আন্তর্জাতিক ডেস্ক
ক্রিকেট এক অনিশ্চয়তার খেলা, অনিশ্চিত ইতিহাসের সব মাত্রাকে ছাপিয়েই যেন গতকাল অনুষ্ঠিত হলো ২০১৯ বিশ্বকাপের ফাইনাল। নাটকীয় ফাইনাল ম্যাচের ক্রিকেটের ত্রুটিপূর্ণ এক নিয়মের মারপ্যাচে সুপার ওভারের খেলায় জেন্টেলম্যানদের দেশ নিউজিল্যান্ডকে বরণ করতে হয়েছে এক দুঃস্বপ্নের পরাজয়। এমন দুর্ভাগ্যের পরাজয় দেশটির প্রধানমন্ত্রী জ্যাসিন্ডা আর্ডার্নকেও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করেছে। অধরা বিশ্বকাপের এত কাছে গিয়েও ইংলিশদের কাছে এমন পরাজয়ের পরে দেশটির খেলোয়াড়দের নিয়ে 'গর্ব' প্রকাশ করতে ভুলে যাননি, বিশ্বের অন্যতম সুহৃদ নেতা জ্যাসিন্ডা।
ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০১৯ যেন এক নাটকীয়তার নাম, প্রতি ম্যাচেই যেন নতুনত্ব আর অনিশ্চিয়তাকে তুলে ধরেছে। ইংল্যান্ডের ক্রিকেটীয় আমেজ যেন এশিয়ান অঞ্চলে আগেই ম্লান হয়ে গিয়েছিল। আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও সর্বশেষ ভারতের পরাজয়ের মাধ্যমে এই অঞ্চলের মানুষের কাছে ফাইনালের প্রতি আগ্রহ অনেকটাই ম্লান হয়ে যায়। তবে, ক্রিকেটের এমন ফাইনাল যে দেশ, জাতি, স্বার্থের ঊর্ধ্বে ক্রিকেট ভক্তদের মাঝে চিরকালের জন্য এক অর্জন হিসেবে খোঁদাই করা থাকবে, তা থেকে কেউই বঞ্চিত হয়নি।
ইংল্যান্ড-নিউজিল্যান্ডের ফাইনাল ম্যাচটি ক্রিকেটপ্রেমীদের একদিক থেকে ভাসিয়েছে চূড়ান্ত আনন্দে এবং অন্যদিকে মন কেঁদেছে বিষাদে। ভক্তদের মতো কিউই প্রধানমন্ত্রী জ্যাসিন্ডাও এমন হারের পর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছেন। এটা ছিল এমন এক ফাইনাল, যাতে কোনো হারের বিরুদ্ধেই প্রার্থনা করেছে ভক্তরা। এমনটা কেউ কখনো দেখেনি, একটা মুহূর্তে গিয়ে অনেকেই চেয়েছেন বিশ্বকাপ ভাগ করে দেয়া হোক। দু-দলের এমন দুর্দান্ত পারফর্ম্যান্সের পরে কারও চোখে হারকে মেনে নেয়া কষ্টের।
জ্যাসিন্ডা রেডিও নিউজিল্যান্ডকে তার খেলোয়াড়দের নিয়ে 'অবিশ্বাস্যভাবে গর্বিত' হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। এমন একটি দলকে নিয়ে গর্ব করতে পারাটা সৌভাগ্যের। কেন উইলিয়ামসনের নেতৃত্বে এবারের বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ড এক অনন্য পুরস্কার অর্জন করেছেন। ব্লাক ক্যাপদের নিয়ে প্রশংসায় সিক্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এমন ভদ্রোচিত, আদর্শ আর দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে কিউইরা বিশ্ববাসীর হৃদয়ে গভীরে স্থান করে নিয়েছেন। ফ্লেমিং-উইলিয়ামসনদের মতো সজ্জন ক্রিকেটারদের কেবল নিউজিল্যান্ডেই দেখা মিলে।
ছবি : বিবিসি নিউজ
প্রযুক্তিগত বাউন্ডারি নিয়মে হেরে যায় নিউজিল্যান্ড আর প্রথমবারের মতো ক্রিকেট বিশ্বকাপ ঘরে তুলতে পারে ক্রিকেটের জনক দেশ ইংল্যান্ড। নাটকীয় ফাইনালের পর জ্যাসিন্ডা বলেন, 'এমন ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের অন্য সবার মতো আমিও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তবে সেই চূড়ান্ত ফলাফলের পরেও আমি ব্ল্যাক ক্যাপদের নিয়ে অবিশ্বাস্যভাবে গর্ব বোধ করছি। আমার মনে হয় প্রত্যেক নাগরিকই আমার মতো গর্বিত কারণ আমাদের খেলোয়াড়রা অসাধারণ ক্রিকেট খেলেছে।'
ইনস্টাগ্রামে করা এক পোস্টে জ্যাসিন্ডা ইংল্যান্ডকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, 'আমি মনে করি একটি জাতি হিসেবে ওই সুপার ওভারটি আমাদের জন্যে বছরের মতো ছিল'। এই ফাইনালকে ঘিরে এবং সুপার ওভারকে নিয়ে ইতোমধ্যেই সমালোচনার ঝড় শুরু হয়েছে। অনেকে নিউজিল্যান্ডের হারকে অন্যায় বলেও ঘোষণা করেছেন।
আইসিসির ৫ বারের বর্ষসেরা আম্পায়ার সাইমন টফেল স্টোকসের করা রানে ওভারথ্রো হওয়াকে উদ্ধৃত করে বলেন, 'তাদের (ইংল্যান্ড) এই নিয়মে ৬ না ৫ রান দেয়া উচিত ছিল। এটা একটা স্পষ্ট ভুল। বিচারের ভুল এটা। যে শটে ওভারথ্রো হয়েছে তাতে স্পষ্টভাবে ব্যাটসমান একবার সফলভাবে স্থান বদল করতে পেরেছিল'। কুমার ধর্মসেনা এই কাণ্ডে ইংল্যান্ডকে ৬ রান উপহার দিয়ে নিউজিল্যান্ডের নিশ্চিত জয় ছিনিয়ে যেন ইংল্যান্ডকেই উপহার দিলেন।
ব্রিটিশ রাজপরিবারের অফিশিয়াল টুইটারের একটি পোস্টেও রানিকে উদ্ধৃত করে নিউজিল্যান্ডের প্রশংসা করা হয়েছে। রানি বলেন, 'নিউজিল্যান্ডের রানার-আপ হওয়াতে আমিও শোকার্ত। আজকের প্রতিযোগিতায়, পুরো টুর্নামেন্ট তারা যেভাবে সম্পন্ন করেছে তা প্রশংসনীয়।'
ছবি : বিবিসি নিউজ
এই নিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো ফাইনালে হেরেছে নিউজিল্যান্ড। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপেও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে হেরে রানার আপ নির্বাচিত হয়েছিল কিউইরা। তবে, হেরেও ভক্তসহ সাবেক ক্রিকেটারদের হৃদয় জয় করে নিয়েছে নিউজিল্যান্ডের 'খেলুড়ে আত্মা'।
কিউই অধিনায়কের ব্যক্তিত্বের প্রশংসায় ভেসে যায় টুইটার, এমন এক দুঃস্বপ্নের হারের পরেও উইলিয়ামসনের হাসিমুখ দেখে বিস্মিত হয়েছে বিশ্ব। টুর্নামেন্টজুড়ে দুর্দান্ত খেলা উপহার দিয়ে টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার জিতেছে উইলিয়ামসন, তার মুখের হাসিতে সেই পুরস্কারের ছাপ নেই, তার মুখে এক উদার আত্মার ছাপ। মানার অযোগ্য হারের পরেও এভাবে আচরণ করা এক মহাত্মার পক্ষেই সম্ভব।
দক্ষিনামুর্থি নামের এক ব্যক্তি টুইটে জানায়, 'মাঝেমাঝে জীবন আমাদের সঙ্গে অন্যায় করে, ক্রিকেটেও তাই করেছে। নিউজিল্যান্ডের জন্য দুঃখ অনুভব করছি। অবশ্যই, বিশ্বকাপ তাদের বঞ্চিত করেছে, কিন্তু তারা বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি ক্রিকেট ভক্তদের হৃদয় জয় করে নিয়েছে।'
তবে, এমন হারের মনের দুঃখ আর চেপে রাখতে পারেনি কিউই খেলোয়ার জিমি নিশাম। টুইটের মাধ্যমে তিনি তরুণদের ক্রিকেটে না আসতে পরামর্শ দিয়েছেন। কিউই ভক্তদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, 'দুঃখিত, যা পাওয়ার জন্য তোমরা আপ্রাণভাবে অপেক্ষা করেছো, তা আমরা দিতে পারলাম না।'
রস টেলর একতি ছবি পোস্ট করেন, যেখানে তার মেয়ের হাসিমুখ ও ছেলের ক্রন্দনরত মুখের কথা টেনে বলেন, 'এমন এক খেলার পরে এই মিশ্রিত অনুভূতির পরে ইংল্যান্ডের প্রতি শুভেচ্ছা।'
ছবি : বিবিসি নিউজ
ক্রিকেটের প্রচলন ইংল্যান্ডে ঘটলেও এর আগে কখনো তারা বিশ্বকাপের স্বাদ পায়নি। ক্রিকেটের দুর্ভাগা জনকের খেতাব গুটাতে পারলেও কিউইরা ব্যর্থ হয়েছেন। এবার যেন ভাগ্য বিধাতা নিচে নেমে এসে কিউইদের হাতের ওঠা কাপ ইংলিশদের হাতে তুলে দেন। দিনশেষে ক্রিকেটই জিতেছে, দুর্দান্ত ক্রিকেট খেলে মানুষের মনে আরও গভীর ভালোবাসায় স্থান করে নিয়েছেন ভদ্র জাতি কিউইরা।
চলতি বছর নিউজিল্যান্ডের জন্য এক অভিশাপের বছর। বছরের শুরুর দিকে দেশটিতে ঘটে যায় এক নারকীয় ঘটনা। দুটি মসজিদে ঢুকে এক শেতাঙ্গ উগ্রা জাতীয়বাদী খুনি গুলি করে পাখির মতো মেরে ফেলে অর্ধশত মুসলিমকে। এমন ঘটনা বিশ্বকে স্তব্ধ করে দিয়েছে, এমন একটা দেশের এই নারকীয় ঘটনা দেশটিকে এক বড়সড় ধাক্কা দেয়। সেই ধাক্কা যেভাবে সামলেছেন জ্যাসিন্ডা, তাতে এমন শোকও তিনি সামলে উঠে তার দেশের নায়কদের জন্য যোগ্য কিছু করবেন বলেই ধারণা।
স্থানীয় গণমাধ্যমকে জ্যাসিন্ডা বলেন, 'এই মুহূর্তে আমরা তাদের স্বাগত জানানোর কাজের পরিকল্পনা করছি। তাদের নায়কোচিতভাবে স্বাগত জানানো হবে। তারা এর যোগ্য'। সত্যিই, অনিশ্চিত এই খেলায় একটা দলকে অবশ্যই হার বরণ করতে হয়। তবে, এমন হার জয়ের চেয়ে কিছুটা বেশি। কিউই-ইংলিশ কেউই এই ম্যাচে হারেনি, জিতেছে ক্রিকেট। বাস্তবে দুর্ভাগা কিউইদের অপেক্ষার পালা বাড়তে থাকবে, বিশ্বকাপ না জেতার অভিশাপ নিয়ে অপেক্ষা করতে হবে আরও ৪টি বছর।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড