• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৩ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

সাহসী নারী স্বপ্নার গল্প

  মোমিনুল ইসলাম বাবু, কুড়িগ্রাম

১৫ জানুয়ারি ২০১৯, ১৮:৪৪
স্বপ্না রাণী
অটোরিকশা চালক স্বপ্না রাণী (ছবি : দৈনিক অধিকার)

একজন স্বাভাবিক পুরুষের মতো সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অনায়াসে অটোরিকশা চালাচ্ছেন স্বপ্না রাণী। আলোচনা-সমালোচনার মুখেও বন্ধ হয়নি তার অটো চালানো। সাধারণ মানুষের ব্যাপক দৃষ্টি কেড়েছেন স্বপ্না রাণী। তার এমন সাহসিকতা এখন নারীদের জন্য মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে তিনি অটো চালিয়ে সংসার চালালেও স্বপ্ন দেখছেন পিক আপ ভ্যান চালানোর।

কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার ভিতরবন্দ ইউনিয়নের দিগটারী গ্রামের বাসিন্দা মৃত. বকসী চন্দ্র বর্মণের মেয়ে শ্রী স্বপ্না রাণী। মা সাবিত্রী বর্মণ। ৫ ভাই আর ৩ বোনের মধ্যে ৬ নম্বর স্বপ্না। বিগত প্রায় ১৭ বছর আগে বাল্য বয়সে পার্শ্ববর্তী ফুলবাড়ি উপজেলার ভাঙ্গামোড় ইউনিয়নের পাখিরহাট নগরাজপুর গ্রামের রণজিৎ দাসের ছেলে স্বর্ণ কারিগর রতন দাসের সঙ্গে ২৫ হাজার টাকা যৌতুকের বিনিময়ে বিয়ে হয় স্বপ্নার। তার ২ সন্তানের মধ্যে মেয়ে রাধারাণী (১২) ৫ম শ্রেণির ছাত্রী এবং ছেলে হৃদয় (৮) ১ম শ্রেণির ছাত্র। তারা ২ জনেই ভিতরবন্দ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে।

স্বপ্নার পড়াশোনার ইচ্ছা থাকলেও অভাবের জন্য সেটা আর হয়ে না ওঠায় ৫ম শ্রেণিতেই থেমে থাকতে হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে সংসার চললেও কিছু দিনের মাথায় নেমে আসে যৌতুকের জন্য অত্যাচার। প্রায় সময় অনাহারে-অর্ধাহারে থাকতে হতো স্বপ্নাকে। নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি একটি এনজিওতে অভিযোগ করে স্বপ্নার পরিবার। এরপর তিন দিনের ছেলেকে রেখে স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যান।

অভাবের তাড়নায় কয়েকদিন উপোষ থাকার পর বড় ভাই নারায়ণ ও সুবল তাকে নিয়ে আসে বাড়িতে। সেই থেকে নিজের পথ চলা স্বপ্নার। রাজমিস্ত্রি থেকে শ্রমিক এমনকি দিন মজুরের কাজ করতে মাঠ-ঘাটে চষে বেড়িয়েছেন স্বপ্না। শত অভাবে পড়েও স্বপ্না বিপথ গামী হয়নি। এর মধ্যে ২০১৫ সালে স্বপ্ন প্রকল্পে দেড় বছর দৈনিক ৬ ঘণ্টা কাজ করে ২শ টাকা মজুরি পেত। প্রকল্প থেকে কাজের পাশাপাশি নারীদের ভাগ্য উন্নয়নে দেওয়া হতো বিভিন্ন প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণ শেষে তার সঞ্চয়কৃত ২০ হাজার টাকা এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সহযোগিতায় একটি অটোরিকশা কেনেন তিনি। প্রায় ২ বছর হতে কুড়িগ্রাম-ভূরুঙ্গামারী-রংপুর এবং শহর কিংবা গ্রামের রাস্তায় দিব্বি অটো চালিয়ে বেড়াচ্ছেন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। কখনো দুর্ঘটনার স্বীকার না হওয়ায় যাত্রীর সংখ্যাও কম নয় তার। মহিলা চালক হওয়ায় নারীরা খুব আগ্রহের সঙ্গে ভিড় জমাচ্ছেন তার গাড়িতে যাতায়াত করার। এই অটোরিকশা চালিয়ে যা আয় হয় তা দিয়ে ৩ জনের সংসার চালাচ্ছেন স্বপ্না রাণী।

শত ব্যস্ততার মধ্যে সন্তানদের পাশে বাবা না থাকার অভাবটা কখনো বুঝতে দেননি এই উদ্যমী নারী। সন্তানদের কাছে স্বপ্নাই বাবা-মা। খাওয়া-পড়া থেকে শুরু করে সন্তানদের আবদার মেটাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। অটোরিকশার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এখন সে পিক আপ কেনার জন্য অর্থ জোগাড় করছেন বলে কথাগুলো জানান জেলার প্রথম নারী অটোরিকশা চালক স্বপ্না রাণী।

তিনি আরও বলেন, প্রথম প্রথম একটু সমস্যা হয়েছে। যাত্রী উঠতে চায়নি সহজেই। কিন্তু আস্তে আস্তে সকলের সহযোগিতায় এখন আর এই সমস্যা হয় না। শুরুতে আয় ভালোই ছিল, দৈনিক প্রায় ২ হাজার টাকা হলেও বর্তমানে অটোরিকশার সংখ্যা বেড়ে গেছে তাই ৫০০-৮০০ টাকা আয় হয়। আর এ কারণেই চিন্তায় আছে পিক আপ কেনার।

স্বপ্নার ২ সন্তান রাধারাণী ও হৃদয় জানান, প্রতিদিন মা সকালে উঠে আমাদের জন্য খাবার তৈরি করে। সে নিজে খেয়ে সকাল ৮টার মধ্যেই বেড়িয়ে যায় আসে রাত ৭-৮টার দিকে। আমরাও পড়াশোনা শেষে স্কুলে চলে যাই।

স্বপ্নার বড় ভাই নারায়ণ বলেন, অনেক আশা ছিল ছোট বোনটা বিয়ের পর ভালো থাকবে। কিন্তু তার কপালে সেই সুখ আর জোটেনি। স্বামী চলে যাবার পর বাচ্চা দুটিকে নিয়ে অসহায় দিন কাটে স্বপ্নার। পড়ে বাধ্য হয়ে নিজ বাড়িতে নিয়ে আসি। এরপর রাজ মিস্ত্রি অথবা যখন যে কাজ জুটেছে তখনি সে কাজ করেছে। অটোরিকশা কেনার পর তার চালানোর কৌশল আর পরিশ্রম করে চলছে এখন পর্যন্ত।

তিনি আরও বলেন, স্বপ্নার দুরবস্থা দেখে নাগেশ্বরীর ইউএনও তাকে একটি ঘর করে দেয় আমার লিখে দেওয়া ৩ শতক জমিতে। ওখানেই বর্তমানে স্বপ্না পরিশ্রম করে ভালোভাবেই জীবনের বাকি দিনগুলো সাহসের সঙ্গে পার করবে। প্রায় সময় স্বপ্নাকে দেখতে অনেক মানুষজন আসে গর্বে তখন বুকটা ভরে যায়।

পাটেশ্বরী যাওয়ার অটোযাত্রী মফিদুল, মজিবর, সহিদুল জানান, প্রথমে একটু অবাক হয়েছিলাম তার অটো চালানো দেখে। ভয়ে উঠতাম না তার অটোতে। কিন্তু যখন একজন পুরুষের মতো স্বাভাবিক নিয়মে অটো চালান, বলতে গেলে তখন থেকে প্রায় নিয়মিত যাত্রী হয়ে গেছি। পুরুষরা প্রতিযোগিতা, গতি তুলে রাস্তায় অটো চালায়। কিন্তু স্বপ্না আপাকে কখনোই দেখি নাই গতি তুলতে কিংবা ওভারটেক করতে।

স্বপ্নার প্রতিবেশী শেফালী এবং কৃষ্ণ চন্দ্র বলেন, আমাদের এই ভিতরবন্দ ইউনিয়ন এখন স্বপ্না নামেই পরিচিতি পাচ্ছে বেশি। স্বপ্না অটোরিকশা চালালেও লোকাল ভাড়া কম খাটে। বেশিরভাগ রোগী নিয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ কিংবা বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে যায়।

ইউএনডিপি স্বপ্ন প্রকল্পের জেলা ব্যবস্থাপক আহমাদুল কবীর আকন বলেন, স্বপ্না তার কঠোর পরিশ্রম দিয়ে জেলা এবং জেলার বাইরেও পরিচিতি লাভ করেছে। স্বপ্না এখন এই দরিদ্র জেলার নারীদের জন্য রোল মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে দেখিয়েছে ইচ্ছা শক্তি থাকলেও নারীরাও পুরুষের মতো সমান তালে কাজ করতে পারে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড