মানুষই দেখলাম না। রত্না সিঁড়ি বেয়ে পাঁচতলায় উঠল সাথে আমিও। ওর রুমটা নাকি পাঁচতলায়। লিফট নেই শুনেও অবাক হলাম না। ছয় তলা বিল্ডিংয়ে লিফটের দরকার খুব একটা হয় না। ওর ওখানে গিয়েই সোমার সাথে আলাপ হল। সোমা ওর রুমমেট। কথাবার্তা চমৎকার। আমরা একসাথে লাঞ্চ করে নিলাম। চা নাস্তা খেলাম। হোস্টেলের সবার সাথে পরিচিত হলাম। হঠাৎ হোস্টেলের সুপার আসতেই রত্না আমাকে দরজার পেছনে লুকিয়ে ফেলল। আমি উঁকি দিয়ে সুপারকে দেখলাম। মোটা শরীরের কালো কুচকুচে এক মহিলা। ওনি চলে যেতেই আমি বের হলাম। রত্নাকে জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে লুকানো হল কেন!

সে বলল এখানে নাকি পারমিশন ছাড়া কাউকে আনা যায়না। বুঝলাম না, কয়েক ঘণ্টার জন্য ফ্রেন্ড আসতে পারবে না এ কেমন নিয়ম! এতসব কিছু করতে করতে কখন যে সন্ধ্যা সাতটা বেজেছে খেয়াল করিনি। হঠাৎ বাসা থেকে ফোন এলো। প্রথমটা না ধরলেও পরেরটা ধরতে বাধ্য হলাম। ধরতেই ভাইয়া বকা দিলো। কোথায় তুই? আম্মা কান্না করতেছে কন্টিনিউয়াসলি তোর জন্য। এখনি বাসায় আয়। তোর বিলাই মিনি ফিনি কিছু খাচ্ছে না। তোর জন্য ম্যা ম্যা করছে। তারাতারি আয়। মিনির কথা শুনে ডিসিশন চেঞ্জ করলাম। মিনি আমার একমাত্র পিছুটান। বাসার দিকেই যাব এবার। রত্নাকে বললাম, দোস্ত অনেক রাত হয়েছে। বাসায় যেতে হবে। আজকে থাক না। নারে। ভাইয়া বকা দিচ্ছে। ঠিক আছে চল।

আমি ব্যাগ নিয়ে আবার বের হলাম। রত্না আমাকে এগিয়ে দিতে বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত আসবে, সাথে সোমাও আসবে। আমরা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছি। হোস্টেলের সবাই যাদের সাথে কথা হয়েছিলো তারা সবাই করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে হাস্যজ্জ্বল মুখ নিয়ে।

রাত তখন আটটা। বাইরে বের হবার পর বুঝলাম বৃষ্টি পড়ছে। প্রথমে ভেবেছিলাম ছাতা ছাড়াই বাস স্ট্যান্ড পৌঁছে যেতে পারব। কিন্তু বৃষ্টি এত জোরে পড়ছিল যে, সেই ভাবনা বাদ দিলাম। রত্না ছয় তলা না গিয়ে দুই তলায় গেলো একটা ছাতা আনতে। পিছে পিছে আমিও গেলাম। সাথে সোমাও এলো। রত্না দরজায় কড়া নাড়তেই খুব সুন্দর দেখতে একটা আন্টি দরজা খুললেন। রত্নার সাথে তার কথা বলার ভঙ্গি দেখে বুঝলাম তিনি রত্নাকে চেনেন। রত্না বলেছিল বাকিটা হসপিটাল অথচ দুইতলায় ফ্যামিলি আসল কোত্থেকে বুঝলাম না।

আমি ঘরে ঢুকে এদিক ওদিক দেখছি আর আন্টি ছাতা খুঁজছেন। রত্না আর সোমা আমার পাশেই দাঁড়ানো। হঠাৎ ঘরের কোণার একটা আয়নায় চোখ গেলো আমার। সারাদিন অনেক খাটনি গেছে চেহারার উপর। তাই নিজের চেহারা মোবারক দেখার জন্য সবাইকে পেছনে রেখে আমি সামনে এগিয়ে গেলাম। সরাসরি আয়নার দিকে তাকিয়ে আমি আতঁকে উঠলাম। আয়নায় একবার হাত রেখে আয়নার অস্তিত্ব বোঝার চেষ্টা করলাম। না যা দেখছি সেটা সত্যিই ঘটছে। আমি চোখ ঘষে আরও ভালো মত দেখার চেষ্টা করলাম। পেছনে যা দেখলাম তাতে আমার দম আটকে যাওয়ার অবস্থা।

আয়নার সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি ঠিকই কিন্তু পেছনে কেউ নেই। রত্না বা সোমা কেউ নেই। আন্টিকেও দেখা যাচ্ছে না। প্রচণ্ড ভয়ে হাত পা কাঁপছে আমার। জানিনা পেছনে ফিরে কি দেখতে পাবো। তবুও মিথ্যে সাহস নিয়ে পেছনে তাকালাম। দেখলাম সবাই বড় বড় চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের চোখ দেখে আমি প্রচণ্ড ভয় পেলাম। ভয়ে হাত পা অবশ হয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল জ্ঞান হারাবো কিন্তু আমি জ্ঞান হারাইনি। তখনই সাহস সঞ্চয় করে দৌড় দেয়ার চেষ্টা করলাম। ভয়ের কারণে ঠিকমত সেটা না করতে পারলেও, ওদের উপেক্ষা করে ঘরটা থেকে বের হয়ে এলাম। তারপর সোজা নিচে নেমে মেইন গেইটের দিকে ছুটে গেলাম।

দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে একেবারে বাসস্ট্যান্ড। কিন্তু একটাও বাস নেই আশেপাশে। এখন এত রাতে ফিরবো কি করে! হতাশ হয়ে রাস্তায় বসে পড়লাম আমি। হাঁপাচ্ছি অনবরত। চারপাশ তাকিয়ে একটা টংয়ের দোকান দেখলাম। রোবটের মত এক লোক দাঁড়িয়ে আছে দোকানের সামনে।দৌড়ে তার কাছে গেলাম। ভাইয়া, এখানে বাস নেই কেন? কখন আসবে জানেন? কাল তো হরতাল। আটটার পর থেকেই বাস বন্ধ।

কথা শুনে ভয় আরও কয়েক ধাপ বেড়ে গেলো আমার। হঠাৎ করে আবার হরতাল এলো কোত্থেকে! লোকটা আবার বলল, আপনি হাঁপাচ্ছেন কেন? পানি খান। কোত্থেকে আসছিলেন? ভূত দেখেছি। কোনমতে জান নিয়ে এসেছি। ভূত? কোথায়? এইতো একটু দূরে, একটা হসপিটালে গিয়েছিলাম। হসপিটাল? এখানে তো আশেপাশে কোন হসপিটাল আছে বলে জানি না।

আছে, বিশ্বাস করুন। কোথায়? চলেন তো দেখে আসি। না না আমি আর যাব না। আমি বাসায় যাব। কোথায় বাসা? মগবাজার। আমিও ওদিকেই যাব। আমার সাথে যাবেন। সমস্যা নেই। চলেন আগে আপনার ভূত দেখে আসি। ভূত দেখার খুব ইচ্ছে আমার।

একা বাসায় যেতে পারব না ভেবে তার এই ভয়ঙ্কর প্রস্তাবে রাজি হলাম আমি। আবারও সেই মরণ ফাঁদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। যদিও এবার একা নই। দেখা যাক না কি হয়! রত্নার হোস্টেলের সামনে এসে আমি থামলাম। লোকটার দিকে তাকিয়ে বললাম, এখানে দেখেছি। এখানেই। এটা তো মর্গ।

শুনে আমি থতমত খেয়ে যাই। ভালো করে আরেকবার তাকাই। ছয় তলা বিল্ডিং হুট করে দুই তলা বিল্ডিং হয়ে গেল কি করে! হঠাৎ সামনে বসা দারোয়ান ডাক দিল। । কি চান আপনারা?

পালিয়ে যাওয়ার সময় দারোয়ানকে দেখিনি। এখন কোত্থেকে উদয় হল কে জানে! আমার সাথে থাকা লোকটা দারোয়ানকে কনভেন্স করে নিল।

বলল, দাদা আমাদের একজনকে খুঁজে পাচ্ছি না দুইদিন ধরে। সব জায়গায় খোঁজ নিয়েছি। এখানে যদি একটু দেখাতেন। আসছেন যে কোন অনুমতি নিয়ে আসছেন? কোন কাগজ আছে? না তা তো নেই নি। তাহলে ঢুকতে দেয়া যাবে না। প্লিজ দিন না। বাসায় ভয়াবহ অবস্থা চলছে। কান্নাকাটি চলছে।

আমি লোকটাকে ডেকে ফিসফিস করে বললাম, যাওয়ার দরকার নেই। প্লিজ। যাবেন না। চলেন বাসায় যাই। আরে কিছু হবে না। আমাদের কথার মাঝখানেই দারোয়ান বলল, ঠিক আছে যান।

অগত্যা লোকটার সঙ্গে আমারও যেতে হল। গেইট দিয়ে ঢুকতেই প্রচণ্ড শীত লাগা শুরু হল। অথচ রত্নার সাথে ঢোকার সময় এমন লাগেনি। ঢুকতেই উপরে দুইতলায় চোখ গেলো। সাদা কাপড়ে জরানো সারি সারি লাশ রাখা। যখন এসেছিলাম করিডোর শূন্য ছিল। দারোয়ান উপরে নিয়ে গেলো আমাদের।

আমি ভয়ে কুকরে যাচ্ছি। হাত পা সমানে কাঁপছে। আমার সাথে আসা লোকটা একের পর এক সবার মুখের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে দেখছে। সবার চেহারা দেখে আমি চমকে গেলাম। হোস্টেলে যাদের সাথে পরিচয় হয়েছিলো এমনকি করিডোরে যারা দাঁড়িয়ে ছিল তাদের প্রত্যেকের লাশ এখানে। এমনকি রত্না আর সোমারও। আমি ভয়ে চলে যাওয়ার জন্য লোকটাকে ডাকব, ওমনি চারপাশ তাকিয়ে দেখি ওনি নেই।

দারোয়ানও নেই। হঠাৎ কোত্থেকে এক দমকা বাতাস এসে আমার পেছনের দুটো লাশের মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে দিলো। দেখলাম লাশ দুটো দারোয়ান আর আমার সাথে আসা লোকটার। চারপাশ যতদূর তাকাচ্ছি শুধু লাশ আর লাশ। সাদা কাপড়ে মোড়ানো লাশ। আর পারলাম না। মাথা ঝিমঝিম করছে। অনেকক্ষণ নিজেকে শক্ত করে রেখেছিলাম। এখন আর পারছি না। সব কিছু ঘোলাটে হয়ে আসছে। বোধহয় জ্ঞান হারাতে আর কয়েক মুহূর্ত বাকি!

প্রচণ্ড ভয়ের ভেতর আমি ধীরে ধীরে চোখ খুলে নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করলাম। তার মানে এতক্ষণ আমি স্বপ্ন দেখছিলাম। কি ভয়ানক স্বপ্ন! আর কিছুক্ষণ থাকলে হয়ত ওখানে নিজেরই লাশ দেখতে হতো। কিন্তু বুঝতে পারলাম না আজ হঠাৎ রত্নাকে স্বপ্নে দেখলাম কেন!

ভয়ের শেষ সীমানা অতিক্রম করলাম যখন দেখলাম বাস্তবে রত্না আমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। আর পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক নার্স। রত্না তাকে বলছে, লাশের বাড়িতে খবর দাও। সি ইজ ডেড।

সাদা চাদরটা দিয়ে আমার মুখ পর্যন্ত ঢেকে দেয়া হল। ফ্ল্যাশব্যাকের মত এতক্ষণে সব মনে পড়ে গেলো আমার। আজ সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার পর আমি এক্সিডেন্ট করেছিলাম। রত্নাই আমাকে এখানে নিয়ে আসে। এতক্ষণ কোমায় থেকে মৃত্যুর সাথে লড়তে লড়তে অবশেষে আমি মারা গেছি।

নবীন- প্রবীন লেখীয়োদের প্রতি আহ্বান: সাহিত্য সুহৃদ মানুষের কাছে ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, রম্য রচনা সহ সাহিত্য নির্ভর আপনার যেকোন লেখা পৌঁছে দিতে আমাদেরকে ই-মেইল করুন [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড