নিশীতা মিতু
একজন অনলাইন উদ্যোক্তা নুসরাত জাহান পিউলি। নিজের জীবনে লড়াই করে টিকে সামনে এগিয়ে যাওয়া নারী তিনি। প্রথমে পোশাক নিয়ে কাজ শুরু করলেও বর্তমানে তিনি কাজ করছেন খাদ্য নিয়ে। উদ্যোক্তা এই নারীর সঙ্গে আড্ডা হয় দৈনিক অধিকারের-
১৯৯৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন পিউলি। বেড়ে ওঠা টাঙ্গাইলের মধুপুরে। সেখানে স্কুল, কলেজ শেষ করেন। এরপরই বিয়ে। ছোটবেলার স্মৃতিচারণ করে পিউলি বলেন, ছোট থেকে বেশ ভালো ছাত্রী ছিলাম। প্রাইমারি পর্যায়ে সবসময় রোল নম্বর ১ ছিল। মাধ্যমিকে রোল কিছুটা পেছালোও ভালো ছিল। শিক্ষকদের পছন্দের তালিকায় ছিলাম।
বিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাধ্যমিক আর মানবিক বিভাগ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেন পিউলি। তবে এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার আগে তার বিয়ে হয়ে যায়। পরীক্ষা শুরুর মাত্র ৩/৪ মাস আগেই পিউলিকে বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। এরপর ২০১৮ সালে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরীক্ষা দেন। এই পরীক্ষা দিতেও বহু কাঠখড় পোহাতে হয় পিউলিকে। শ্বশুরবাড়ির কেউ চাইতেন না তিনি পরীক্ষা দিক। তবে স্বামীর ইচ্ছায় তিনি পরীক্ষা দিতে সক্ষম হন।
ভালো ফলাফল করলেও পড়াশোনা আর আগাতে পারেননি পিউলি। নতুন করে আর ঝামেলা বাড়াতে চাননি। তখন থেকেই ইচ্ছাকে অন্য রূপ দেওয়ার কথা ভাবেন। সেই ভাবনা থেকেই অনলাইন ব্যবসায় আসা।
বর্তমানে সংসার আর ব্যবসা সামলাচ্ছেন পিউলি। বিয়ের পরপরই মা হয়ে গেছিলেন, এরপর সংসারে পুরো মন দেন। দুই সন্তান কিছুটা বড় হওয়ার পর নিজের যোগ্যতায় কিছু করার ইচ্ছা থেকে শুরু করলেন পোশাক বিক্রি করা, পরবর্তী বিক্রি শুরু করলেন আচার।
সুলতানা'স কিচেনের নানা পদের আচার
স্রোতের বিপরীতে হাঁটা শুরু করেছিলেন পিউলি। জানালেন ব্যবসা শুরুরদিকের কথা। পিউলি বলেন, আমি যখন কাজ শুরু করলাম তখন আমাকে সবার অজান্তে, আড়ালে থেকে কাজ করতে হতো। এমনকি আচার নিয়ে যখন কাজ শুরু করি তখন লুকিয়ে আচার বানাতে হতো। যৌথ পরিবার হওয়ায় সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পর আমাকে প্যাকেজিং করতে হতো।
এমনও অনেকদিন গেছে যে আমার পোশাকের পার্সেলগুলো তিনতলার বারান্দা থেকে ডেলিভারি ম্যানকে ছুঁড়ে দিয়েছি। কারণ, সবাই যখন ডাইনিংয়ে বসে নাস্তা করত সেই ফাঁকে আমাকে কাজটা করতে হতো। এমন কাজে ডেলিভারি ম্যান বেশ অবাক হতো।
কথাগুলো বলতে বলতে বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন পিউলি। চোখের জল সামলে ফের বললেন, আসলে কতটা যুদ্ধ করে আজকের পর্যায়ে এসেছি তা আমি জানি আর আল্লাহ জানেন। অন্য কেউ হলে হয়তো সংসার বা ব্যবসা যেকোনো একটা বেছে নিতো। আমি দুটোই সামলে চলার চেষ্টা করেছি, এখনও করছি। ফলাফল, আমি এখন একজন অনলাইন উদ্যোক্তা।
পিউলির পোশাক নিয়ে করা প্রতিষ্ঠানের নাম ‘নুসরাত’স কালেকশন’। বর্তমানে আচার ও বিভিন্ন খাবার নিয়ে কাজ করছেন অনলাইন প্রতিষ্ঠান ‘সুলতানা’স কিচেন’ এর মাধ্যমে। নিজের স্বপ্নকে ছুঁতে একাই হেঁটেছেন পিউলি। ২০১৭ সালে মাত্র ৯০ টাকা মূলধনে নুসরাত’স কালেকশনের যাত্রা শুরু করেন। ২০১৯ সালে শুরু করেন খাবার নিয়ে কাজ করা।
কাঁচামাল থেকে শুরু করে কুরিয়ার- সবকিছু একাই খুঁজে বের করেছেন পিউলি। কোথায় থেকে কম দামে কোন পণ্য মিলবে তার সন্ধান করে গেছেন একাই। আচারের বয়াম থেকে ব্যাগের লোগো কিংবা প্রতিষ্ঠানের স্টিকার ঠিক করা- সবটাই করেছেন একা হাতে।
কী কী রয়েছে সুলতানা’স কিচেনে? পিউলি জানালেন, প্রতিষ্ঠানের মূল পণ্য আচার। নানা উপাদানের তৈরি আচারই গ্রাহকের চাহিদার শীর্ষে রয়েছে। এছাড়াও পুডিং, হালুয়া, পোলাও, রোস্টসহ নানা ঘরোয়া খাবার পাওয়া যাবে এখানে।
অনেক ঝড় ঝাঁপটা পেরিয়ে টিকে রয়েছেন পিউলি। নিজের পথ চলার তিক্ত অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, অনেক বাধা বিপত্তির সৃষ্টি হয়েছে। কারণ সবাই ছিল আমার বিপরীতে। আমি ছিলাম একদম একা। আর একা যে কোনো লড়াই করা খুব কঠিন। তার থেকেও কঠিন যারা বুঝতে চায় না তাদের বোঝানো। একটা সময় ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। নিজেকে প্রশ্ন করেছি, আমি কি খারাপ কিছু করছি?
কাছাকাছি বয়সী দুই সন্তানকে সামলে, যৌথ পরিবারের সব দায়িত্ব শেষ করে তারপরই তো কাজ করছি। তবে কেন এত বাধা? যদিও এসব ভেবে আমি ভেঙে পড়িনি বরং আরও শক্ত হয়ে উঠেছিলাম। ভালো কাজ করতে গেলে যদি খারাপ কিছু সম্মুখীন হতে হয়, তবে তাই হোক- এমন একটা জেদ চেপে বসেছিল।
এই জেদকেই পথ চলার সাহস মনে করেন পিউলি। আর তাই হয়তো এখন সবাই তাকে কাজের উৎসাহ দিচ্ছে। এমনকি ৬ আর ৮ বছর বয়সী সন্তানরাও পাশে আছে। পিউলি মনে করেন, ব্যবসায় টিকে থাকতে প্রয়োজন ইচ্ছা শক্তি, ধৈর্য আর শ্রম। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাস রাখা।
একসময় আচারের জন্য সারা বাংলাদেশের মানুষ পিউলিকে চিনবেন এমনটাই স্বপ্ন দেখেন তিনি। প্রতিটি দোকানে তার তৈরি আচার সাজানো থাকবে আর আচারের একটা ছোট্ট দোকান থাকবে- এমনটাও রয়েছে স্বপ্নের তালিকায়। একা পথ হেঁটে জয়ী পিউলি জয় করুক তার স্বপ্নগুলো এই কামনায় শেষ করলাম আড্ডা।
ওডি/নিমি
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড