• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

লালাখালের পথে

  সৈয়দ মিজান

০২ এপ্রিল ২০১৯, ২০:২৫
লালাখাল
লালাখালের এমন রূপ দেখতে চলে যেতে পারেন দলবেঁধে । ( ছবি : সৈয়দ মিজান )

হাঁটু অবধি নামতেই অদ্ভুত একটা ভালোলাগা ছুঁয়ে গেল। কী ঠান্ডা পানিটা! মুহূর্তেই ঝাঁপিয়ে পড়লাম সবুজ জলে। বিরিশিরির পর এমন সবুজ পানি এখানেই দেখছি। গ্রুপের সবাই একসাথে নেমে পড়েছে পানিতে। রীতিমত জলকেলি। এমন পানি দেখলে না নেমে থাকা যায় না সত্যিই। গ্রুপের যে কয়জন সাঁতার জানে না তারাও লাইফ জ্যাকেট পরে ভেসে ভেসে শীতল পরশ নিচ্ছে।

পানিটা ঠিক সবুজ না। ফিরোজা রঙের মতন একটা ব্যাপার আছে। নদীটার নাম সারী নদী। লোকে ডাকে লালাখাল বলে। নাম যাই হোক ভেসে ভেসে মেঘলা আকাশ দেখতে বেশ লাগছে। দূরে একটা চিল উড়ছে। একা। কেমন নিস্তরঙ্গ ভেসেই চলেছে। আমিও ভাসছি। নিজেকে চিল মনে হচ্ছে। এমন অনুভূতি কেবল বৃষ্টিতে ভেজার সময় হয়। মনে হয় সব পাপ ধুয়ে মুছে যাচ্ছে। নিজেকে পবিত্র পবিত্র লাগে।

আজ অবশ্য বৃষ্টিতেও ভিজেছি। সিলেট এসে বৃষ্টির অভ্যর্থনা না পাওয়াটা দুর্ভাগ্যই। নিজের ভাগ্যকে নিজেরই হিংসে হচ্ছে। বাস থেকে নেমেছি সূর্য ওঠারও আগে। আর কখনো সিলেটের মাটি স্পর্শ করা হয়নি। অনেক আগ্রহ নিয়ে চলে এসেছি তাই। গ্রুপের সবাই অপরিচিত। একজন বাদে। টিম লিডার পরাগ ভাই। তার সাথে এর আগে “বন জিলাপির দেশ” কুয়াকাটা ভ্রমণের সুযোগ হয়েছিল।

সৈয়দ মিজান বৃষ্টি নামার আগে জাফলং ( ছবি : সৈয়দ মিজান )

ডিম পরোটা পেটে ঢুকিয়ে নিজেরাও ঢুকে গেলাম ধবধবে সাদা দুইটা লেগুনার পেটে। প্রতিটাতে ১২ জন করে। গন্তব্য জাফলং। লেগুনার একদম পেছনের দিকে বসতেই ভাললাগে আমার। সবকিছু দূরে সরে সরে যাচ্ছে দেখতে কেমন একটা আরাম লাগে চোখে।

দুপাশের দোকানপাট পেছনে ফেলে ছুটছে আমাদের লেগুনা। আমার মাথায় গান ঘুরছে..

পাখিটা উড়ি উড়ি উড়ি উড়ি করে/ পাখিটা ঘুরি ঘুরি ঘুরি ঘুরি চলে...

পাখিটা পথ চেনে না/ পাখিটা ভাষা জানেনা/ পাখিতো জন্মের কানা/ পাখিটা পথে পথে পথে পথে চলে...

পাখিইতো আমি। পাখির মতন উড়ুউড়ু মন। শুধু ছুটতেই চায়। উড়তে চায় আকাশ ছুঁয়ে ছুঁয়ে। আকাশে তাকালাম। মেঘ করে আছে। হঠাৎ জোরে ঝাঁকি খেল লেগুনা। আরেকটু হলে ছিটকে পড়তাম বাইরে। রাস্তা ভাঙা। প্রথম আছাড়টা খাবার পর অবশ্য বুঝিনি আরো কয়েকশো এমন আছাড় অপেক্ষা করছে সামনে। লেগুনার সবাই গান ধরেছে। নিথুয়া পাথারে নেমেছি বন্ধুরে ধরো বন্ধু আমার কেহ নাই..... একটা আপু গাইছে গলা খুলে। দারুণ গলা। এখনো কারো নাম জানি না। নাম না জানা ভ্রমণ সঙ্গীদের নিয়ে এবড়োথেবড়ো পথের ঝাঁকি খেতে খেতে কত নতুন সব দৃশ্য চোখে পড়ছে। টুকরো টুকরো কথা, হাসি আর গান শুনতে শুনতে ছুটে চলেছি একদল ভবঘুরে।

সৈয়দ মিজান

মাছ ধরছেন এক বৃদ্ধ ( ছবি : সৈয়দ মিজান )

লেগুনা থেকে নামতেই দেখি সবাই কোমরে হাত দিয়ে আছে। আছাড় খেয়ে খেয়ে একেকজনের কোমর শেষ। এমন ভাঙাচোরা রাস্তা আগে কখনো দেখিনি। এই রাস্তা করেই ফিরতে হবে ভাবতেই সব আনন্দ পানি হয়ে যাচ্ছে। সামনে তাকিয়ে দেখি বিশাল এক পাহাড়। তারপরে পাহাড়, আরও পাহাড়। আমি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছি। সপ্তাহখানিক আগেই সাজেক থেকে ঘুরে এসেছি। তখন যেমন মুগ্ধ হয়েছিলাম, এখনো হচ্ছি। পাহাড় মুগ্ধ করার মতনই এক জিনিস। কী স্নিগ্ধ আর কোমল দেখতে। দূরে একটা পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসছে শুভ্র ঝরনাধারা। গলা দিয়ে আপনাতেই বেরিয়ে এলো, “জুড়িয়ে দিল চোখ আমার, পুড়িয়ে দিল চোখ!”

খাড়া ঢাল বেয়ে নামছি সবাই। ঢালের ঠিক নিচেই চরের মতন দেখতে একটা জায়গা। সামনে একখণ্ড মাঠ। ঘন সবুজ ঘাসে ঢাকা। তারপর রূপালি একটা স্রোত। এরপর শুধু বালু আর বালু। অনেকটা দূরে আবার পাহাড়। ভারতের পাহাড়। নানা রঙের বাড়ি ঘর, পাহাড়ের গা ঘেঁষে রাস্তা, গাড়ি চলছে। সব যেন সিনেমায় দেখা দৃশ্য। আমি মুগ্ধ! অল্পতেই মুগ্ধ হই আমি। আর এসব দৃশ্য দেখলে... থাক...

পানির কাছাকাছি আসতেই দেখলাম একজন বৃদ্ধ জাল টেনে তুলছে। উৎসুক কয়েকজন দেখছে দাঁড়িয়ে। মাছ ধরা ব্যাপারটাতে কী যেন একটা আনন্দ আছে। ধরার চেয়ে দেখতে বেশি সুখ। বেশি মাছ পড়েনি জালে। একটা দুটা পুঁটিমাছ দেখা যাচ্ছে। আমরা সামনে বাড়লাম। আমাদের সাথে এক পিচ্চি জুটেছে। নাম সিমরান। সাত-আট হবে বয়স। সবার সাথে খাতির জমাচ্ছে সে। খানিক বাদে তার উদ্দেশ্য বোঝা গেল। সে আসলে মার্কেটিং করছে। তাদের খাবার হোটেলে যেন দুপুরে খাই।

সৈয়দ মিজান

লালাখালের পানি দেখে মুগ্ধ হবে যে কেউ ( ছবি : সৈয়দ মিজান )

নৌকায় করে ওপাড়ে যাচ্ছি। একটু জল। হেঁটেই পাড় হওয়া যায়। যাচ্ছি ঝরনা দেখতে। অনেকক্ষণ হেঁটে হতাশই হতে হলো। ঝরনা শুকনো। একফোঁটা পানিও নেই। ফিরতি পথ ধরলাম। যেতে যেতে পথে নামলো বৃষ্টি। ঝুমমমমমম। দৌড়ে একটা পলিথিনের ঝুপড়িতে ঢুকলাম সবাই। দশ জনের জায়গায় পঁচিশ জন আশ্রয় নিয়েছি। লাভের লাভ কিছুই হচ্ছে না। প্রায় ঘন্টাখানিক পর বৃষ্টি থামল।

লেগুনার কাছে যখন ফিরেছি ভিজে কাক হয়ে আছি একেকজন। যারা ব্যাগ নিয়েছিল সঙ্গে করে তাদের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। সব ভিজে গেছে। কারো কারো ক্ষিদে পেয়েছে খুব। একজন বলে বসল, ‘১ টাতো বাজেই মনে হয় খাব কখন?” তার কথাতে ঘড়ি দেখলাম। ১১টা বাজতে ৮ মিনিট বাকি! অথচ সত্যিই মনে হচ্ছে দুপুর গড়িয়ে গেছে।

সৈয়দ মিজান

জুড়িয়ে দিল চোখ আমার , পুড়িয়ে দিল চোখ ( ছবি : সৈয়দ মিজান )

ভয়ঙ্কর পথ ধরে আবারও ছুটে চলেছে লেগুনা। এবার গন্তব্য লালাখাল। লেগুনা থেকে নামতেই দেখি চায়ের দোকান। চায়ের তেষ্টায় জানা যায় অবস্থা। প্রথম চুমুক দিয়েই মনে হলো ধাতে ফিরলাম। লেগুনার আছাড় খাওয়া ভুলে গেলাম মুহূর্তেই।

এবার নৌকায় চড়ার পালা। লালাখাল ঘাটে সারি বাঁধা অনেক নৌকো। আমাদের মতন ঘুরতে এসেছেন অনেকজন। দুইটা নৌকা ঠিক করা হলো আমাদের। পানির অনেক সুনাম শুনেছি কিন্তু এ তো দেখি স্বাভাবিক পানিই। একটু বেশি স্বচ্ছ এই যা। ভুল ভাঙতে বেশি দেরি হলো না। টলটলে সবুজ পানি দেখে ভিরমি খাবার জোগাড়। কেউ যেন ইচ্ছে করে পানিতে সবুজ রং গুলে রেখেছে। সে রং ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। মনে হচ্ছে বিশাল এক সুইমিংপুল পাড় হচ্ছি নৌকায় করে।

সৈয়দ মিজান

ফিরতে চায় না মন ( ছবি : সৈয়দ মিজান )

নামলাম জিরো পয়েন্ট। খানিকক্ষণ ঝাঁপাঝাঁপি, লাফালাফি করে চা বাগানের পথ ধরলাম। ছোট্ট সবুজ চা বাগানের নীরবতার গল্প আলাদা করে শোনাব। চা বাগান থেকে ফিরে এখন ডুবে যাচ্ছি লালাখালের সবুজ জলে। আহ! জীবন কত আনন্দের! বেঁচে থাকা কত দারুণ! এই জল ছুঁয়ে প্রার্থনা...

এমনি যেন একটা জীবন কাটতে থাকে আনন্দে..

ভবঘুরে হয়ে বাঁচি, হাসি-গান আর চা গন্ধে...

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড