নিশীতা মিতু
পাহাড়ি এলাকা রাঙামাটির বাসিন্দা লামিয়া। স্বামী আর এক বছর বয়সী কন্যা সন্তান নিয়ে তার সংসার। সন্তান সামলানোর পাশাপাশিই সামলাচ্ছেন ব্যবসা। অনলাইনে জামদানি শাড়ি বিক্রি করেন তিনি। পাহাড়ি এলাকা থেকে ক্রেতার শখের জামদানি চলে যায় দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। কখনোবা ছাড়িয়ে যায় দেশের সীমানা। অনলাইন উদ্যোক্তা লামিয়া ইসলাম আলভীর পথচলার গল্প নিয়েই দৈনিক অধিকারের স্বপ্নছুঁইয়ের আজকের আয়োজন।
নরসিংদীর মেয়ে লামিয়া। জন্ম এবং বেড়ে উঠা নরসিংদীর ঘোড়াশালে। হিসাব বিজ্ঞানে মাস্টার্স শেষ করেছেন। ছোটবেলা থেকেই ক্যারিয়ার সচেতন তিনি।
লামিয়া বলেন, ইচ্ছে ছিল আগে নিজের পায়ে দাঁড়াবো, এরপর বিয়ে করবো। কিন্তু ওই যে আল্লাহ সব ঠিক করে রেখেছিলো। পড়াশোনা শেষ হওয়ার এক বছরের মধ্যেই বিয়ের পিঁড়িতে বসে যাই। তাও চলে আসি একদম পাহাড়ে। আমার আরেকটা পরিচয় আমি একজন মা। আমার একটি ছোট মেয়ে আছে যে সবেমাত্র ১ বছরে পা দিয়েছে। যেহেতু ছোট বাচ্চা নিয়ে আপাতত চাকরি করা সম্ভব হয় না তাই অনলাইন বিজিনেসের কথা মাথায় আসে। কারণ চাচ্ছিলাম নিজে কিছু করি। নিজের আলাদা একটা পরিচয় থাকুক।
দেড় বছর আগে শুরু করলে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হয় বছরখানেক আগে। সদ্য মাত্র মা হওয়ার পাশাপাশি শুরু করেন ব্যবসায়িক জীবনের নতুন পথ চলা। লামিয়ার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নাম ‘রুচিশীল পরিধান’। নামটি তার স্বামীর দেওয়া।
কী পণ্য নিয়ে কাজ করেন, জানতে চাই লামিয়ার কাছে। লামিয়া বলেন, শুরুতে বিভিন্ন পাঁচমিশালি পন্য নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম। কিন্তু কেন জানি সেসব পণ্য নিয়ে কাজ করতে তেমন আগ্রহ পেতাম না। মনে হলো এমন একটা কিছু নিয়ে কাজ করতে হবে যেটা নিয়ে কাজ করতে আমি সাচ্ছন্দ্যবোধ করবো, যেটার প্রতি ভালোলাগা, ভালোবাসা দুটোই থাকবে। তারপর মাথায় আসলো জামদানির কথা। জামদানি যা আমাদের দেশীয় ঐতিহ্য, আমাদের আভিজাত্য। বিদেশি শাড়ির প্রভাবে আমরা আমাদের এই দেশীয় ঐতিহ্যকে ভুলতেই বসেছিলাম। কিন্তু এখন অনেকেই জামদানিকে টিকিয়ে রাখতে আবার নতুন উদ্যমে কাজ করছে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে আমিও জামদানি নিয়েই কাজ শুরু করলাম।
বর্তমানে শাড়ি, থ্রিপিস, ২ পিস, ওড়না এসব নিয়েই কাজ করছেন লামিয়া। নিজের কাজের ব্যাপারে বলতে গিয়ে লামিয়া বলেন, জামদানি নিয়ে কাজ করার আগে প্রথমে নিজে এ নিয়ে কিছু দিন রিসার্চ করেছি, ব্যাসিক জ্ঞানটুকু নিয়েছি। কারণ আমি মনে করি আমি যেই পন্য নিয়ে কাজ করবো সে ব্যাপারে আগে আমার নিজের ধারণা থাকা উচিত। কাজ করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত তাঁতীদের কাছ থেকে জামদানি সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য জানছি, অনেককিছু শিখছি। সবচেয়ে ভালো লাগে যখন প্রবাসী ক্রেতা পাই। কারণ আমার কাছে মনে হয় আমাদের এই দেশীয় ঐতিহ্যকে বিশ্বের দরবারে প্রবাসীরাই রিপ্রেজেন্ট করতে পারেন।
রুচিশীল পরিধানের কিছু পণ্য
ইউরোপ, আমেরিকাসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পণ্য পাঠানোর অভিজ্ঞতা হয়েছে লামিয়ার। অএনেক্র সঙ্গেই গড়ে উঠেছে ভালো সম্পর্ক। তবে হুট করেই যে ক্রেতার মনে শক্ত অবস্থান সৃষ্টি হয়েছে তা নয়। বরং নিজের সততা, ধৈর্য আর কাজের প্রতি একাগ্রতার মাধ্যমে এ অবস্থান সৃষ্টি করেছেন তিনি।
লামিয়া বলেন, আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ইন্ডিয়াতেও জামদানির খুব ভালো চাহিদা রয়েছে। অনেক ইন্ডিয়ান ক্রেতাও রয়েছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার হোলসেলে নিয়ে নিজেরা সেখানে খুচরা বিক্রি করে থাকেন।
করোনার কারণে ব্যবসায় কিছুটা মন্দাভাব দেখা দেয়। জামদানি কিছুটা বেশি মূল্যের শাড়ি হওয়ায় অনেক ক্রেতারই ইচ্ছা থাকার পরও কিনতে পারেননি। এজন্য অর্থনৈতিক মন্দাকে দায়ী মনে করেন তিনি। তবে বর্তমানে অবস্থার বেশ উন্নতি হয়েছে। এখন ক্রেতার সংখ্যা বাড়ছে।
ক্রেতাদের সম্পর্কে লামিয়া বলেন, আমার বেশিরভাগ ক্রেতাই খুব ভালো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের সঙ্গে খুব ভালো একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে যায়। আলহামদুলিল্লাহ বেশ কিছু ক্রেতা পেয়েছি যারা একের অধিকবার রুচিশীল পরিধান থেকে কেনাকাটা করেছেন। তবেকিছু তিক্ত অভিজ্ঞতাও আছে। যেমন, আমাদের দেশের ভৌগলিক অবস্থার পরিবর্তনের কারণে এখন আর ১০০ কাউন্ট সুতার শাড়ি হয় না বললেই চলে। ১০০ কাউন্ট সুতা দিয়ে বানাতে চাইলে সুতা বিদেশ থেকে কিনে আনতে হয় যেটাও সবসময় পাওয়া যায় না। অথচ জামদানি নিয়ে যারা কাজ করে তাদের অনেকেই ৪০-৫০ হাজারের একটা শাড়িকে ১০০ কাউন্ট বলে চালিয়ে দেয়। যেখানে অরজিনাল ১০০ কাউন্ট শাড়ির মূল্য দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। এই সত্যটাই যখন বুঝাতে যাই অনেক সময় উল্টো বিপাকে পড়ি। আবার কিছু কাস্টোমার খুব সুন্দরভাবে বুঝে যায়। এছাড়া মাঝেমধ্যে ডেলিভারি সংক্রান্ত জটিলতায় ও পরতে হয়।
ব্যবসায় আসা নিয়ে স্বামীকে সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞতা জানান লামিয়া। তার সমর্থন আর পরামর্শেই অনলাইন ব্যবসায় এসেছেন তিনি। লামিয়া বলেন, একা সংসার সামলে এবং ছোট বাচ্চা নিয়ে সারাদিন ক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা খুব কঠিন। কিন্তু এই মানুষটা আমাকে সবসময় মানসিকভাবে সাপোর্ট দেন। সে যখন ফ্রি থাকে আমার মেয়েকে রাখে এবং সংসারের কাজে সাহায্য করে যাতে আমি একটু রিল্যাক্সভাবে বিজনেসে সময় দিতে পারি।
আরও পড়ুন : সফল ফ্রিল্যান্সার মাহাবুবের ‘সফটি ডিজিটাল’
স্বামীর পর মা কে কৃতজ্ঞতা জানান লামিয়া। তিনি বলেন, আম্মু প্রতিদিন আমার ব্যবসার খবর রাখেন। একদিন যদি শাড়ির নতুন ছবি আপলোড না দেই জিজ্ঞেস করবে তুমিতো আজকে কোনো ছবি আপলোড দিলা না। আবার মাঝেমধ্যে বিক্রি কম হলে যদি আমি একটু হতাশ হয়ে যাই আম্মু আমাকে বুঝায়, আরে তুমি কাজ চালিয়ে যাও, দেখবে বিক্রি হবে। আসলেই তখন আবার নতুন করে সাহস খুঁজে পাই।
লামিয়া বলেন, মাঝেমধ্যে হতাশ হয়ে যাই। কারণ এখন অনলাইন ব্যবসা মানেই প্রতিযোগিতা। নিজেকে টিকিয়ে রাখতে হলে দরকার নিজের সৃজনশীলতা, নিত্য নতুন মার্কেটিং আইডিয়া বের করে সেগুলোকে বিজনেসস কাজে লাগানো। কিন্তু হার মানতে আমি রাজি না। আমার বিশ্বাস, লেগে থাকলে এবং শ্রম দিলে সফলতা আসবেই। তাই নিজেকেই নিজে বুস্ট আপ করে আবার কাজে ঝাপিয়ে পড়ি।
নিজের উদ্যোগ নিয়ে অনেক পরিকল্পনা রয়েছে লামিয়ার। জামদানিতে কিছুটা ফিউশন আনার ইচ্ছে রয়েছে। খুব শিগগিরই নতুন কিছু করবেন। ইচ্ছে আছে নিজের একটা শোরুম করার। সর্বোপরি সবাই তার উদ্যোগকে চিনুক, তাকে কাজের পরিচয়ে চিনুক এমনটাই কামনা লামিয়ার।
ওডি/নিমি
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড