• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

এলাইড বাইকার্স গ্রুপের সাথে ঘুরে এলাম কুমিল্লা

  মাসুম আহমেদ আদি

১১ নভেম্বর ২০১৮, ১০:১৫
কুমিল্লা ট্যুর
এলাইড বাইকার্স গ্রুপের সাথে কুমিল্লা ট্যুর

এলাইড বাইকার্স গ্রুপের দ্বিতীয় ট্যুর এটা, এবং আমারও। বাইক নিয়ে একা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরলেও গ্রুপের সাথে প্রথম গিয়েছিলাম সিরাজগঞ্জের চায়না বাধে। সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজে, ভাঙ্গা রাস্তায় ৩০০ কি.মি. বাইক চালিয়ে অভিজ্ঞতার ঝুলি তো ভরেছেই, সাথে আত্মবিশ্বাসটাও বেড়ে গেছে অনেক। নিজেকে যেন নিজের মধ্যে খুঁজে পেয়েছি। এই রকম একটা ট্যুর যে কী পরিমাণ দরকার ছিল সেটা না গেলে বুঝতে পারতাম না।

আমাদের গ্রুপে আমার মতই অনেক নবীন বাইকার্স যেমন রয়েছে, তেমনি আমাদের গাইড করার জন্য রয়েছেন পিন্টু ভাই, হাসিব ভাই, মাসুম তালুকদার ভাই, সাকিব ভাই, শিহাব ভাইয়ের মতন অভিজ্ঞ বাইকাররা। বিশেষ করে হাসিব ভাই আমাদের যেভাবে গাইড করে এক লাইনে নিয়ে গেছেন সেটার জন্য তাকে ধন্যবাদ দিয়ে শেষ করা যাবে না। শুধুমাত্র এই ট্যুরের জন্য রাতের বাসে যশোর থেকে ঢাকায় এসেছেন তিনি। হ্যাটস অফ বস। বড়দের আশির্বাদ এবং ছোটদের ভালোবাসা নিয়ে শুরু করছি কুমিল্লা ট্যুরের বর্ণনা।

সাধারণত ট্যুরের আগের রাতে আমার ঘুম ভালো হয় না। কথাটা আসলেই সত্য। যেকোনো ধরণের ট্যুরের ক্ষেত্রেই এটা আমার বেলায় ঘটে। তবে এবার কোনো এক অদ্ভুত কারণে ঘুম ভালো হয়েছে। সাতটায় শাহবাগ যাদুঘরের সামনে জমায়েত হতে হবে, তাই এলার্ম দিয়ে রেখেছিলাম সাড়ে পাঁচটায়। সময় মত ঘুম থেকে উঠে গোসল করে বের হতে হতে সাড়ে ছয়টা। একে তো শীতের সকাল তার উপর শুক্রবার, রাস্তা একদমই ফাঁকা ছিল।

১৫ মিনিটে নিকুঞ্জ থেকে চলে গেলাম শাহবাগে। গতবার আমি ফার্স্ট হলেও এবার চাচা ভাতিজা ফার্স্ট হয়ে গেল। মানে আমাদের মাহবুব ভাই আর তার চাচা আগে চলে এসেছেন। পুরান ঢাকা থেকে বিপ্লব ভাইও হাজির। পরিচয়ের পর থেকেই ভাইকে সাথে নিয়ে ট্যুরে যাওয়ার একটা সুপ্ত বাসনা মনের মধ্যে ছিল, বাসনাটা পূরণ হয়ে গেল। বাকিরা আসতে আসতে আমরা একটু চা খেয়ে শরীর গরম করে নিলাম।

বাইক ট্যুর

বাম থেকে অনিক, বিপ্লব, পিন্টু জামান (অ্যাডমিন), নুর, মাসুম আহমেদ আদি(অ্যাডমিন) এবং হাসিব বাবু( অ্যাডমিন)

আমাদের মুরুব্বি মানে পিন্টু ভাই ততক্ষণে মাসুম তালুকদার ভাইকে নিয়ে চলে এসেছেন। একে একে সাইফ ভাই, দিপু ভাই, সাকিব ভাই, নুর ভাই, হাসিব ভাই, শিহাব ভাই এবং ভাবি, ফয়সাল ভাই এবং উনার টিম, জাহিদ, রোহান, ঐক্য চলে এসেছেন। সাব্বির ভাই তার টু হুইলার কার নিয়ে ইতোমধ্যে হাজির। জিনান ভিস্তাকে কেন টু হুইলার কার বলেছি, সেটা কেউ একবার ওটা চালিয়ে দেখলেই বুঝতে পারবেন। কিছু সময়ের জন্য শাহবাগে ওটা চালিয়ে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। আর এজন্যে ধন্যবাদ প্রাপ্য সাব্বির ভাইয়ের।

মোটামুটি সাড়ে সাতটার মধ্যেই সবাই চলে এসেছে। এবার যাত্রা শুরুর পালা। পিন্টু ভাই সবাইকে ডেকে ট্যুর প্ল্যান নিয়ে একটু আলোচনা করলেন। লীড দিবেন যথারীতি হাসিব ভাই, উনি সবার সামনে থাকবেন। বরাবরের মতন তার পিছনেই আমি, এবং একে একে বাকিরা একটা লাইনে। সবার শেষে পিন্টু ভাই। যাত্রা শুরুর আগে সবাই যখন এক লাইনে দাঁড়িয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন কোত্থেকে যেন এক পাগল হাজির। তার হাতে বাংলাদেশের পতাকা। সে পতাকা নাড়িয়ে "যাত্রা শুভ হোক" বলে আমাদের শুভকামনা জানিয়েছে । এই ব্যাপারটা যে আমাদের মধ্যে কী পরিমাণ পজেটিভ ইফেক্ট ফেলেছে ভাষায় প্রকাশ করার মত না।

কাঁটায় কাঁটায় আটটায় আমরা যাত্রা শুরু করলাম। সাকুল্যে বাইক তখন ২৮ টা। টিএসসি হয়ে চাঁনখারপুল দিয়ে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার। এক টানে যাত্রাবাড়ী। যাত্রাবাড়ী থেকেই জ্যাম শুরু। তার মধ্যে প্রায় ২৫ টার মত গাড়ি নিয়ে ভি আই পি যাচ্ছেন, সামনে পেছনে পুলিশ এসকর্ট দিচ্ছে তাদের। হাসিব ভাই টের পেলেন তারা রঙ সাইড দিয়ে যাবেন, উনিও আমাদের সিগনাল দিলেন। পুলিশের সম্মতি নিয়েই আমরাও তাদের পিছু পিছু ফুড়ুৎ। একবারে কাঁচপুর ব্রিজ পর্যন্ত এক টানে চলে এলাম। হাসিব ভাই, আমি, সাকিব ভাই এবং মাহবুব ভাই ছিলাম এসকর্টের পিছনে। কিন্তু ট্রাফিকের চাপে বাকিরা আমাদের পায়নি। কী আর করা, কাঁচপুর পার হয়ে আমরা এক জায়গায় দাঁড়ালাম। বাকিদের সবার আসতে প্রায় ৩০ মিনিট লাগলো। তারপর আবার যাত্রা শুরু। একই প্যাটার্নে সবার আগে হাসিব ভাই, সবার শেষে পিন্টু ভাই।

সকাল দশটায় আমরা সবাই থেমেছি মুন্সিগঞ্জের গজারিয়াতে। শাহ শের আলী সি এন জি ফিলিং স্টেশন। এখানে চমৎকার একটা রেস্টুরেন্ট আছে। সকালের নাস্তার জন্য বেস্ট। ধোয়া ওঠা গরম গরম পরোটার সাথে মুগ ডাল আর ভাজির মিক্সটা অতি সুস্বাদু ছিল। নাশতা পর্ব শেষে আবার যাত্রা শুরু। জ্যাম পাব না আশা করেছিলাম, কিন্তু মেঘনা সেতুর অনেক আগে থেকেই প্রচুর জ্যাম। সাইড দিয়ে একে একে আমরা বেরিয়ে গেছি যদিও, কিন্তু অনেকটা সময় নষ্ট হয়েছে এখানে। সেতু পার হওয়ার পর আমাদের আর পায় কে। সামনে বিশাল ফাঁকা রাস্তা। এয়ারপোর্টের রানওয়ের মত একদম মসৃণ এবং চওড়া। এখানে হাসিব ভাইয়ের নেতৃত্বে সবাই ৮০-৯০ কি.মি. প্রতি ঘন্টা স্পিডে টেনে গেছি।

সামনে যেখানেই হেভি ট্রাফিক ছিল, হাসিব ভাইয়ের পিলিওন নুর ভাই আমাকে সিগনাল দিয়েছেন, আমি সিগনাল দিয়েছি পরের জনকে। এভাবে একে একে পেছনের জন পর্যন্ত সিগনাল পেয়ে গতি কমিয়ে ঐটুকু পার হয়েছি। গাড়ির চাপ কমে যাওয়ার পর নুর ভাই আবার সিগনাল দিয়েছেন সামনে ফাঁকা। আবার একইভাবে সবাই গতি বাড়িয়ে টেনে গিয়েছি। এবার এক টানে চান্দিনা এসে টি ব্রেক নিয়েছি। এখানে আগে থেকেই আমাদের অপেক্ষায় ছিলেন রাশেদ ভাই। এখানে চা পান খেয়ে আবার যাত্রা শুরু। চায়ের সাথে পান কেন? কারণ হলো আমাদের শিহাব ভাই এবং ভাবি (আমি ভাবির নাম জানিনা) আবার পানখোর। আর আমারও একটু আধটু অভ্যেস ছিল। তাদের পান খাওয়া দেখে আমারও লোভ লাগলো, আমিও নিলাম একটা।

ক্যান্টনমেন্ট

ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি

এবার ক্যান্টনমেন্ট হয়ে চলে গেলাম ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রিতে। কিন্তু একি! যেই ভিআইপি গাড়ি বহরের সাথে আমরা কাঁচপুর পার হয়েছিলাম তারা এখানে! পরে শুনলাম আটটা দেশের রাষ্ট্রদূত নাকি এটা ভিজিট করতে এসেছেন। একজন পুলিশ কর্মকর্তা এগিয়ে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমরা কোথায় যাব। উনাকে বুঝিয়ে বলার পর উনি বললেন আপনারা ৩০ মিনিট আশেপাশে কোথাও অপেক্ষা করুন, ভিআইপিরা বেরিয়ে গেলে আপনারা ঢুকবেন। তখন বেলা সাড়ে বারো। ভাবলাম, এখানে অপেক্ষা না করে রাণী ময়নামতির প্রাসাদ দেখে আসা যাক। একটু সামনেই তার প্রাসাদ। প্রাসাদ বলতে এখন শুধু তার ধ্বংসস্তূপ আর কি।

কুমিল্লা

শালবন বিহার

সবাই মিলে চলে গেলাম পাঁচ মিনিটেই। ওখানে কয়েকদফা ফটোসেশন হলো। নামাজের বিরতিও ওখানেই দেয়া হলো। কুমিল্লা ট্যুরের এই জায়গাটাই আমার সব থেকে ভালো লেগেছে, সবাই অনেক মজা করেছি এখানে। নামাজ শেষে সবাই মিলে ঢুকলাম ওয়ার সিমেট্রিতে। এখানে আর বেশি সময় নিলাম না। ১৫ মিনিটে পুরোটা ঘুরে শেষ। আসলে বেলা দুটো পার হয়ে গেছে, মোটামুটি সবার পেটেই ছুঁচো ডন বৈঠক শুরু করে দিয়েছে ততক্ষণে। সিদ্ধান্ত হলো রেলগেটে ছন্দু মিয়ার হোটেলে খেতে যাব। ওখানে খেতে যাওয়ার কারণ হলো, ওখানকার গরুর মাংস আর আলুভর্তা। অনেক অনেক আগে ছন্দু মিয়া এই জায়গাটায়ই রাস্তার পাশে বসে ভাত আর আলুভর্তা বিক্রি করতেন। তারপর সাথে গরুর মাংস যোগ করলেন। আর তারপর?

তারপর বড় হতে হতে এটা অনেক বড় হলো। কিছুদিন আগ পর্যন্তও খাবারের জন্য সিরিয়াল ধরা লাগতো। এখন অবশ্য নতুন ফ্লাইওভারের কারণে কিছুটা মিইয়ে গেছে ছন্দু নিয়ার পসার। ধোয়া ওঠা গরম ভাত, আলুভর্তা, গরুর মাংস/মুরগীর মাংস/খাসির মাংস সহযোগে আমরা খাওয়া পর্ব শেষ করলাম। ছন্দু মিয়ার হোটেলের কেন এত সুনাম সেটা বুঝতে পারলাম খাওয়ার সময়। খাওয়া শেষে আবারও পান খেলাম ভাই ভাবির সাথে। ভাবিকে ধন্যবাদ আমাকে দাঁতে দাগ না ফেলে পান খাওয়ার টিপস দেয়ার জন্য। এখান থেকে শিহাব ভাই আর ভাবি চলে গেলে তাদের বাড়িতে। আমরা গেলাম শালবন বিহারে। সাব্বির ভাইয়ের স্কুটির পেছনের চাকায় পেরেক ঢুকায় উনি মাসুম ভাইকে সাথে নিয়ে চলে গেলেন শহরের ভিতরে, চাকা ঠিক করতে।

শালবন বিহারে ঘুরার জন্য বেশি সময় আমাদের হাতে ছিল না। এমনিতে শীতের দিন, পাঁচটার পরেই ঝুপ করে অন্ধকার নেমে যায়। রাতের বেলা হাইওয়েতে বাইক রাইডিং সেফ না।এজন্যে পাঁচটার আগেই আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে আবার রওনা শুরু করলাম। সবার আগে হাসিব ভাই সবার পেছনে পিন্টু ভাই। একজন মানুষ একা যখন চলাচল করেন তখন তার বাইকের স্পিড থাকে ১০০-১১০ কি.মি. প্রতি ঘন্টায়। অথচ তিনিই ট্যুরের সময় সবার পেছনে থেকে নিশ্চিত করেন কেউ ছিটকে পড়লো কিনা, কেউ পেছনে পড়লো কিনা। এটা কী পরিমাণ ধৈর্যের কাজ আমরা সবাই জানি। এজন্যে উনাকে ধন্যবাদ দিলেও কম হয়ে যাবে।

যখন আপনি দেখবেন, গ্রুপের মোস্ট সিনিয়র পার্সন একটা শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে সবাইকে নিয়ে যাচ্ছেন, সেখানে আপনি চাইলেও উল্টাপাল্টা স্পিডে টানতে পারবেন না, মন থেকে সায় পাবেন না। এখানে একটা ব্যাপার লক্ষণীয়, আমার বাইক ১০০ সিসি, অনেকেই আছেন যাদের ১৫০-১৬০ সিসি, তারা চাইলেই আমাকে ওভারটেক করে যেতে পারতেন। কিন্তু কেউ সেটা করেননি। সবাই একই লাইনে চালিয়েছেন। এজন্য ট্যুরে অংশ নেয়া সকল ভাইকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। ঢাকায় ঢোকার আগে সোনারগাঁও মেট্রো সিএনজি স্টেশনে শেষবারের মতন বিরতি নিয়েছিলাম। এখানে সবাই সবার থেকে বিদায় নিয়ে নিয়েছি। ঢাকায় ঢোকার পর একেক জন একেক দিকে চলে যাবেন, তাছাড়া ট্রাফিকের চাপে একসাথে নাও যাওয়া যেতে পারে। বিদায় নিয়ে আবার রওনা দিলাম সবাই। নয়টার আগেই সবাই নিরাপদে বাসায় পৌঁছে গেছেন আলহামদুলিল্লাহ্‌। কোনো রকম দুর্ঘটনা ছাড়াই এত সুন্দর একটা ট্যুরের কৃতিত্ব ট্যুরে অংশ নেয়া সব ভাইদের।

পরামর্শ:

রাইডার পিলিওন উভয়েই অবশ্যই হেলমেট পরবেন। লং ট্যুরে রাতের বেলা উজ্জ্বল কাপড় পরবেন। এবং অবশ্যই লিডারের কমান্ড মেনে রাইড করবেন। ধন্যবাদ সবাইকে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড