• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৫ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

আলোর পরশ

  আমানুল্লাহ নোমান

০৯ মার্চ ২০২০, ১৬:০৮
আমানুল্লাহ নোমানের গল্প
ছবি : সংগৃহীত

চৈত্রের প্রখর রোদ। সূর্যের উত্তাপে অস্থির প্রকৃতি। কোথাও একটু প্রবাহমান বাতাসের অনুভব পাওয়া যাচ্ছে না। এমন কাঠফাটা রোদে মাঠের কাজ শেষে বাড়ি ফিরেছেন মতি মিয়া। নাম তার মতিউর রহমান। গ্রামে নাম সংক্ষেপনের প্রচলনে মতিউর রহমানের নাম হয়েছে মতি মিয়া। রোদে পুড়ে প্রচণ্ড পিপাশার্ত হয়ে বাড়ি ফিরছেন। পানি পান করতে যেয়ে দেখেন খালি কলস পড়ে আছে। মেজাজ খারাপ করে পানির কলসীকে এক আছাড় মেরে কলের কাছে যান তিনি। কল চেপে পর্যাপ্ত পানি পান করে বারান্দায় হোগলপাতার পাঁটি বিছিয়ে শুয়ে শুয়ে বউকে বলেন- কী কামডা করো তুমি? একটু পানিও ঘরে রাখতে পারো না! : রাখছিলাম। আমনের পোলাপানে খাইয়া হালাইছে। : তোমার পোলাপানগুলো আছেতো খালি খাওনের তালে। এজুস-মেজুসের চাইতেও হারামি। হারাদিন খালি খাই খাই করে। পারলে আমার কইলজাডাও খাইয়া হালাইবে। : থামেনতো। খালি আকতা কইয়েন না। আমনের পোলাপান আমনেরডা না খাইলে কারডা খাইবে? : পড়ালেহা করে না কামও করে না। মুই কী জন্ম দিয়া ঠেকছি? : চুপ করেনতো। মানষে হুনলে কী কইবে? : রাহ তোমার মানষের কতা। মানষে মোগ ভাত দেয় না পানি দেয়? : এই পোলাপান তোমার শক্তি। ওরা বড় অইলে তোমার মোনের জোর বাড়বে। : বলদা শক্তি কোন কামে লাগে না। পড়ালেহা কইরা মানুষ অইলে কামে লাগতো। আমিতো বুঝি নাই। ছোড বেলায় বাবারে হরাইছি। হেইরলইগ্যা মানুষ আর অইতে পারলাম না। এগুলারে এ্যাত কইলাম স্কুলে যা। কেডা হোনে কার কতা। : হোনেন রহমতের বাপ। আমনের সাতখান পোলা। এ্যাকখানে খারাইলে আমনের সাতটা লাডি। সাতজনে যহন কামাই করবে তহন মোগ সোংসারে আর কোন দুঃখখো থাকবে না। : ওরে আমার নশু। তুমি না ঘুমাইয়্যা কত হপ্পন যে দ্যাহো। পারলে ওগুলারে স্কুলে পাডাও। স্কুলে না গেলে কামে পাঠাও। : মুইতো কোম চেষ্টা করি নাই। হেগুলায় স্কুলে যাইবে না। হেদিন হেডমাস্টারও আইলো। অগো স্কুলে পাডাইতে কইলো। কওদেহি মুই এহন কী করতে পারি? স্ত্রী আলেয়া বেগমের কথা শুনে নীরব হয়ে যান মতি। স্বামীর নীরবতায় স্ত্রীও নীরব। শুধু দুহাত নেড়ে বাতাস করে যাচ্ছেন প্রিয় স্বামীকে। অনেকক্ষণ নীরব থেকে প্রিয় স্বামীকে জিজ্ঞেস করছে কিছু কননা যে। চুপ করে আছেন ক্যান? স্ত্রীর প্রশ্নের কোন জবাব নেই মতির মুখে। শরীর ঘুরিয়ে মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে জোরে নিঃশ্বাস ফেলেন তিনি। জোর নিঃশ্বাসের শব্দ প্রশ্ন জাগায় আলেয়ার মনে। স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে কী অইছে আমনের? এত জোরে নিঃশ্বাস নিলেন যে! : না কিছু অয়নাই। : কিছু না অইলে খালি খালি কী কেউ এমন কইর‌্যা নিঃশ্বাস নেয়? কী অইছে আমারে খুইল্যা কন। : না হেইরহম কিছু না। সামনের দিনগুলার কতা চিন্তা করতেছিলাম। ক্যামনে আমাগো দিন যাইবো। : হোনেন রহমতের বাপ। অত ঘাবরাইয়ে না। দেইখ্যেন সামনের দিনগুলা ভালোই যাইবো। সময় অইলে আল্লাহ আমাগোদিগে মুখ খুইল্যা তাকাইবো। : তুমিতো কত কতাই কও। ফলতো দেহি না। : আল্লাহর উফরে বিশ্বাস রাহেন। এ্যাকদিন ফল পাইবেন। : ইনশাআল্লাহ কও বউ। ইনশাল্লাহ কইলে আল্লাহ সবকিছুতে বরকত দ্যান। : ইনশাল্লাহ বরকত অইবে। : বৌ সব ঠিক আছে। কিন্তু কষ্ট লাগে হেইসময় যেসময় জমির কতা মনে ওডে। নিজের জমি থাকতে মুই পরের জমি বর্গা চই। : কী আর করবেন। গরীবের কেউ নাই। দ্যাশের কোর্ট-কাচারী, মন্ত্রী-এমপি, উকিল-পুলিশ সব কিছু ধনীগো, গরীবগোনা। : এগ্রিমেন্ট দলিলের কোন ভিত্তি নাই মুই এই কতাডাই বুঝাইতে পারলাম না। সালাম হরদার ওগো সবাইরে টাহা দিয়া কেনছে। থানায় বইয়া শালিসী অইলো। হেহানেও ভেজাল। এহন মোগমত মানষে যাইবে কই? : চিন্তা কইরেন না। জমি একদিন অধমাগো দহলে আইবোই। সত্যরে বেশিদিন চাঁইপ্যা রাহন যায় না। : ভাত খামু। কী রানছো? : কদুর হাক আর ডাইল। : ভাত আন। বেশী ক্ষিধা লাগজে। : সবুর কর,আনতেআছি। বউ ভাত এনে দিলে খেতে বসে মতি। লাউ শাক আর ডাল দিয়ে তৃপ্তি সহকারে ভাত খাচ্ছেন। এমন সময় বাহির থেকে ডাক আসে। মতি ভাই ,ও মতি ভাই, ঘরে আছেন? : আছি। কেডা? : আমি সমিতির লোক, রফিক। : ওহ! আমনে! আহেন, ভেতরে আহেন। বউ সামনে একটা চেয়ার দ্যাও। : থাক। লাগবেনা মতি ভাই। : কিস্তির টাকাটা দেন আমি চলে যাই। : ভাই টাহাতো যোগার করতে পারিনাই। : মতি ভাই কতদিন আর ঘুরাবেন। চার মাসের টাকা বাকি পড়েছে। এর পরে সুদের টাকাতো আছেই। : মুই কোন দুঃখখে আমনেগো টাহাযে নেলাম! এই কথা বলে নিজ কপালে হাত দেন মতি মিয়া। : লোনে টাকা যেহেতু নিয়েছেন সুদে-আসলে ফেরত দিতেই হবে। : হ ভাই জীবন যায় যাউক। আমনেগো টাহার মাইর নাই। : ভাই আমাকে এসব বলে লাভ কী? আমি পেটের দায়ে চাকরি করি। আজ আমি আসছি। কাল আমি না থাকলে অন্য কেউ আসবে। : হ ভাই কানে ধরছি। সুদে আর টাহা উডামুনা। সুদ য্যারে ধরে হ্যারে শ্যাষ কইর‌্যা দেয়। মুই এ্যত কইর‌্যা কইলাম মোর ফসল নষ্ট নষ্ট অইছে। কেডা হোনে কার কতা। আমনেগো সুদে-আসলে টাহা ফেরত দিতেই অইবে। : ভাই এখন কী করবেন। টাকা কী দেবেন? : ভাই ছোডকালে বাবায় মোগ কাবুলীওয়ালার গপ্প হুনাইছিল। হ্যারাও এনরহম সুদে টাহা দিত। আমনেরা হ্যাগোও ছাড়াইয়্যা গেছেন। হ্যারাতো কোন বিদেশী পুরস্কার পায় নাই। কিন্তু আমনেরা নোবেল পাইলেন কোন দুঃখখে। বিদেশিগো মাতা মনে হয় পুরাই খারাপ অইছে। : ভাই লেকচারতো কম দিলেন না। এতকিছুই যেহেতু বুঝেন। লোনটা না নিলেওতো পারতেন। : একটা খোন্দ মাইর যাইবে হেই চিন্তা কইর‌্যা নিছিলাম। কিন্তু বইন্যায় সব ডুইব্যা গেছে। তবুও আমনেগো টাহা খারা রইছে। : ভাই আমাকে এসব বলে কোন লাভ নেই। আমি আপনার টাকা কমাতেও পারবো না বাড়াতেও পারবো না। অফিস যে আদেশ দেয় আমি তা বাস্তবায়ন করি মাত্র। এখন বলুন টাকা কবে দেবেন। : ভাই পরশু আহেন। আমনের সব টাহা দিয়ো তওবা পড়মু। : ঠিক আছে ভাই মিস হয় না যেন। আমি পরশু আসবো। ঐদিন মিস হলে নোটিশ জারী করবো কিন্তু। এ কথা বলে সমিতির লোক চলে যায়। : দ্যাখছো আলেয়া সুস্থমত দ্গ্গুা ভাত ও খাইতে পারমুনা। লোনডা নিয়া কী যে ভুল করছি। : এহন করনের আর কী আছে। বেডায়তো ডেলি জ্বালাইবে। : দেহি কী করা যায়। : সিদ্দিক ভাইরধারে কিছু টাহা চাবাকিনা? : হ্যার ধারেগোনে কয়দিন আগেও টাহা নেলাম। এহন আবার চাই ক্যামন করইয়্যা কও। এত্ত জ্বালা-যন্ত্রণা ভালো লাগে না। মোনে চায় এ্যাকদিকে আডা দেই। : অত উতালা অইয়োনা। সবুর কর। আল্লায় ব্যবস্থা করবে। : হোন আলেয়া মরছিদে হুজুরে কইছে সুদ খাওয়া দেওয়া বড় গুনাহ। সুদ খাওয়ার ছোড গুনাহ হলো মার লগে জেনা করার গুনা। সুদ যে দেয়,যে খায়,আর যে স্বাক্ষী থাহে সবাই হোমান গুনাগার। : তোবা তোবা কী কও এ্যাত্ত গুনা। : এর লইগ্যা প্রথম মুই নেতে চাইনাই। পরে লোভে পইর‌্যা নিছি। এহন লোভের পাপে ধরছে। : হোনেন রহমতের বাপ তাইলে এ্যাকটা কাম করি মোগ গরুডা বেইচ্যা দ্যান। লোনের সব টাহা দিয়া তওবা পরি যে আর কোন দিন সুদে লোন নিমুনা। : হ তাই করতে হবে। আমি না হয় আতালের গরুডা হারামু। অনেকেতো নিজের ভিডা-বাড়িও আরাইছে। নাহ! এই শ্যাষ আমি আর সুদ-ফুদের মধ্যে যামুনা। : গরুর গাহেক বিছরাও। : মুই আগেই বুজজি গরু বেচা লাগবে। হেইরলইগ্যা গরুর ব্যাহারীরে আগেই আইতে কইছে। পরের দিন গরুর ব্যাপারী মতি মিয়ার বাড়িতে আসে। মতি মিয়া ব্যাপারীর কাছে গরুটি পঞ্চাশ হাজার টাকায় বিক্রি করে। গরু বিক্রির সব টাকা দিয়ে লোনের টাকা পরিশোধ করেন। লোনের টাকা পরিশোধ করতে পেরে বেজায় খুশি তিনি। যদিও গরুটি হারিয়েছেন। গরুটি এখন তার কাছে মুখ্য নয়। তিনি সুদ মুক্ত হয়েছেন এতেই তিনি মহা খুশি। বিকেল বেলা শাক বিক্রি করতে বাজারের উদ্দেশে বের হন মতি মিো। পথে ইমাম সাহেবের সাথে দেখা। : আসসালামু আলাইকুম, হুজুর। : ওয়াআলাইকুমুস সালাম। মতি ভাই কেমন আছেন? : আমনেগো দোয়ায় ভালোই আছে। : কোথায় যাচ্ছেন? : বাজারে যামু। : শাক বিক্রি করবেন বুঝি। : হ হুজুর। : খুব ভালো জিনিষ। বিষমুক্ত শাক উৎপাদন করবেন। বিষমুক্ত খাবার তৈরি করা ঈমানী দায়িত্ব। : হুজুর আমনের লগে কিছু কথা আছে। : এখন বলবেন, না পরে বলবেন? : না এহনই কই। : বলুন। : হুজুর আমনে এ্যাকদিন জুমার নামাজের ওয়াজে কইছিলেন যে, সুদ খাওয়া বড় গুনা। সুদ খাওন,দেওন, আর স্বাক্ষী থাহন সবই হোমান গুনা। এই কতা হুইন্নাও মুই লোভে পইর‌্যা সুদে টাহা নেছেলাম। অবস্থা বেগতিক দেইখ্যা আতালের গরু বেইচ্যা সুদের টাহা দিয়া দিছি। এহন আল্লায় কী মাফ করবেন হুজুর? : মতি ভাই শয়তান মানুষের পেছনে লেগেই থাকবে। আল্লাহ পরম দয়ালু। বান্দাহ অনিচ্ছা বশত গুনাহ করে ফেললে তখন খাঁটি তওবা করতে হয়। আর খালেস তওবা মানুষকে গুনাহ মুক্ত করে। আপনি আপনার ভুল বুঝতে পেরে সুদেও জীবন থেকে নিজেকে ফিরিয়ে এনেছেন তা নিঃসন্দেহে ভালো কাজ। আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুক এই প্রার্থনা করি। আর কিছু কথা না বললেই নয় মতি ভাই। আমাদের সমাজ অনেক কুলষিত। আমরা অনেকেই নামে মুসলমান কিন্তু কাজে নয়। আজ সমাজে যদি যাকাত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত থাকেতো তাহলে সমাজে মহামারি আকারে সুদ ছড়াতো না। গ্রামের অনেক লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সুদের সাথে জড়িত। এজন্য আমাদের সমাজ ব্যবস্থা,রাষ্ট্র ব্যবস্থা দায়ী। এ দায় থেকে আমরা কেউ এড়াতে পারবো না। তার পরও মাশাআল্লাাহ আপনি ভুল বুঝতে পেরে ফিরে এসেছেন। এ জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। : হুজুর মোর একটু কষ্ট লাগতে আছে। হ্যারপরও মুই খুশি। : ও ভালো কথা। আমাদের গ্রামে যাকাত ভিত্তিক একটি বেসরকারি সংগঠন কাজ শুরু করেছে। তারা দারিদ্র বিমোচনের জন্য বিনা সুদে নানা কার্যক্রম শুরু করেছে। আমি তাদের কাছে আপনার ব্যাপারে সুপারিশ করবো। কাল অথবা পরশু আপনি আমার সাথে দেখা করেন। আপনাকে ঐ অফিসে নিয়ে যাবো। : ঠিক আছে হুজুর। মুই কাইল-ই আমু। আইজ হেলে যাই। আসসালামু আলাইকুম। হুজুরকে সালাম দিয়ে বিদায় নেয় মতি মিয়া। বাজারে শাক বিক্রি করে খুশি মনে বাড়ি ফেরেন তিনি। আজ বেচা-বিক্রি বেশ ভালোই হয়েছে। অন্যদিনের চেয়ে বাজারে ভালো দাম পেয়েছেন। বাড়ি ফিরে ইমাম সাহেব হুজুরের সাথে আলোচিত কথাগুলো বউয়ের সাথে শেয়ার করেন। মতি মিয়ার বউ কথাগুলো শুনে বললেন, দেখছেন ভালো চিন্তা করলে আল্লায় ভালো পোত বাইর কইর‌্যা দেয়। কাইল হুজুরের লগে হেই অফিসে যান। দ্যাহেন হে কী করতে পারে। : হ যামু। দেহি হেহানে গেলে কী ব্যবস্থা অয়। পরেরদিন হুজুরের সাথে সেন্টার ফর যাকাত ম্যানেজমেন্টের শাখা আফিসে যান মতি মিয়া। ম্যানেজারের সাথে পুরো বিষয়টি শেয়ার করেন তিনি। ইমাম সাহেব হুজুর ম্যানেজারকে বলেন ভাই আমার মসজিদের মুসল্লী। ভুল বুঝতে পেরে সুদ ব্যবস্থা থেকে ফিরে এসেছেন। তার জন্য কিছু করতে পারলে ভালো হতো। মতি মিয়ার সাথে কথা বলেন ম্যানেজার সাহেব। তার পেশা ও পরিবারের সব বিষয়ে তথ্য নেন তিনি। সব কিছু বিবেচনা করে মতি মিয়াকে কয়েকটি প্রস্তাব দেন ম্যানেজার। মূলত দরিদ্র লোকজনের পেশা বিবেচনা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে সংস্থাটি। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার পরে ফলোআপে রাখেন তারা। মতি মিয়াকে তারা বেশ কয়েকটি প্রকল্পের প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবগুলো হলে মাছ চাষ প্রকল্প, চাষাবাদ প্রকল্প, যানবাহন প্রকল্প ও কুটির শিল্প প্রকল্প। রাতে বাসায় ফিরে পুরো ব্যাপারটি নিয়ে স্ত্রীর সাথে আলাপ করে মতি মিয়া। মতি মিয়ার বউ বুদ্ধিমান মানুষ। বউয়ের বুদ্ধিমত্তার জোরে সংসারটি কোনভাবে টিকে আছে। বউ সবকিছু শুনে কুটির শিল্প প্রকল্প নেওয়ার সিদ্ধান্ত দেয়। পরেরদিন মতি মিয়া অফিসে এসে সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে ফরম পূরণ করে। অফিস পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে মতি মিয়াকে কুটিরশিল্প স্থাপনের যাবতীয় সরঞ্জামদি কিনে দেয় এবং উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। প্রশিক্ষণ পেয়ে বেশ উজ্জিবীত হয় মতি মিয়া। নতুনভাবে কাজ শুরু করেন তিনি। কুটিরশিল্প হিসেবে মতিমিয়াকে মহিলাদের চুলের ব্যন্ড তৈরির একটি পাওয়ার মেশিন ক্রয় করে দেন। ঢাকার নারায়ণগঞ্জ ডায়িং সুতা এবং বিদেশ থেকে আমদানীকৃত পিটি ( পাওয়ার প্রোফাইলিং) সুতা এবং রাবার ক্রয় করে বিভিন্ন ডিজাইনের ব্যান্ড তৈরি শুরু করেন। প্রথমে ভালো সাড়াপান তিনি। সর্ব প্রথম স্থানীয় বাজারের কসমেটিকস এর দোকানে প্রোডক্ট দেন তিনি। প্রোডাক্টের গুণগত মান বজায় থাকায় চারিদিকে সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। ব্র্যান্ডের নাম দেন “সাত ভাই চম্পা চুলের ব্যান্ড”। ধীরে ধীরে নিজ উপজেলা থেকে বিভিন্ন উপজেলায় ও জেলায় মতি মিয়ার প্রোডাক্টের চাহিদা বেড়ে চায়। সেই সাথে বেড়ে যায় মতি মিয়ার প্রোডাকশন। প্রডাকশন বেড়ে যাওয়ায় ব্যস্ততা বেড়ে যায় মতি মিয়ার। প্রথমে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কাজ শুরু করলেও মতি মিয়ার কারখানায় এখন দশজন কর্মচারী কাজ করছে। বেশ ভালোই দিন কাটছে তার। আগের সেই দুঃখ নেই। নেই সেই সুদের লোনের বোঝা। ছোট ছেলে ও মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন। অভাবের তাড়নায় অন্য সন্তানদের লেখা পড়া না করাতে পারলেও ছোট এ দুজন সন্তানকে লেখাপড়া শেখাতে বেশ তৎপর। স্কুলে ভর্তি করিয়ে হেড মাস্টার স্যারকে মতি মিয়া বলেছেন, ছার আল্লাহ মোগো উফরে রহমত দিছে। আগে অভাবে ছিলাম এহন নাই। ছার মোর এই পোলা ও মাইয়াডারে একটু মানুষ কইরা দিবেন। শুরু হয় মতি মিয়ার নতুন জীবন। কাজের ব্যস্ততায় দিনের সময়গুলো কিভাবে যে কেটে যায় কোন কিছুই অনুভব করতে পারেনা মতি মিয়া। নিজের পরিবার, কারখানা, কারখানায় কর্মরত শ্রমিক সবাইকে নিয়ে বেশ সাচ্ছন্দে আছেন তিনি। সব কিছুর উছিলা মসজিদের ইমাম সাহেব হুজুর। ইমাম সাহেব হুজুরের সুপারিশে যাকাতের টাকা পেয়ে জীবনের মোর ঘুরে যায় তার। তাই ইমাম সাহেব হুজুরের সাথে দেখা হলেই কৃতজ্ঞভরে মোসাহাফা করতে দুহাত বাড়িয়ে দিয়ে হুজুরকে বলেন হুজুর আপনের জন্য মোর আইজ এত উন্নতি। আপনের এই উপকারের কথা কোন দিন ভোলতে পারমুনা হুজুর। উত্তরে হুজুর বলেন মতি ভাই সব কিছু আল্লাহর ইচ্ছা। আমি উছিলা মাত্র। আজ পবিত্র জুমার দিন। মসজিদে মতি মিয়া এবং তার সন্তান ও কর্মচারীদের নামাজ আদায় করতে এসছেন। হুজুর আজ পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থার কুফল সম্পর্কে আলোচনা করছেন। এর পাশাপাশি যাকাত ভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থার সুফল সম্পর্কে আলোচনা করছেন তিনি। যাকাত ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার উদাহরণ দিতে গিয়ে হুজুর বলেন, আপনাদের সামনে বাস্তব প্রমাণ আমাদের পাড়ার মতি ভাই। সুদ ভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থা মতি ভাইকে কেমন রেখেছিল! আজ মতি ভাই যাকাত অর্থ পাওয়াতে এখন কেমন আছে। মুসল্লী ভাইয়েরা সবাই যার যার অবস্থান থেকে সতর্ক হোন। শুধু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করলেই ইসলামের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। এর সাথে অনেক দায়িত্ব জড়িত। সমাজকে অনিষ্টের হাত থেকে রক্ষা করা প্রত্যেকের দায়িত্ব। তাই আসুন আমরা সকলে সুদ ভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থাকে না বলি। সবাই সঠিকভাবে যাকাত আদায় করি। নামাজ শেষে ইমাম সাহেব হুজুরের সাথে দেখা করেন তিনি। সাথে সন্তান ও দোকানের কর্মচারীরা। : আসসালামু আলাইকুম। মতি ভাই কেমন আছেন? : হুজুর আপনাদের দোয়ায় ভালো আছি। : আপনার কারখানা কেমন চলছে? : ভালো হুজুর। হুজুর আইজ যাকাতের কতা কইলেন। মুইতো আশা করি সামনের বছর মোর যাকাত দেওন লাগবো। কিন্তু কেমনে হিসাব করে দিমু। : নিয়ম হলো আপনার যাবতীয় সম্পত্তি এবং আপনার যাবতীয় সব খরচ মিটিয়ে আপনার কাছে যদি সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ অথবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য আথবা এর সমপরিমাণ মূল্য আপনার কাছে অবশিষ্ট থাকে তাহলে এর উপর থেকে আপনাকে অবশিষ্ট টাকা বা সম্পদের উপর ২.৫% হারে যাকাত দিতে হবে। এতো গেল সম্পদের হিসেব। এভাবে গরু, ছাগল, ভেড়া ও ফসলের উপর ও যাকাত দেওয়ার বিধান রয়েছে। সেক্ষেত্রেও বিধিবিধান ইসলাম স্পষ্ট করে দিয়েছে। মতি ভাই ইসলাম শুধু ধর্ম নয় এটা একটা জীবন ব্যস্থা। সবকিছুর সমাধান এখানেই রয়েছে। যাক যাকাত দেওয়ার বিষয়ে আপনি ভাববেন না যে সংগঠন আপনাকে টাকা দিয়েছে তাদের ওখানে এ সেবাটি চালু আছে। তাদেরকে জানালে আপনার কারখানা ও আয় ইনকামের সবকিছু কষ্টিং করে অপনাকে কত টাকা যাকাত দিতে হবে সে হিসেব তারা বের করে দেবে। হুজুরের কথা শুনে আশ্বস্থ হন মতি মিয়া। যাকাত সমাজের জন্য কতটা উপকারী তা হারে হারে টের পেয়েছেন তিনি। তাই নিজেও যাকাত দিতে উদগ্রীব। আগামী বছর তিনি যাকাত দেওয়ার উপযুক্ত হবেন। তাই এখনই ইচ্ছা পোষণ করেছেন যে, আগামী বছর যাকাত প্রদান করে গরীব মানুষের ভাগ্য ফেরাতে কাজ করবেন তিনি।

ওডি/এএস

নবীন- প্রবীন লেখীয়োদের প্রতি আহ্বান: সাহিত্য সুহৃদ মানুষের কাছে ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, রম্য রচনা সহ সাহিত্য নির্ভর আপনার যেকোন লেখা পৌঁছে দিতে আমাদেরকে ই-মেইল করুন [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড