• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ছোটগল্প: চোখ সাড়াতে মনচুরি

  মাহবুব নাহিদ

১০ এপ্রিল ২০২০, ২০:০৭
ছোটগল্প
ছোটগল্প: চোখ সাড়াতে মনচুরি

আশকোনা সিটি কমপ্লেক্স, দক্ষিণখান, ঢাকা

আবরার সেই ছোটবেলা থেকেই চশমা পরে। প্রতি ছয় মাস পরপর তার ডাক্তার দেখানো লাগে। তারা আগে থাকতেন লালবাগ। অল্প কিছুদিন হয় উত্তরা এসেছে। এখানে একজন ভালো চক্ষু বিশেষজ্ঞ খুঁজে বের করতে হবে। টাকায় নাকি বাঘের চক্ষু মেলে। তাই হাতে টাকা নিয়ে বের হয়ে গেল সে। অবশ্য টাকা মানিব্যাগে নিয়েছে।

এবার তার মনে পড়ল ছোটবেলার এক বান্ধবীর কথা। তার বাসাও উত্তরায়। তাকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে। তবে বিবাহিতা মেয়েকে এই দুপুরে ফোন দেয়া ঠিক হবে কিনা সেটাও ভাবল সে! ওসব ভাবনা চিন্তা না করে ফোন দিয়েই দিলো সে। তার বান্ধবীও ছেলেকে নিয়ে নাকি বাহিরে বের হয়েছে। তাকে কফি খাওয়ার দাওয়াত দিয়ে দিয়েছে। বাহ! ছেলে! কী দারুণ! আর আবরার তো এখনো বিয়ের মুখই দেখতে পারল না। দেখা হয়ে গেল বান্ধবীর সাথে, হয়ে গেল কফি খাওয়া! বান্ধবী তাকে দিয়ে গেল। চোখের ডাক্তারের ঠিকানা চলে যাওয়ার সময় কি দারুণ লাগছে তাদের! মা ছেলে দুজনই লাল ড্রেস পড়া! কিছুই হলো না আবরারের জীবনে।

উত্তরার আজমপুরে ঢাকা আই কেয়ার সেন্টার-যেখানে চোখের অত্যন্ত ভালো মানের চিকিৎসা হয়ে থাকে। আবরার হন্তদন্ত হয়ে ঢুকল সেখানে, ঢুকেই টিকিট কাটার সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে গেল। কিন্তু বাদ সাধলো এসে গার্ডম্যান। সে এসে বললো আপনি জুতা খুলে আসুন।

আবরারের মেজাজ গেল চটে, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক মধ্যবয়স্ক মহিলাকে বলল "আন্টি আমি কিন্তু আপনার পরেই ছিলাম, কেউ আসলে বলবেন, আমি জুতাটা রেখে আসি।" মহিলা খুবই বিনয়ের সাথে আবিরারের সিরিয়াল রেখে দেওয়ায় সম্মতি জানালো। আবরার গেল জুতা রাখতে। জুতা যেখানে রাখার জায়গা সেখানে গিয়ে সে আবিষ্কার করলো অনন্য সুন্দর একটা কিছু, যা সে আগে কখনো দেখেনি। অবশ্য কোনো চোখই এর আগে তা দেখেছে কিনা তা নিয়ে আবরার সন্দিহান। অনিন্দ্য সুন্দর সেই মেয়েটা যেই বাক্সে জুতা রাখলো আবরারও খুবই উদ্দেশ্য করে সেই বাক্সেই জুতা রাখলো। যেন ইচ্ছা করেই তার কাছে থাকার চেষ্টা করা। জুতায় জুতা স্পর্শ হওয়াই যেন পায়ে পা স্পর্শ হওয়া। যাক প্রথম স্পর্শেই প্রেম এসে গেল আবরারের মনে। আর তা অবশ্যই জুতায় জুতার স্পর্শে নয়, মেয়েটা জুতা রেখে যাওয়ার সময় আবরারের সাথে মৃদু একটা ধাক্কা লাগলো, এটাকে অবশ্য ধাক্কা বলা অপরাধ, এটা একটা স্পর্শ, যে স্পর্শ মানুষকে প্রেমিক বানায়, কবি বানায়, উন্মাদ বানায়। ঠিক তেমনই আবরারও দৃষ্টিশক্তিহীন হয়ে গেল বধির হয়ে গেল। সে তার চারপাশের কোনোকিছুই দৃষ্টে আনতে পারছে না ওই মেয়েটিকে ছাড়া। হঠাৎ তার জ্ঞান ফিরলো গার্ডম্যানের ধাক্কা খেয়ে। জ্ঞান আসার পরে আবরার খেয়াল করলো সেই মেয়েটিকে আর দৃষ্টিসীমার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে না। তার মানে মেয়েটি নিশ্চিত সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। হ্যাঁ, আবরারের ধারনাই সঠিক মেয়েটি সিরিয়ালে দাঁড়িয়েছে এবং আবরারের জায়গাটা দখল করেই। সিরিয়ালের কাছে গিয়ে সে আঁচ করতে পারলো ওই মধ্যবয়স্কা নারী তার সিরিয়াল নিয়ে মেয়েটার সাথে ঝগড়া লাগিয়ে দিয়েছে। আবরারের সিরিয়াল রক্ষার্থে ঠিক যেন দেবদূতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন তিনি।

কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো আবরার কাছে গিয়ে খুবই করুণ ভঙ্গিতে বলল, "থাক উনিই দাঁড়াক। "

এবার তো মহিলা গেলেন চটে। ছ্যাঁচড়া, ছ্যাঁচোর, লুইচ্চা যা যা মুখে মুখে আসে সবই বলল আবরারকে কিন্তু অন্যদিকে ফিরে। আবরার তা যেন গায়ে লাগালো না। আর মাঝেমাঝে ভালো কিছুর জন্য অনেক খারাপ কিছুর সম্মুখীন হতেও হয়। যাক সিরিয়াল এখন সেই মেয়েটার টিকিট নেয়ার। তার নাম জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, আববার একদম সুতীক্ষ্ণ নজরে, কান খোলা রেখে তাকিয়ে রইলো ফরমের দিকে। নাম বললো মালিহা, বয়স বলল ১৪ বছর। অবাক হয়ে গেল আবরার, এই মেয়ের কীভাবে ১৪ বছর হয়? এ তো একদম বাচ্চা মেয়ে, কিন্তু দেখে তো মনে হয় বাচ্চার মা হবার বয়সও হয়ে গেছে। এই পিছনে লেগে থাকলে বাল্যপ্রেমের অপরাধে কঠোর শাস্তি হবে আবরারের। তবে দুঃখের বিষয় নিয়ে ভাবনার ঘোরপাকে থাকা অবস্থায় মেয়েটার ফোন নম্বর বলা শেষ হয়ে গেছে। যাক প্রয়োজন হলে আর ইচ্ছা থাকলে পরেও বের করে নেয়ার সুযোগ আসবে। ওয়েটিং রুমে গিয়ে দেখে মেয়েটার পাশের সিটটা খালি, আর ওই একটা সিটই খালি পুরো রুমে। স্বভাবতই আবরার বসে পড়ল সেই সিটে। কি মনে করে আবরার সিট থেকে উঠলো ,তবে তার কাঁধেচাপা ব্যাগটা রেখে গেল ওই সিটেই। কিছুক্ষণ পর এসে দেখলো তার সিটে বসে পড়েছে আরেকটা মেয়ে তবে আবরারের সেই কথিত নায়িকা মেয়েটির সাথে একদম কানে মুখ লাগিয়ে কথা বলছে। বুঝতেই পারা গেল এরা পরিচিত। আবরার আসার সাথে সাথে নতুন মেয়েটিকে উঠে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিলো তার নায়িকা। আবরার এবারো বাদ সাধলো। দাঁড়িয়ে রইল আবরার।

হঠাৎ মেয়েটি কথা বলে উঠলো, "আসলে ও আমার ছোটবোন আর ওর জন্যই চোখের ডাক্তার দেখাতে এসেছি"

আবরার বলল "আমি এখানে পাঁচ বছর ধরে আসি।"

এরপর তাদের ডাক পড়ল কনসালটেন্সি রুমে, যেখানে চোখের পাওয়ার পরীক্ষা করা। সেখানে গিয়েও দেখা গেল একটাই সিট বসার জন্য। তবে এবার মালিহা শুধু বসলো আবরার আর মালিহার বড় বোন দাঁড়িয়ে রইল। চোখের পরীক্ষার সকল সময়ে আবরার মালিহাকে সাহায্য করল। কারন সে অভিজ্ঞ চোখের রোগী।

এরপর গেল ডাক্তারের রুমে। সেখানে আলাদা আলাদা যাওয়া হলো দুজনেরই, মালিহাকে ডাক্তার দেখিয়ে বের হলো সে আর তার বোন। আবরারের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেল মালিহা ও তার বোন। আবরার ডাক্তারের কাছে নিয়মিত চোখ পরীক্ষার অংশ হিসেবে চোখ পরীক্ষা করিয়ে বের আসলেন আর মনে মনে ভাবতে লাগলেন দেখা হবে না আর কোনোদিন। নামটাই জানা হলো না মোবাইল নম্বর তো অনেক পরের বিষয়। মনকষ্ট আর বিষাদগ্রস্ত অবস্থায় ওয়েটিং রুমের দিকে এগিয়ে গেলেন আবরার যেখানে তার প্রিন্টেড প্রেসক্রিপশন দেয়া হবে। কিন্তু কেন যেন মাঝে

মাঝে ভাগ্যও অনেক সহায় হয়ে ওঠে। ওয়েটিং রুমে এসে দেখে মালিহারা এখনো বসে আছে। আবরার গিয়ে তাদের পাশেই বসে পড়ল। সেখানে তাদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা, কথা তাদের দুজনের মধ্যেই হলো শুধু, মালিহা একদম চুপ।

আবরারের বাসা আশকোনা সিটি কমপ্লেক্স আর মেয়েটির বাসা প্রেমবাগান, পড়ে গ্রীণ ইউনিভার্সিটি ইংরেজি দ্বিতীয় বর্ষে। প্রেসক্রিপশন দিতে দেরী করছে বলছে বিরক্ত মালিহা, বিরক্ত মালিহার বোনও এমনকি আবরারও। তবে মালিহা ব্যতীত বাকি দুজনের বিরক্তি মেকি এবং ওই কার্য যতটুকু বিলম্বিত হতে পারে তাতেই যেন খুশি তারা। কি উচ্ছ্বাস কি আবেগ নিয়ে কথা বলছে তারা, যেন যুগ যুগ ধরে চেনে একে অপরকে। অবশেষে আসলো মালিহার সিরিয়াল, কিন্তু আবরারের সিরিয়ালের কোনো বালাই নেই। আবরারকে হাসিমুখে বিদায় দিয়ে চলে গেল তারা। আবরার রইলো একা, এতটা একাকী নিজেকে তার কখনো মনে হয়নি। কিছুক্ষণ পর আসলো তার প্রেসক্রিপশন, ইচ্ছা করছিল ম্যানেজমেন্ট কে দেরী করার জন্য একদম ধুয়ে দিতে কিন্তু তা সে করলো না। দ্রুত বের হবার প্রস্তুতি নিলো। উসাইন বোল্টের মত দৌড় শুরু করতেই পায়ে কিছু একটা বাধলো। আবরার তাকিয়ে দেখলো একটা মোবাইল। আরে এ তো সেই মোবাইল টাই যেটা ওই মেয়ে চালাচ্ছিলো, স্ক্রিনেও তার একটা শাড়ি পড়া ছবিও আছে। মোবাইল হাতে পেয়ে মেয়েটির নম্বর নেয়ার ইচ্ছা করলো না আবরারের তবে ইচ্ছা করছিল শাড়ি পড়া ছবিটা নিয়ে নিতে। কিন্তু সেই ইচ্ছা মুহুর্তেই আবার মিলিয়ে গেল তার। কারন মোবাইল টা মেয়েটার কাছে তো পৌঁছাতে হবে। সে দৌড় শুরু করলো। এক দৌড়ানি দিয়ে চলে গেল আজমপুর বাসস্ট্যান্ডে। সেখানে গিয়ে দেখে একটা বাস ছেড়ে যাচ্ছে, ঠিক সেই বাসেরই জানালায় মালিহা বসা। এবার আবার দৌড়। চলন্ত বাসের পিছনে দৌড়াচ্ছে আবরার। অনেক কস্ট ক্লেশ করে সে মোবাইল টা পৌঁছাতে সক্ষম হলো। তবে ধন্যবাদ দেয়ারও সুযোগ পেলো না বোনদ্বয়।

বাসায় পৌঁছাতেই জানতে পারলো মালিহার বড়বোনের একটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছে, ছেলে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। কোথাও যেন একটা সুর কেটে গেল মেয়েটার। সে কোনো উত্তর দিতে পারলো তার বাবা-মা কে। ওদিকে বেচারা আবরার নাম ও মোবাইল নাম্বার কিছুই জানতে পারলো না।

মেয়েটা পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই চলে গেল আশকোনা সিটি কমপ্লেক্স । সারাদিন ঘোরাঘুরি করলো আশেপাশে। সন্ধায় যখন বাসায় ফিরে যাবে তখন দেখা পেলো আবরারের। তবে দেখা পেয়ে তার আনন্দে মুখে হাসি ফুটলো না বরং কান্নায় চোখ ভেসে গেল। সে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলো, এক দৌড়ে চলে গেল বাসায়। বাবা-মা কে বিয়েতে তার রাজির হবার মত জানিয়ে দিলো।

ছয় মাস পরে সেই একই জায়গা: আই কেয়ার সেন্টার। আবারো হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলো আবরার তবে এবার জুতা রেখেই গেল ভিতরে আর সিরিয়ালেও কোনো ঝামেলা হলো না।

তবে ওয়েটিং এ গিয়ে দেখলো মালিহার বড় বোন বসা।

আবরার গিয়ে বললো, "আপনি কি মালিহাকে ডাক্তার দেখাতে এসেছেন? কি আজব ব্যপার! আমিও আমার ছোটবোন কে ডাক্তার দেখাতে এসেছি"

মেয়েটি বললো, "না, আমি নিজের জন্যই ডাক্তার দেখাতে এসেছি আমার হাজবেন্ড এর সাথে" আবরার একদম চুপ হয়ে গেল।

আর ঠিক তখনই একটা মেয়ে ওয়েটিং রুমে প্রবেশ করলো আর আবরারকে বললো, "ভাইয়া তুমি এখানে? আমি তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।"

মেয়েটি দেখলো, খুব ভালো করে দেখলো, সুতীক্ষ্ণ নজর দিয়েই দেখলো এই তো সেই মেয়েটা যাকে আবরারের সাথে দেখে গার্লফ্রেন্ড বা বউ মনে করেছিল আর কষ্টে-দুঃখে বাসায় বিয়ের জন্য রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। এ তো দেখি ওর বোন।" দুইজন ই চাপা কষ্টে ভুগতে লাগলো, কারটা বেশি তা বোঝা গেল না, তবে এবার গতবারের মত কিছুই হলো না।

নবীন- প্রবীন লেখীয়োদের প্রতি আহ্বান: সাহিত্য সুহৃদ মানুষের কাছে ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, রম্য রচনা সহ সাহিত্য নির্ভর আপনার যেকোন লেখা পৌঁছে দিতে আমাদেরকে ই-মেইল করুন [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড