• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৬ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

জল জোছনার রাতে

  সৈয়দ মিজান

২৬ জুন ২০১৯, ২২:১৮
হাওর
জোছনা রাতে হাওরে এক অপূর্ব দৃশ্য দেখা যায়। (ছবি : লেখক)

আকাশ ঝকঝকে নীল। বর্ষার টইটম্বুর কংশ নদেও প্রতিবিম্বিত হচ্ছে। চোখ জুড়ানোর মতই দৃশ্যটা। ট্রলারের একটানা ভটভট শব্দের মধ্যেও আকাশ দেখে মন খুশি হয়ে উঠতে বাধ্য। কেনইবা হবে না! শহরবন্দী জীবনে ঠিক মতন নিঃশ্বাস নেবারই তো সুযোগ মেলেনা। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলাম। আহ!

এই নিঃশ্বাস নিতেই ছুটে এসেছি একদল কর্মবন্দী মানুষ। গন্তব্য হাওর। ডিঙ্গাপোতা হাওর। আর গানের মানুষ উকিল মুনশীর ভিটে মাটি ঘুরে দেখা। বর্ষার শেষ প্রায় আমরা ছুটে চলেছি কংশ নদের স্রোত ধরে। আজ রোদ উঠেছে বেশ। গত কয়েকদিন অবশ্য বৃষ্টির তোড়জোড় বেশ ভয় পাইয়ে দিয়েছিল আসা নিয়ে।

হাওরের বুকে পূর্ণিমা দেখার লোভেই ছুটে আসা এতদূর। নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে ট্রলার ভাড়া নিয়েছি। সারারাত হাওরে থাকব। কোমল চাঁদের আলোয় বসবে গানের আসর। ভ্রমণ দলের অধিকাংশই গান করেন। দু একজনের সুখ্যাতিও আছে বেশ। ট্রলারের শব্দ ছাপিয়ে একসাথে অনেকগুলো কণ্ঠ ভেসে উঠলো বাতাসে। নদীর ঢেউও যেন একই সুরে তাল মিলিয়ে দুলছে।

ঘন্টা দেড়েক পর হাওরে পড়লো ট্রলার। দলের বেশিরভাগেরই এর আগে হাওর দেখা হয়নি। ভাসা ভাসা একটা ধারণা আছে। হাওর হলো বড় জলাশয়। কিন্তু সমুদ্রের মতন এমন দিগন্তরেখা ছুঁয়ে যাওয়া জল দেখে কারোরই চোখ সরেনা। দূরে দূরে হঠাৎ একটা দুটো নিঃসঙ্গ গাছ দেখা যায়। একা দাঁড়িয়ে আছে অসহায়ের মতন।

হাওর

হাওরের এমন রূপ দেখে কে না মুগ্ধ হবে। (ছবি : লেখক)

মাঝেমধ্যে পাকা সেতুর দেখা মেলে। সেও নিঃসঙ্গ ভেসে আছে। শুকনো মৌসুমে এই ব্রিজের উপর দিয়েই সবার যাতায়াত হয়। প্রচণ্ড বাতাস বইছে। এ বাতাস স্নিগ্ধ, কোমল। হাওরের বাতাসে কেমন একটা ব্যাপার আছে। গায়ে লাগলে নিজেকে পবিত্র পবিত্র লাগে।

আমরা ভেসে যাচ্ছি বনের মতন একটা জায়গা দিয়ে। জলমগ্ন বন। গলা পর্যন্ত ডুবো গাছগুলো, ন্যাড়া ন্যাডা মাথা। ছোট ছোট কয়েকটা ডাল আর তাতে বড় বড় পাতা। মাঝিকে জিজ্ঞেস করে জানলাম এই গাছের নাম করচ গাছ। সারি করে লাগানো গাছগুলো দেখে হ্যামক টাঙ্গিয়ে শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে। জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে শুয়ে থেকে আকাশ দেখার অনুভূতি নিতে মন আকুপাকু করছে। কিন্তু হ্যামক তো সাথে নেই। আফসোস হচ্ছে বড়। পরের বার এই ভুল করা যাবে না।

নৌকা ভিড়লো গানের মানুষ উকিল মুনশীর বাড়ির ঘাটে। হাওরের বুকে অসংখ্য খাল আর নদী বয়ে গেছে। উকিল মুনশীর বাড়িটি বেতাই নদীর তীর ঘেঁষে। ঘাট থেকে উঠতেই দেখলাম দুটো বাঁধানো কবর। একটি উকিল মুনশীর অন্যটি তার সন্তান আরেক গানের মানুষ আব্দুস সাত্তারের। উকিল মুনশীকে নিয়ে একটু বলা দরকার। গানের এই মানুষটির ছিল হাওরের মতই খোলা গলা। মসজিদের ইমাম ছিলেন। কিন্তু গান গাইতেন আসরে। কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমদের মধ্যাহ্ন উপন্যাসে তার কথা পাওয়া যায়। তার বেশ কয়েকটি গান হুমায়ূন আহমেদ তার শ্রাবণ মেঘের দিন চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেছেন। 'শুয়াচান পাখি আমি ডাকি তাছি তুমি ঘুমাইছো নাকি..' 'আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানিরে..' 'আমার গায়ে যত দুঃখ সয়..' এইরকম বেশ কিছু গান মানুষের প্রাণ ছুঁয়ে গেছে।

গ্রামটা ঘুরে দেখলাম। গ্রাম না বলে ছোটখাটো একটা দ্বীপ বলে চালিয়ে দেয়া যায়। চারপাশে পানি। আর ভেতরে অসংখ্য খাল যাতায়াতের জন্য। প্রতিটা বাড়িরই নিজস্ব নৌকা আছে। হাওরের গ্রামগুলো এমনই হয়। একেকটা ছোট্ট দ্বীপ হাওরের গল্প, দুঃখ আনন্দের সাক্ষী হয়ে থাকে দিনেরপর দিন।

হাওর

জুড়িয়ে দিল চোখ আমার পুড়িয়ে দিল চোখ। (ছবি : লেখক )

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা এলো। বদলে যেতে লাগলো হাওরের রূপ। সূর্যটা দূরে টুপ করে ডুবে গেল। কিন্তু সাথে সাথে আঁধার নেমে এলোনা। কেমন একটা অপার্থিব আলো ঝুলে রইলো অনেকক্ষণ ধরে।

আস্তে আস্তে উঠে এলো চাঁদ। বিশাল একটা চাঁদ। স্থানীয়দের ভাষায় 'ভুইত্তামরা চান'। এই চাঁদের রূপ দেখতেই এত আয়োজন। রাত বাড়ছে। আমরা গ্রামের এক বাড়িতে রাতের খাবারের আয়োজন করেছি। উদর পূর্তি শেষে। হাওরের বুকে ভাসলাম ট্রলার। গ্রামের কয়েকজন তরুণ সঙ্গী হয়েছে আমাদের। একা নিঃসঙ্গ এক বৃক্ষের কাছে গিয়ে থামলো ট্রলার। ইঞ্জিন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

চাঁদের গা থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে রূপ। বাতাস এসে ধুয়ে দিচ্ছে শহুরে গন্ধ। হাওরের ঢেউর মধ্যে ভেসে উঠেছে চাঁদের প্রতিচ্ছবি। কোন শব্দ নেই। কোন আলো নেই। প্রকৃতি এতটা কাছাকাছি চাইলেই হওয়া যায় না। ভাগ্য লাগে সত্যিই।

একটা নৌকা ভেসে আছে হাওরের বুকে। পাশে একটা চির নিঃসঙ্গ বৃক্ষ। মাথার উপর মস্ত চাঁদ। জলের মধ্যে তার ছায়া। দৃষ্টিসীমার মধ্যে কেবল এই দৃশ্যই। দূরে শুধু একটা করচ বন দেখা যাচ্ছে আবছা আলোয়।

চাঁদের আলোয় হাওরের বুকে ভাসতে ভাসতে মনে হচ্ছিল এ যেন পৃথিবী নয়। অন্য কোন গ্রহ। এ সৌন্দর্যের বর্ণনা করা দুঃসাহসিক কাজ। ব্যাখ্যাতীত মুগ্ধতা নিয়ে গান শুনছি... উকিলের গান..

আমারে নিলানা নাইওর পানি থাকতে তাজা.. আমি দিনের পথ আদলে যাইতাম রাস্তা হইতো সোজারে.. আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানিরে...

হাওরে চাঁদের এই রূপ দেখতে বারবার আসা লাগবে। এমন নিস্তব্ধতা আর জলের মধ্যে চাঁদের মুখ টানবেই আবার।

ওডি/এসএম

দেশ কিংবা বিদেশ, পর্যটন কিংবা অবকাশ, আকাশ কিংবা জল, পাহাড় কিংবা সমতল ঘুরে আসার অভিজ্ঞতা অথবা পরিকল্পনা আমাদের জানাতে ইমেইল করুন- [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড