শানজানা আলম
আজমল স্যার আমাদের স্কুলে আসেন সাতানব্বই সালে, আমরা তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি। স্যার ছিলেন একটু দূরের স্কুলে, তিনি যখন আমাদের স্কুলে এলেন, স্কুলের চেহারাই পাল্টে দিলেন। এসেই কাব দল শুরু করলেন, স্কাউটের প্রথম ধাপ। পুরো স্কুলের সাদা ওয়াল গুলো বিভিন্ন রঙিন নীতিকথায় ভরে গেল। যেমন, শিক্ষাকাল দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত, জ্ঞান অর্জনে প্রয়োজনে সুদূর চীনদেশে যাও, তারপর, সাগরের চেয়ে কে আছে মহান, তুষ্ট হৃদয় তারও চেয়ে গরীয়ান। চলতে ফিরতে নামতা গুলো চোখে পড়তো, আর মনে গেথে গিয়েছিল। তিনি ছিলেন আমার প্রিয় শিক্ষক। যাই হোক, আমার মা শিক্ষিকা ছিলেন সেই স্কুলের। তাই টিচার্স কমনরুমে ছিল আমার অবাধ যাতায়াত। টিফিন টাইমে খেতে যেতাম মায়ের কাছে। একদিন খেতে খেতেই স্যার গল্প করছিলেন, বুজলেন ম্যাডাম, বাড়ির কাজ শুরু করবো।জায়গা রেখেছিলাম। কিছু টাকা জমেছে। সব শিক্ষকরা শুনে খুশি হলেন। বলাবাহুল্য, প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকদের তখন বেতন আহামরি কিছু ছিল না। সেখান থেকে সংসার সামলে, ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা করিয়ে টাকা জমিয়ে পাকা বাড়ি করা স্বপ্নের মতো। বেশির ভাগ শিক্ষকই পারতেন না। স্যার অনেক স্বপ্ন নিয়ে বাড়ির কাজ ধরলেন। কয়েকদিন পরে শুনলাম তিনি আলোচনা করছেন আরেক স্যারের সাথে, তিনতলা ফাউন্ডেশন দিয়ে কাজ করবেন। তিনি শেষ না করতে পারলেও দুই ছেলে আছে, দুই মেয়ে তারা কাজ করে নিবে অপর শিক্ষক বললেন সেটা তো অনেক টাকার বিষয়!. স্যার বললেন, হুম, দেখি, কতদূর পারি। স্যার কাজ শুরু করলেন। মাঝে মাঝেই দেখি তিনি ইট বালু সিমেন্টের হিসেব করেন স্যারের সাথে। একদিন শুনলাম তিনি বলছেন শহরের মতো বাড়ির ভেতরে রান্নাঘর আর বাথরুম করবেন। ছেলেরা বউ আনবে, তারা এসে ঘরের ভেতর সুযোগ সুবিধা পাবে। গ্রামে বিয়ে হওয়ার দুঃখ থাকবে না।
আজ থেকে প্রায় বাইশ বছর আগে রান্নাঘর আর বাথরুম আমাদের এলাকায় বাসার বাইরে করাই স্বাভাবিক বিষয় ছিল। কয়েক মাস পরে স্যারের বাড়ির কাজ শেষ হলো মোটামুটি। স্যার একদিন গল্প করছিলেন টিচার্স কমনরুমে, রিক্রিয়েশন বিলটা পেলে, বাড়ির সামনের সিড়িটা তিনি মোজাইক করবেন। আপাতত যেটুকু কাজ হয়েছে, সেটা দেখতে তিনি সব কলিগদের দাওয়াত করলেন। আমিও গেলাম মায়ের সাথে। দেখলাম স্যারের একটা রুম করা হয়েছে মোটামুটি। বাকি রুমের নিচটা ইট বিছানো। ছাদ ঢালাই করা হয়েছে তখন সবে। কয়েকটা জানলায় টিন দিয়ে আটকে দেওয়া। সবাইকে স্যারের বউ খুব যত্ন করে খাওয়ালেন। বাড়ির গেট তখন বাশ কেটে বানানো। একপাশে একটা মাধবীলতা গাছ লাগানো হয়েছে। তখন আমরা ফোরে পড়ি। স্যার আমাদের অংক ক্লাশ নিতেন। মাঝে মাঝে গল্প করতেন, বুঝলি, দুটো গ্রিল বানিয়েছি জানলার। সামনের রুমে ফুল করিয়েছি গ্রীলে। পেস্ট কালার রং করবো। তখন জানতাম না পেস্ট কালার কেমন হয়, তবে স্যারের মুখ দেখে ধারনা করে নিয়েছিলাম, নিশ্চয়ই অনেক সুন্দর। একদিন এক ছেলে একটা ফুল নিয়ে এলো। নীল রঙের ঝিরিঝিরি পাপড়ি। এখন জানি ওটা ছিল ঝুমকো লতার ফুল। কি মোহনীয় সুঘ্রান তার। স্যার ধরলেন, আমাকে চারা দিতে হবে। দিতেই হবে। স্যারের সাথে আরো কয়েকজন ছেলেটার বাড়ি গিয়ে একটা চারা জোগাড় করে এনেছিল। পরে স্যার বলেছেন, তিনি গাছটা লাগিয়েছেন তার গেটের কাছে। এভাবে কয়েক বছর ধরে, ইদ কোরবানির বোনাস আর স্যারের ঘামের মূল্য জমে জমে স্যারের বাড়ি একসময় শেষ হলো। আমার শ্বশুরবাড়ি যেতে হয় স্যারের বাড়ির সামনে থেকে। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম স্যারের বাড়ি এই রাস্তায়। একদিন পথে যেতে স্যারের গেটে মাধবীলতা আর ঝুমকোলতার ঝাড় দেখে মনে পড়লো। বাসায় ফিরে মা কে জিজ্ঞেস করলাম, আজমল স্যারের বাড়িটা ওখানে না?? আম্মু বললো, হু, স্যার তো গত বছর মারা গিয়েছেন। তাকে কোথায় কবর দিয়েছে জানো, বাড়ির একদম পিছনে, খালপাড়ে। কারণ বাড়ি ভাগ হবে, তখন ছেলেমেয়ে কার না কার ভাগে পরবে কবর, তাদের লস হবে। আমি কতক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম। চোখে ভেসে উঠলো সেই সব দিনগুলি, স্যারের বাড়ি করার সময়কার কথা। স্যারের এত কষ্টের করা বাড়ি, তিনি আসে পাশেও জায়গা পেলেন না।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড