লামিয়া আলভী
আজ লিখব ‘রাবণের লংকাপুরী’ খ্যাত দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র ‘শ্রীলঙ্কা’ নিয়ে। শ্রীলঙ্কা ভারত মহাসাগরের ওপর, বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত। শ্রীলঙ্কা নামটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘শ্রী’ ও ‘লংকা’ থেকে। শ্রী শব্দের অর্থ পবিত্র এবং লংকা শব্দের অর্থ দ্বীপ। ১৯৭২ সালের আগে এই দ্বীপ ‘সিলন’ নামেও পরিচিত ছিল। ইতালির পর্যটনবিদ মার্কো পোলো একে ‘সবচেয়ে সুন্দর দ্বীপ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। দেশ পরিচিতি-
আয়তন : ৬৫,৬১০ বর্গ কিলোমিটার প্রশাসনিক রাজধানী : শ্রী জয়াবর্ধেনেপুরা কোট্টে বাণিজ্যিক রাজধানী : কলম্বো রাষ্ট্রীয় ভাষা : সিংহলী এবং তামিল মুদ্রা : শ্রীলঙ্কান রুপি ধর্ম : বৌদ্ধ জনসংখ্যা : ২,১২,০৩,০০০ রাষ্ট্রপতি : মৈত্রিপাল সিরিসেন প্রধানমন্ত্রী : রানিল বিক্রমাসিংহে সাক্ষরতার হার : ৯২শতাংশ জাতীয় দিবস : ৪ ফেব্রুয়ারি
প্রাচীনকাল থেকেই শ্রীলঙ্কা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত। সিংহলী সম্প্রদায় এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী। উত্তর পূর্বদিকের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে তামিল সম্প্রদায় দেশের সর্ববৃহৎ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে মূর, বার্ঘের, কাফির, মালয় উল্লেখযোগ্য।
শ্রীলঙ্কার সংবিধান অনুযায়ী দেশটি গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, প্রজাতন্ত্রী হিসেবে পরিচিত হবে। দেশটিকে একেশ্বরবাদী রাষ্ট্রও বলা হয়েছে। শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি একধারে রাষ্ট্রপ্রধান, সামরিক বাহিনীর প্রধান প্রশাসক ও সরকার প্রধান এবং তিনি নির্বাচিত হন ছয় বছরের জন্য।
দেশটির অর্থনীতি চা উৎপাদনের ওপর সবচেয়ে নির্ভরশীল। শ্রীলঙ্কা বিশ্বের তিনটি বড় চা উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে অন্যতম। এছাড়া কফি, নারিকেল, রাবার উৎপাদন ও রপ্তানিতে বিখ্যাত। এদেশের আরেকটি সুনাম রয়েছে। এখানে পাওয়া যায় ভারত মহাসাগর থেকে আহরিত উন্নতমানের মুক্তা। দক্ষিণ এশিয়ার সর্বোচ্চ মাথাপিছু আয়ের দেশ হলো শ্রীলঙ্কা।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কার সাক্ষরতার হার সবচেয়ে বেশি যা হলো ৯২ শতাংশ। এখানে ৮৩ শতাংশ মানুষ মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষিত। অবৈতনিক শিক্ষা ব্যবস্থা এদেশের সাক্ষরতায় বিরাট অবদান রেখেছে। শতকরা ১০ ভাগ লোক সার্বক্ষণিক ইংরেজিতে কথা বলে। শ্রীলঙ্কায় প্রায় ১৬টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।
পৃথিবীতে শ্রীলঙ্কা একমাত্র অমুসলিম দেশ যেখানে রেডিও ও টেলিভিশনে পাঁচ ওয়াক্ত আজান দেওয়া হয়। শ্রীলঙ্কার জাতীয় খেলা ভলিবল তবুও ক্রিকেট এখানে সর্বাধিক প্রিয়। অন্যান্য খেলার মধ্যে রাগবি, ফুটবল, টেনিস ও নানারকম জলক্রীড়া প্রচলিত রয়েছে।
শ্রীলঙ্কানদের প্রধান খাবার হলো নারিকেল আর ভাত। সকল ধরনের খাবারে নারিকেলের উপস্থিতি থাকবে। এমনকি খাবার রান্নার তেল হচ্ছে নারিকেল তেল। কিন্তু তাদের রান্নায় নারিকেল তেলের কোনো গন্ধই পাওয়া যায় না।
নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সংবলিত সমুদ্রসৈকত, তদুপরি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য শ্রীলঙ্কাকে সারা পৃথিবীর পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
শ্রীলঙ্কাকে বলা হয় "ল্যান্ড অফ সেরেন্ডিপিটি"।
কলম্বো :
ঢাকাকে যদি মসজিদের শহর বলা হয় তবে কলম্বোকে বলা যায় "মহামতি বুদ্ধের শহর"। কয়েক কদম পরপর এবং সবর্ত্র দেখা যায় মহামতি বুদ্ধের মূর্তি। তবে বুদ্ধের একা ছবি আপনি তুলতে পারবেন কিন্তু বুদ্ধের সাথে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ।
গল ফেস গ্রিন বিচ কলোম্বোর অন্যতম উল্লেখযোগ্য সৌন্দর্য্যের একটি। যেখানে সুনীল সমুদ্র এবং সমুদ্রের ঢেউ ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন ওয়াটার স্পোর্টসের ব্যবস্থা।
এলিফ্যান্ট শো এর জন্য বিখ্যাত এক চিড়িয়াখানার নাম দেহিওয়ালা জু। ১১ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত এই চিড়িয়াখানায় দুর্লভ প্রজাতির পশুপাখি রয়েছে।
পিন্নায়েলা হাতির আশ্রম :
কলম্বো থেকে ক্যান্ডি যাওয়ার পথে দেখা যায় পৃথিবীর একমাত্র "অনাথ হাতির আশ্রম"। কলম্বো থেকে প্রায় আড়াই ঘণ্টা লাগে যেতে। টিকিট লাগে ৫০০ রুপি এ আশ্রমে প্রবেশ করতে।
বনায়ন উজাড়ের ফলে বা জাতিগত দাঙ্গার কারণে অনেক হাতি তাদের আবাসন হারিয়েছে বা কোনোভাবে আহত হয়েছে। এইসব হাতিদের এ আশ্রমে ৫/৬ মাসের জন্য সেবাযত্ন, খাবার দেওয়া হয়।
অনুরাধাপুর :
শ্রীলঙ্কার অন্যতম প্রাচীন শহরের নাম অনুরাধাপুর। কলম্বো থেকে ২০৬ কিলোমিটার. দূরে অবস্থিত এই এলাকাটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করেছে ইউনেস্কো। এখানে রয়েছে ১৩ মিটার উঁচু গ্রানাইট পাথরের তৈরি বুদ্ধের স্ট্যাচু "আওকনা বুদ্ধ"। রাজা দাথুসেনের শাসনকালে নির্মিত হয়েছে এটি।
পাবেন তৃতীয় শতাব্দীতে নির্মিত ইসরুমিনিয়া মন্দির। এছাড়া রয়েছে রাজা দুতুগামানুর ছেলে সালিয়া এবং তার প্রেমিকার কাহিনী থেকে অনুপ্রাণিত খোদাইচিত্র "লাভারস" নামের কার্ভিং। অসাধারণ খোদাইচিত্র এটি। এছাড়া রয়েছে এখানে মনাস্ট্রি এবং স্তুপগুলো।
ক্যান্ডি :
ক্যান্ডিকে শ্রীলঙ্কার সাংস্কৃতিক রাজধানী বলা হয়। কলম্বো থেকে ১১৫ কিলোমিটার. দূরে অবস্থিত এই শহর। দ্যা টেম্পল অব টুথ, দ্য ওল্ড ওয়েল প্যালেস কম্পাউন্ড, লংকাতিলকা মন্দির, এম্বেকা মন্দির ক্যান্ডির উল্লেখযোগ্য ঘুরে বেড়ানোর স্থান।
এডাম পিক ( Adam's peak) :
বিশ্বের সকল বিখ্যাত এবং পবিত্র জায়গার মধ্যে শ্রীলঙ্কার এডাম পিক বা আদম চূড়া অন্যতম। এর উচ্চতা ৭৩৫৯ ফুট বা ২২৪৩ মিটার। যেখানে বিশ্বের প্রথম মানব হযরত আদম(আ.) কে বেহেশত থেকে ফেরেশতারা নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। যেখানে রয়েছে আদম (আ.) এর পদচিহ্ন। যার দৈর্ঘ্য ২ ফুট এবং প্রস্থ ৬ ইঞ্চি। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে এই পদচিহ্ন প্রথম আবিষ্কৃত হয়। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন এই পদচিহ্নটি গৌতম বুদ্ধের, হিন্দুরা বিশ্বাস করেন এই পদচিহ্ন তাদের দেবতা শিবার। যুগে যুগে লক্ষ লক্ষ পর্যটক এই পবিত্র চূড়াটি পরিভ্রমণ করেছে।
রহস্যময় ব্যাপার হলো আদম চূড়ায় যেখানে পদচিহ্ন রয়েছে সেখানে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সূর্যের আলো পড়ে না আবার মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মেঘের ঘনঘটা বা বৃষ্টিও সেখানে পড়ে না।
শ্রীলঙ্কা ভ্রমণে গেলে যদি এর জাতীয় জাদুঘর না দেখেন তবে আপনার ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। জাদুঘরটি ১৮৭৭ সালে নির্মিত হয়েছে। শ্রীলঙ্কার ইতিহাসের বিভিন্ন সময়কালের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে এ জাদুঘরে। যেমন- তামার পাত্র, খোদাই করা পাথর, জেড, চীনা মাটির পাত্র এবং চমৎকার সব হস্তশিল্প। জাদুঘরটি ঘুরে দেখলে আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠবে শ্রীলঙ্কার সুদীর্ঘকালের ইতিহাস।
সময় সুযোগ করে ঘুরে আসতে পারেন এই নয়নাভিরাম লংকাপুরী থেকে।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড