• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩০ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

কাশ্মীর সঙ্কট ছাপিয়ে ভারতের চলমান ইস্যু

হারান মন্ত্রিত্ব, খাটেন জেল, হন নির্বাসিত : সময় এখন প্রতিশোধের

  আন্তর্জাতিক ডেস্ক

২২ আগস্ট ২০১৯, ১১:১৭
অমিতের প্রতিশোধ
প্রায় এক দশক আগে যে পরিস্থিতির শিকার হয়েছিল বর্তমান কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত, আজ কংগ্রেসের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চিদম্বরম অনুকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন। ছবি : সংগৃহীত

প্রথমে দিল্লি হাইকোর্ট থেকে আইএনএক্স মিডিয়া মামলায় গ্রেফতার থেকে সুরক্ষা দিতে অস্বীকার, পরে পাঁচিল টপকে ঘরে ঢুকে সিবিআই গ্রেফতার করল ভারতের কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পি চিদম্বরমকে। অনেক নাটকীয়তার পর বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে পি চিদম্বরমকে নিয়ে রাম মনোহর লোহিয়া হাসপাতালে যায় সিবিআই। ২০১০ ও ২০১৯ সালে ভারতের দুটো ঘটনাকে যদি পাশাপাশি রাখা যায়, ঘটনার পাক যে কারও কাছে রাজনৈতিক প্রতিশোধকে আধেয় করে নির্মিত ব্যবসাসফল এক মূলধারার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র মনে হলে অতুষ্টি হবে না।

যাই হোক, হাসপাতালের মেডিকেল পরীক্ষার পর তাকে সিবিআই সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। ঘটনাচক্রে চিদম্বরম যখন ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন, সিবিআই-এর নয়া সদর দপ্তর বিল্ডিংটি তিনিই উদ্বোধন করেছিলেন। সেখান থেকে তাকে সিবিআই-এর গেস্টহাউসে রাখা হয়। গেস্টহাউসের ৫ নম্বর সুইটে রয়েছেন চিদম্বরম।

খুব স্বাভাবিক ঘটনা মনে হলেও এটা তেমন কিছু নয়, এর পেছনের ঘটনা বলিউড কিংবা দক্ষিণা, ভারতের মূলধারার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের রাজনৈতিক নকশায় সজ্জিত। অবাক লাগলেও অমিত শাহ-পি চিদম্বরম কাণ্ড চলচ্চিত্রের চেয়ে কম নয় কোনোভাবে। অনুঘটনাগুলো যখন একটার সঙ্গে আরেকটা জোড়া দেয়া যাবে তখন অমিত-চিদম্বরম নাটক দাঁড়িয়ে যাবে।

ছবি : সংগৃহীত

কাশ্মীরের ৩৭০ অনুচ্ছেদকে মুছে দিয়ে এক যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করার তথ্য বর্তমানে ভারতের গণমাধ্যমে যতটা স্থান পাচ্ছে, তার চেয়ে চিদম্বরম কাণ্ডই যেন গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছে। চিদম্বরমের ছেলে অবশ্য এমন অভিযোগই এনেছিল, কাশ্মীরের ইস্যু চাপা দিতেই আইএনএক্স মামলা নিয়ে বিজেপি সরকার এসব করছে।

আইএনএক্স মিডিয়া মামলায় চিদম্বরের ছেলেকেও জেলে যেতে হয়েছিল, এই আইএনএক্স মিডিয়া মামলা আসলে কী?

সিবিআইয়ের পাশাপাশি ভারতের এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটও (ইডি) একটি আর্থিক তছরুপের মামলা দায়ের করে। প্রসঙ্গত সেই সময়েই কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন পি চিদম্বরম, যিনি আইএনএক্স মিডিয়াকে ওই বিপুল অঙ্কের বিদেশি তহবিল পাওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করেছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

ভারতের তদন্তকারী সংস্থাগুলোর কাছে প্রবীণ কংগ্রেস নেতা পি চিদম্বরমের বিরুদ্ধে মামলা গঠনে তাসের টেক্কা হলেন আইএনএক্স মিডিয়ার কর্ণধারের স্ত্রী ইন্দ্রানী মুখার্জী। যিনি বর্তমানে নিজের মেয়েকে খুনের অপরাধের সাজা ভোগ করছেন। প্রাক্তন মিডিয়া ব্যারন পিটার মুখার্জীর স্ত্রী ইন্দ্রানী মুখার্জীর বয়ানের ভিত্তিতেই প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পি চিদাম্বরম এবং তার পুত্র কার্তি চিদম্বরমের বিরুদ্ধে মামলাটি সাজানো হয়েছে।

ইন্দ্রাণী মুখার্জী (ছবি : সংগৃহীত)

ওই দুজনেই তখন আইএনএক্স মিডিয়া নামক টেলিভিশন সংস্থাটির প্রধান ছিলেন, এবং ওই সংস্থার জন্যেই পি চিদম্বরম ইউপিএ সরকারের অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন বৈদেশিক তহবিলের অনুমোদনে সহায়তা করেছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, তার ছেলে কার্তি চিদাম্বরম এই চুক্তির বিনিময়ে বিরাট অঙ্কের ঘুষ পেয়েছিলেন।

২০১৫ সালের আগস্টে মেয়ে শীনা বোরাকে হত্যার অভিযোগে ইন্দ্রানী মুখার্জীকে গ্রেফতার করা হয়, পরে তার স্বামী পিটার মুখার্জীকেও সিবিআই গ্রেফতার করে। এ বছরের শুরুর দিকে, ইন্দ্রানী মুখার্জী বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করেন ।

২০১৭ সালে, কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা সিবিআই একটি এফআইআর দায়ের করে অভিযোগ করে যে বিদেশি বিনিয়োগ সংক্রান্ত বোর্ড বা এফআইপিবি আইএনএক্স মিডিয়াকে ২০০৭ সালে বিদেশ থেকে ৩০৫ কোটি টাকার তহবিল পাওয়ার জন্য ছাড়পত্র দিয়েছিল।

ছবি : সংগৃহীত

দিল্লি হাইকোর্টে এই মামলাটির পরিপ্রেক্ষিতে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট যুক্তি দেখায় যে, ইন্দ্রানী মুখার্জীর বয়ানের ভিত্তিতেই পি চিদম্বরম এবং তার ছেলের বিরুদ্ধে এই মামলাটি গঠিত হয়েছে। ফলে, আদালত প্রাক্তন মন্ত্রীর আগাম জামিন প্রত্যাখ্যান করে। বুধবারই গ্রেফতার করা হয় পি চিদম্বরমকে।

আইএনএক্স মিডিয়াতে বৈদেশিক বিনিয়োগ এনে দেওয়ার বিনিময়েই কার্তি চিদম্বরমকে ঘুষ দেয়ার চুক্তি হয় বলেই জানান ইন্দ্রানী মুখার্জী। তিনি চেজ ম্যানেজমেন্ট ও অ্যাডভান্টেজ স্ট্রাটেজিক নামে দুটি সংস্থারও উল্লেখ করে বলেন যে, কার্তি চিদম্বরমের প্রাপ্য টাকা ওই দুই সংস্থাকে দেওয়ার কথাই বলা হয়।

ইন্দ্রানী মুখার্জীর বয়ানের রেকর্ড তদন্তকারী সংস্থার কাছে রয়েছে, যা থেকে স্পষ্ট হয় যে পি চিদম্বরমের এই ষড়যন্ত্রে সক্রিয় ভূমিকা ছিল। তিনি এখন সিবিআই দপ্তরে রয়েছেন, আর কিছুক্ষণ পরই তাকে আদালতে হাজির করা হবে।

এ দিকে, কংগ্রেস সিবিআই-এর এই পদক্ষেপকে চিদম্বরমের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বলেছিল। পি চিদম্বরম ভারতের রাজনীতির এক শক্তিশালী নাম। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের দশ বছরের শাসনকালে সর্বাধিক ক্ষমতাশালী মন্ত্রী ছিলেন। তার পোর্টফোলিওতে ছিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র ও অর্থ মন্ত্রণালয়।

আর এই প্রবীণ নেতার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিশোধ নিতেই সিবিআইকে দিয়ে এসব করানো হচ্ছে বলে অভিযোগ। গোটা ঘটনাকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার চরম নিদর্শন বলেই অভিযোগ করেছেন পি চিদম্বরমের ছেলে কার্তি। ঘটনাচক্রে, প্রায় দশ বছর আগে মনমোহন সিংয়ের কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের বিরুদ্ধে বিজেপি ঠিক একই অভিযোগ তুলেছিল।

প্রাক্তন কংগ্রেস সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ছিলেন পি চিদম্বরম। ছবি : সংগৃহীত

ফিরে দেখা

গুজরাটের তত্কালীন মন্ত্রী ছিলেন ভারতের বর্তমান কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। সে সময়ে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী সোহরাবউদ্দিন শেখ এনকাউন্টার মামলায় তদন্ত চলছিল। ২০০৪ সালে পুলিশ হেফাজতে ৬০টি অপেক্ষমান মামলার আসামি সোহরাবউদ্দিনের মৃত্যু হয়, যখন অমিত শাহ গুজরাটের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

তখন, ওই এনকাউন্টার সাজানো বলে অমিত শাহের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে, পরে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে মামলাটি ২০১০ সালের জানুয়ারিতে সিবিআই-এর কাছে স্থানান্তর করা হয়েছিল। কংগ্রেসের এই পি চিদম্বরমই তখন ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

ছয় মাস পর- ২০১০ সালের জুলাইতে, সোহরাবউদ্দিন এনকাউন্টার মামলায় অমিত শাহকে গ্রেফতার করে সিবিআই এবং তার বিরুদ্ধে হত্যা, চাঁদাবাজি এবং অপহরণের অভিযোগ দায়ের করে। তিনিও জামিনের আবেদন করেছিল, গুজরাট হাইকোর্টে সিবিআই ঠিক তখনো এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করে। অমিত শাহ তার রাজনৈতিক প্রভাবকে প্রমাণ লোপাট বা সাক্ষীদের হুমকি দেয়ার জন্য ব্যবহার করতে পারেন বলে আদালতে যুক্তি দিয়েছিল সিবিআই।

তিন মাস পরে- ২৯ শে অক্টোবর, ২০১০- অমিত শাহ গুজরাট হাইকোর্ট থেকে জামিন পান। পরের দিন, আদালত সাপ্তাহিক বন্ধ ছিল, সিবিআই বিচারপতি আফতাব আলমের কাছে যোগাযোগ করে, যিনি অমিত শাহকে গুজরাট থেকে নির্বাসিত করেছিলেন। ২০১০ থেকে ২০১২ পর্যন্ত অমিত শাহ গুজরাটে প্রবেশ করতে পারেননি।

গুজরাট থেকে অমিত তখন দিল্লীতে নির্বাসনে চলে যায়, রাজধানীর অশোক রোডের ৯ নম্বর বাংলোটি বরাদ্দ ছিল অরুণ জেটলির নামে। পাশের ১১ নম্বরটি সেই সময় বিজেপি সদর দপ্তর। জেটলি তখন ভারতের রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা। দুপুরের পর দরবার বসতেন। আর প্রায় রোজই চুপ করে বসে থাকতেন এক আগন্তুক, তিনি আর কেউ নন, নির্বাসিত অমিত শাহ।

সোহরাবুদ্দিন মামলায় তখন তিনি রাজ্যছাড়া, গুজরাটে প্রবেশ করতে পারতেন না। গ্রেফতারের ঠিক আগে আহমদাবাদের বিজেপি দপ্তরে গিয়ে অমিত বলে এসেছিলেন, সব অভিযোগ মিথ্যা। বিজেপি অমিতের কথা রেখেছে, তাকে নির্দোষ করেছে, তিনি এখন দলটির সর্ব-ভারতীয় সভাপতি এবং দেশের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী মোদীর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সেনাপতি বললে ভুল হবে না।

কার্তি চিদম্বরমের মতো অমিত শাহ ও তখন চিদম্বরম এবং কংগ্রেসকে রাজনৈতিক বিরোধীদের টার্গেট করতে সিবিআইয়ের অপব্যবহারের অভিযোগ এনেছিলেন। অমিত শাহকে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সমস্ত অভিযোগ থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, ততদিনের মধ্যে নরেন্দ্র মোদী ভারতের সরকারের আসনে বসে গিয়েছেন।

বিজেপি ঘোষণা করেছিল যে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকার অমিত শাহ নির্দোষ ছিল, তবুও তিনি নিগৃহীত ছিলেন। মজার বিষয় হচ্ছে, আইএনএক্স মিডিয়া মামলায় চিদম্বরমের জড়িত থাকার বিষয়ে কংগ্রেস একই দাবি করছে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড