রাকিব রওনক
মাহমুদুল হাসান
প্রকৃতি সবচেয়ে উদারতার পরিচয় দিল পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে! তার কাছে থাকা সৌন্দর্যের বেশিরভাগ অংশই এখানে দিয়ে গেল। বান্দরবান, রাঙ্গামাটি কিংবা খাগড়াছড়ি। পাহাড়, লেক, জলপ্রপাতে ঘেরা সৌন্দর্যে মুগ্ধ হবে না এমন কেউ আছেন?
তেমনি এক প্রাকৃতিক আশ্চর্য বান্দরবানের বগালেক আর কেউক্রাডং শৃঙ্গ। চান্দের গাড়ি করে কালাপড়া নেমে ৩০/৪০ মিনিট হেঁটে সোজা খাড়া একটা পাহাড় ডিঙিয়ে দেখা হবে সমুদ্র পৃষ্ট থেকে সাড়ে ৩২৭ মিটার উপরে একটা লেকের সাথে। নাম তার বগালেক। হুম, শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি এবং বিস্ময়কর। সৃষ্টিকর্তা আসলে মহা পরাক্রমশালী। চারপাশে পাহাড় ঘেরা এই লেকের সান্ধ্যকালীন সৌন্দর্য অত্যান্ত মনোমুগ্ধকর। সবুজ, শীতল, স্থির পানির ওপর পাহাড়ের প্রতিচ্ছবি সত্যিই মন ভোলানো। প্রচণ্ড ঠান্ডা এই পানিতে লাল শাপলাদের হালকা আনাগোনা। একপাশের পাহাড়ে আর্মি ক্যাম্প আরেক পাশে ছোট ছোট পাহাড়ি ধাঁচের কটেজগুলো।
এই লেকের গভীরতা ১১৫ ফিট হলেও সর্বোচ্চ গভীরতা প্রায় ৫০২ ফিট! ১৯৭৩ সালের দিকে জরিপে দেখা গিয়েছিল অতিরিক্ত এসিডিটির কারণে কোনো জীবের বেঁচে থাকা দুষ্কর। ২০০৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ শহীদুল ইসলাম ধারণা করেন এটি সমুদ্র পৃষ্ট থেকে ১০৭৩ ফুট উঁচুতে এবং প্রায় ১১৫ ফিট গভীর।
স্থানীয় এক বয়স্ক ডিম বিক্রেতা বলেন, অতীতে এটি সৈকত পাড়া নামে পরিচিত ছিল যা বমরা পরে বগালেক নামকরণ করে। যদিও এটা নিয়ে অনেক মিথ আছে। সবচেয়ে জনপ্রিয়, পুরাতন মিথ হচ্ছে এটা আগ্নেয়গিরির মুখ ছিল। আবার একজন স্থানীয় প্রবীণের ভাষ্যমতে, এই এলাকায় খুমি গ্রামের মানুষরা (আদি সম্প্রদায়) একটি দেবতাকে মেরে ফেলে এবং তার মাংস ভক্ষণ করে। কিন্তু দেবতাটি পরে ড্রাগন হিসেবে ফিরে আসে আর তখনই হঠাৎ ভূমিকম্প শুরু হয় যার ফলে পাহাড়টি নিচু হয়ে যায়, সাথে গ্রামটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এবং এই বগা লেকের সৃষ্টি করে।
আগের সাধারণ জ্ঞান বইতে পড়ে থাকতে পারেন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কেওক্রাডং (এখন না)। কল্পনা করুনতো আপনি তার চূঁড়ায় উঠবেন! সাড়ে তিন ঘণ্টার টানা ট্র্যাকিং, হাইকিং করে কেওক্রাডং চূঁড়াতে যাবার পথের চারপাশের দৃশ্যগুলো আপনাকে কখনো ক্লান্ত হতে দেবে না। মাঝপথে দেখতে পাবেন চিংড়ি ঝর্ণা। তারপর আবার হাঁটা শুরু করুন। ভোরে কুয়াশাগুলো পাহাড়কে এমনভাবে ভাসিয়ে রাখে যেন পাহাড়গুলো সমুদ্রের মাঝে কিছু বরফখণ্ড। চারিদিকে যেন সুন্দরের পশরা সাজানো। একেকটা পাহাড়ের উঠানামা।
এই আশপাশ দেখতে দেখতে যখন আপনি দার্জিলিং পাড়ায় পৌঁঁছে যাবেন, তখন বুঝবেন গন্তব্য আর দেরি নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনি পৌঁছে যাবেন কেওক্রাড়ং। পাশাপাশি দুটো পাহাড়, হ্যালিপ্যাড আর আর্মি ক্যাম্প। ১৯৯৩ সালের ২ মার্চ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৩৮ ব্যাটালিয়নের কমান্ডার মেজর এএম মোশারফ হোসেনের জরিপ মতে, কেউক্রাডং পাহাড় ৩১৭২ ফিট (৯৬৬ দশমিক ৮ মিটার) উঁচু। বর্তমানে এটার উচ্চতা এবং কততম তা নিয়ে মতবিরোধ আছে। মেঘবিহীন আকাশের সুর্যাস্ত আপনার ভেতরটাকে আন্দোলিত করবে।
আর পরদিন সকালের সূর্যোদয় হবে আপনার জীবনের সেরা সূর্যোদয়ের একটি। ভোর পাঁচটার দিকে সূর্যটা যখন উঁকি দেবে তখন ভাববেন, এত সুন্দর কী কোনো সকাল হতে পারে? দুচোখ ভরে দেখে নেবেন এই সূর্যোদয়।
কেউক্রাডং নামটি আসছে স্থানীয় আদিবাসী মারমাদের ভাষা থেকে। তাদের ভাষায় কেওক্রাডং মানে উঁচু পাথরের পাহাড়। দূর থেকে কেওক্রাডংয়ের চূড়া শূন্যে মিলিয়ে আছে মনে হয়, আর চূড়ায় উঠলে পাহাড় মেঘের মিতালী আপনার ভেতরটা নাচিয়ে তুলবে তার মায়াবী আকর্ষণ।
সবচেয়ে বিস্ময়কর খবর হচ্ছে এই কেওক্রাডং শৃঙ্গটি ব্যক্তি মালিকানাধীন। মালিকের নাম লাল মুন থন হাওং। স্থানীয়ভাবে ওনি লালা বম নামে পরিচিত। খ্রিস্টান ধর্মানুসারী এরা বম উপজাতী নামে পরিচিত। বর্তমানে উনি জীবিত নেই, তার পরবর্তী প্রজন্মরা তা দেখাশোনা করে। এটা বম বাড়ি নামে পরিচিত। ২০১৪ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কেওক্রাডং সফরের ছবি বম বাড়ির দেয়ালে শোভা পাচ্ছিল।
সবশেষে নিজেদের অভিজ্ঞতার কিছু কথা বলি....
উপজাতীরা খুব সহজ সরল। যথেষ্ট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং সৎ! ছোট্ট একটা ঘটনা, আমি আর আমার বন্ধু দেখে অবাক হয়েছি, লেকের সামনের দোকানগুলোর খুব গোছানো এবং পরিচ্ছন্ন। রাতের বেলা চা খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছিলাম, তখন দোকানদার মহিলাটি এসে পাশে পড়ে থাকা একটা ছোট টিস্যুর টুকরা কুড়িয়ে নিয়ে চলে গেলেন। আমরা হা করে তাকিয়ে ছিলাম। আর আশে পাশে একটা ময়লাও নেই! এটাই শিক্ষণীয় একটা মুহূর্ত হয়ে থাকল। কাজেই ভ্রমণে তো যাবেন কিন্তু যাতে কোনো ময়লা আবর্জনা ফেলে আসা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন।
যেভাবে যাবেন :
- কলাবাগান/ফকিরাপুল থেকে বান্দরবানের বাস - বান্দরবান থেকে টমটমে রুমা বাস স্টেশন - রুমা বাস স্টেশন থেকে সুগন্ধা পরিবহনে করে রুমা বাজার। মাঝপথে আর্মি চেকপোস্টে এন্ট্রি - রুমা বাজার ট্যুরিস্ট অফিস থেকে ফরম দুই রকমের ফরম নিয়ে তা পূরণ করে আর্মি ক্যাম্পে এন্ট্রি - রুমা স্টেশন থেকে চাঁন্দের গাড়ি নিয়ে কালাপাড়া বাজার - ওখান থেকে হেঁটে বগালেক গিয়ে আর্মি ক্যাম্প এন্ট্রি
বগালেকে রাতে থেকে পরদিন সকালে আবার আর্মি ক্যাম্পে স্বাক্ষর করে কেওক্রাডং যাত্রা। তিন/চার ঘণ্টা হেঁটে চূড়ায় পৌঁছানো। সেখানে আবার আর্মি ক্যাম্প এন্ট্রি করা। একদিন থেকে ঠিক উল্টো পথে ফিরে আসা।
রুমাবাজার থেকে একজন গাইড সাথে নিলে সব কাজ সহজ হয়।
নিজস্ব অভিজ্ঞতার কথা বলি..
খাবার মান খুব উঁচু না। তবে কোনো মতে চলবে। পর্যটক মৌসুমে বগালেক থাকা ১৫০ টাকা। একবেলা খাবার ১১০ (ডিম, ভর্তা), ১৫০ (মুরগি, ভর্তা)। আর কেওক্রাডং থাকা ৩০০ টাকা। খাবার ১৩০ (ডিম, সবজি), ২০০ (মুরগি, সবজি)। স্যালাইন, গ্লুকোজ, কিছু ড্রাইফুড রুমা বাজার থেকে কিনে নিলে সুবিধা হয়।
পরিশেষে, আপনার ভ্রমণ সফল ও সুন্দর হোক এই কামনায়।
লেখক : রাকিব রওনক (শিক্ষার্থী, ঢাকা মেডিকেল কলেজ) ও মাহমুদুল হাসান (শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়)
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড