নিশীতা মিতু
টিভির পর্দায় আরএফএলের ‘আঞ্চলিকতা মানেই সংকীর্ণতা নয়’ শিরোনামের বিজ্ঞাপনটি দেখেছেন নিশ্চয়ই। সেখানে বাসে বসা একজন ব্যক্তিকে মোবাইল কানে নিয়ে বলতে শোনা যায়, ‘হ্যালো আকাসের মা, শুইনছো গো। কথা বইলছো না ক্যানে? আকাস কি ইসকুলে গেছে?’ কথার শেষ পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘ক্যানে? কথা বইলতে লইজ্জা কিসের?’ যা নাড়া দেয় সবার বিবেককে। পর্দায় আকাশের বাবা হিসেবে অভিনয় করা এই ব্যক্তিটি হলেন আরিফ হক। নিজের প্রবল মানসিক শক্তি, কিছু করার চেষ্টা আর নিজের লক্ষ্যের প্রতি একাগ্রতায় যিনি হয়েছেন একজন অভিনেতা।
ঢাকায় জন্মগ্রহণ করলেও আরিফের বেড়ে ওঠা ভারতে। হিন্দিতে কথা বলার কারণে বাংলাও বলতে জানতেন না তিনি। তাহলে কীভাবে এলেন বাংলাদেশের অভিনয় জগতে? কীভাবেই বা আয়ত্ত করলেন বাংলা ভাষা? কেমন ছিল অতীতের দিনগুলো? সব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে কিছুটা সময় আড্ডা দেওয়া হয় এই অভিনেতার সঙ্গে। জানা যায় তার কষ্টে কাটানো শৈশব, স্বপ্নময় কৈশোর আর চ্যালেঞ্জিং যৌবন নিয়ে।
শুরুটা করা যাক শৈশব দিয়েই। জীবনে চলার জন্য পড়াশোনা জরুরি- এ বিষয়টি আরিফ বুঝেছিলেন। আর তাই জীবনের সব সমস্যা সামলেই এগিয়েছেন শিক্ষাজীবন। অভিনয়ের বীজ শৈশবেই নিজের মধ্যে রোপণ করে নিয়েছিলেন আরিফ। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন, বড় হয়ে নায়ক হবেন।
ছেলেবেলার স্মৃতিচারণ করে আরিফ বলেন, একবার বাবার হাত ধরে হাঁটছিলাম একটি সিনেমার পোস্টার দেখতে দেখতে। সেই পোস্টার দেখে এতটাই মোহিত হয়ে গেলাম যে কখন বাবার হাত ছেড়ে দিয়েছি বলতে পারবো না। হঠাৎ একটি পিলারের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে সম্ভিত ফিরে এলো। তাকিয়ে দেখি বাবা অনেক সামনে চলে গেছেন। সিনেমা বা সিনেমার সম্পর্কিত বিষয়গুলো আমার হৃদয়ে এতখানি জায়গাই দখল করে ছিল, এখনও আছে।
শুধু কী তাই, বৃষ্টি হলে কখনো জুতা খুলতেন না আরিফ। শার্টের হাতাও গুটাতেন না, প্যান্ট গুটাতেন না। কারণ সিনেমার নায়করা এসব করেন না। নিজের এসব কাজকেই সঠিক মনে হতো আরিফের। কেউ উল্টোটা করলে বরং মনে হতো ভুল করছে।
অভিনয় জগতে আরিফ হকের পদার্পণ ভারতের রামলীলা মঞ্চের মাধ্যমে। প্রথমে রাক্ষসের চরিত্র, পরের বছর নারী চরিত্র, এরপর পুরুষের চরিত্র- এভাবেই এগিয়ে গেছেন কাজে। এরপর চলে আসেন বাংলাদেশে। দেশে ফেরার পর প্রধান ও মূল সমস্যা দেখা দেয় ভাষা নিয়ে। বাংলা বুঝতে পারলেও বলতে বা লিখতে পারতেন না তিনি। কিন্তু অভিনয় করতে হলে ভাষা জানা জরুরি। আর তাই শুদ্ধভাবে বাংলা শিখতে শুরু করেন আরিফ। এরপর থিয়েটারে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে দেশের অভিনয় প্রাঙ্গণে পদার্পণ করেন তিনি।
পেশায় একজন অভিনেতা হলেও আরিফ হকের পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায়। আঁকাআঁকি ভালো লাগায় এবং এ কাজে দক্ষতা থাকায় তিনি পড়াশোনার ক্ষেত্রে এই বিষয়টিকে বেছে নেন। সাফল্যের সঙ্গেই শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করেন আরিফ। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীনই জাতীয় ইংরেজি দৈনিকে কভার আঁকার সুযোগ পান। চারুকলা বিষয়ক কাজে একসময় ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। কিন্তু কোথায় যেন একটা টান পড়ে। মন বারবার চলে যায় ছোটবেলার ধ্যান অভিনয় জগতে।
আরিফ হক
এরপর ২০১২ সালে অদ্ভুত এক কাণ্ড করে বসেন আরিফ। ছেড়ে দেন চাকরি। মন ও মননে জায়গা দেন কেবল ‘অভিনয়’ শব্দটিকে। অভিনয় জগতে হুট করে এসেই চট করে জায়গা করে নেননি আরিফ। সময় নিয়েছেন, ধীর পায়ে এগিয়েছেন। নিজের কাজের দক্ষতা, সর্বোচ্চ দেয়ার চেষ্টা তাকে অল্প অল্প করে পরিচিত করেছে দর্শকদের কাছে।
অভিনয়ে উত্তম কুমারকে আদর্শ মানেন আরিফ। কেন ভালো লাগে উত্তম কুমারকে? জানতে চাইলে আরিফ বলেন, আমি তো একসময় বাংলা জানতাম না। তাই, উত্তম কুমারের সিনেমাও দেখা হতো না। বাংলা শেখার পর তার সিনেমা দেখা শুরু করি। বাংলা শিখতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম যে প্রমিত বাংলায় কথা বলতে গেলে মুখ বিকৃত হয় প্রচুর। মুখ বিকৃত হলে তো অভিনয় ভালো লাগবে না। তখন আমি এই বিষয়টি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করি। আবিষ্কার করি উত্তম কুমার আর সালমান শাহ্- এই দুজন অভিনেতা মুখ বিকৃত না করে সবচে ভালো এক্সপ্রেশন ও ডায়ালগ ডেলিভারি দিতে পারেন। সবমিলিয়ে বলতে গেলে, অভিনয় শিখতে গিয়ে আমার মনে প্রশ্ন আসে কার থেকে শিখবো, কাকে ফলো করবো? তখন আমি উত্তম কুমারকে শিক্ষক হিসেবে পাই এবং তখন থেকেই তাকে ভালো লাগা।
বাংলা ভাষাকে নিয়ে প্রচুর সময় কাটান আরিফ। জোরে জোরে উচ্চারণ করে এখনও স্ক্রিপ্ট পড়েন নিয়মিত। কঠিন শব্দগুলোকে বারবার উচ্চারণের মাধ্যমে সহজ করে নেন। বাবার কাছে প্রমিত বাংলা শেখা এই অভিনেতা এখনও বাংলায় কথা বলার ক্ষেত্রে কখনো স্ত্রী, কখনো কন্যার উপদেশ নিয়ে থাকেন।
পরিচালক মীর আহসানের চিলে কোঠা দিয়ে বাংলাদেশে অভিনয় শুরু করেন আরিফ হক। অভিনয় করেছেন বুনন, তিন গোয়েন্দা, বাতিঘর, গুড বাই কমান্ডার, চিরকাল, যদি একদিন এবং ছায়া ছবিসহ অসংখ্য নাটকে। চলচ্চিত্রেও রয়েছে তার সমান পদচারণা। কাজ করেছেন- ফখরুল আরেফিন খানের ভুবন মাঝি, পংকজ পালিতের একটি না বলা গল্প, আগস্ট ১৯৭৫, চিরঞ্জিব মুজিব এবং বঙ্গবন্ধুর বায়োপিকে।
ভবিষ্যতে একজন তারকা হতে চান আরিফ। তার মতে, অভিনয় নিয়েই যদি বেঁচে থাকতে হয় তবে তারকা হওয়ার বিকল্প নেই। নিজের বড় স্বপ্ন বুকে লালন করে, দুচোখে অভিনয়ের গালিচা মেলে এগিয়ে চলছেন এই অভিনেতা।
ওডি/নিমি
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড