• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

জিনজিয়াং : রক্তাক্ত আরেক মুসলিম জনপদ

  মাওলানা নজরুল ইসলাম

১১ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৩:০১
uighur_odhikar
নির্যাতিত উইঘুর মুসলিম সম্প্রদায়। ছবি : সংগৃহীত

চীনের জিনজিয়াং। বিশ্বের সর্ববৃহৎ প্রদেশ। আয়তনে বাংলাদেশের বারো গুণ। মোট আয়তন ১৬ লাখ ৪৬ হাজার ৪০০ বর্গ কিলোমিটার। চীনের উত্তরপশ্চিম সীমানা ঘেঁষে এর অবস্থান। পশ্চিম ও উত্তর পশ্চিম দিকে রয়েছে মুসলিম দেশ তাজিকিস্তান, কিরগিজস্থান এবং কাজাখিস্তান। দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে আছে আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ভারত অধিকৃত জম্মু কাশ্মির। ২ কোটি ১৮ লাখ লোকের মধ্যে ১ কোটি ২৫ লাখ লোক হচ্ছে উইঘুর মুসলিম সম্প্রদায়। মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৮ ভাগ মুসলিম।

এই বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠী আজ নিদারুণভাবে নির্যাতিত। নিপীড়িত। নিগৃহীত। সব ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত। তাঁদের ওপর চলা ভয়ানক ঘটনার খবর কোনো মিডিয়ায় আসে না। কীভাবে আসবে? সরকারি সংবাদ মাধ্যম ব্যতীত কোনো নিউজ এজেন্সির সেখানে চোখ মেলে তাকানোর সুযোগ নেই। মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে কড়া নজরদারিতে রাখা হয়। প্রদেশের ভেতর ঢোকার সাধ্য তাদের নেই। হাই-টেক সার্ভিলেন্স সিস্টেম চালু রয়েছে। ফেসবুক, টুইটার, গুগলসহ সবধরনের সামাজিক মাধ্যম সেখানে নিষিদ্ধ। চীন কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত মাধ্যম ছাড়া অন্য কোন সংবাদ মাধ্যম চালানোর সুযোগ নেই।

তবে চীন সরকার মায়ানমার, ইসরাইল, শ্রীলংকা, ফ্রান্স, রাশিয়া, কানাডা বা অন্যান্য মুসলিম বিদ্বেষী দেশের মতো ধরো-মারো নীতি অবলম্বন করেনি। উইঘুর মুসলিমদের শাসাতে চীন কর্তৃপক্ষ এক অভিনব ও ঝঁঝাটে পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। জিনজিয়াং প্রদেশে ভয়ঙ্কর কারাগার স্থাপন করেছে চীন সরকার। বাহির থেকে দেখলে একটুও কারাগার মনে হবে না। ফুলে ফুলে সজ্জিত পথ-প্রান্তর। বিশাল এলাকাজুড়ে সবুজ গাছগাছালি। চাকচিক্যময়। দেয়ালে দেয়ালে চোখ ধাঁধানো কারুকাজ। কোলাহল মুক্ত এক নির্জন সজীব এলাকা। নতুন কেউ প্রথমবার দেখে মনে করতে পারে, অত্যাধুনিক কোনো বাংলো। সবুজ পত্রপল্লবে নুইয়ে পড়া সারিসারি গাছের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে ভেতরে সাঁটানো সাইনবোর্ড দেখলে আরো রহস্যময় মনে হবে। বিশাল সাইনবোর্ডে লেখা ‘রি-অ্যাডুকেশন ক্যাম্প’। নামের সাথে পরিবেশের রয়েছে যথেষ্ট মিল। কিন্তু ভিতরে নানান রকমের অসহনীয় শাস্তি থরেবিথরে সাজানো। ভয়ানক এক কারাগার। বাহিরটা যতটা সুন্দর এর ভেতরকার দিকটা ততটাই লোমহর্ষক।

রি-অ্যাডুকেশনাল ক্যাম্পে সেসকল মুসলিমদের রাখা হয় যারা ধর্ম-কর্ম পালন করেন। পুরোপুরি একত্ববাদে বিশ্বাস করেন। নিয়মিত নামাজ আদায় করেন। রোজা পালন করেন। হারাম খাবার থেকে বেঁচে থাকেন। নিম্ন লিখিত কয়েকটি কাজের কোন একটি কাজে কারওর সংশ্লিষ্টতা পেলেই তাকে ধরে এনে এই ক্যাম্পে সোপর্দ করা হয়—

১. নিয়মিত নামাজ আদায় করা। ২. সিয়াম পালন করা। ৩. হিজাব পরিধান করা। ৪. দাড়ি রাখা। ৫. তালিকাভুক্ত ২৬টি মুসলিম দেশের কোন একটিতে ভ্রমণ করা। কাজাখিস্তান, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং আরব বিশ্বের অধিকাংশ দেশ এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত। শুধু ভ্রমণ করা নয়; অন্যদেশে অবস্থানরত কোন আত্মীয়ের সাথে কথা বলাও দণ্ডনীয় অপরাধ। ৬. হজ করতে যাওয়া। ৭. কোন নিকটাত্মীয় বিদেশে বসবাস করা। ৮. চাইনিজ ভাষার প্রতি বিতৃষ্ণা প্রকাশ করা। ৯. কমিউনিজমে অনাগ্রহ প্রকাশ করা। ১০. অ্যালকোহল ও শুকরের মাংস ভক্ষণ না করা।

এককথায়, যাকেই তারা সন্দেহ করবে তাকেই ধরবে। হোক মহিলা কিংবা ছোটছোট বাচ্চা। কুঁজো হয়ে যাওয়া বৃদ্ধ কিংবা গুরুতর অসুস্থ। গর্ভবতী কিংবা সদ্যপ্রসূতি। কাউকেই রেহাই দেয়া হয় না। মানবিক দিক বিবেচ্য নয়। আইনের ধার তারা ধারে না। প্রায় এক মিলিয়ন সাদা পোশাকধারী গোয়েন্দা সদস্য নিত্যদিন এলাকায় ঘুরেফিরে উইঘুর মুসলিমদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে। তাদের ঘরের চারদিকে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি বসানো থাকে। সর্বক্ষণ তাদের নাড়াচাড়া রেকর্ড হয়। বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ করার ন্যূনতম ফাঁকফোকর নেই। জিনজিয়াং কর্তৃপক্ষ সেখানকার মুসলিম অধিবাসীদের জন্য বায়োমেট্রিক নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করেছে। আমাদের মতো শুধু আঙুল ও চোখের ছাপ নয়, আরো কিছু। যেমন: ভয়েস স্যাম্পল, রক্তের ডিএনএ। এছাড়াও মানুষের কোষের ভেতর ইন্টেলিজেন্ট ডিভাইস সেট-আপ এবং তা থেকে বড়সড় ডাটা সংগ্রহের ব্যবস্থা তো রয়েছেই। সবার ঘরের দেয়ালে কিউআর কোড সম্বলিত বোর্ড লটকানো থাকে। কিউআর কোড স্ক্যান করার সাথে সাথে বাসিন্দার আদ্যন্ত পরিচয় তারা পেয়ে যায়। দূর থেকে নানান আধুনিক যন্ত্রের মাধ্যমে সেখানকার খবরাখবর সংগ্রহ করা হয়।

এবার কাউকে সন্দেহভাজন মনে হলে সাথে সাথে গ্রেফতার করা হয়। কোন আইনে, কী কারণে গ্রেফতার করা হলো তা কেউ জানতে পারে না। এমনকি কোথায় রাখা হবে তাও জানার সুযোগ নেই। উকিল নিয়োগ করার প্রশ্নই ওঠে না। একদম চুপচাপ তুলে নিয়ে রি-অ্যাডুকেশনাল ক্যাম্পে রাখা হয়। এসব ক্যাম্পের আরো কিছু নাম রয়েছে। যেমন কাউন্টার এক্সট্রিমিজম ট্রেনিং সেন্টার, অ্যাডুকেশন এবং ট্রান্সফরমেশন ট্রেনিং সেন্টার ইত্যাদি।

গ্রেফতারকৃতদের প্রথমেই শাস্তির সেলে নেয়া হয় না। তাদের সামনে একটি প্রস্তাব রাখা হয়। যারা সেই প্রস্তাবে রাজি হয় তাদের বোর্ডিং হাই স্কুলের অনুরূপে গঠিত ট্রেনিং সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সিলেবাস থাকে, শিক্ষক থাকে, ইউনিফর্ম থাকে। স্কুলের নিয়মকানুন রক্ষা করে চলতে হয়। এ এক নতুন শিক্ষাগ্রহণ ব্যবস্থা।

প্রথমেই তাদের চাইনিজ ভাষা রপ্ত করতে বাধ্য করা হয়। নিজেদের ভাষা জলাঞ্জলি দিয়ে চাইনিজ ভাষার প্রতি ভালোবাসা তৈরি করতেই হবে। এছাড়া কোনো উপায় নেই। কমিউনিস্ট পার্টির গুণকীর্তন প্রকাশক গান গাইতে হবে। তাদের কাজকে পবিত্র বলে বিশ্বাস করতে হবে। কমিউনিজমের প্রতি মনের দুর্বলতা প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক। ইসলাম থেকে কমিউনিজম উত্তম তা লেখায়, কথায়, বিশ্বাসে এবং আচরণে প্রমাণ করা জরুরি। অর্থাৎ কনভার্টিং ফ্রম ইসলাম টু কমিউনিজম। জিনজিয়াং কর্তৃপক্ষ উইঘুর মুসলিমদের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। যে নীতিমালার সব ধারা-উপধারা সরাসরি ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। সেই নীতিমালা আত্মস্থ করা অপরিহার্য। নির্দিষ্ট সিলেবাস যারা সফলভাবে শেষ করতে পারবে তাদেরই মুক্তি মিলবে। অন্যথায় অনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পাঠ চালিয়ে যেতে হবে। আর যারা এমন শিক্ষা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায় তাদের সোজা টর্চার সেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। অকথ্য নির্যাতন এবং অবর্ণনীয় শারীরিক ও মানসিক কষ্টে নাস্তানাবুদ হতে হয়।

তথ্যসূত্র 1. Wikipedia : Xinjiang re-education camps 2. Vice News : China’s Vanishing Muslims: Undercover In The Most Dystopian Place In The World, Published on Jun 29, 2019. 3. Wall Street Journal : Life Inside China's 'Re-Education' Camps, Published on Aug 20, 2018.

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড