• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

প্রবন্ধ

রফিক আজাদ : এক দুঃখী প্রজন্মের কবি

  শব্দনীল

১২ মার্চ ২০২০, ১১:৪৫
কবিতা
ছবি : কবি রফিক আজাদ

চুনিয়ারও অভিমান আছে, শিশু ও নারীর প্রতি চুনিয়ার পক্ষপাত আছে; শিশুহত্যা, নারীহত্যা দেখে-দেখে সেও মানবিক সভ্যতার প্রতি খুব বিরূপ হয়েছে।

যিনি নিজেকে দুঃখী প্রজন্মের কবি বলে ঘোষণা করলেও ছিলেন কাউন্টার কালচারের এক প্রতীক। ষাটের দশকে তরুণদের ভেতরে একধরনের অস্থিরতাপূর্ণ সময় গিয়েছে। নৈরাশ্যবাদীতাকে ধারণ করে ইশ্বরকে অস্বীকার করে মানবতাই ছিলো যার মূল কথা তিনি কবি রফিক আজাদ।

যদিও আমারা তাকে ‘ভাত দে হারামজাদা’, ‘সীমাবদ্ধ জলে সীমিত সবুজে’, ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’, ‘পাগলা গারদ থেকে প্রেমিকার চিঠি’র কবি চিনি। অনেকে আবার বলে থাকেন স্লোগানসর্বস্ব কবি। ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা টগবগে এক তরুণ হঠাৎই আবিষ্কার করেন নিজের স্বপ্নভঙ্গের এবং যার উপলব্ধি হয় ঢাকা নিরাশার এক শহর ও পৃথিবী দুঃখ ভারাক্রান্ত। তার কবিতা বুঝতে হলে নিজের রুচিবোধকে এক পাশে সরিয়ে রেখে পড়তে হবে। ষাটের নিরাশা, অন্ধত্ব, বধিরতায় নিমগ্ন কবিদেরই মাঝে নিজে এনে দাঁড় করালেই চলতে পারবেন অসম্ভবের পায়ে পায়ে রফিক আজাদের সাথে।

কবি নিজেই বলেছেন, আমি দুঃখী প্রজন্মের কবি। আমরা সমাজ বিচ্ছিন্ন, আত্মধ্বংসী, মৃত্যুপরায়ণ, বিষণ্ণ। আমাদের একমাত্র বিশ্বস্ত বন্ধু সিগারেট...’

ষাটের দশকের বাঙালি জীবনের রাজনৈতিক উত্তাপ গায়ে না মেখে কবি নৈরাশ্যের পচা ডোবার ভিতর থেকে কবিতা লিখেছেন বারবার। জীবনকে দেখেছেন স্পন্দনহীন, স্বপ্নহীন, আলোহীন ভাবে। রফিক আজাদের কয়েকটি কবিতার শিরোনাম দিকে তাকালে অনেকটা বুঝা যায়- ‘সৈকতে স্বপ্নহীন’, ‘নগর ধ্বংসের আগে’, ‘কুয়াশার চাষ’ ‘বাতাসের উল্টো দিকে যাত্রা’, ‘স্বগত মৃত্যুর পটভূমি’, ‘জ্যোৎস্না আর নেই’, ‘ঊর্ধ্বশ্বাস অশ্বগুলি’, প্রভৃতি। ‘নগর ধ্বংসের আগে’ কবিতায় তিনি লিখেছেন- নগর বিধ্বস্ত হ’লে, ভেঙ্গে গেলে শেষতম ঘড়ি উলঙ্গ ও মৃতদের সুখে শুধু ঈর্ষা করা চলে। ‘জাহাজ, জাহাজ’ – ব’লে আর্তনাদ সকলেই করি - তবুও জাহাজ কোনো ভাসবে না এই পচা জলে।’

হতাশাকে লালন করে বুকের জমিন করেছেন উর্বর। ফলল তুলেছেন মুঠো ভরে নৈরাশ্যের। ‘রোগশয্যায়’ কবিতায় নিজেই লিখেছেন- ‘আজীবন রুগ্নতায় হাসপাতালের বেডে পড়ে আছি অন্ধ ও বধির? রোগীদের মতো ম্লান অল্পপ্রাণ বাল্ব জ্বলে ওঠে এমন আলোর থেকে আলোহীনতাই ভালো।’

সময়, সমাজ, মানবতা, রাজনীতি, নৈরাশ্যবাদ, স্বপ্নভঙ্গ ছিলো না শুধু, তার কবিতার পথচলায় ছিলো প্রেমও। তিনি কবিতার মধ্য দিয়ে বারবার কামনায় কাতর হয়েছেন নারী সঙ্গের এবং বিরহকে করেছেন লালন। কবি সিকদার আমিনুল হক প্রেম প্রত্যাশি কবি সম্পর্কে লেখেন, ‘রফিকের কবিতায় প্রেম ও নারীর প্রসঙ্গ এসেছে বারবার, প্রতিশ্রুতি মুক্তির অপরিমিত আলো নিয়ে। তাই তিনি স্বভাবতই নারীকে বলতে পারেন, ‘তোমার হাঁটার ভঙ্গি দেখে মুহূর্তেই লেখা হয়/কবিতার ব্যবহার্য সমস্ত ছন্দের মূলসূত্র।’… তিনি প্রেমকে প্রচলিত আধুনিক নিয়মে ব্যঙ্গ করেননি- বঞ্চিত অবস্থায়ও বিষণ্ণ ও আন্তরিক সশ্রদ্ধ থেকেছেন। প্রেমের সফলতা বা পূর্ণতার দিকে সোচ্চার হতে তিনি পারেননি- এক মেদুর হতাশা নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে দেখেছেন মাত্র।’

কবি ভালোবাসা পাওয়ার জন্য ছিলেন ব্যকুল এবং স্বপ্নবান পুরুষ অন্যদিকে সরলতা ছিলো তার কবিতার লাইনে। যিনি বলছেন প্রেমীকাকে পেলে জীবনের ভুলগুলি শুধরিয়ে নিবেন, পাহাড় ডিঙ্গাবেন, সমুদ্র সাঁতার কাটবেন । ‘যদি ভালবাসা পাই’ কবিতায় তিনি লিখেছেন- ‘যদি ভালবাসা পাই পাহাড় ডিঙ্গাবো আর সমুদ্র সাঁতরাবো যদি ভালবাসা পাই আমার আকাশ হবে দ্রুত শরতের নীল’

অপেক্ষায় থাকা এক প্রেমিকের মতো হাজার আন্দোলন বুকে চেপে রেখেছেন শুধু বলতে পারেননি কিছুই শুধু নীরবতা ছাড়া তার ছিলো না কিছুই দেওয়ার। ‘মাধবী এসেই বলে: ‘যাই’ কবিতায় তিনি লিখেছেন- ‘খণ্ডিত ব্রিজের মতো নত মুখে তোমার প্রতিই নীরবে দাঁড়িয়ে আছি: আমার অন্ধতা ছাড়া আর কিছুই পারি নি দিতে ভীষণ তোমার প্রয়োজনে; উপেক্ষা করো না তবু, রানী—তোমার অনুপস্থিতি করুণ বেদনাময়—বড় বেশি মারাত্মক বাজে বুকের ভিতরে কী যে ক্রন্দনের মত্ত কলরোলে।’

অভিমানি কবি বলছেন- ‘আমাকে খুঁজো না বৃথা আমাকে খুঁজো না বৃথা কাশ্মীরের স্বচ্ছ ডাল হ্রদে, সুইৎজারল্যান্ডের নয়নলোভন কোনো পর্যটন স্পটে, গ্রান্ড ক্যানালের গন্ডোলায়ও নয়, খুঁজো না ফরাসি দেশে পারীর কাফেতে, মধ্যরাতে; রাইন বা মাইনের তীরে, সুবিস্তীর্ণ ফলের বাগানে…’

রফিক আজাদ ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছেন কবি। তার কবিতা স্পর্শ করেছে শিল্পের শীর্ষবিন্দু। তিনি প্রথম জীবনে ছিলেন সৌন্দর্যকাতর এক কবি কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিপার্শ্বের অন্যান্য অনুষঙ্গকে নিয়েছেন নিজের করে। নৈরাশ্য, রাজনীতি, প্রেম, দেহ, হিংসাকে এক এক করে চিত্রশিল্পীর মতো তুলি দিয়ে এঁকে তুলেন ক্যানভাসে। তার কিছু সৃষ্টি অমর শিল্পে রূপান্তর হয়েছে । এখানে শুধু হতাশা নয় আছে জীবনের আশাবাদ। তার কবিতায় কোনো নির্দিষ্ট বিষয় ছিলো না অথবা বলা যায়, কোনো নির্দিষ্ট বিষয় তার কবিতাকে ধারণ করার যোগ্যতা রাখে না। এটা সত্য প্রথম থেকে এখনোও রফিক আজাদ সুন্দরের অভিলাষী। এর সঙ্গে ক্রমে যুক্ত হয়েছে সত্যের ধারণা। সুন্দর ও সত্যের সন্ধানী কবি রফিক আজাদ। তিনি ‘সত্য ও সুন্দর’ কবিতায় লিখেছেন- ‘সুন্দরের দিকে চোখ রেখে সত্যের সামান্য অংশ খুঁজে পেতে অনেকেই লাঙলের ফলা আঁকড়ে ধরে- সত্যের বদলে কিছু উঠে আসে সুন্দরের সীতা! সত্যে ও সুন্দরে কোনো দীর্ঘস্থায়ী বিরোধ বাঁধে না!’

১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি রফিক আজাদ ছিলেন তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। যিনি ভাষা শহীদদের স্মরণে বাবা-মায়ের কঠিন শাসন অস্বীকার করে খালি পায়ে হেঁটেছেন মিছিলে। ভাষার প্রতি এই ভালোবাসেই পরবর্তী সময়ে রফিক আজাদকে তৈরি করেছে কবি। তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের অংশগ্রহণ করেছেন কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে। ১৯৪২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। কর্মজীবনে সাংবাদিকতা, সরকারি চাকরি ও শিক্ষকতা করেন রফিক আজাদ। ২০১৬ সালের ১২ মার্চ ৭৪ বছর বয়সে মারা যান একুশে পদক প্রাপ্ত নৈরাশ্যবাদের এই কবি।

আরও পড়ুন : একজন বঙ্গ রাখাল ও লণ্ঠনের গ্রাম

নবীন- প্রবীন লেখীয়োদের প্রতি আহ্বান: সাহিত্য সুহৃদ মানুষের কাছে ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, রম্য রচনা সহ সাহিত্য নির্ভর আপনার যেকোন লেখা পৌঁছে দিতে আমাদেরকে ই-মেইল করুন [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড