এস এম সোহাগ
সভ্যতার শুরুর দিক থেকে বিশ্বের যে দেশটি সর্বাধিক পরিচিত, সেই মিশরের দীর্ঘকালীন স্বৈরতন্ত্রের অবসান ঘটানো শেষ আশাটুকুও নিভে গেল। দেশটির প্রথম নির্বাচিত গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির আকস্মিক মৃত্যু যেন এক পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। প্রাচীন সভ্যতার এই দেশটির গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাত্র একমাত্র আশা ছিলেন মুরসি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যাপনা ছেড়ে নিজ দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেছিলেন, যুক্ত হয়েছিলেন মুসলিম ব্রাদারহুডের সক্রিয় রাজনীতিতে। মিশরের বিগত ৬০ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে ২০১২ সালে প্রথম নির্বাচিত গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন ইমাম হিসেবে খ্যাত মোহাম্মদ মুরসি। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বপালনের এক বছর না যেতেই রক্তাক্ত সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাকে উৎখাত করে বন্দি করে তৎকালীন সেনাপ্রধান ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ আল সিসি।
২০১৩ সালে প্রেসিডেন্ট থেকে কয়েদি হিসেবে কারাবাস শুরু হয় মিশরের গণতন্ত্রের একমাত্র আশার প্রদীপের। কারাগারে তিনি যে নির্মমতার শিকার হন তা নিয়ে মানবাধিকার সংস্থাগুলো তার মৃত্যুকে অত্যন্ত আশাজনক ঘটনা বলেই ব্যাখ্যা করেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মুরসির মৃত্যুকে ‘প্রত্যাশিত’ বলেই ঘোষণা করে।
সংস্থাটির মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা বিভাগের নির্বাহী পরিচালক সারাহ লেহ হুইটস টুইটারে বলেন, ‘মুরসির মৃত্যু ভয়ানক কিন্তু সম্পূর্ণ প্রত্যাশিত, কারাগারে তাকে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা পর্যন্ত দেয়ার অনুমতি ছিলনা’। কারাগারে পরিবার ও আইনজীবীর সঙ্গে পর্যন্ত সাক্ষাৎ করার অনুমোদন ছিল না মিশরের এই নিভে যাওয়া গণতান্ত্রিক আশার প্রদীপের।
ছবি : সংগৃহীত
তার মৃত্যুকে বিশ্ব নেতারা শহীদী মৃত্যু হিসেবেই ব্যাখ্যা করেছেন, তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান এক শোক বিবৃতি দিয়ে মুরসির জন্য আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তিনি বলেন, ‘নিজের কারণের সঙ্গে লড়াই করা একজন ব্যক্তি ছিলেন শহীদ মুরসি, যিনি তার দেশকে, জনগণকে স্বৈরতন্ত্র থেকে স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন। এমন শহীদের মৃত্যুর দায়ীদের ইতিহাস কখনো ক্ষমা করবে না।’
মৃত্যুর সময় মুরসিকে অনেকগুলো আইনি অভিযোগের মুখোমুখি হতে হয়েছিল, মানবাধিকার গ্রুপ এবং স্বাধীন পর্যবেক্ষকের পাশাপাশি অনেকেই একে রাজনৈতিকভাবে অনুপ্রাণিত মামলা বলে অভিহিত করেন। মিশরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মুরসির প্রতিদ্বন্দ্বী হামদিন সাবাহীও তার মৃত্যুতে সমবেদনা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি মহান আল্লাহ্র কাছে তার মহিমান্বিত জান্নাতে মুরসিকে স্বাগত জানানোর, তার দয়া গ্রহণ করে, ভুলগুলো উপেক্ষা করে এবং তার প্রিয়জনকে ধৈর্য্য বজায় রাখার শক্তি দেয়ার প্রার্থনা করি।’
আরব বসন্ত ও সিআইএ চক্রান্ত
একজন ইসলামপন্থি নেতা হিসেবে মুরসির ইসলামপ্রীতিকেই তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের হাতিয়ার বানানো হয়েছিল। ফিলিস্তিনের সঙ্গে মিশরীয় রাজনীতি অনেক আগে থেকেই জড়িত, গেল শতকের উপসাগরীও যুদ্ধের সম্পর্কে ধারণা থাকলে বিষয়টি আরও ভালোভাবে বোঝা যাবে। মুরসি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য বিশ্ব দরবারে এবং দেশেও প্রচারণা চালিয়েছিলেন আর তাই তার সঙ্গে হামাসকে জড়িয়ে ফেলা হয়েছিল।
আরব বসন্তের ছোঁয়ায় ২০১১ সালে মিশরে যে গণবিপ্লব শুরু হয়েছিল, যে সময়টাতেই মূলত ৩০ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে হোসনি মুবারককে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল। সে সময় মুরসি হামাসের মাধ্যমে মিশরের পুলিশ স্টেশন ও বিভিন্ন স্থানে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করেন, এমন অভিযোগেই তার বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়। তবে, মিশরের সাবেক এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা একে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর এক ষড়যন্ত্র হিসেবে সাক্ষ্য দেয়।
মিশরের সাবেক স্বৈরশাসক হোসনি মুবারক। ছবি : সংগৃহীত
মিশরের স্টেট সিকিউরিটি এজেন্সি (বর্তমানে জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা নামকরণ করা হয়) এর একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সাক্ষী, আদেল আজাব। আরব বসন্তের অংশ হিসেবে ২০১১ সালের ২৫ জানুয়ারি বিদ্রোহের সময় তিনি সংস্থার মুসলিম ব্রাদারহুড সম্পর্কিত বিষয়গুলির জন্য দায়বদ্ধ ছিলেন।
তার সাক্ষ্য-প্রমাণের প্রথম অংশে, আজাব বলেন হোসনি মুবারককে ক্ষমতাচ্যুত করার গণবিপ্লব ছিল মূলত পশ্চিমা শক্তির গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে ও মার্কিন সিআইএ দ্বারা আয়োজিত এক বিশাল ষড়যন্ত্রের অংশ। সিআইএর সঙ্গে ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং জার্মানির গোয়েন্দাসংস্থার মিলিত ষড়যন্ত্র। মধ্যপ্রাচ্য ও মিশরে এই বিশাল পরিকল্পনাটি মুসলিম ব্রাদারহুড পরিচালনা করেছিল বলে আজাব অভিযোগ করেন।
আজাব অভিযোগ করেন যে, এই চক্রান্তটি মধ্যপ্রাচ্য ও বিশেষত মিশরে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করার লক্ষ্যে করা হয়েছিল। চক্রান্তে মিশরের পূর্ব সীমান্তের লঙ্ঘন এবং কারাগারে ভাঙাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। তিনি দাবি করেন যে, ২০০৪ সালে শুরু হওয়ার পর চক্রান্তটি সাত বছর ধরে চলছে। ব্রাদারহুড সিআইএ এবং অন্যান্য পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিদের সাথে একটি চুক্তি করেছিল। ‘মিডল ইস্ট মনিটর’
প্রত্যক্ষ ষড়যন্ত্রের অংশটি ছিল কিছু আরব দেশকে ছোট সত্তাতে বিভক্ত করা এবং তাদের তুরস্ক, ইরান ও কাতারের অধীনে ভাগাভাগি করা, যার সবগুলোই চক্রান্তের অংশ ছিল। পশ্চিমা শক্তিগুলির এই ধরনের ষড়যন্ত্র এটাই প্রথমবারের মত নয় বলে আজাব অভিযোগ করেন। আফগানিস্তানেও অনুরূপ একটি ঘটনা ঘটেছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের শাসনামলে "সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ" করার প্রতিশ্রুতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চলমান প্রচেষ্টার অংশ ছিল এই চক্রান্তটি।
ছবি : সংগৃহীত
২০১৩ সালে গণতান্ত্রিকভাবে মিশরের প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার এক বছর যেতে না যেতেই সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মুরসিকে উৎখাত করা হয়েছিল। ২০১১ সালের আরব বসন্তের সময় কারাগার ভাঙ্গা এবং মিশরের পূর্ব সীমান্ত লঙ্ঘনের অভিযোগে মুরসির সঙ্গে ২৮ জন অভিযুক্তের বিচার চলছিল।
২০১২ সালে কোর্ট অব ক্যাসেশনের পর ২০১৫ সালে নিম্ন আদালতে প্রদত্ত পূর্ববর্তী রায়ের বিরুদ্ধে দায়ের করা একটি আবেদন গৃহীত হওয়ার পর মুরসির এবং অন্য আসামিরা এখন পুনরায় চেষ্টা করছেন। কায়রো ফৌজদারি আদালতে ২০১৫ সালে মুরসি ও অন্যান্য প্রতিবাদীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার অভিযোগ আনা হয়েছিল। এটি কারান্তরীণ কয়েকজন বিপ্লবীকেও দণ্ডিত করেছে।
কে এই মুরসি?
উত্তর মিশরের শারক্বিয়া প্রদেশের আল-আদওয়াহ গ্রামে ১৯৫১ সালের ২০ই আগাস্ট জন্মগ্রহণ করেন মুরসি। কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকৌশল বিভাগে ১৯৭৫ সালে স্নাতক ও ১৯৭৮ সালে স্নাতকোত্তর শেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান মুরসি। ১৯৮২ সালে ইউনিভার্সিটি অফ সাউথ ক্যালিফোর্নিয়াতে মোহাম্মাদ মুরসির প্রকৌশল বিষয়ে গবেষণা শেষ হয় এবং তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।
এ বছরই তিনি ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি, নর্থরিজে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। অধ্যাপনা ছাড়াও ইমাম হিসেবে খ্যাতি আছে তার। ১৯৮৫ সালে মুরসি শারকিয়া প্রদেশের জাগাজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে ক্যালিফোর্নিয়ার অধ্যাপনার চাকরি ছেড়ে মিশরে চলে যান। মুরসির পাঁচ সন্তানের মধ্যে দুইজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করেন এবং জন্মসূত্রে তারা মার্কিন নাগরিক।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকৌশলে ডক্টরেট করা মুরসি ইমাম হিসেবেও পরিচিত। ছবি : সংগৃহীত
মুরসির রাজনৈতিক জীবন
মুরসি সাবেক স্বৈরশাসক হোসনি মুবারকের আমলে ২০০০ সালে মিশরের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সাংগঠনিকভাবে তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্য হলেও, নির্বাচনে তাকে ব্রাদারহুডের অন্যান্য নেতাদের মতো আইনত স্বতন্ত্রভাবেই লড়তে হয়, কারণ হোসনি মুবারাকের শাসনামলে মুসলিম ব্রাদারহুড মিশরের প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে নিষিদ্ধ ছিল।
মুরসি ব্রাদারহুডের গুরুত্বপূর্ণ গাইড্যান্স অফিসের প্রধান হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন, যার পরিণতিতে ২০১১ সালে ব্রাদারহুডের প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক দল ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি গঠনের পর তিনিই দলটির চেয়ারম্যান পদ লাভের জন্য সবচেয়ে সম্ভাব্য ছিলেন।
২০১২ সালের মিশরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন মূলত দলীয় উপনেতা ও রাজনৈতিক প্রধান খাইরাত এল-শাতেরই ছিলেন মুসলিম ব্রাদারহুডের মূল প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী। কিন্তু, প্রচারণা শুরুর আগেই শাতেরসহ একাধিক প্রার্থীকে একটি আদালত নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করলে ব্রাদারহুড বা এফজেপি প্রার্থী হিসেবে মুরসির নাম উঠে আসে, যিনি মূলত সংগঠনটির দ্বিতীয় মনোনয়নপ্রার্থী ছিলেন। পরে এফজেপি মুরসিকে তাদের প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত করে।
ব্রাদারহুডের এক দলত্যাগী জনপ্রিয় নেতার অংশগ্রহণ সত্ত্বেও মুরসি ২৩ মে, ২০১২ এর নির্বাচনে ২৫.৫ শতাংশ ভোট পান, যা ছিল সর্বোচ্চ। প্রথম পর্বের পর মুহাম্মাদ মুরসি এবং আহমেদ শফিক দ্বিতীয় পর্বের চূড়ান্ত ভোটাভুটির জন্য মনোনীত হন।
দ্বিতীয় পর্বের নির্বাচনের আগে মুরসি মিশরের সর্বস্তরের মানুষের প্রতি আহমেদ শফিকের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানান। মুরসির রাজনৈতিক দল আহমেদ শফিককে, যিনি সাবেক বিমান বাহিনী প্রধান ও হোসনি মুবারাকের অধীনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাকে ক্ষমতাচ্যুত মুবারাকের রক্ষাকর্তা হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রচার করে যে, শফিক নির্বাচিত হলে মিশরের ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসন নতুন জীবন পাবে।
আল-আকসা মসজিদে মুরসির জন্য জানাজা। ছবি : সংগৃহীত
৩০ মে, ২০১২ তারিখে মুরসি মিশরীয় টেলিভিশন উপস্থাপক তাওফিক ওকাশার বিরুদ্ধে একটি মানহানি মামলা করে বলেন, ওকাশা ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল তথ্য উপস্থাপন করে মুরসি ও তার রাজনৈতিক দলের সম্মানহানি করেছে। মিশরীয় গণমাধ্যমের সূত্রমতে, ওকাশা ২৭ মে তারিখে প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী একটি টেলিভিশন বক্তব্যে মিশরে ‘ইসলামপন্থিদের হাতে খ্রিস্টানদের হত্যাকাণ্ডের’ প্রমাণাদি তুলে ধরে প্রশ্ন করেন, হত্যাকারীরা কীভাবে দেশ চালাবে। বিতর্কিত প্রমাণাদিগুলোতে ইসলামপন্থি হিসেবে মূলত মুসলিম ব্রাদারহুডকে ইঙ্গিত করা হয়েছিল।
২৪ জুন, ২০১২ তারিখে মুরসিকে দ্বিতীয় পর্বের নির্বাচনে জয়ী, অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। এর পরপরই মুরসি মুসলিম ব্রাদারহুড ও ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি থেকে আনুষ্ঠানিক অব্যাহতি গ্রহণ করেন।
মিশরের সরকার ও অভ্যন্তরীন নীতিমালা পরিবর্তন
ক্ষমতা গ্রহণের পর মুরসি বলেন, ‘আমি আশা করি জনগণ আমাকে ফ্রিডম এন্ড জাস্টিস এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের ইসলামি প্রার্থী হিসাবে বেছে নেবে, এবং আল্লাহর ইচ্ছায় সিস্টেমটি স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের দিকে অগ্রসর হবে। কোন অস্তিত্বশীল বস্তু মিশরের সংবিধানের ওপরে থাকবে না’ তবে সেনাবাহিনীর অবস্থানের জন্য তার দৃষ্টিভঙ্গি বানাননি।‘
ছয় দশক ধরে মিশরের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণকর্তা সেনাবাহিনীকে উদ্দেশ্য করে মুরসি বলেন, সেনাবাহিনীর বাজেট সংসদ কর্তৃক তত্ত্বাবধায়ন করা উচিত তবে নির্দিষ্ট এলাকায় গোপনীয়তার প্রয়োজন হবে।’
তিনি মিশরের সংবিধানকে সম্মান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং দেশটির প্রতিটি মানুষকে একটা স্বাধীন জীবন পদ্ধতি উপহারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। মিশরে একটি উন্মুক্ত ইসলামিক বাজার ব্যবস্থা চালু করার চেষ্টা করেছিলেন মুরসি। তবে, ইসলাম একটা নীতিমালার ওপরেই বাজার ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে পারে বলে তিনি মিশরের বিদ্যমান পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে চেষ্টা করেছিলেন।
মুরসির মৃত্যু
মুরসি আটক হয় ২০১৩ সালে, এরপর থেকে দীর্ঘ ৬ বছর ধরে একরম সলিটারি কনফাইনমেন্টেই ছিল মুরসি। একাধিক মামলায় তার বিভিন্ন মেয়াদের সাজাও হয়। সোমবার (১৭ জুন) কায়রোর একটি আদালতে গুপ্তচরবৃত্তি মামলার শুনানি চলছিল। বার্তা সংস্থা ‘এএফপি’র কাছে এক সূত্র জানায়, মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার আগে মুরসি বিচারককে উদ্দেশ্য করে কিছু বলার সময়ই অজ্ঞান হয়ে যান এবং সেখান থেকে তাকে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
মুরসির এমন মৃত্যু অনেক প্রশ্ন জাগিয়ে তুলেছে। কারাগারে তাকে যেভাবে রাখা হয়েছে তা নিয়ে মানবাধিকার সংস্থাগুলি বারবার সতর্ক করে আসছিল। ২০১৮ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে একদল ব্রিটিশ সাংসদ আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী মুরসিকে প্রয়োজনীয় অধিকার প্রদান করা হয়নি বলে জানান। ডায়াবেটিস ও কিডনি সমস্যায় জর্জরিত মুরসিকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়নি। এমনকি, রাজনৈতিক বন্দিদের ক্ষেত্রে ‘ম্যান্ডেলা আইন’ অনুযায়ী যে সেবা পাবার কথা ছিল তাও প্রদান করা হয়নি মুরসিকে, যা নিয়ে ব্রিটিশ সাংসদরা বলেছিলেন, এমন অবস্থা মুরসিকে স্থায়ী মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের নির্বাহি পরিচালক সারা হুইটসন বলেন, ‘মিশরীয় সরকার মুরসিকে চিকিৎসা সেবা ও পারিবারিক সাক্ষাৎ থেকে বঞ্চিত করেছে। ২০১৭ সালে মুরসিকে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করা নিষিদ্ধ করে যা তাকে নিঃসঙ্গতা ও মানসিক দুর্বলতার দিকে ঠেলে দেয়। সরকারের এসব আচরণের বিরুদ্ধে পাহাড়সম আইনি অভিযোগ করে মানবাধিকার সংস্থাটি।
মিশরের সেনাবাহিনীর প্রধান ও মুরসিকে উৎখাতের নেতা সিসি, বর্তমান প্রেসিডেন্ট। সিসি এক স্বৈরতান্ত্রিক নেতা যে মিশরের গণতন্ত্রের আশাকে মিশরীয়দের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। মুরসিকে উৎখাত খুব একটা সহজ বিষয় ছিল না, দেশটির প্রথম নির্বাচিত এই নেতার বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থান দেশটিকে ফের এক গণবিপ্লবের দিকে ঠেলে দেয়। সিসি শক্ত হাতে সেটা মোকাবিলা করে, এজন্য হাজার হাজার লাশের স্তূপের ওপর দিয়ে চলতে হয়েছে সিসিকে।
ব্রাদারহুড নেতা, সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্ট ও মুরসি সমর্থকসহ হাজার হাজার মিশরীয়কে আটক করতে হয়েছে সিসিকে। কঠোরভাবে মিশরের মানুষের কাছ থেকে গণতান্ত্রিক আশাকে মেরে ফেলেন এই সামরিক নেতা। সিসি ক্ষমতাগ্রহণের পর দেশটিতে মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিষিদ্ধ করে একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে আখ্যা দেয়। তিনি ২০১৯ সালে মিশরের সংবিধানে এমন পরিবর্তন আনেন যা তাকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত দেশটির ক্ষমতায় থাকতে সহায়তা করবে। একই সঙ্গে বিচার ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন।
মিশরের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ও মুরসি উৎখাত করা স্বৈরশাসক সিসি। ছবি : সংগৃহীত
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাকে স্বীকৃতি দিলে উন্মুক্তভাবে তিনি এসব বাস্তবায়ন করেন। চলতি বছর এপ্রিলে দ্বিতীয়বারের মতো হোয়াইট হাউজ সফরে যান সিসি। সিসির ক্ষমতাগ্রহণকে সমর্থন জানিয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘সিসি চমৎকার একটি কাজ করছে বলেই আমার মনে হচ্ছে, আমি তার প্রচেষ্টা সম্পর্কে জানি না তবে আমি আপনাদের এতটুকুই বলতে পারি যে, সিসি ভালো করছে।’
মুরসিই সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে নিগ্রোহিত রাজনৈতিক বন্দি ছিল, তাকে বিশ্বের সবচেয়ে হাই-প্রোফাইল বন্দি হিসেবে অভিহিত করে মানবাধিকার সংস্থা। কারাগারে মুরসিকে মারাত্মক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। তার মৃত্যু আদৌ স্বাভাবিক কোনো মৃত্যু কি না তা নিয়েও দেখা দিয়েছে সন্দেহ। মঙ্গলবার (১৮ জুন) পূর্ব কায়রোতে পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতেই সাবেক এ মুসলিম ব্রাদারহুড নেতার দাফন সম্পন্ন হয়েছে বলে তারা আইনজীবীরা জানিয়েছেন।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড