• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৬ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ঘুরে আসুন অপরূপ প্রকৃতির বগালেক ও কেওক্রাডং

  আসিফ আহমদ

০৭ জানুয়ারি ২০২০, ১০:৩০
কেওক্রাডং
পাহাড়ের চূড়ায় এমন কটেজেই থাকবেন আপনি; (ছবি- লেখক)

সদ্য গত হওয়া বছরের সবচেয়ে ঠান্ডার রাতটা ছিল সম্ভবত ২০ ডিসেম্বর। তার আগের রাতে জ্যাকেট, মাফলার জড়িয়ে নিজেদের সম্পূর্ণ আবৃত করে রাত ১০টা ৪৫-এর এস আলম বাসের সর্বশেষ সিট দুটোতে চেপে বসলাম দুই বন্ধু। গন্তব্য বান্দরবান।

ভোর সোয়া পাঁচটার দিকেই বাস পৌঁছে দিল বান্দরবানের বাসস্ট্যান্ডে। সেখানে ট্রাফিক মোড়ের দিকে রয়েল হোটেলে অবস্থান করছিল রাঙামাটি-চট্টগ্রাম থেকে আসা আরও পাঁচ বন্ধু। হোটেলে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে গেলাম আমরা। নাস্তা করে পাখির মোড়/ধনেশের মোড়ে এলাম চান্দের গাড়ি খুঁজতে। সেখানে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে সবুজ চান্দের গাড়ি আর সাদা মাহিন্দ্রা।

কিন্তু লাইনের গাড়িগুলো সিন্ডিকেট করে দাম বাড়তি চাচ্ছিল। তাই আগে থেকেই যেই গাইডের সাথে কথা বলে রেখেছিলাম তাকে ফোন দিয়ে একটা গাড়ি ঠিক করে নিলাম। সে সিন্ডিকেটের বাইরের। ৩৫০০ টাকা দিয়েই রাজি হলো রুমা পর্যন্ত যাওয়ার জন্য।

রুমা পর্যন্ত যাওয়ার পথে মিলনছড়ি চেকপোস্টে একবার, আর ওয়াই-জংশনের পরে একবার এন্ট্রি করতে হয় ট্যুরিস্টদের। রুমায় নেমে আরেকবার এন্ট্রি করতে হয় আর্মি চেকপোস্টে। সেখানে অঙ্গীকারনামায়ও সাইন করে আসতে হয়। সবকিছু গাইড আর ড্রাইভারই বলে দেবে।

রুমা থেকে বগালেকের দিকে রওনা দেওয়ার সময়ই মুরগি আর বারবিকিউর যাবতীয় সব জিনিস কিনে নিয়েছিলাম রুমা বাজার থেকে। বগালেকে এসব কিনতে পাওয়া যায় না। গাইড আগে থেকেই বগালেকে কটেজ বুক করে রেখেছিল। লাঞ্চ ওখানে গিয়ে করব বলাতে লাঞ্চেরও অর্ডার দিয়ে রেখেছিল। রুমা থেকে বগালেকের ভাড়া ২৫০০ টাকা।

বগালেকে পৌঁছে আরেকবার এন্ট্রি করতে হয় চেকপোস্টে। এন্ট্রি করে একটু ওপরের দিকেই মূল লোকালয়ে চলে গিয়ে নিজেদের কটেজের দিকে আসলাম আমরা। আমাদের কটেজটা বাজার থেকে একটু সাইডের দিকে। নীরব এবং নতুন। কিম বমের কটেজ বললেই গাইড ওখানে ঠিক করে রাখবে। এই কিম বম প্রচণ্ড স্মার্ট একজন মানুষ। আর তার দোকানেই আছে সব ধরনের খাবারের আয়োজন। রান্না খুবই মুখরোচক। আমরা কটেজে গিয়ে ব্যাগ-ট্যাগ রেখে ফ্রেশ হয়েই খেতে বসে গিয়েছিলাম। প্রচণ্ড ক্ষুধায় খাবারগুলো অমৃত মনে হচ্ছিল।

এরপর রুমে ফিরে জামাকাপড় খুলে সাতজন মিলে গোসল করে নিলাম বগালেকে। বলে রাখা ভালো, পানিতে নেমে সাঁতরানোর পারমিশন নেই। আরও বলে রাখা ভালো, বগালেকের উচ্চতা ১০০০ ফিটেরও ওপরে বলে ওখানে সাঁতরাতে গেলে খুব অল্পতেই হাঁপায়ে যাবেন এবং বুঝে ওঠার আগেই ডুবে যেতে পারেন। এমন ঘটনা ঘটেছে বলেই এখন পানিতে নামা বন্ধ। এছাড়াও বগালেককে ওখানকার মারমা জনগোষ্ঠীরা পবিত্র লেক মনে করে, তারাও চান না ওখানে মানুষ নামুক, দাপাদাপি করুক। তাই মগ দিয়ে গা ভিজিয়ে নেওয়াই ভালো।

পাহাড়

মেঘের এমন বিছানা কি আগে দেখেছেন কখনো? (ছবি- লেখক)

ওখান থেকে ফিরে গরম জামা-কাপড় পরে বিকেলে সমগ্র এলাকাটা ঘুরে দেখলাম, ছবি-টবি তুললাম। সন্ধ্যায় আগুন জ্বালিয়ে বারবিকিউ করে গানের আসর বসিয়ে প্রকৃতির সান্নিধ্য উপভোগ করলাম। বগালেকে বিকেল পাঁচটার পর থেকেই হাড় কাঁপানো ঠান্ডা শুরু হয়। একে তো লেকে কুয়াশা জমে থাকে, তার ওপরে প্রচণ্ড বাতাস। কটেজটা বাঁশের তৈরি বলে হু-হু করে বাতাস ঢোকে। সব মিলিয়ে প্রচণ্ড ঠান্ডার অভিজ্ঞতা হয়েছে।

পরদিন আমাদের টার্গেট ছিল সকাল আটটায় রওনা দিব কেওক্রাডং। সাড়ে ছয়টায় ঘুম থেকে উঠেও সূর্যের দেখা পাওয়া যাচ্ছিল না। এমনকি সকাল আটটায়ও লেকের পানি দেখা যাচ্ছিল না প্রচণ্ড কুয়াশার কারণে।

যাই হোক, এবার বলব দুটি রুটের কথা। দুইভাবে যাওয়া যায় কেওক্রাডং। এক পায়ে হেঁটে। প্রায় চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা লাগে। ট্রেকিংয়ের অভিজ্ঞতার ওপর সময় ডিপেন্ড করে। এই ট্রেইলটা খুবই সহজ ট্রেইল। ভয়ঙ্কর না একদমই। সুন্দর পায়ে হাঁটার রাস্তা আছে। কিন্তু চড়াই অনেক বেশি, তাই বুকে দম ধরে রাখা কষ্ট। প্রায় তেরো কিলোমিটার হাঁটতে হবে আর ধীরে ধীরে উঠতে হবে আরও দুই হাজার ফিট উঁচুতে। সাথে একদম ছোট বাচ্চা থাকলে এই প্ল্যান না করাই ভালো।

আমাদের সাথে সম্পূর্ণ নতুন দুইজন ট্রাভেলার ছিল বলে আমরা সহজ পথটা বেছে নিয়েছি। উঠার সময় ট্রেকিংয়ের দিকেই যাইনি। ফোর-হুইলার কিছু জিপ যায় কেওক্রাডং পর্যন্ত। সচরাচর সাড়ে তিন হাজার টাকায় যায়। সেরকম একটা জিপে করে চলে গিয়েছি ২৫০০/- দিয়ে। দাম কম কেন নিল সেটা পরে বলছি।

বগালেক থেকে হারমন পাড়া, দার্জিলিং পাড়া হয়ে জিপ চলে যায় কেওক্রাডংয়ের চূড়ায়। কিন্তু গাড়ির কথা শুনে লাফ দিয়ে উঠবেন না। যদি সাথে বাচ্চা-বয়স্ক বা অসুস্থ কেউ থাকে তাহলে কেওক্রাডংয়ের কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। একে তো রেগুলার কোনো গাড়ি যায় না, তার ওপর রাস্তা এত বেশি খারাপ, এত বেশি চড়াই-উতরাই যে আমাদেরই কলজেটা গলার কাছে উঠে এসেছিল! বিশেষ করে ঢালগুলো এত খাড়া যে ড্রাইভার দুইহাতে হুইল ধরে রাখার পর ফ্রন্টসিটে আমি বসায় দুই হাত দিয়ে গিয়ার ধরে রাখতে হচ্ছিল, তাও গিয়ার স্টিক হাতকে পেছনে ঠেলে সরিয়ে দিতে চায়। একবার হাত থেকে ফসকালেই সাক্ষাৎ মৃত্যু!

পাহাড়

রাতের আকাশ ঠিক এভাবেই স্বাগত জানাবে; (ছবি- লেখক)

হারমন পাড়া আর দার্জিলিং পাড়ায় বেশ খানিকটা সময় কাটিয়ে প্রায় দেড় ঘণ্টায় আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম কেওক্রাডংয়ের চূড়ায়। সেখানে আর্মি চেকপোস্টে এন্ট্রি করে উঠে গিয়েছিলাম লালা বমের নতুন কটেজে। যেই কটেজকে আমি বাংলাদেশের বেস্ট কটেজ বলব শুধুমাত্র কটেজের থেকে দেখা পরাবাস্তব ভিউর জন্য। আমি নিজে পাহাড়ে বড় হওয়া মানুষ হয়েও এই সৌন্দর্যে বিভোর হয়ে গিয়েছিলাম।

আর বড় করব না লেখা। কেওক্রাডংয়ে সারাদিন থাকা, খাওয়া বা এনজয় করার ব্যাপারগুলো যার যার নিজেদের মতো। এই যে বিভিন্ন জায়গায় থাকা বা খাওয়ার ব্যাপারগুলো দেখা, এমনকি অসাধারণ বারবিকিউ করে দেওয়া, সব কাজই করে দেবে আপনাদের গাইড। আমাদের সাথে গাইড ছিলেন তাপস বড়ুয়া। এত অমায়িক ভদ্রলোক খুব কম দেখেছি গাইড হিসেবে।

শুধু একটাই সমস্যা, খুব চিকনচাকন লোক বলে উনি কোনো এক্সট্রা ব্যাগ নিতে পারেননি। অন্যান্য অনেক গাইড ট্যুরিস্টদের একটা ব্যাগ ক্যারি করে দেয়। তবে এই লোকটাকে ভালো লাগার কারণ সে কাউকে অহেতুক খরচ করতে দিতে চায় না। কোনো ট্যুর গ্রুপ তার সাথে যোগাযোগ করলে সে নিজ থেকেই চেষ্টা করে যেদিকে যেভাবে পারে খরচ কমিয়ে দিতে। যেমন ফেরার পথে সে কোনো গাড়ির সাথে কন্টাক্ট করেনি কারণ সে জানে রুমা থেকে অনেক গাড়ি বান্দরবানে ফাঁকা আসে। সেগুলো হাজার দুয়েকেই নিয়ে আসে ট্যুরিস্টদের। এমনিতে কথা বলে ঠিক করতে গেলে সাড়ে তিন/ চার হাজারের নিচে আসে না।

আসার পথে হেঁটেই এসেছি আমরা। সকালে কেওক্রাডং থেকে সূর্যোদয় দেখে ফ্রেশ হয়ে ব্যাগ গুছিয়ে চেকপোস্টে সাইন আউট করে ব্যাক করেছি বগালেক। পথে দার্জিলিং পাড়ায় নাস্তা করেছি মেঘলা নবীয়ালের দোকানে। গাইডকে বলে দিলে এখানেই খাবারের আয়োজন করবে। চাইলে ব্যাম্বু চিকেনও খেতে পারেন এখানে। এছাড়া বাকি খাবারগুলোও বেশ চমৎকার।

পাহাড়

এমন পাহাড়ের দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হবেন নিশ্চয়ই; (ছবি- লেখক)

দার্জিলিং পাড়াকে বলা হয় বাংলাদেশের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম। সেখানে ক্রিসমাসের উন্মাদনা চলছিল গির্জায়। বাকি পাড়াগুলোও বেশ পরিচ্ছন্ন ছিল। সেখান থেকে রওনা দিয়ে মাঝপথে রুথলং পাড়ায় কিছুক্ষণ থেমে লেবুর জুস আর মাত্র গাছ থেকে নামানো কলা খেয়ে আবার রওনা করেছি বগালেকের দিকে।

বগালেক পৌঁছে চেকপোস্টে সাইনআউট করে আগে থেকে ঠিক করে রাখা গাড়িতে চেপে চলে এসেছি রুমা। সেখানে আবার সাইনআউট করে আরেক গাড়িতে চেপে চলে এসেছি বান্দরবান। তখন সময় ৩টা ৪৫ মিনিট।

প্রথমেই দিয়ে দেই গাইডের নাম্বার। গাইড তাপস বড়ুয়া- ০১৮৮৪৭৫৬৪৮২

এবার আসি খরচে। আমরা টিমে মাত্র সাতজন ছিলাম বলে খরচ হয়েছে জনপ্রতি ৪৩০০/- করে। কিন্তু খরচটা আরও বাড়তে পারত। বেশ কিছু জায়গায় গাড়িতে আমাদের খরচ হয়েছে নরমাল রেটের থেকে অনেক কম। এটা পেয়েছি নিজে ডিফেন্স অফিসার হওয়ার সুবাদে।

যদি আপনারা অন্তত ১০-১২ জনের টিম নিয়ে যান তাহলে ২ রাত আর ৩ দিনের এই ট্যুরে খরচ অনেকটা এমনই থাকবে। তবে ঢাকা টু বান্দরবান আর বান্দরবান টু ঢাকা দুইটা রাতকে এখানে এড করিনি। সেই দুই রাতের খরচটা এড করলে জনপ্রতি আরও হাজারখানেক টাকা বেড়ে যাবে।

হাতে তিন চার দিন সময় নিয়েই ঘুরে আসুন এই দুটো জায়গা। কথা দিচ্ছি সময়টা অনেক বেশি ভালো যাবে এবং সারাজীবনের জন্য কিছু স্মৃতি বাঁধা থাকবে স্মৃতির ফ্রেমে।

আর হ্যাঁ, যেখানেই যান দয়া করে নোংরা করবেন না জায়গাগুলোকে। দেশকে পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব আমার-আপনার সকলের। হ্যাপি ট্রাভেলিং।

ওডি/এনএম

দেশ কিংবা বিদেশ, পর্যটন কিংবা অবকাশ, আকাশ কিংবা জল, পাহাড় কিংবা সমতল ঘুরে আসার অভিজ্ঞতা অথবা পরিকল্পনা আমাদের জানাতে ইমেইল করুন- [email protected]
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড