স্বাস্থ্য ডেস্ক
মহামরিতে রূপ নেওয়া করোনা ভাইরাস বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যেই বিশ্বের প্রায় ১৯৫টি দেশে ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাসটিতে আক্রান্ত ও মৃত মানুষের সংখ্যাও যেন সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছে। এমতাবস্থায় সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়া অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। আর হয়েছেও তাই। কিন্তু মুশকিল হলো, এই আতঙ্কের সঙ্গে ভাইরাসটি নিয়ে নানা বিভ্রান্তিও ছড়িয়ে পড়ছে। নানা সূত্রের বরাত দিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমেও দেওয়া হচ্ছে নানা পরামর্শ ও সুরক্ষা কৌশল।
তবে করোনাকে হারাতে অপরীক্ষিত এসব কৌশল ও পরামর্শ যদি সঠিক না হয়, তাহলে ঘটতে পারে নানা বিপদ। এ ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দেওয়া পরামর্শই অনুসরণ করা উচিত। যেহেতু বিশ্বে করোনা ভাইরাসটি মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশের সংস্থাগুলোর নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগের সঙ্গে কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বয়ের কাজটি ডব্লিউএইচও করছে, সেহেতু তাদের দেওয়া তথ্যের ওপরই নির্ভর করাটাই মঙ্গলজনক। চলুন, দেখে নেওয়া যাক ভাইরাসটি নিয়ে চারপাশে কী কী বিভ্রান্তি রয়েছে এবং এগুলো সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাই–বা কী বলছে—
গরম ও শীতল আবহাওয়াতে কোভিড-১৯ ছড়ায় না— ভুল
ইতোমধ্যেই বিভিন্ন মাধ্যমে উচ্চারিত হতে শোনা গেছে যে, নতুন করোনা ভাইরাস উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় সংক্রমিত হয় না বলে একটি তথ্য । তবে এই তথ্যটি ভুল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এখন পর্যন্ত উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়াসহ সব ধরনের পরিবেশ এবং এলাকায় করোনা ভাইরাসের সংক্রমিত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। জলবায়ু ও আবহাওয়া যেমনই হোক, সতর্ক থাকুন। কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছে- এমন এলাকা ভ্রমণের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সতর্ক থাকুন। মনে রাখবেন, কোভিড-১৯ থেকে সুরক্ষিত থাকার সবচেয়ে ভালো পথ হচ্ছে একটু পরপরই সাবান-পানি বা অ্যালকোহলভিত্তিক হ্যান্ড রাব বা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করা। একই সঙ্গে হাত দিয়ে নাক-মুখ ও চোখ স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন।
তুষার ও ঠান্ডা আবহাওয়া করোনা ভাইরাসকে মারতে পারে— ভুল
করোনা ভাইরাস বা অন্য যেকোনো রোগ প্রতিরোধে ঠান্ডা আবহাওয়া কার্যকর—এমন ধারণার কোনো যুক্তি নেই। কারণ, বাইরের তাপমাত্রা যা-ই হোক না কেন, মানুষের শরীরের তাপমাত্রা ৩৬ দশমিক ৫ থেকে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের (৯৭-৯৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট) মধ্যেই থাকে।
করোনা ভাইরাস রোধে গরম পানিতে গোসল কার্যকরী— ভুল
নতুন করোনা ভাইরাস থেকে প্রতিরোধের উপায় হিসেবে অনেকে গরম পানিতে গোসলের কথা বলছেন। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, গরম পানিতে গোসলের মাধ্যমে করোনা ভাইরাস থেকে সুরক্ষিত থাকা যাবে না। কারণ, বাইরের তাপমাত্রা যা-ই হোক না কেন, মানুষের শরীরের তাপমাত্রা ৩৬ দশমিক ৫ থেকে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের (৯৭-৯৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট) থাকে। তাই মনে রাখবেন, কোভিড-১৯ থেকে সুরক্ষিত থাকার সবচেয়ে ভালো পথ হলো সাবান-পানি দিয়ে সবসময় হাত পরিষ্কার রাখুন।
মশার মাধ্যমেও করোনা ভাইরাস ছড়ায়— ভুল
আসছে বর্ষার মৌসুম। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মশার উপদ্রবও বেড়ে গেছে। এমতাবস্থায় মশার মাধ্যমে নতুন করোনা ভাইরাস ছড়ায় কি না, তা নিয়েও শুরু হয়েছে নানা জল্পনা-কল্পনা। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, মশার মাধ্যমে নতুন করোনা ভাইরাস ছড়ানোর বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো তথ্য বা প্রমাণ পাওয়া যায়নি। নতুন এই ভাইরাস শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি ভাইরাস। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশির সময় তাদের শ্বাসতন্ত্র থেকে নির্গত ড্রপলেট বা লালার বিন্দু বা নাক ঝাড়ার সময় নির্গত জলকণার মাধ্যমে ছড়ায়। কাজেই নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার পাশাপাশি হাঁচি-কাশি রয়েছে- এমন ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন।
নতুন করোনা ভাইরাস মারতে হ্যান্ড ড্রায়ার কার্যকর— ভুল
হ্যান্ড ড্রায়ার দিয়ে হাত শুষ্ক করার মাধ্যমে নতুন করোনা ভাইরাসকে মারা যায় না। কোভিড-১৯ থেকে সুরক্ষিত থাকার সবচেয়ে ভালো পথ হচ্ছে একটু পরপরই সাবান-পানি বা অ্যালকোহলভিত্তিক হ্যান্ড রাব বা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করা। তবে হাত ধোয়ার পরপরই টিস্যু পেপার বা উষ্ণ বাতাস বা হ্যান্ড ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে নিতে পারেন।
অতিবেগুনি রশ্মিতে করোনা ভাইরাস মরে— প্রমাণ নেই
অতিবেগুনি রশ্মিতে করোনা ভাইরাস মরে কি না, তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে, এ রশ্মি থেকে ত্বকের বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। তবে অতিবেগুনি রশ্মিতে করোনা ভাইরাস মরে- এখনো এই যুক্তির কোনো প্রমাণ নেই।
থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিকে শনাক্ত করা যায় — সম্পূর্ণ সঠিক নয়
কারও শরীরে জ্বর থাকলে, তা থার্মাল স্ক্যানারে ধরা পড়বে। নতুন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে যেসব লক্ষণ প্রকাশ পায়, তার একটি হলো জ্বর। তবে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্বর হয় না। এমন লক্ষণ প্রকাশ পেতে ২ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত সময় লাগে। তাই জ্বর নেই, কিন্তু করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত— এমন ব্যক্তিকে থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে শনাক্ত করা যায় না।
শরীরে অ্যালকোহল বা ক্লোরিন ছিটিয়ে কি করোনামুক্ত থাকা যায়?- ‘না’
এই প্রশ্নের একটিই উত্তর, ‘না’। পশ্চিমা দেশে এ ধরনের কিছু বিভ্রান্তি ছড়িয়েছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, যে ভাইরাস এরই মধ্যে শরীরে প্রবেশ করেছে, তাকে মারতে সারা শরীরে অ্যালকোহল বা ক্লোরিন বা ব্লিচিং ছড়িয়ে কোনো লাভ নেই। এ ধরনের রাসায়নিকের সংস্পর্শ চোখ ও মুখের ত্বক ও ঝিল্লি (মিউকাস মেমব্রেন) ক্ষতি করে। এ দুটি রাসায়নিকই ঘরদোর পরিষ্কারের কাজে লাগে। তবে ব্যবহারের আগে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ পরামর্শ মেনে ব্যবহার করতে হবে।
নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিন করোনা থেকে সুরক্ষা দেয় — ভুল
নিউমোকক্কাল ভ্যাকসিন বা হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ বি ভ্যাকসিনসহ নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিন শুধু নিউমোনিয়ার বিরুদ্ধেই কার্যকর। এগুলো নতুন করোনা ভাইরাস থেকে সুরক্ষা দেবে না। এই ভাইরাস একেবারেই নতুন এবং আগেরগুলোর চেয়ে এতটা আলাদা যে, এর প্রতিরোধে একেবারে নতুন ভ্যাকসিনেরই প্রয়োজন। বিভিন্ন দেশের গবেষকেরা করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা করছেন, যেখানে সহায়তা দিচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বিদ্যমান ভ্যাকসিনগুলো কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে কার্যকর না হলেও শ্বাসযন্ত্রের অসুস্থতা রোধে বিদ্যমান ভ্যাকসিন যেকোনো মানুষকেই গ্রহণের পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা।
লবণ-পানি বা স্যালাইন দিয়ে নিয়মিত নাক ধুলে কি সুরক্ষিত থাকা সম্ভব? ‘না’
লবণ-পানি কিংবা স্যালাইন দিয়ে নিয়মিত নাক পরিষ্কার করে নতুন করোনা ভাইরাস থেকে সুরক্ষিত থাকা যায়—এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাধারণ ঠান্ডাজনিত অসুস্থতায় এ কৌশল কাজে লাগে। শ্বাসপ্রশ্বাসের কোনো সমস্যার ক্ষেত্রে এটি কার্যকর নয়।
রসুন বা এমন কিছু করোনা ভাইরাস থেকে সুরক্ষা দিতে পারে?
রসুন স্বাস্থ্যকর খাবার এবং এর রয়েছে অণুজীবনাশক ক্ষমতা। একইভাবে থানকুনি বা তুলসীপাতাও স্বাস্থ্যকর এবং এগুলোর নানা ওষুধি গুণ রয়েছে। কিন্তু এর কোনোটিরই করোনা প্রতিরোধী কোনো ক্ষমতা নেই। এমন কোনো প্রমাণও এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
নতুন করোনা ভাইরাসে শুধু বয়স্ক ব্যক্তিরা আক্রান্ত হন— ভুল
নতুন করোনা ভাইরাস সব বয়সী মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে। বয়স্ক মানুষ বিশেষত যাদের অ্যাজমা, ডায়াবেটিস, হৃদ্রোগসহ নানা স্বাস্থ্য সমস্যা আগে থেকেই রয়েছে, তাদের ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে গুরুতর অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি বেশি। সব বয়সী ব্যক্তিদের সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এ ক্ষেত্রে নিয়মিত হাত ধোয়া ও শ্বাসপ্রশ্বাস সম্পর্কিত সু-অভ্যাসের ওপর জোর দিচ্ছে সংস্থাটি।
নতুন করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ এবং এর চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর— ভুল
অ্যান্টিবায়োটিক ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করে না। এটি শুধু ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করে। নতুন করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ একটি ভাইরাস। তাই এর প্রতিরোধ বা চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা উচিত নয়। তবে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি অনেক রোগীকে হয়তো অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, সেগুলো করোনা ভাইরাসের চিকিৎসার জন্য নয়, বরং ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ যেন না ঘটে, সেজন্য দেওয়া হচ্ছে।
আরও পড়ুন : করোনার ভয়াল থাবা থেকে বাঁচাবে ঘুম!
নতুন এই ভাইরাস প্রতিরোধে বা এর চিকিৎসায় কোনো সুনির্দিষ্ট ওষুধ আছে?
নতুন করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে বা এর চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট ওষুধ নেই। তবে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রকাশিত বিভিন্ন উপসর্গ অনুযায়ী তাকে চিকিৎসাসেবা দিতে হবে। যাদের অবস্থা গুরুতর হবে, তাদের বিশেষ পরিচর্যার আওতায় নিতে হবে। এর ভ্যাকসিন ও চিকিৎসার জন্য সুনির্দিষ্ট ওষুধ তৈরিতে গবেষণা চলছে। এ বিষয়ে গবেষণার গতি বাড়াতে বিভিন্ন দেশে কাজ করে চলা গবেষক ও সংস্থাগুলোকে সহায়তা দিচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কোনো সুনির্দিষ্ট ওষুধ আবিষ্কৃত হলে তার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হবে আগে।
তথ্যসূত্র : ডব্লিউএইচও
ওডি
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড