• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩০ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

উদ্যোক্তার খ্যাতিতে হারিয়েছে শরিফার কম শিক্ষার ক্ষত

  নিশীতা মিতু

১৪ নভেম্বর ২০২১, ১১:৩২
আয়াত কাঁথা ঘর
আয়াত কাঁথা ঘরের কর্ণধার শরিফা হোসেন

নিজের শক্ত অবস্থান তৈরির পেছনে বেশিরভাগ মানুষের সঙ্গী হয় কষ্টকর যাত্রাপথ। কেউ ভয়ে পথে হাঁটেন না, কেউ অল্প হেঁটে থেমে যান বঞ্চনা পেয়ে আর কেউ সব সহ্য করে এগিয়ে যান আপন শক্তিতে। এমনই একজন নারী শরিফা, যিনি সব বাধাকে তুচ্ছ করে এগিয়ে গেছেন নিজের স্বপ্নকে নিয়ে। সফল উদ্যোক্তা এই নারীর চলার পথ কেমন ছিল, কীভাবে শুরু করলেন কাজ সেসব গল্প নিয়েই আড্ডা হয় তার সাথে।

শরিফার পুরো নাম শরিফাতুন্নেসা। তবে সবার কাছে তিনি শরিফা হোসেন নামেই পরিচিত। আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলাতে ছোট থেকে বড় হয়েছেন তিনি। বর্তমানে অনলাইন ব্যবসা সামলাচ্ছেন, সেসঙ্গে সংসারের দায়িত্ব তো আছেই।

এসএসসি’র গণ্ডি পেরোনোর আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় শরিফাকে। এইচএসসি পরীক্ষার আগে জানতে পারেন মা হতে যাচ্ছেন, ফলে থেমে যায় পড়ালেখা। সন্তান, সংসার সামলে পড়ালেখা শুরু করার আর সুযোগ মেলেনি তার।

শরিফা বলেন, মেয়েকে নিয়ে সারাদিন বাসায় একা থাকতে থাকতে বিরক্ত হতাম। ২০১৬ সালের কথা, অনলাইন ব্যবসায় তখন খুব কম মানুষের আনাগোনা ছিল। ফেসবুকে কিছু পেজের লাইভ, পোস্ট দেখতাম। সেগুলো দেখে খুব উৎসাহ পেতাম। বাচ্চা রেখে যেহেতু ঘরের বাইরে গিয়ে পড়াশোনা বা কাজ কোনটাই করার উপায় ছিল না, তাই এমন কিছু করার কথা ভাবতাম যা ঘরে বসেই করা যায়।

বিছানা থেকে একটি কাঁথার ভাঁজ খুলতে খুলতে আবার বলতে শুরু করলেন শরিফা, কী নিয়ে কাজ করবো চিন্তা করতেই মাথায় আসলো আমার এলাকার ঐতিহ্যবাহী পণ্য নকশীকাঁথার কথা। বাড়ির কাউকে না জানিয়ে কোনোরকমে একটা ফেসবুক পেজ খুললাম। মায়ের বাক্স থেকে হাতের কাজ করা নকশিকাঁথাগুলো বের করে ছবি তুলে পোস্ট করলাম পেজে। একদিন, দুইদিন যায় কিন্তু কোনো অর্ডার আর আসে না। এভাবেই কেটে গেল তিন মাস। কোথাও যেন একটা আশা ছিল আমার, মনে হচ্ছিল একদিন না একদিন ঠিকই অর্ডার আসবে। অবশেষে সেই দিনটি এলো। বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন শরিফা।

চোখের জল সামলে আবার বলতে লাগলেন, সুইডেন প্রবাসী সোনিয়া সিদ্দিকী আপু একদিন নক দিলেন। একটি কাঁথার ছবি দিয়ে জানালেন সেটি তার পছন্দ হয়েছে, কিনতে চান। আপুর সঙ্গে সব আলাপ আলোচনা করে অর্ডার নিলাম। দেড় মাস পর তার পণ্য ডেলিভারি দিলাম। এরপর কিছুদিন বাদে আরেকটি অর্ডার পেলাম। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত আর থেমে থাকতে হয়নি।

আয়াত কাঁথা ঘরের কিছু নকশিকাঁথা

শরিফার সন্তানের নাম আয়াত। তার নামেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করেছেন ‘আয়াত কাঁথা ঘর’। ২০১৬ সাল থেকে অনলাইন ব্যবসা জগতে শরিফার পদার্পণ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজের প্রতিষ্ঠানকে আরও সমৃদ্ধ করেছেন তিনি। কেবল নকশিকাঁথা নিয়ে কাজ শুরু করলেও বর্তমানে এর পাশাপাশি চাঁপাইনবাবগঞ্জের কাঁসা পিতল শিল্পকে তুলে ধরতে কাজ শুরু করছেন কাঁসা পিতলেন পণ্য নিয়ে। মৌসুমে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নিজস্ব বাগানের ফরমালিন মুক্ত আম নিয়েও কাজ করেন তিনি।

বর্তমানে নকশিকাঁথা নিয়ে অনেকেই কাজ করছেন। আয়াত কাঁথা ঘর তাদের থেকে আলাদা কেন হবে? জানতে চাইলে শরিফা বলেন, আমি যখন কাজ শুরু করি তখন অনলাইনে নকশিকাঁথা নিয়ে খুব কম মানুষ কাজ করত। এখন অনেক মানুষ একই পণ্য নিয়ে কাজ করলেও তাদের থেকে আমার কাজ আলাদা। কেননা, ব্যবসার শুরু থেকেই আমি একটা জিনিসে সবসময় নজর রেখেছি, তা হলো কাঁথার কোয়ালিটি বা মান বজায় রাখা।

আমার কাঁথার মান ভালো হওয়ায় ক্রেতা বারবার রিপিট হয় আলহামদুলিল্লাহ। এইতো কিছুদিন আগে এক প্রবাসী কাস্টমার ২টি কাঁথার ছবি দেখিয়ে বললেন আছে কি না। আমি হ্যাঁ বলার সাথে সাথেই তিনি এড্রেস দিয়ে পাঠিয়ে দিতে বললেন। এমনকি দামটাও জিজ্ঞেস করেননি। কারণ, তিনি আগেও আমার থেকে কাঁথা নিয়েছিলেন আর আমার ওপর তার পূর্ণ বিশ্বাস আছে।

করোনা আসার পর কাজ থেকে কিছুটা দূরে ছিলেন শরিফা। কাজ থেকে দূরে থাকলেও নিজের পরিচিতি গড়ার কাজে সক্রিয় ছিলেন তিনি। ফেসবুকের উদ্যোক্তাদের নিয়ে গঠিত বিভিন্ন গ্রুপে সময় দিয়েছেন, নিজের আর নিজের উদ্যোগ সম্পর্কে সবাইকে জানিয়েছেন। সেসময় বিক্রি না হলেও এর ফল পরবর্তীতে পেয়েছেন তিনি। এই পরিচিতিই পরবর্তীতে তাকে অনেক ক্রেতা এনে দিয়েছে। আর তাই, করোনাকে ব্যবসাক্ষেত্রে খুব একটা খারাপভাবে দেখছেন না তিনি।

ব্যবসাক্ষেত্রে পরিবারের কেমন সাপোর্ট পেয়েছেন জানতে চাই শরিফার কাছে। তিনি বলেন, শুরুর দিকে পারিবারিক সাপোর্ট পাইনি বললেই চলে। আমাদের সমাজ এখনো এটাই বিশ্বাস করে যে, মেয়েরা শুধুই সংসার আর বাচ্চা সামলাবে। অনেক রকম বাধা-বিপত্তি পার করে এই পর্যন্ত আসতে পেরেছি।

সবার মতের বিরুদ্ধে কোনো কাজ করাটা একটু বেশিই কষ্টের। শরিফার বেলাতেও তাই। অনেকবার ভেবেছেন কাজ ছেড়ে দেবেন। শরিফা বলেন, এটা তো মাঝখানে নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে গেছিল। প্রতিটা মুহূর্তে মনে হতো, আর পারছি না আমি। এতো লড়াই, এতো যুক্তি, তর্ক দিয়ে আর কত দিন? হেরে গিয়ে তিন দিনের জন্য সবকিছু বন্ধ করে, আইডি, পেজ, ম্যাসেঞ্জার সব বন্ধ করে বসে ছিলাম। এরপর সবার ফোনকলের ঝড়ে আবার ফিরলাম। বুঝতে পারলাম, ব্যবসা কেবল আমার নয় এখানে অনেক মানুষের স্বপ্ন আর মায়া জড়িয়ে আছে। এই মানুষগুলো আমাকে আবার স্বপ্ন দেখতে শিখালো। এবার আমি আর সেই লাজুক শরিফা নই, নিজের মনোবল যথেষ্ট শক্ত করে নেমেছি। আমি এখন নিজেই নিজেকে বলি, থেমে গেলে চলবে না, টিকে থাকার লড়াইটা কেবলই আমার। আমাকে লড়াই করেই টিকে থাকতে হবে।

খুব বড় স্বপ্ন দেখতে ভয় পান শরিফা। তিনি বলেন, অনেক বড় স্বপ্ন দেখার ডানা আমার শুরুতেই কেটে দেওয়া হয়েছে। তবুও অনলাইন জগতে নিজের অবস্থান আরও মজবুত করতে চাই। নিজের উদ্যোগকে আরও অনেক মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চাই।

লড়াই করতে যারা শিখে যায়, সফলতা তাদেরই হয়। সব বাঁধার সঙ্গে লড়াই করে বহুদূর এগিয়ে যাক শরিফা, গুছিয়ে দিক তার কম শিক্ষার ক্ষত— এই প্রত্যাশায় আড্ডার ইতি টানলাম।

ওডি/নিমি

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড