অধিকার ডেস্ক ২০ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৩:৩৪
বারাণসী বা বেনারসকে বলা হয় ইতিহাসের জননী, ঐতিহ্যের মাতামহী ও কিংবদন্তির মহান-মাতামহী। পাপমোচনকারিণী পবিত্র গঙ্গার পশ্চিম তীরে অবস্থিত এই শহর কাশী নামেও পরিচিত ও পৃথিবীর অন্যতম পুরোনো জীবিত শহর। স্থানীয় মানুষজন মনে করেন যে এই শহর প্রায় তিন হাজার বছর আগে তৈরি হয়।
বিখ্যাত আমেরিকান লেখক মার্ক টোয়েনের কথায়, বারাণসী শহর ইতিহাসের থেকে পুরোনো, সভ্যতার ঐতিহ্য ও প্রথা থেকেও পুরোনো, এমনকি কিংবদন্তির থেকেও পুরোনো, আর শহরটিকে দেখলে মনে হয় এদের সবার যোগফলের দ্বিগুণ পুরোনো।
হিন্দু মতে এই শহর মোক্ষ লাভের শহর যা বিখ্যাত হয়ে আছে শক্তিপীঠ ও দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের জন্যে (কাশী বিশ্বনাথ মন্দির)। এটা হিন্দুদের সাতটি পবিত্র শহরের মধ্যে একটি। হিন্দু ধর্মবিশ্বাসী মানুষজন মনে করেন যে এখানে কোনো মানুষের মৃত্যু ও দাহ হলে তারা সরাসরি মোক্ষলাভ করেন ও পুনর্জন্ম থেকে নিষ্কৃতি পান।
ঘাটে ঘাটে একটু ঘুরলে জানতে পারা যায় যে এখানকার গঙ্গায় স্নান করলে মানুষের পাপ ধুয়ে যায় আর তিন রাত্রি উপবাস করলে হাজার জীবন জন্ম নেওয়ার থেকে মুক্তি মেলে। পূজারীদের অভিমত হচ্ছে যে এখানে দান করা অর্থের হাজার গুনের বেশি ফেরত পাওয়া যায় যদিও আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অন্যরকম।
বারাণসী বিখ্যাত তার গলি ও ঘাটের জন্যে। এখানে প্রায় ৮৮টি ঘাট আছে যার মধ্যে অসি ঘাট, চেত সিং ঘাট, দ্বারভাঙ্গা ঘাট, দশাশ্বমেধ ঘাট, মান মন্দির ঘাট, সিন্ধিয়া ঘাট, ভোঁসলে ঘাট, মণিকর্ণিকা ঘাট ইত্যাদি বিখ্যাত। বারাণসী তৈরি হয় তার গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন সমৃদ্ধ বাণিজ্যিক প্রেক্ষাপটে।
এখানকার তৈরি সিল্ক, সুগন্ধি, হাতির দাঁতের কাজ ভুবন বিখ্যাত। শহরের ধর্মীয় গুরুত্ব শীর্ষস্থান অধিকার করে অষ্টম শতাব্দীতে, যখন আদি শঙ্করাচারিয়া এখানে শিবের পুজো শুরু করেন ও মন্দির তৈরি করেন। মুসলিম রাজত্বেও এই শহর হিন্দু উপাসনা, অতীন্দ্রিয়বাদ ও কাব্যের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পীঠস্থান ছিল। ফলে বারাণসী সংস্কৃতি ও ধর্মশিক্ষার একটা মিলনস্থলে পরিণত হয়। তুলসী-দাস তাঁর রাম চরিত মানস মহাকাব্য এখানেই রচনা করেছিলেন। অন্যান্য ব্যক্তিত্বের মধ্যে কবীর, রবিদাস, রবিশঙ্কর, ওস্তাদ বিসমিল্লা খান এখানেই বাস করতেন।
কাশীর রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় এখানে বেনারসী ঘরানার হিন্দুস্থানী ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত বিকাশ লাভ করে। ষোড়শ শতাব্দীতে মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে বারাণসী সাংস্কৃতিক রেনেসাঁ দেখে। তিনি শিব ও বিষ্ণুর দুটি বিশাল মন্দির তৈরি করেন ও এই শহরের উন্নতিকল্পে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন। তবে এখানকার বেশিরভাগ উন্নয়নই হয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে মারাঠি ও ব্রাহ্মণ রাজাদের আমলে।
বেনারসের রাজাকে মোঘলরা ও ব্রিটিশরা সরকারি পদমর্যাদায় রাজা বলে মেনে নেন (Princely State) ও তা চলে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার আগে অব্দি। বারাণসী সবসময়ই সবার কাছে প্রাণবন্ত, উচ্ছল, ও নবীন। সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে এই শহরের আকর্ষণ অনন্য। ফলে দেশী, বিদেশি, ধর্মপরায়ন, ফটোগ্রাফার, ব্যবসাদার, গরিব, বড়লোক সমস্ত ধরনের মানুষজনকেই এখানে দেখা যায়।
বেনারস থেকে ১৫ কি.মি. দূরে গঙ্গার পূর্ব তীরে অবস্থিত রামনগর ফোর্ট তৈরি হয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে। মোঘল গঠনশৈলীতে স্থাপত্যটি তৈরি ও রয়েছে সুন্দর ব্যালকনি, খোলা মাঠ ও সুদৃশ্য প্যাভেলিয়ান। খরচ একটু বেশি হলেও নৌকায় চড়ে দশাশ্বমেধ ঘাট থেকে রামনগর গেলে তা এক মনে রাখার মতো ভ্রমণ হবে।
বারাণসীর সমস্ত দর্শনীয় স্থান ও পুরোনো আভিজাত্যের আবরণ উন্মোচন হয় এই ভ্রমণেই। যা না করলে বেনারস ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যায় তা হলো- বেনারসী পান খাওয়া, সিল্কের শাড়ি কেনা আর ১৯১৬ সালে তৈরি এশিয়ার সবথেকে বড় আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় দেখা।
লেখক : রাইয়ান মন্ময়
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড