কালো বলে ক্লাসে বসা মানা, বাইরে দাঁড়িয়েই ডাক্তার!

একজন শিক্ষকের কাছে তার সব শিক্ষার্থীই সমান। তবে ক্লারার শিক্ষকের কাছে বোধহয় তা ছিল না। মেয়েটি কালো, কিছুটা ব্যঙ্গ করে বললে তার গায়ের রং ময়লা। এই ছিল তার অপরাধ। অন্যদের মতো সে ফর্সা নয়। আর তাই ক্লাসে বসার অনুমতি ছিল না ক্লারার। সাদা কালোর এই দ্বন্দ্ব ঢুকেনি তার মাথায়। কেবল প্রশ্ন করেছিল, এতে আমার কী দোষ?

কৃষ্ণকায়া মেয়েটির পুরো নাম ক্লারা বেলে উইলিয়ামস। কেবল কালো হওয়ায় অগণিত বৈষম্যের শিকার হয়েছেন তিনি। ক্লাসে বসতে পারতেন না বলে দাঁড়িয়ে থাকতেন ক্লাসের বাইরেই। সেখান থেকে শিক্ষকদের সব কথা নোট করতেন। এই দৃশ্য অবশ্য খুব একটা খেয়াল করতেন না কেউই।

ক্লাসে বসতে না পারলেও সর্বোচ্চ নম্বর অর্জন করেন ক্লারা। এতে সবাই অবাক হন বটে কিন্তু শিক্ষক বা সহপাঠীদের মন গলেনি। উপেক্ষিত হলেও নিজের কাছে হারতে শিখেননি ক্লারা। তার বিশ্বাস ছিল, আঁধারের পেছনেই লুকিয়ে রয়েছে আলো।

গায়ের কালো রং নিয়ে তিনি লড়ে গেছেন নিজের মেধা দিয়ে। আর তাই তো ইতিহাসে তার নাম লেখা রয়েছে স্বর্ণাক্ষরে। ক্লারাই প্রথম আফ্রিকান আমেরিকান হিসেবে নিউ ম্যাক্সিকো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন।

১৮৮৫ সালের ২৯ অক্টোবর টেক্সাসের লাগ্রাঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন এ নারী। মাধ্যমিকের পর্ব শেষ করেন সেখানকারই একটি ছোট স্কুলে। ১৯০১ সালে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেন প্রেইরি ভিউ নরমাল অ্যান্ড ইন্ডিপেন্ডেন্ট কলেজ থেকে।

১৯০৫ সালে প্রেইরি ভিউ নরমাল অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল কলেজে পড়ানো শুরু করেন তিনি। নিযুক্ত হন সুইং বিভাগের প্রধান হিসেবে।

১৯১৭ সালে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। স্বামী জেসপার উইলিয়াম ছিলেন একজন ফার্মাসিস্ট। একে একে তিন ছেলের জননী হন ক্লারা। এরপর স্বামীর সঙ্গে মিলে একটি ওষুধের দোকান দিলেন। ভালোই চলছিল ব্যবসা।

এরই মধ্যে মেডিসিন বিষয়েও ভালো দক্ষতা অর্জন করেন তিনি। পরবর্তী সময়ে ১৯২৪ সালে টেক্সাস ছেড়ে নিউ মেক্সিকোতে চলে যান তারা। এখানে এসে তিনি আবার লেখাপড়া শুরু করেন। ভর্তি হন মেক্সিকো কলেজ অব এগ্রিকালচার অ্যান্ড ম্যাকানিক আর্টসে (বর্তমানে নিউ মেক্সিকো স্টেট ইউনিভার্সিটি)।

সেখানেই প্রথম বৈষম্যের শিকার হতে শুরু করেন ক্লারা। তাকে ক্লাসে ঢুকতে দেওয়া হতো না। আর তাই হলরুমে দাঁড়িয়েই শিক্ষকের কথা শুনতেন, নোট করতেন তিনি। ক্লাস না করেও তিনিই প্রথম আফ্রিকান আমেরিকান হিসেবে স্নাতক সম্পন্ন করেন। এরপর একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতেও স্নাতক করেন। দুঃখের বিষয় হলো, এরপরও বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনেও উপস্থিত থাকার অনুমতি মেলেনি তার।

১৯৫১ সালে শিকাগোতে চলে যান ক্লারা। সেখানে তার বড় ছেলে একটি ক্লিনিক খোলেন। বাকি জীবন সেখানে থাকারই সিদ্ধান্ত নেন তিনি।

হঠাৎ করেই যেন তার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। তারা খুঁজে বের করেন ক্লারাকে। এত দিনে তারা উপলব্ধি করতে পারেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতক সম্পন্নকারী এই ছাত্রীর সঙ্গে তারা অবিচার করেছেন। ক্লারাকে উৎসর্গ করে একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন তারা।

কখনো কখনো জীবনে এমন কিছু ঘটে যার জন্য আমরা বলে বসি, সত্যিই পৃথিবী গোল। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে, ক্লারার তিন পুত্রই ফিজিশিয়ান। তারা সবাই মেক্সিকো বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই স্নাতক সম্পন্ন করেছেন।

১৯৬৬ সালে একজন সার্থক মা ও নারী ব্যবসায়ীর তকমা অর্জন করেন ক্লারা। পরবর্তী সময়ে নিউ মেক্সিকো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ক্লারার নামে তাদের একটি হলের নামকরণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে আসার ৪৩ বছর পর ক্লারা তার পূর্ণ সম্মানটুকু পেয়েছিলেন।

আরও পড়ুন : জীবনে বহুবার ভেঙে গিয়েও সফল উদ্যোক্তা ফারাহ্

এরপর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ক্লারাকে রেসিস্ট ট্রিটমেন্টের ওপর একটি ডিগ্রি গ্রহণের প্রস্তাব দেয়। ক্লারার বায়োগ্রাফি অনুসারে, ৯১ বছর পর্যন্ত তিনি তার ছেলের ক্লিনিকে রিসিপশনিস্ট হিসেবে কাজ করেন।

১০৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন ক্লারা। ২০০৫ সালে তার নামানুসারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইংরেজি বিভাগের নামকরণ করেন ক্লারা বেলে উইলিয়ামস হল। ক্লারার নামে তারা একটি স্কলারশিপের ব্যবস্থাও চালু করেছেন।

নিজের গায়ের রং নিয়ে আমরা অনেকেই হতাশ হয়ে পড়ি। ফর্সা হওয়ার দৌড়ে দমিয়ে রাখি নিজের মেধা আর জ্ঞানকে। ক্লারা সব নারীদের জন্যই একজন উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

সূত্র : ফেসটুফেসআফ্রিকা

ওডি/এনএম