চাণক্য বাড়ৈ
কাহিনি-সার
আমার আগ্রহের বড় জায়গাজুড়ে রয়েছে প্রকৃতি। এর কারণ হতে পারে আমার বেড়ে ওঠা। আমার শৈশব আর কৈশোর কেটেছে প্রকৃতির বিস্ময় সুন্দরবনের উপকণ্ঠে। সত্যিই প্রকৃতির অপার বিস্ময় এই সুন্দরবন। অসংখ্য কিংবদন্তী রয়েছে এই ম্যানগ্রোভ বন, রয়েলবেঙ্গল টাইগার আর বনবিবিকে নিয়ে। কিংবদন্তী রয়েছে সুন্দরবনের মূর্তিমান আতঙ্ক জলদস্যুদের নিয়েও। কিন্তু এর সবই কি কিংবদন্তী, নাকি বাস্তবতাও কিছু আছে?
এই ভাবনা থেকেই দৃষ্টি ফেরাই সুন্দরবনের ইতিহাসের দিকে। হাতের কাছে যেসব বই পাই পড়ে ফেলি, ইন্টারনেট ঘাঁটি। ইতিহাস বলছে, সেই কোম্পানি আমলেও সুন্দরবনের প্রধান সমস্যা ছিল জলদস্যুতা; বর্তমানেও যা বিদ্যমান। এখনও পর্যটক, সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী আর বনের প্রতিবেশের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি এই জলদস্যু। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার সুন্দবনকে জলসদ্যুমুক্ত ঘোষণা করলেও বিবিসিসহ অন্যান্য গণমাধ্যমে উঠে এসেছে ভয়াবহ চিত্র। নদী আর জঙ্গলে এখনও সক্রিয় রয়েছে অস্ত্রধারী দুর্ধর্ষ জলদস্যুরা।
কী কারণে একজন মানুষ জলদস্যুতার মতো অন্ধকার আর ঝুঁকিপূর্ণ জীবনকে বেছে নেয়? স্ত্রী-সন্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দিনের পর দিন কাটিয়ে দেয় বনের প্রতিকূল পরিবেশে? এর দায় কি কেবলই তার? নাকি সমাজেরও কোনো দায় আছে? কারা এদের প্রতিপালন করে? প্রেম-সহমর্মিতা বলে কি কিছুই নেই এদের?
এই কৌতূহল মেটাতে গিয়ে দেখা গেল, সব মানবিক বৈশিষ্ট্যই আছে এদের। মায়া-মমতা, ভালোবাসা, আবেগ-অনুভূতি, ভালোভাবে বাঁচার আকাক্সক্ষা, সব। আমাদের মতোই রক্ত-মাংসের মানুষ তারা। কেবল নেই আমাদের মতো স্বাভাবিক একটা জীবন। নিজেরই অজান্তে কখন সেই জীবনকে তারা হারিয়ে ফেলেছে!
তাহলে যে জীবন তারা বয়ে বেড়াচ্ছে, তা কেমন? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়েই লেখা হলো এই উপন্যাস ‘জলমানুষ’। হ্যাঁ, খুব সচেতনভাবেই আমি তাদের ‘জলমানুষ’ বলেছি। কেননা, বাস্তবেও দেখেছি, একজন ভয়ঙ্কর জলদস্যুর আড়লে লুকিয়ে রয়েছে একজন প্রকৃত মানুষের রূপ।
নির্বাচিত অংশ-
মমিন সাহেব কিছুক্ষণ চেয়ে দেখলেন, ঘটনা সত্য। নদীর দুই পারেই থেকে থেকে টর্চের ক্ষীণ আলো দেখা যাচ্ছে। যেন জোনাক পোকার চেয়ে তার আলো খুব বেশি উজ্জ্বল নয়। এখন ফাঁকা আওয়াজ বন্ধ করে দিয়ে তাদের গতিবিধি লক্ষ করছে দস্যুরা। নৌকা এখান থেকে সরাতে গেলেও বিপদ। দুই দিক থেকেই গুলি আসবে। নদীর এই অংশটুকু বেশি চওড়া নয়। তারা অনেক ভেবেচিন্তে এখানেই নৌকাটা নোঙর করেছিল। দুই তীর কাছাকাছি থাকায় এখান থেকে বনও খুব সুন্দর দেখা যায়। হঠাৎ ঝড়-ঝাপটা এলে এখানে বাতাসের তীব্রতা তুলনামূলক কম হবে। আবার ডাকাতদেরও ধারনা করার কথা নয় যে, এখানে কোনো বোট নোঙর করা আছে। তাছাড়া স্থানীয় কূপ বা ফাঁড়িতেও তারা তাদের অবস্থানের কথা ইনফর্ম করে রেখেছিল। কিন্তু সেসব সমীকরণ এখন আর মেলানো যাচ্ছে না। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে।
মমিন দেখলেন এ তো মহা বিপদ! ওরা কী চায়, আগে সেটা জানতে পারলে বেশি ভালো হতো। কারণ, একজন ফরেস্টার, একজন গার্ড, একজন ইঞ্জিন মাস্টার আর তিনজন মাঝিমাল্লা নিয়ে এদের সাথে এই রাতে কোনোভাবেই প্রতিরোধ গড়ে তোলা যাবে না। যদিও মমিনের কাছেই দুটো আগ্নেয়াস্ত্র আছে। কিন্তু মুশকিল হলো, ওরা গুলি ছুড়ছে ডাঙ্গা (স্থল) থেকে। গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে। নদীতে বসে বন্দুক কেন, কামান মেরেও ওদের কাবু করা যাবে না। তবুও মমিন আর আলতাফকে সঙ্গে নিয়ে তীর লক্ষ করে গুলি চালাতে শুরু করলেন।
সঙ্গে সঙ্গে আবারও বৃষ্টির মতো গুলি এসে পড়তে শুরু করল বোটের আশেপাশে। একটা গুলি যেন আলতাফের হ্যাট ঘেঁষে চলে গেল। একটা গুলিতে গলুইয়ের ডান দিকের কাছি বেঁধে রাখার দ-টি উড়ে গেল। জিনিয়া শিশুদের মতো কান্না শুরু করে দিলেন, ‘আল্লা গো, কী হবে এখন। হায় আল্লা। আমাদের বাঁচাও, আল্লা!’ ইত্যাদি।
মমিন জিনিয়ার মুখ চেপে ধরলেন। বললেন, ‘একটুও শব্দ কোরো না, প্লিজ। আমার কাছে যথেষ্ট টাকা আছে। ওদের দিয়ে দিলে ওরা চলে যাবে। কিন্তু তোমার কান্নার শব্দ যদি ওরা শোনে তাহলে কিন্তু ওরা অন্য মতলব করতে পারে। বুঝতে পারছ কিছু?’
এ কথা শুনে জিনিয়ার যেন আত্মা উড়ে যাওয়ার জোগাড়। তিনি আবার চিৎকার করে উঠলেন। মমিন আবারও তাঁর মুখ চেপে ধরলেন। বললেন, ‘বাচ্চাদের মতো কোরো না। এভাবে কি বিপদ আরও ডেকে আনতে চাও?’ এক মাঝি তার মনিবের স্ত্রীকে অনুনয়ের সুরে থামতে অনুরোধ করল। আর পরামর্শ দিল বোটের খোলের মধ্যে লুকিয়ে পড়তে। মমিন তা-ই করলেন। জিনিয়াকে বোটের খোলের মধ্যে ঢুকে চুপ করে বসে থাকতে বললেন। বললেন, ‘বেশি টেনশন নিয়ো না। আমরা দেখছি কী করা যায়।’ বেচারা জিনিয়া বোটের অপ্রশস্ত খোলের মধ্যে কাঁচুমাচু হয়ে বসে রইলেন। কিন্তু স্বামীর প্রাণ যেখানে সংশয়ের মুখে পড়ে, সেখানে একজন নারী নিজে নিরাপদে থেকে, আর কোনো সান্ত¡নাবাক্যে স্থির থাকতে পারে না।
আজ মমিন সাহেব সদলবলে একটু আগেই আগেই বেরিয়েছিলেন। কয়েকটি কূপ থেকে বেশ কিছু টাকা কালেকশন করেছিলেন ঘুরে ঘুরে। বাদায় যারা মাছ, কাঁকড়া, চিংড়ি ধরতে যায়, কাঠ বা গোলপাতা কাটার অনুমতি নিতে যায়, মধু আর মোম আহরণ করতে যায়, তাদের বন বিভাগ থেকে পাশ নিতে হয়। সব কিছুরই নির্দিষ্ট রেট আছে। তবে প্রায়ই এইসব প্রান্তিক মানুষকে বেশি রেট দিয়ে পাশ নিতে হয়। আবার অনেকে অবৈধভাবে অননুমোদিত গাছ কাটার জন্য বড় রকমের আনুতোষিকও দিয়ে থাকে। সেইসব টাকা আর ব্যক্তিগত কিছু টাকা, সবমিলে প্রায় সোয়া দুই লাখ টাকার মতো মমিন সাহেবের কাছে গচ্ছিত হয়ে ছিল। বিপদের মুহূর্তে তিনি ভাবলেন, এই টাকাগুলোর মায়া ত্যাগ করতে পারলে আজকের মতো যদি বাঁচা যায়, তা-ও ভালো।
পেট্রোল বোটে হ্যান্ড মাইক আছে। তিনি আলতাফকে সেটা দিতে বললেন এবং গুলি চালাতে নিষেধ করলেন। হ্যান্ড মাইকটা হাতে নিয়ে মমিন বললেন, ‘ভাই, আপনারা যারাই হোন, আমাদের প্রাণে মারবেন না। আমরা আর গুলি চালাচ্ছি না। আপনারাও গুলি চালানো বন্ধ করে আমার কথাগুলো একটু শুনুন। এটা একটা পেট্রোল বোট। শুধুমাত্র সরকারি দায়িত্ব পালন করার জন্য আমরা এখানে বোট ভিড়িয়েছি। আমাদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য বা আমাদের কাছে কোনো টাকা-পয়সাও নাই। প্লিজ আপনারা গুলি করা বন্ধ করুন। আমাদের বাঁচতে দিন।’
মমিনের ঘোষণায় গুলি চালানো বন্ধ হলো। এতে তাঁরা বেশ আশ^স্ত হলেন। কিন্তু ডাকাতদের কাছেও হ্যান্ড মাইক আছে। নদীর পশ্চিম তীর থেকে হ্যা- মাইকের ঘোষণা এল, ‘আপনাদের সব অস্ত্র, টাকা, গহনা ও অন্যান্য দামি মালামাল দিয়ে দেন। আপনাদের কোনো ক্ষতি আমরা করব না। একটি মেয়ের চিৎকার শুনলাম একটু আগে। তাকেও আমাদের কাছে দিয়ে দেন। তাহলে কাউকে প্রাণে মারব না। বেশি সময় আপনাদের দিতে পারব না। আমাদের চাহিদার কথাও শুনেছেন। আমাদের কথার কোনো হেরফের হয় না। আপনারা আমাদের আক্রমণ করতে চাইলে কেউই প্রাণ নিয়ে ফিরে যেতে পারবেন না। আপনাদের সিদ্ধান্ত জানান। সময় পাঁচ মিনিট। পাঁচ মিনিট পার হলেই সবার শরীর লক্ষ করে গুলি ছুঁড়ব। বাকিটা আপনাদের সিদ্ধান্ত।’
আরও পড়ুন- হিমুর ছায়ায় ‘মহাপুরুষ’
চাণক্য বাড়ৈর ‘জলমানুষ’ উপন্যাসটি ভাষাচিত্র প্রকাশনি থেকে প্রকাশ হচ্ছে একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০-এ। উপন্যাসটি প্রচ্ছদ করেছেন পার্থপ্রতীম দাস। ‘জলমানুষ’ পাওয়া যাবে ভাষাচিত্র প্রকাশনির ১৬৭-১৬৮-১৬৯-১৭০ নং স্টলে।
ওডি/এসএন
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড