• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৩ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

বিলুপ্তি ঘটতে পারে মানবসভ্যতার!

৩য় বিশ্বযুদ্ধ : চীন-রাশিয়া-ইরান-উ.কোরিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন জোটে কারা?

যে যুদ্ধে স্বরণকালের ভয়াবহতম পরিণতি দেখবে বিশ্ব

  এস এম সোহাগ

২৬ জুন ২০১৯, ১৮:৩১
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ
সমসাময়িক পরিস্থিতির আলোকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে সম্ভাব্য পরস্পর বিরোধী জোট। ছবি : সম্পাদিত

সংঘাত মানুষের আদি প্রকৃতির একটি, টিকে থাকার জন্য শুরু থেকেই মানুষকে যুদ্ধের আশ্রয় নিতে হয়েছে। প্রানীর ওপর মানুষের কর্তৃত্ব অর্জিত হয়েছে বহু আগেই, এরপরেই শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে মানুষই মানুষের প্রতিপক্ষ হয়েছে। বিশ্বের প্রায় প্রতিটা সভ্যতায়, প্রতি কালে যুদ্ধ সংঘটিতে হয়েছে। সভ্যতার বিকাশে বিশ্ব বিভক্ত হয়েছে জাতিতে, দেশে, ভাষাকে কেন্দ্র করে। আর এনিয়ে বিংশ শতকেই দুটো বিশ্বযুদ্ধের সাক্ষী হয়েছে মানব সভ্যতা।

পারমাণবিক,হাইড্রোজেন ও রাসায়নিক অস্ত্রের এই যুগে যুদ্ধ মানবসভ্যতার জন্য একটা ভয়াবহ হুমকি। মানুষের প্রভাবে বিশ্বের বহুপ্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে, হচ্ছে। এই তালিকায় এবার মানুষের নাম যুক্ত হবার পালা। এসব অস্ত্র যদি ৩য় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহার হয়, তাহলে বিশ্ব এক গণকবরে পরিণত হবে। লাশ গোণার জন্য বেঁচে থাকবে না কোন মানুষ, পারমাণবিক অস্ত্রের আঘাতে বিলীন হয়ে যাবে প্রাণ।

বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ

১৯১৪ সালের ২৮ জুন বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভো শহরে অস্ট্রিয়ার যুবরাজ আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্ডিনান্ড এক সার্বের গুলিতে নিহত হন। অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি এই হত্যাকাণ্ডের জন্য সার্বিয়াকে দায়ী করে এবং ওই বছরের ২৮ জুন সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই যুদ্ধে দুদেশের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়ে। এতে যোগ দিয়েছিল সে সময়ের অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী প্রায় সব দেশ। এভাবেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) সূচনা হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ; ছবি : সংগৃহীত

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে একপক্ষে ছিল উসমানীয় সাম্রাজ্য, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, জার্মানি ও বুলগেরিয়া। যাদের বলা হতো কেন্দ্রীয় শক্তি বা অক্ষ শক্তি। আর অপরপক্ষে ছিল সার্বিয়া, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জাপান, ইতালি, রুমানিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যাদের বলা হতো মিত্রশক্তি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ

মানবসভ্যতার ইতিহাসে এ যাবতকাল পর্যন্ত সংঘটিত সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল, এই ছয় বছর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়সীমা ধরা হলেও ১৯৩৯ সালের আগে এশিয়ায় সংগঠিত কয়েকটি সংঘর্ষকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়। তৎকালীন বিশ্বের সব পরাশক্তি এবং বেশিরভাগ রাষ্ট্রই এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং দুইটি বিপরীত সামরিক জোটের সৃষ্টি হয়। মিত্রশক্তি আর অক্ষশক্তি। এই মহাসমরকে ইতিহাসের সবচেয়ে বিস্তৃত যুদ্ধ বলে ধরা হয়, যাতে ৩০টি দেশের সব মিলিয়ে ১০ কোটিরও বেশি সামরিক সদস্য অংশগ্রহণ করে।

অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রসমূহ খুব দ্রুত একটি সামগ্রিক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং সামরিক ও বেসামরিক সম্পদের মধ্যে কোনোরকম পার্থক্য না করে তাদের পূর্ণ অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা প্রয়োগ করা শুরু করে। এছাড়া বেসামরিক জনগণের ওপর চালানো নির্বিচার গণহত্যা, হলোকস্ট (হিটলার কর্তৃক ইহুদীদের ওপর চালানো গণহত্যা), পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র পারমাণবিক অস্ত্রের প্রয়োগ প্রভৃতি ঘটনায় কুখ্যাত এই যুদ্ধে প্রায় ৫ কোটি থেকে সাড়ে ৮ কোটি মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এসব পরিসংখ্যান এটাই প্রমাণ করে যে এটাই পৃথিবীর ইতিহাসে নৃশংসতম যুদ্ধ।

পূর্ব এশিয়ায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে জাপান ইতোমধ্যেই ১৯৩৭ সালে প্রজাতন্ত্রী চীনে আক্রমণ করে। পরবর্তীতে ১৯৩৯ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর হিটলারের জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করে এবং তার ফলশ্রুতিতে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। দ্বিতীয় ঘটনাটিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা বলে গণ্য করা হয়।

১৯৩৯ থেকে ১৯৪১ পর্যন্ত একনাগাড়ে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ অভিযান পরিচালনা আর চুক্তি সম্পাদনার মাধ্যমে জার্মানি ইতালির সাথে একটি মিত্রজোট গঠন করে এবং ইউরোপ মহাদেশের অধিকাংশ অঞ্চল নিজের দখলে বা নিয়ন্ত্রণে আনতে সমর্থ হয়। মলোটভ- রিবেনট্রপ চুক্তি অনুসারে জার্মানি আর সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের দখলিকৃত পোল্যান্ড, ফিনল্যান্ড ও বাল্টিক রাষ্ট্রসমূহ নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়। এই সময় শুধু যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য ব্রিটিশ কমনওয়েলথভুক্ত দেশসমূহ অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছিল। (যেমন 'উত্তর আফ্ৰিকার যুদ্ধসমূহ’ আর বহুদিন ধরে চলা ‘আটলান্টিকের যুদ্ধ’)।

১৯৪১ সালের জুন মাসে ইউরোপীয় অক্ষশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে যার ফলশ্রুতিতে সমর ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ রণাঙ্গনের অবতারণা ঘটে। এই আক্রমণ অক্ষশক্তির সামরিক বাহিনীর একটা বড় অংশকে মূল যুদ্ধ থেকে আলাদা করে রাখে। ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে জাপান অক্ষশক্তিতে যোগদান করে এবং প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় উপনিবেশগুলো আক্রমণ করে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে পশ্চিম প্ৰশান্ত মহাসাগরের অধিকাংশ অঞ্চল জয় করতে সক্ষম হয়।

২য় বিশ্বযুদ্ধ; ছবি : সংগৃহীত

জাপান পার্ল হারবার আক্রমণ করলে এরপরেই ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র মিত্রশক্তির সাথে যোগ দেয়। মূলত জার্মানি এবং জাপান দুই অক্ষশক্তিই যুক্তরাষ্ট্রে আক্রমণ করার মাধ্যমে একে যুদ্ধে ডেকে আনে। অপরদিকে চীনের সাথে জাপানের ছিল পুরাতন শত্রুতা; ১৯৩০ সালের মাঝামাঝি সময় থেকেই এই দুই দেশের মধ্যে দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধ চলছিল। এর ফলে চীনও মিত্রপক্ষে যোগদান করে। ১৯৪৫ সালে জার্মানি এবং জাপান উভয় দেশের নিঃশর্ত আত্মসমর্পনের মধ্য দিয়েই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির মাধ্যমে ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘের আবির্ভাব ঘটে, পৃথিবী যেন আর কোনো বিশ্বযুদ্ধের প্রাঙ্গণ না হয় সেই মটো নিয়ে জাতিসংঘের আগমন। এরপর বিশ্বে বহুবার বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হলেও ৭৪ বছরে ঘটেনি তেমন কোনো দুর্ঘটনা। স্নায়ু যুদ্ধ, কোরীয় যুদ্ধ, উপসাগরীয় যুদ্ধ, ইরাক-ইরান যুদ্ধ, আরব বিশ্বে সন্ত্রাসবাদের উছিলায় মার্কিন আগ্রাসনে লাখ লাখ মানুষ মরলেও তাতে বিশ্বযুদ্ধ সৃষ্টি হয়নি।

এমন পরিস্থিতিতে যদি সেই বাঁধ ভেঙে বিশ্বের পরাশক্তিগুলি যুদ্ধে জড়িয়েই পড়ে তাহলে তা যে স্মরণকালের ইতিহাসের ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনবে তা বলাই বাহুল্য। বর্তমান যুগ পারমাণবিক অস্ত্রের যুগ, বিশ্বের পরাশক্তিগুলি পারমাণবিক অস্ত্রবহুল দেশ, এই যুদ্ধে যদি সব রাষ্ট্রই পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে তাহলে তা যে মানবসভ্যতাকে বিলীন কর দিবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার না করে যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘটে তাহলে কারা হবে দুইটি পক্ষে, কোন কোন বিশ্বশক্তি জোট বেঁধে একে অপরের সঙ্গে লড়াই করবে। এসব বিষয় নিয়েই এখানে আলোচনা করা হবে।

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ : (সম্ভাব্য)

বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গত প্রায় এক শতাব্দী ধরেই বিশ্ব ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান করছে দেশটি। অর্থনীতি, সামরিক সক্ষমতা থেকে পারমাণবিক অস্ত্রের সর্বোচ্চ স্থানটি দখলে রয়েছে দেশটির। বিশ্বের নিয়ন্ত্রণ নিতে গিয়ে একই সঙ্গে অন্যান্য পরাশক্তিদের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র।

পৃথিবীর সামরিক শক্তির শীর্ষে থাকা যুক্তরাষ্ট্র; ছবি : সংগৃহীত

দেশটির সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে আশ্চর্যজনকভাবে আক্ষরিক অর্থে কোনো যুদ্ধে জড়ায়নি দেশটি। তবে, বিশ্ব শক্তিদের সঙ্গে সম্পর্ক এমন এক অবস্থায় এনেছে, যা পরাশক্তিগুলোকে মার্কিন বিরোধী এক জোটে পরিণত করেছে।

এই মুহূর্তে যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগে আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে যদি মিত্র শক্তিই ভাবা যায় তাহলে অক্ষ শক্তি কারা হবে? এমন প্রশ্ন সবার মনস্পটেই ঘোরাফেরা করে। এ যাবতকালের যারা মিত্র শক্তি হিসেবে মার্কিনদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে তারাই হবে বিরোধী জোট।

মার্কিন জোটসমূহ :

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেই ক্ষমতার চাবিকাঠি ইউরোপ থেকে ফসকে মার্কিনদের হাতে চলে যায়। তবে, মার্কিনদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগীর তালিকায় রয়ে যাবে ইউরোপিয়ান পরাশক্তিরাই।

ব্রিটেন :

প্রায় ৫০০ বছর বিশ্ব শাসন করা এই জাতি এখন পরাশক্তির তালিকায় শীর্ষ অবস্থানে নেই। গত শতাব্দীতেই তারা সেই অবস্থান হারিয়ে ফেলেছে। ক্রমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক ছায়া রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে দেশটি, তবুও বিশ্বে সামরিক ও অর্থনৈতিক দুই দিক থেকেই শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই দেশটিকে নিঃসন্দেহে মার্কিনপন্থি রাষ্ট্র হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। তাই, ৩য় বিশ্বযুদ্ধে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনা না ঘটলে যুক্তরাষ্ট্রের জোটে প্রথমেই পারমাণবিক শক্তিধর দেশটি অন্তর্ভুক্ত হবে।

ব্রিটিশ-সৌদির সামরিক শক্তির অংশ। ছবি : সংগৃহীত

ফ্রান্স:

ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সহযোগী ছিল ফ্রান্স। সেই থেকেই দেশদুটির মধ্যকার সম্পর্ক ঈর্ষণীয়। বিশ্বে অন্যতম পরাশক্তির এই দেশটি এখন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী হিসেবেই উপস্থিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কথা আসা মাত্রই আমাদের চিন্তায় যে প্রতীকটিকে কল্পনা করি, সেই স্ট্যাচু অব লিবার্টি কিন্তু মার্কিনদের উপহার দিয়েছিল ফরাসীরাই।

ন্যাটো সদস্যভুক্ত দেশটি পারমাণবিক অস্ত্রেরও ধারক, আদি থেকে আধুনিক, সব সভ্যতাই তারা এক পরাশক্তি হিসেবে পরিচিত। সুতরাং, এখন পর্যন্ত যে পরিস্থিতি, তাতে ৩য় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন জোট হিসেবেই উপস্থিত হবে ফ্রান্স, এমনটাই স্বাভাবিক অনুমান।

সৌদি আরব :

মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন জোট হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত সৌদি আরব। চলমান বিশ্বের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় অস্ত্র ক্রেতা মুসলিমদের তীর্থভূমি। ইয়েমেন থেকে শুরু করে ইরান বিরোধী ভূমিকায় যুক্তরাষ্ট্রের পলিসিকে বাস্তবায়ন করতেই দেখা যায় মক্কার এই দেশকে।

তেলসমৃদ্ধ পবিত্র এই রাষ্ট্রটি ক্রমেই তাদের সামরিক সক্ষমতা বাড়িয়ে চলেছে। মার্কিন এজেন্ডার আলোকে আঞ্চলিক রাজনীতিতে আমিরাতকে সঙ্গ নিয়ে ইরান বিরোধী জোট গড়েছে সৌদি। বিশ্বের তেল বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়ন করতে সালমানের রাষ্ট্রটি তেলের দাম পর্যন্ত কমিয়ে দিয়েছে।

ইরানকে একঘরে করে রাখতে এবং তাদের মূল তেল বাণিজ্যকে পঙ্গু করতেই তেলবাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে শক্ত অবস্থানে রিয়াদ। মার্কিন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সর্বদাই সৌদিকে উৎসাহী হতে দেখা যায়। মধ্যপ্রাচ্যের এই পরাশক্তি যে ৩য় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন জোটের শক্তিশালী সহযোগী হচ্ছে তা নিয়ে সন্দেহের সুযোগ নেই।

ভারত :

উদীয়মান পরাশক্তি ভারত; ছবি : সংগৃহীত

মাত্র ৫০ বছর আগেও, আরও স্পষ্টভাবে বলতে গেলে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ-পাকিস্তান যুদ্ধে মার্কিনদের পাকিস্তান প্রেম স্পষ্ট ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধী শক্তির একটি ছিল যুক্তরাষ্ট্র। তৎকালীন পরিস্থিতি যেন বর্তমানে মুদ্রার উলটো পিঠ। পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ও ভারতের সঙ্গে উন্নতি আশ্চর্যজনক হলেও স্পষ্ট।

পারমাণবিক শক্তিধর ভারত ক্রমেই বিশ্ব পরাশক্তিদের তালিকায় শীর্ষ অবস্থানের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। অর্থনৈতিক-সামরিক ক্ষেত্রে প্রথম ৫টি শক্তিশালী রাষ্ট্রের একটি ভারত। ১৩০ কোটি মানুষের দেশটির মুখ্য উৎসাহ পাকিস্তান বিরোধী অনুভূতি।

চিরবৈরী পাকিস্তানের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্কের অবনতি ও রুশ-চীনের সঙ্গে সখ্যতা স্বাভাবিকভাবেই ভারতকে মার্কিন জোটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এশিয়ান রাজনীতিতে কর্তৃত্ব ধরে রাখতে ভারতমুখী হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রও। তাই সমসাময়িক পরিস্থিতি বিবেচনা করলে মার্কিন জোটে যে ভারত অংশগ্রহণ করবে তা মোটামুটি নিশ্চিত।

এছাড়াও ইসরায়েল, কানাডা, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ ইউরোপিয়ান শক্তি ও ন্যাটোভুক্ত রাষ্ট্রগুলোও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জোট গড়তে পারে।

মার্কিন বিরোধী জোট :

দুটো বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যারা জোট গড়েছে তাদের বৃহৎ এক অংশ এই সময়টাতে মার্কিন বিরোধী জোট হবে বলেই ধারণা। কারা হতে পারে :

রাশিয়া :

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই বিশ্ব নেতৃত্বে নিয়ন্ত্রণ নিতে যারা এক স্নায়ুযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তাদের মধ্যে প্রধান একটি দেশের নাম সোভিয়েত ইউনিয়ন। গেল শতকে দীর্ঘকাল ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধ চালিয়ে যায় বিশ্বের বৃহত্তম দেশটি। সামরিক দিক থেকে রাশিয়া এক পরাশক্তির নাম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের অদম্য নাৎসি বাহিনী এই রাশিয়াতে ঢুকেই হিটলারের শক্তি অর্ধেক করে ফেলে।

যুক্তরাষ্ট্রের পরেই সামরিক দিক থেকে পরাশক্তি রাশিয়া। ছবি : সংগৃহীত

রাশিয়া-মার্কিন বৈরিতা বিশ্বে কারোই আর অজানা নয়, সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই হোক কিংবা কূটনৈতিক রাজনীতি। এরা সর্বদা দুই প্রতিপক্ষ হিসেবেই বিবেচিত। গত ৭ দশকে বিশ্বে যতগুলি যুদ্ধ বাঁধে তার অধিকাংশতেই এরা একে অপরের বিপরীত অবস্থানে ছিল, এমনকি সমসাময়িক সিরিয়া যুদ্ধে বাশার সরকারের সবচেয়ে বড় সহযোগী পুতিন, যেখানে মার্কিনজোট বাশারের বিরুদ্ধেই যুদ্ধে লিপ্ত ছিল।

এমতাবস্থায় ৩য় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন বিরোধী জোটের নেতৃত্ব স্থানে থাকবে রাশিয়া, এটাই মানুষের চিন্তার প্রধান বিষয়। যদিও, এ যাবতকালের দুইটি বড় যুদ্ধেই এরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে কিংবা এখন পর্যন্ত সরাসরি কোনো যুদ্ধে না জড়ানোটাও একটা বড় পয়েন্ট। তবুও, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ফলে রাশিয়া বিশ্বে মার্কিন বিরোধী রাষ্ট্র হিসেবেই সর্বাধিক পরিচিত।

চীন :

গত ৫ দশকে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি উন্নতি করা রাষ্ট্রটির নাম চীন। জাপানের আগ্রাসনে কয়েক শতাব্দী ধরে পরাধীন থাকা দেশটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেই মাথা উঁচু করে বাড়তে থাকে। আয়তনে বিশ্বে ৪র্থ এই রাষ্ট্রটির জনসংখ্যা বিশ্বের এক পঞ্চমাংশ। দেড়শো কোটি মানুষের দেশটি গত ৪ দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি লাভ করে আসছে।

প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাজার চীন, বিশ্ববাজারে প্রযুক্তির কাঁচামাল তৈরি ও সরবারহে চীনের ধারেকাছেও কোনো রাষ্ট্রের অবস্থান নেই। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রটি বিশ্বের ২য় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ, বাণিজ্যের সবকিছু অন্তর্ভুক্ত করলে তাদের অর্থনীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে দিতে পারে বলে ধারণা ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের। তবে, সমসাময়িক সময়ে দেশটি এক মারাত্মক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি। ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে শি এর বাণিজ্য যুদ্ধ দেশটিকে এক জটিল সমস্যার মুখে ফেলেছে, যা মার্কিন এই সহযোগীকে অন্যতম বিরোধী হিসেবে আবির্ভাব ঘটিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের পরেই সামরিক খাতে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করা চীন। ছবি : সংগৃহীত

সামরিক দিক থেকেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরেই চীনের অবস্থান, কোনো কোনো পরিসংখ্যানে যুক্তরাষ্ট্রের পরে রাশিয়াকে পেছনে ফেলে চীনই সবচেয়ে বড় সামরিক শক্তি। প্রযুক্তির সাফল্যের ফলে বিশাল অর্থনীতির আদলে এক গুরুত্বপূর্ণ সামরিক শক্তি অর্জন করেছে পারমাণবিক শক্তিধর দেশটি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুখ্য এই প্রতিদ্বন্দ্বী তাই মার্কিন বিরোধী জোটের যে বড় অংশ হতে পারে, সে বিষয়ে ভাবাটা খুব একটা ভুল হবে না।

উত্তর কোরিয়া :

ষাটের দশকে কোরিয়া উপদ্বীপের যুদ্ধকে কেন্দ্র করে দুটি দেশের জন্ম হয়, একটি দক্ষিণ ও অন্যটি উত্তর কোরিয়া। দক্ষিণ অংশটা মার্কিনপন্থি, উত্তর মার্কিন বিরোধী। দক্ষিণ কোরিয়া বর্তমানে অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতি ও প্রাযুক্তিক পরাশক্তির এক দেশ। অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক উত্তর কোরিয়া দুর্বল অর্থনীতি ও পারমাণবিক শক্তির দেশে পরিণত হয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একের পর এক নিষেধাজ্ঞার জেরে বিশ্বে প্রায় একঘরে হয়ে গিয়েছে উত্তর কোরিয়া। চীন ছাড়া আর কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কও নেই কিমের দেশটির। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর চেয়ারম্যান কিমের সঙ্গে দুই দফা সাক্ষাৎ হলেও কোনো উন্নতি হয়নি দেশদুটির।

সর্বশেষ ভিয়েতনাম সম্মেলন চলাকালীন কিম ওয়াকআউট করে আলোচনা থেকে। কোরিয়াকে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের শর্ত বেঁধে দিয়ে আলোচনা হয়, কিন্তু মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না করলে কিম আরও বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অন্যতম হুমকি এই দেশটি আবার রাশিয়া-চীন এর সম্মিলিত এক জোটের অংশ। পারমাণবিক শক্তিধর দেশটি ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক ব্যর্থ হলে রাশিয়া সফরে যান। এবং গত সপ্তাহেই কিমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পিয়ংইয়ং সফর করেন শি জি পিং। মার্কিন বিরোধী জোটের শক্তিশালী অংশীদার হিসেবে নির্দ্বিধায় উত্তর কোরিয়া নাম অন্তর্ভুক্ত করা যায়।

ইরান :

চলমান বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে পরিচিত আরব বিশ্বের এই মেরুদণ্ডী জাতি। আরব বিশ্বের অধিকাংশ দেশ যেখানে শুধুমাত্র তেল বাণিজ্যের ওপর ভিত্তি করে আছে, সেখানে ইরান তাদের মেধাকে বিকশিত করে আধুনিকতার আদলে এক ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বিজ্ঞান, সাহিত্য, যুদ্ধ সব ক্ষেত্রেই সভ্যতার আদিযুগ থেকে এক শক্তিশালী নাম পার্সি, যারা ইরান হিসেবেই আধুনিক যুগে পরিচিত।

কোরিয়া ও চীন উভয়েই পরাশক্তি হিসেবে বিবেচিত। ছবি : সংগৃহীত

তেল বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে গেল শতকের ষাটের দশকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বৈরিতার শুরু। ১৯৭৯ সালে মার্কিনপন্থি রেজা শাহকে নির্বাসনে পাঠিয়ে ইরানের মার্কিন বিরোধী ইতিহাসের সূচনা ঘটে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগানের শাসনামলের পর ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলেই তেহরান-ওয়াশিংটন বৈরিতা চূড়ান্ত অবস্থানে পৌঁছে। ৪ দশক ধরে ইরানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দেশটির অর্থনীতিকে ভঙ্গুর করে দেয়।

২০১৫ সালে ওবামার প্রশাসনের সঙ্গে জার্মানিসহ ভেটো ক্ষমতার দেশগুলির অংশীদারিত্বে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এক পারমাণবিক চুক্তি হয়। ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম বন্ধে এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের উদ্দেশ্যেই এই চুক্তি করা। ২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসন সেই চুক্তি থেকে সরে গিয়ে ইরানের ওপর ফের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। মধ্যপ্রাচ্যে এর পর থেকেই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে, সৌদি-আমিরাত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে ইরানকে একঘরে করে দেয়।

সর্বশেষ মার্কিন গোয়েন্দা ড্রোন ভূপাতিত করার মাধ্যমেই দেশদুটির মধ্যে উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়। হুমকি-পাল্টা হুমকি, এটাই এখন তেহরান-ওয়াশিংটন পরিস্থিতি। এমন অবস্থায় ৩য় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন বিরোধীদের তালিকায় ইরান হবে মার্কিন বিরোধী জোটের অন্যতম অংশীদার।

এছাড়াও, এই জোটের সঙ্গে পাকিস্তান, কিউবা, বলিবিয়া, নিকারাগুয়া, ইয়েমেন ও লেবানন অংশগ্রহণ করতে পারে বলে ধরা যায়। কর্তৃত্ব আর নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে যদি একটা বিশ্ব যুদ্ধ লেগেই যায় তাহলে কোটি কোটি প্রাণহানি ঘটবে। পরমাণু অস্ত্র, হাইড্রোজেন অস্ত্রের এই যুগে একটা বিশ্বযুদ্ধ মানব সভ্যতাকে শেষ করার ঝুঁকিতে থাকবে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড