আন্তর্জাতিক ডেস্ক
সামরিক বাহিনীর জাতিগত নিধনযজ্ঞের হাত থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে প্রত্যাবাসনের 'ন্যূনতম' প্রস্তুতি নেই বলে জানিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার একটি থিংক-ট্যাংক। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া লাখ লাখ রোহিঙ্গাদের দুই বছরেও দেশে ফেরানো যায়নি, বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে প্রস্তুত দাবি করলেও অস্ট্রেলিয়ান স্ট্র্যাটেজিক পলিসি ইনস্টিটিউট (এএসপিআই) উপগ্রহ থেকে তোলা ছবিতে প্রস্তুতির কোনো চিহ্ন দেখেনি।
২০১৭ সালে মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে সামরিক বাহিনী পরিচালিতে গণহত্যা অভিযানের হাত থেকে বাঁচতে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাধ্য হয়ে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। জাতিসংঘ সামরিক বাহিনীর এই অভিযানকে 'গণহত্যার অভিপ্রায়ে' চালানো গণহত্যাসহ গণধর্ষণ বলে অভিযোগ করেছে। তৎকালীন সহিংসতায় প্রায় সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গা অধ্যুষিত প্রায় ৪০০ গ্রাম পুড়িয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে ফেলা হয়েছিল।
অস্ট্রেলিয়ান স্ট্র্যাটেজিক পলিসি ইনস্টিটিউট (এএসপিআই) মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) শেষ বেলায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানায়, কর্তৃপক্ষ (মিয়ানমার) উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে, উপগ্রহ থেকে সংগৃহীত ছবিগুলো বিশ্লেষণে দেশটির নির্যাতিত জাতির প্রাক্তন আবাসন পুনর্নির্মাণ বা নতুন করে 'পুনর্গঠনের কোনো চিহ্ন দেখা যায়নি। এমনকি কিছু এলাকায়, আবাসিক ভবনগুলো ধ্বংস অব্যাহত রয়েছে।'
এএসপিআই এর আন্তর্জাতিক সাইবার পলিসি সেন্টারের এক গবেষক নাথান রুজার একটি বিবৃতিতে '২০১৮ ও ২০১৯ সালের মধ্যে ওই আবাসিক এলাকায় ধ্বংসযজ্ঞ যে অব্যাহত ছিল তা আমাদের উপগ্রহের অনুদৈর্ঘ্য ছবি বিশ্লেষণের মাধ্যমে স্পষ্টভাবে শনাক্তযোগ্য। ফলস্বরূপ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের একটি নিরাপদ ও মার্জিত প্রত্যয়ন প্রক্রিয়া সহজতর করার বিষয়ে মিয়ানমার সরকারের ইচ্ছার বিষয়ে গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে।'
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সম্পূর্ণ প্রস্তুত বলে মিয়ানমার সরকার বারবার দাবি করে আসছে, আর প্রত্যাবাসন না হওয়ার জন্য তারা বাংলাদেশকে দোষারোপ করে আসছে। এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর বার্তা সংস্থা রয়টার্স মিয়ানমার সরকারের মুখপাত্রকে মন্তব্যের আহ্বান জানালেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। এমনকি রাখাইন রাজ্যের জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগের উপপরিচালক কিউ সোয়ার তুন মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
এ দিকে ১০ জাতির আঞ্চলিক সংগঠন সাউথ ইস্ট এশিয়ান নেশনস অ্যাসোসিয়েশন (আসিয়ান)-এর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ইউনিট 'মসৃণ ও সুশৃঙ্খল' প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার জন্য মিয়ানমারের প্রচেষ্টার প্রশংসা করেছে।
আসিয়ানের মানবাধিকার সমন্বয় কেন্দ্র (এএইচএ)-এর একটি প্রতিবেদন জুনে ফাঁস হয়ে গেলে এক তথ্য বের হয়ে আসে। যেখানে দুই বছরের মধ্যে অর্ধ-মিলিয়ন শরণার্থী ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে।
তবে, মানবাধিকার সংস্থাগুলো চরম নির্যাতনের ওপর আলোকপাত না করে এবং এই অঞ্চলের চলমান দ্বন্দ্ব উপেক্ষা করে মূল্যায়নটি দাঁড় করানো হয়েছিল বলে জানায়। জাতিসংঘের দাবি, রাখাইন রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার জন্য এখনো প্রস্তুত না।
দেশটির উত্তরাঞ্চলে সরকারি সৈন্যরা এখনো আরাকান সেনাবাহিনীর বিদ্রোহীদের সঙ্গে লড়াই করছে। দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ জাতিগতের অন্তর্ভুক্ত মানুষের মধ্য থেকেই নিয়োগপ্রাপ্ত আরাকান সেনাবাহিনী গঠিত, যারা অঞ্চলটিতে বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসন চায়।
২০১৭ সাল থেকেই এই অঞ্চলে 'সুরক্ষাকরণের' একটি প্যাটার্ন চালু হয়েছে বলে এএসপিআইয়ের প্রতিবেদনে জানায়। রোহিঙ্গাদের প্রাক্তন বসতিগুলোর ওপরে ছয়টি সুবিধাসহ একটি সামরিক ঘাঁটি নির্মিত হচ্ছে বলে ধারণা করছে সংস্থাটি।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে রয়টার্স একটি তদন্তে মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলিমদের আবাসনের ওপর সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ জাতিগোষ্ঠীর জন্য ঘর নির্মাণের প্রমাণ খুঁজে পায়। সরকার কর্তৃক প্রস্তুত খসড়া পুনর্নির্মাণের মানচিত্র প্রকাশ করে যে, রোহিঙ্গারা তাদের আসল গ্রামে ফিরে যাওয়ার পরিবর্তে কয়েক ডজন নতুন জনবসতিতে যাবে, যেখানে কেবলমাত্র রোহিঙ্গা বসতি থাকবে।
বাংলাদেশে আশ্রিত লাখ লাখ মুসলিম শরণার্থীদের জন্যে আবাসনের ব্যবস্থা না করে তুলনামূলক অনেক কম সংখ্যক হিন্দু পরিবারের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছে। জুলাইয়ের শুরুতে, ভারত সরকার উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইনের বিভিন্ন গ্রামে সহিংসতায় বিতাড়িত হিন্দু পরিবারের কাছে ২৫০টি ঘর হস্তান্তর করেছিল। যেখানে রোহিঙ্গাদের জন্য একটি ঘরও ছিল না।
মংডু শহরের এক রোহিঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা জুয়ারমান রয়টার্সকে বলেন, 'হিন্দু ও রাখাইন মানুষ তাদের বাড়ি হারিয়েছে এবং আমরাও আমাদেরগুলো হারিয়েছি। আমরা চাই, আমাদের রোহিঙ্গাদেরও তাদের (হিন্দু) মতো একটা ঘর থাকত'। মুসলিম সংখ্যালঘুদের জন্য মিয়ানমারে আদৌ কোনোদিন ঘর হবে কিনা তা অনিশ্চিত, আপাতত আশ্রিত ১১ লাখ রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশ সরকার যে বেশ সঙ্কটে পড়বে তা নতুন এই প্রতিবেদন মোটামুটি নিশ্চিত করে দিয়েছে।
ওডি/এসএমএস
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড