• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

দরিদ্রতাকে পাহাড়বন্দি করে আলো ছড়ানো এক যুবক

  নিশীতা মিতু

২৪ নভেম্বর ২০১৮, ১৫:৩৫
তৌহিদ আকাশ
তৌহিদ আকাশ

পড়ন্ত বিকেলে ছেলেবেলার দিনগুলোকে কল্পনার চিত্রপটে আনলে ভেসে উঠে নানা সুখ আর দুঃখের স্মৃতি। কারো কারো ক্ষেত্রে ছেলেবেলা হয় ভীষণ রঙিন, আবার কারো ক্ষেত্রে বিবর্ণ ফ্যাঁকাসে। অনেকগুলো না পাওয়ার মালা গেঁথে কাটানো ছেলেবেলার গল্প জমা থাকে কারো জীবন ঝুড়িতে। তেমনই একজন তৌহিদ আকাশ।

নাহ, নাম করা কোনো ব্যক্তি নয়, তবে নিজের অবস্থানে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো একজন মানুষ। বর্তমানে এই যুবক শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে রাঙামাটির পাহাড়ি ফুলের মতো ছোট ছোট শিশুদের মধ্যে। ঢাকায় জন্ম নেওয়া ছেলেটি কেন গেল রাঙামাটি? কেমন ছিল তার বেড়ে ওঠার গল্প? ছেলেবেলার গল্প নিয়ে কিছুটা সময় আড্ডা দেওয়া হয় আকাশের সঙ্গে।

১৯৮০’র দশকের শেষ দিকে ঢাকার কচুক্ষেত এলাকায় জন্ম নেন তৌহিদ আকাশ। সেখান থেকে এলাকা পাল্টে পরিবার চলে যায় জুরাইনে। সেখানেই বড় হতে থাকা। চতুর্থ শ্রেণীতে পড়াকালীন সময়ে হঠাৎ মা-বাবা সিদ্ধান্ত নেয় রাজধানী ছাড়ার। মা-বাবা দুজনেই ছোট চাকরি করতেন। ভাবলেন এই ছোট চাকরি দিয়ে সন্তানদের ভালো অবস্থান দেওয়া সম্ভব নয়। ব্যস, পুরো পরিবার চলে যান পাহাড়ি এলাকা রাঙামাটিতে।

১৯৯৮ এ রাঙামাটিতে যাওয়ার পর শুরুর দিকের সময়গুলো ভালোই কাটছিল সবার। এলাকার প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হয়ে গেলেন আকাশ। প্রথমদিকে একা থাকলেও রফিকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়ার পর ভালো লাগতে শুরু করলো। কিন্তু পরিবারের সুন্দর দৃশ্যপট খুব তাড়াতাড়িই বদলে যেতে শুরু করলো।

এক বছরের মধ্যেই শেষ হয়ে গেল বাবা-মায়ের জমানো সব টাকা। দাদা, চাচারা আগে থেকেই সেখানে থাকতেন, ঢাকা থেকে যাওয়ার পর বাবা আলাদা জমি কিনে থাকার কথা বললেও দাদা-চাচারা তা চাননি। যথেষ্ট সম্মানও দিচ্ছিলেন, কিন্তু জমানো টাকা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের আদর আর সম্মানও ফুরিয়ে গেল।

সেসময়ের স্মৃতিচারণ করে আকাশ বলেন, ‘হঠাৎ করেই একদিন দাদা বলে দিলেন সংসার থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার জন্যে। কিন্তু ততদিনে বাবার হাত শূন্য। ব্যস শুরু হয়ে গেলো আমাদের জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম অধ্যায়। বিলাসিতা তো দূরের কথা ঠিকমত তিন বেলা খেতে পর্যন্ত পারতাম না সে সময়। যে বাবা দোকানে আড্ডায় বসে সেই ১৯৯৮ সালে হাজার হাজার টাকা বিল তুলতেন সেই বাবা শুরু করলেন মানুষের ক্ষেতে খামারে দিন মজুরি করা, মাটি কাটার কাজ করা, বোঝা টানার কাজ করা।

বাবা তার ছোট বেলায় খুব ভালোমানের ফুটবলার ছিলেন। সেই ছোটবেলার একটা ইঞ্জুরির জন্যে উনি ভারী কোনো কিছু বহন করতে পারেন না। পায়ে ব্যথা উঠে যায়। সেই বাবাকেই দেখতাম মাথায় করে ভারী বোঝা টানছেন মানুষের। কারণ, গ্রামে তখন এছাড়া আর কিছু করার নেই আর ব্যবসা করার মত পুঁজিও অবশিষ্ট নেই।

মাকে দেখতাম কী সুন্দর আমাদের দুই ভাইকে খাইয়ে, বাবাকে খাইয়ে, নিজে না খেয়ে শুয়ে থাকতেন। আমি সব দেখতাম বুঝতামও কিন্তু বলতে পারতাম না কিছুই। হঠাৎ আবিষ্কার করলাম বাবা প্রচণ্ড বদরাগী হয়ে গেছেন। কারণে অকারণে মা কে মারধর করা শুরু করলেন। সারাদিন বাইরে কাজ করে বাসায় আসলেই আমার মহান দাদা আর চাচারা উল্টা পাল্টা কী সব বলতেন বাবাকে আর বাবাও এসে মাকে মার শুরু করতেন।’

এভাবেই তিন বছর কেটে গেল। জীবন আরও বেশি কঠিন হয়ে উঠলো আকাশ ও তার পরিবারের। কারণ, ৩ বছর পর দাদা তার জমি থেকে আকাশের পুরো পরিবারকেই তাড়িয়ে দিলেন। বাবার জীবনে নেমে এলো জীবন যুদ্ধের এক নতুন রূপ। একদম শূন্য অবস্থান থেকে নতুন করে জীবন সাজাতে শুরু করলেন তিনি।

আকাশ আবার বলতে শুরু করলেন, ‘একজন মানুষের জমিতে আশ্রয় নিয়েছিলাম আমরা। কোনমতে দুইদিনের মধ্যে একটা বাঁশ আর খুটির ঘর তুললাম বাবা, মা, আমি আর ভাই মিলে। শুরু হলো আমাদের নিজেদের মত করে সংসার। বাবা বদলাতে শুরু করলেন অল্প অল্প করে। এখন আর কারণে অকারণে রেগে গিয়ে মাকে মারেন না। আমাকেও মারেন না। বাবার দিনমজুরির পাশাপাশি মা শুরু করলেন বাড়ির আঙিনায় সবজি লাগানো। নিজেদের খাওয়ার পরে বাড়তি সবজিগুলো বাজারে মাথায় করে নিয়ে বিক্রি করতাম আমি।

আল্লাহ মুখ তুলে তাকালেন। অনেক বছর কষ্টের পর বাবা কীভাবে যেন খোঁজ পেলেন সমাজ সেবা মন্ত্রণালয়ের ক্ষুদ্র ঋন কার্যক্রমের। বাবা ঋন নিয়ে শুরু করলেন নিজেদের আনারস এর বাগান। সাথে এলাকায় কয়েকটা সমিতি করে বাবা হয়ে গেলেন ইউনিয়ন দলপতি। এই ঋন কার্যক্রমের টাকা দিয়েই আস্তে আস্তে উপরে ওঠা শুরু আমাদের।

২০০৫ এ বাবা একেবারে মানুষের ক্ষেত খামারে দিন মজুরি বন্ধ করলেন। এর মধ্যে ২০০২ তে আমার বোন এসে গেছে পৃথিবীতে। কেন যেন মনে হয় ও আমাদের পরিবারের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। কারণ, ওর জন্মের পর থেকেই ধীরে ধীরে আমাদের সব বদলে যেতে শুরু করল।’

এভাবে হেরে যেতে যেতে নতুন করে জীবনে জয়ের দেখা পান আকাশ ও তার পরিবার। নিজের বাবার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘বাবার মধ্যে একটা চ্যালেঞ্জ দেখতে পেতাম ছোটবেলা থেকেই। আপন মানুষেরা যেই ধাক্কাটা দিয়েছিল বাবা খুব করে চাইতেন সেই গর্ত থেকে বের হয়ে এমন কিছু করতে যাতে কিছু না বলেও অনেক কিছু বলা হয়ে যায়।’

আকাশ

১৯৯৯ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত অভাবকে সঙ্গী করেই কেটেছে আকাশের শৈশব আর কৈশর। কাছ থেকে দেখেছেন অভাব, অনুভব করেছেন না পাওয়ার কষ্ট। ঠিক মতো খাওয়া তো কপালে জুটতোই না, ঈদে নতুন পোশাক কী তাও ভুলে গেছিলেন। ফুটপাত থেকে কেনা ১৫০টাকার শার্ট আর পোশাকেই চলে যেত ছোট ভাই আর বোনের ঈদ। দরিদ্র বাবা অবশ্য কথা দিতেন, পরের ঈদে আকাশকেও পোশাক কিনে দেবেন। কিন্তু পরের ঈদটা আর আসতো না। মা-বাবার কষ্টের কাছে সেই নতুন পোশাক না পাওয়ার কষ্টটা কিছুই ছিল না। পুরো হাইস্কুল পার করেছেন তালি দেওয়া প্যান্ট আর এক শার্টে।

নিজের ছোটবেলার অভাবের দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতে করতে আকাশ একটি ঘটনা বলেন, ‘আমি ক্লাস ৫ এ পড়ি। এলাকায় তখন নতুন নতুন ক্রিকেট খেলা শুরু করেছিলাম। কিন্তু খেলতে গেলে মাঠে প্রতিদিন ২ টাকা দিতে হতো আর ম্যাচ খেলতে গেলে ৫ টাকা। এই টাকা কোথায় পাবো আমি? একদিন ভাবলাম কোন মতে যদি ১০০ টাকা হাতে আসে তাহলে অনেকদিন আরামসে খেলে যেতে পারবো।

নীল রফিকের সাথে তখন আমার খুব খাতির। ওর বাসায় যাওয়া আসা হরহামেশা। রফিকের মা তখন বাড়িতে সেলাই এর কাজ করতেন। আমি ওনাকে দাদি ডাকি। একদিন দেখলাম দাদি ১০০ টাকার একটা নোট তাকের উপর একটা কাঁচের জার এর নিচে রাখলেন। ওটা দেখার পর সারা বিকেল সারা রাত না ঘুমিয়ে ভেবেছি কি করা যায়।

পরদিন সকালে লোভের কাছে হার মেনে গিয়ে ওর বাসার জানালা দিয়ে ঢুকে টাকাটা চুরি করে নিয়ে আসলাম। আর সাথে দাদির বানানো চালতার আচার খেয়ে আসলাম চুরি করে। বিকেল বেলাতেই দাদি ডাকলেন আমাকে। ডেকে নিয়ে একটা বাটিতে আচার দিয়ে বললেন খেতে। আমি তো ভয়ে শেষ। পরে বললেন, “ভাই আমি জানি এই আচার তোর পছন্দ। ডেলিই তো খাস বাড়িত আইলে। টেহা ডাও যে তুই নিছস এইডাও জানি আমি। খরচ কইরা ফেলছত সব? না করলে আমারে ফেরত দে কেউরে কমু না”।

আমি ৭০ টাকা ফেরত দিতে পেরেছিলাম। বাকি ৩০ টাকা দিয়ে অন্তত ২ বছর পর আমি এক প্যাকেট বোম্বে সুইটস এর চিপস আর একটা সেজান জুস খেয়েছিলাম। চিপস আর জুস মিলে ২৩ টাকা ছিল আর ৭ টাকা দিয়ে চুইংগাম খেয়েছিলাম।

দাদির কাছে ওই ৩০ টাকা এখনো ঋণ আছে আমার আর সাথে আছে আমার। ওই সময়ের পুরোটা মান সম্মান। এই ৩০ টাকা কোনদিন দিব না আমি। আজীবন একটা কৃতজ্ঞতাবোধ থাকবে আমার এই ৩০ টাকার জন্যে।’

এভাবেই কেটে যায় তৌহিদ আকাশের ছেলেবেলা। জীবন সংগ্রামে যুদ্ধ করতে করতেই ১৯৯৮ এর শিশুটি পার করে ফেলেছেন শৈশব, কৈশর। ক্লাস ৯ এ ওঠার পর থেকে বাবাকে না জানিয়ে দিন মজুরের কাজ করতেন মানুষের ক্ষেতে।

সময় এখন ২০১৮, আকাশের বয়স ৩০ এর কোটায়। বাবা পার করেছেন ৬০। বর্তমানে কেবল গ্রাম নয়, পুরো জেলাতেই আকাশের বাবা একজন জানাশোনা ব্যক্তি। নানিয়ারচর উপজেলার একজন নেতা তিনি। আকাশ বর্তমানে শিক্ষক হিসেবে সরকারি চাকরি করছেন বুড়িঘাট পূনর্বাসন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেসঙ্গে সামলাচ্ছেন নিজের দু তিনটে ব্যবসা। ছোট ভাই এমবিএ করছেন একটি স্বনামধন্য প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে। বোন উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ছেন রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজে। আর মা এখনো নীরবে নিভৃতে পুরো পরিবার সামলে যাচ্ছেন।

নিজের বর্তমান অবস্থার কথা বলতে গিয়ে আকাশ বলেন, ‘যে আমাদের একটা সময়ে মানুষের জমিতে আশ্রয় নিতে হয়েছিল সেই আমাদেরই এখন ২০০ একর এর মতো জমি আছে। সোজা করে বললে ১১টা পাহাড় আছে আমাদের নিজস্ব যা বাবা কিনেছেন। অপূর্ণতা বলতে রয়ে গেছে শুধু এখন পর্যন্ত একটা কংক্রিটের বাড়ি করতে না পারা।’

আর্থিকভাবে হয়তো এখনো আহামরি স্বচ্ছল নন, তবে ২০২০ সালের মধ্যেই ইনশাল্লাহ সব অপূর্ণতা গুলো পূর্ণতা পাবে। এমনটাই কামনা আকাশের।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড