• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৬ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ফটিকছড়ির ভরসার নাম ড. বখতিয়ার রশিদ

  নিশীতা মিতু

২৫ নভেম্বর ২০১৯, ১৪:০৮
ডা. বখতিয়ার
রোগী দেখছেন ডা. বখতিয়ার;

ছোটবেলায় জীবনের লক্ষ্য রচনায় আমরা অনেকেই লিখতাম বড় হয়ে ডাক্তার হতে চাই। আর তাতে নিজের ইচ্ছার কথা বলতে গিয়ে লিখতাম, গ্রামের গরিব মানুষদের বিনামূল্যে চিকিৎসা করাতে চাই।

বড় হয়ে সবাই ডাক্তার না হলেও কেউ কেউ ঠিকই ছোটবেলার স্বপ্ন পূরণ করেন। নামের আগে ডাক্তারের পদবি লাগিয়ে নেমে পড়েন মানবসেবায়। কিন্তু ছোটবেলা কথা মনে রাখে কজন? গ্রামের মানুষগুলোর কাছে কি কেউ আদৌ ছুটে যায়? গেলেও কি বিনা অর্থে চিকিৎসা করায়?

কোনো পেশার মানুষ যদি প্রতিনিয়ত সবচেয়ে বেশি মানুষের অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড়ায় সেই তালিকা করলে ডাক্তাররা থাকবেন একদম উপরের সারিতে। অথচ এই ডাক্তারদের জীবনের পুরোটাই চলে যায় মানুষের পেছনে।

রোজ অভিযোগ কাঁধে বয়ে বেড়ানো এই মানুষগুলোর মধ্যে কিছু ব্যতিক্রমীও রয়েছে। এমই এক তরুণের গল্প চলুন আজ জানা যাক-

ডাক্তারি পাশ করার পর বেশিরভাগ ডাক্তারের ইচ্ছা এবং চেষ্টা থাকে কীভাবে ক্যারিয়ারকে সবচেয়ে উঁচুতে নিয়ে যাওয়া যায়। আর তাই সবাই ছোটে শহর পানে। প্রায়ই ডাক্তারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে নিজের পোস্টিং থাকার পরেও জেলা শহর বা গ্রামে তারা মাসে হয়তো এক দুদিন যান কিংবা যান না। কিন্তু ফটিকছড়ির তরুণ বখতিয়ারের গল্পটা পুরোই ভিন্ন। বলছিলাম ডাক্তার বখতিয়ার রশিদের কথা যিনি কিনা পাশ করার পর সব রকম সুযোগ সুবিধা থাকার পরও শহরে না এসে প্রতিনিয়ত সেবা দিয়ে যাচ্ছেন নিজ উপজেলায়, নিজের গ্রাম ও আশেপাশের গ্রামের শত শত মানুষকে। সহপাঠীরা প্রায় সবাই যখন শহরে ক্যারিয়ার গড়ে স্থিত হওয়ার পথে সেখানে ডা. বখতিয়ার চিন্তা করেন শহরে তো চাইলেই চলে যাওয়া যায় কিন্তু গ্রামের মানুষগুলোর কী হবে? তাদেরও তো একটা হক আছে।

তার কাছে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য শুধু ফটিকছড়ি নয়, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবানের মতো পার্বত্য অঞ্চল থেকেও মানুষ চলে আসেন। ডাক্তারদের অপর নাম যেখানে ‘কসাই’ বলে আখ্যায়িত করা হয় প্রায়ই, সেখানে এই তরুণ গ্রামের অনেকের চিকিৎসা করে দেন বিনামূল্যে। তার প্রাপ্য সম্মানী তিনি তাদের থেকে অবশ্যই নেন যাদের সেটা দেওয়ার ক্ষমতা আছে। কিন্তু চিকিৎসা তিনি ধনী গরীব সবাইকেই দেন কারণ এটা দেওয়ার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা তাকে দিয়েছেন।

নাজিরহাট পৌরসভার মামুনুর রশিদ এবং পারভিন আক্তারের তৃতীয় সন্তান ডা. বখতিয়ার। তিন বোনের আদরের একমাত্র ভাই। অথচ পরিবারকে সেই সময়টুকুও দিতে পারেন না ব্যস্ততার কারণে। কখনো কখনো এমনও হয় দুপুরে বাসায় ভাত খেতে খেতে হয়তো চেম্বারে পেশেন্ট চলে এসেছে, পানি খেতে হয়েছে চেম্বারে গিয়ে।

তবে এই প্রফেশনালিজম আর আন্তরিকতার উপহারও তিনি পান। কোনোদিন হয়তো শরীর খারাপের জন্য চেম্বারে বসতে না পারলে রোগীই মধ্যরাতে চলে যান তাকে দেখতে। এমন বিষয়গুলো অবশ্য মধুর যন্ত্রণা মনে করেন তিনি।

ডাক্তাররাও মানুষ, তাই তাদেরও শরীর খারাপ হয়, ক্লান্তি আসে মনে। জীবনের খারাপ সময়ে একটু খোলা বাতাসে নিশ্বাস নিতে ইচ্ছা করে। কাছের মানুষদের সময় দিতে না পারায় ভারী হতে থাকে অভিমান আর অভিযোগের পাল্লা। তবুও তারা রোগীকে সেবা দিয়ে যান নিরলসভাবে।

দন্ত চিকিৎসক হওয়ার কোনো স্বপ্ন ছোটবেলায় ছিল কিনা এমন প্রশ্নে তিনি জানান নিজের সেরকম স্বপ্ন না থাকলেও বাবা মা আর দাদার ইচ্ছাতেই পড়তে আসা এবং শুধু ৩২টি দাঁতকে ঘিরেই পাঁচ বছর কঠিন অধ্যবসায়ের পর এখন ভালোবাসার আরেক নাম হয়ে গিয়েছে ডেন্টিস্ট্রি।

এর জন্য তিনি এখন কৃতজ্ঞ পরিবারের কাছে এই পেশাকে ভালবাসার পথটা দেখিয়ে দেয়ার জন্য। আর কৃতজ্ঞতার কথা আসতেই চলে আসলো বন্ধুদের কথাও। গত একবছরে জীবনে অনেক উত্থান পতন হয়েছে, জীবন থেকে হারিয়েছেন প্রিয় বাবাকেও। তবু দমে যাননি। আর এই দমে না যাওয়ার পেছনে কাছের শুভাকাঙ্ক্ষীরা বিশেষ করে বন্ধুদের অবদান অনস্বীকার্য যারা ভালবাসা আর ভরসা দিয়ে আসছেন সবসময়।

তিনজনের কথা না বললেই নয় ডা. রিজওয়ান সাদিক, ডা. আব্দুল্লাহ হাসান আকিব, ডা. সাইফুল ইসলাম। এই তিনজন তার আরেক পরিবার যে পরিবারের নাম বন্ধুত্ব। যাদের ছাড়া জীবন অসম্ভব। জীবনের উঁচু নিচু পথে বন্ধুরা সবসময়ই শক্ত করে হাত ধরে ছিল, এখনো আছে।

চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল ডেন্টাল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল থেকে বিডিএস শেষ করে ফটিকছড়ি ক্লিনিকে নিজের চেম্বার করেছেন ডা. বখতিয়ার। পাশাপাশি বর্তমানে এমপিএইচ ডিগ্রি নিচ্ছেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে।

সবার প্রতি অনুরোধ জানিয়ে ডা. বখতিয়ার বলেন, কষ্ট হয় যখন দেখি আমরা কঠিন পরিশ্রম করে ৫টা বছর পড়ালেখা করে তবেই নামের পাশে ডা. লেখার সুযোগটা পাই এবং আমাদের সবসময় চেষ্টা থাকে সর্বোচ্চ সেবাটা রোগীর কাছে পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু কিছু মানুষ ছোটখাটো কয়েক মাসের কোর্স করে যখন শুধুমাত্র নামের ডা. হয়ে যায় আর অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্করের প্রমাণ দিয়ে, রোগীর জীবন বিপন্ন করে ফেলে সেই রোগীই কিন্তু ঘুরেফিরে পরে আমাদের কাছে আসে যাকে সুস্থ করে তোলা তখন অধিক কঠিন হয়ে যায়।

সবার কাছে অনুরোধ আপনারা যথাযথ ডিগ্রীধারী ডাক্তারের কাছে যান। ভিজিট দেওয়ার সামর্থ্য আপনার না থাকলে ডাক্তারকে বলুন কিন্তু সামান্য কিছু টাকা বাঁচাতে গিয়ে নিজের শরীরের ক্ষতি করবেন না। মনে রাখবেন বিডিএস নয় তো অবশ্যই সে দন্ত বিশেষজ্ঞ নয়।

হয়তো ক্যারিয়ারের জন্য ডা. বখতিয়ারকেও একসময় শহরে স্থায়ীভাবে স্থিত হতে হবে কিংবা হয়তো দেশের সীমানাও পার হতে হবে কিন্তু তখনো তিনি সাধ্যের ভেতর সবটুকু সেবা দিয়ে যেতে চান তার প্রিয় ফটিকছড়িকে।

নিজের কঠোর পরিশ্রম আর প্রবল ইচ্ছায় এতদূর আসা এই অমায়িক তরুণ ডাক্তারের সঙ্গে একবার দেখা করে আসতেই পারেন ফটিকছড়ি গেলে। শুদ্ধ তারুণ্য সবসময় বাঁচার স্পৃহা জাগায়। ভালবাসা এবং শ্রদ্ধা ডা. বখতিয়ার রশিদের জন্য। এরকম কিছু মানুষ এখনো আছে বলে টিকে আছে মানবতা ও ধরণী।

ওডি/এনএম

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড