• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

হুয়াওয়ে : ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত এক কোম্পানি

  জুবায়ের আহাম্মেদ

২৬ মে ২০১৯, ০৯:১৯
হুয়াওয়ে
ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত এক কোম্পানির নাম হুয়াওয়ে

ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবার প্রাণকেন্দ্রে বিশাল এক ভবন। দেখতে অনেকটা স্পেসশিপের মতই। বিকেলের রোদে রীতিমতো উজ্জ্বল ভবনের বাইরের দিক। ভবন দেখে চোখ কপালে উঠবে যে কারোরই। দারিদ্র্যের চাপে পিস্ট আফ্রিকান দেশগুলোতে এমন কিছু দেখা যায়নি কখনোই। ভবনটি আফ্রিকার অভিভাবক তুল্য প্রতিষ্ঠান আফ্রিকান ইউনিয়নের সদর দপ্তর। অথচ ভেতরে পা রাখতেই আপনার চোখে পড়বে মান্দারিন ভাষায় লেখা স্বাগতবাণী। সাথে থাকছে চীনের ঐতিহ্যবহন করা ঝকঝকে এক লাল গালিচা। কিছুটা ভেতরে গেলেই আপনাকে অভিবাদন জানানো হবে মান্দারিন (চাইনিজ) ভাষায়। সেই সাথে চোখে পড়বে প্লাস্টিকের পাম গাছে আচ্ছাদিত চায়না ডেভলপমেন্ট ব্যাংকের লোগো। ৮০০০ কিলোমিটার দূরে, আফ্রিকান শহর আদ্দিস আবাবার বুকে যেন এক টুকরো চীন গড়ে উঠেছে আফ্রিকান অভিভাবক সংস্থার একেবারেই গভীরে।

আফ্রিকা

আদ্দিস আবাবায় আফ্রিকান ইউনিয়ন সদর দপ্তর (ছবি: ইথিওপিয়া টুডে)

২০০৬ সালে চীনের বেইজিং এ স্বাক্ষরিত ২০০ বিলিয়নের চুক্তি অনুসারে ২০১২ সালে শেষ হয় এর নির্মাণকাজ। মূলত বিশ্বের অনেক দেশের মতই আদ্দিস আবাবায় চীনের টাকায় গড়ে উঠেছে আফ্রিকান ইউনিয়নের পুরো সিস্টেম। যার মাঝে আছে সম্পূর্ণ কম্পিউটার নেটওয়ার্ক। পরের কয়েকবছর চীন এবং আফ্রিকা মৈত্রীর বড় নিদর্শন হয়ে রইলো এই বিশালাকায় ভবন। দুই জায়গায় বাণিজ্য বাড়লো জলের মত করে। ২০ শতাংশ প্রতি বছর হারে আফ্রিকার সাথে বাণিজ্য বাড়িয়েছে চীন। সবই যখন ঠিকঠাক তখন ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে নতুন বোমা ফাটালো আফ্রিকা ভিত্তিক ফ্রেঞ্চ পত্রিকা লা মুন্ডে আফ্রিকা।

রিপোর্ট অনুযায়ী, আফ্রিকান ইউনিয়নের পুরো কম্পিউটার সিস্টেমই আছে আরেক জনের নিয়ন্ত্রণে। পাচার হচ্ছে সকল তথ্য। ৫ বছর, দিনের হিসেবে ১৮২৫ ধরে রাত ১২ টা থেকে রাত ২টার মাঝে আদ্দিস আবাবার শত শত কম্পিউটার থেকে তথ্য চলে গিয়েছে চীনের আরেক অভিজাত ভবনে। মূলত ব্যাপারটি নজরে আসে ২০১৭ সালে যখন আফ্রিকান ইউনিয়নের কম্পিউটার বিশেষজ্ঞরা লক্ষ্য করেন অফিস সময়ের বাইরেও তাদের কম্পিউটার কাজ করে যাচ্ছে পূর্ণ উদ্যমে। লা মুন্ডে আফ্রিকার এই প্রতিবেদন বারুদের মত ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। কিন্তু ফলাফল ছিল অন্যরকম। আলাদা আলাদা বিবৃতিতে আফ্রিকান ইউনিয়ন এবং চীন দুই পক্ষই জানায় পুরো ব্যাপারটাই পশ্চিমা বিশ্বের সাজানো। যারা মূলত আফ্রিকান ইউনিয়ন এবং চীনের মাঝে বিভেদ ঘটাতে আগ্রহী।

হুয়াওয়ে

হুয়াওয়ে ভবন (ছবি: স্কাইস্ক্রাপার)

কিন্তু ভিতরে ঠিকই আফ্রিকান দেশগুলো জানে তাদের তথ্য পাচার হয়ে গিয়েছে ৮০০০ কিলোমিটার দূরের আরেকটি ভবনে। চীনের শেনজেং শহরের হুয়াওয়ে নামের চীনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানির কাছে।

রেন জেংফেই এবং হুয়াওয়ে

‘৩০ বছর আগে আমি যখন শুরু করেছিলাম আমাদের বলতে গেলে টেলিফোনই ছিলো না। আমাদের হাতে ছিল হাতে ডায়াল ঘোরানোর মত ফোন, যেসব আপনি ২য় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে চলচ্চিত্রতে দেখতে পাবেন। আমরা তখন সত্যিই খুব পিছিয়ে ছিলাম’।

হুয়াওয়ের যাত্রার শুরুর দিনগুলো এভাবেই ব্যাখ্যা করেন প্রতিষ্ঠাতা রেন জেংফেই। ১৯৮৭ সালে চীন যখন নিজেদের অর্থনীতির পুনর্গঠনের পথে হাঁটছিলো তখনই নিজের কোম্পানির শুরু করেন রেন। চীন সে সময় মুক্ত বাজার অর্থনীতির পথে প্রথম অবস্থায় ছিলো। রেন জেংফেই বলেন, ‘আমি তো বটেই, সরকারের নীতি নির্ধারক পর্যায়ে অনেকেই তখন জানতেন না আসলেই মুক্তবাজার অর্থনীতি কাকে বলে। তখন সবারই এই বাজারে টিকে থাকা কষ্টসাধ্য বলে মনে হচ্ছিলো।’

রেন

হুয়াওয়ে প্রতিষ্ঠাতা রেন জেংফেই (ছবি: ফরচুন ডট কম)

দারিদ্র্যের সাথে নিয়মিত সংগ্রাম করে বড় হওয়া দারিদ্র্য ঘোচাতে এসে নিয়েছিলেন যা সেসময় সব তরুণই করেছিলেন। যোগ দেন পিপলস লিবেরেশন আর্মিতে। সেখানে কাজের পাশাপাশি মিলিটারি কোম্পানিতে ছিলেন টেকনিশিয়ান হিসেবে। ১৯৭২ এ যোগদান করে ১৯৮৩ সালে সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে সরাসরি ব্যবসায় নেমে পড়েন রেন। কিন্তু প্রথম দিকে ব্যবসায় সফল ছিলেন না তিনি। পরবর্তীতে নিজেই নেমে পড়েন মুক্তবাজার অর্থনীতি নিয়ে ব্যাপক পড়াশোনায়। ‘মুক্ত বাজার অর্থনীতি কী সেটা নিয়ে আমি ব্যাপক গবেষণা শুরু করি। আমি আইন নিয়ে পড়তে শুরু করি। এমনকি আমেরিকা বা ইউরোপের আইন নিয়েও। সেসময় চীনের আইন নিয়ে জানার বেশি কিছু ছিলো না তাই আমি বাইরের আইন নিয়েই পড়া শুরু করি।’

৫ বছর পর ১৯৮৭ সালে জন্ম নেয় হুয়াওয়ে। মান্দারিন এই শব্দের বাংলা দাঁড়ায় দুইভাবে। ‘অসামান্য সাফল্য’ কিংবা ‘চীনের পক্ষেও সম্ভব’। আর ১৯৯০ সালে প্রথমবার চীন সরকারের আস্থাভাজন হয়ে ওঠে হুয়াওয়ে। চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি যেখানে নিজেই আগে কাজ করতেন রেন, সেখানেই টেলিকমিউনেশন সাপ্লাই এর কাজ পায় হুয়াওয়ে। ১৯৯৫ সাল নাগাদ শুধুমাত্র চীনের বাজার থেকেই হুয়াওয়ে আয় করে প্রায় ২২০ মিলিয়ন ডলার। ১৯৯৬ সালে চীন সরকারে ‘ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন’ পদক আসে রেন এবং হুয়াওয়ের হাতে। ধীরে ধীরে চীন সরকারের আস্থার বড় নাম হয়ে উঠে হুয়াওয়ে। অ্যাপল থেকে অনুপ্রাণিত এই কোম্পানি এখন অ্যাপলকেই ছাড়িয়ে হয়ে আছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি টেলিকমিউনিশন প্রযুক্তি বিক্রেতা।

অনেকের মতে সরকারের সাথে আলাদা যোগাযোগ হুয়াওয়ের সাফল্যের মূল কারণ। কিন্তু তা অস্বীকার করেছেন রেন জেংফেই। ‘দয়া করে এটা ভাববেন না, আমাদের বিশেষ যোগাযোগ আমাদের সাফল্যের কারণ। শতভাগ রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানও কিন্তু এমন সাফল্য পায় না। তাহলে আপনিই বলুন, নিজেদের মাঝে ভাল যোগাযোগ কি সাফল্যের কারণ হতে পারে? হুয়াওয়ের সাফল্যের মূল কারণ আমাদের কঠোর পরিশ্রম’।

হুয়াওয়ে এবং বিতর্ক

১ ডিসেম্বর, ২০১৮। আর্জেন্টিনার বুয়েন্স এইরেসে জি-২০ সম্মেলন শেষে শি জিং পিং আর ডোনাল্ড ট্রাম্প বসেছেন দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে। ডোনাল্ড ট্রাম্প হাসিমুখে ঘোষণা দিলেন চীন-মার্কিন সম্পর্ক আজ নতুন দিগন্তে পৌঁছেছে। কিন্তু সত্যটা হলো, সেদিন থেকেই বরং বড় যুদ্ধের শুরু। হাজার মাইল উত্তরে কানাডার ভ্যানকুভার শহরের বিমানবন্দরে আটক হলেন এক নারী। নাম মেং ওয়ানঝু। তিনি হুয়াওয়ের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা। তারচেয়ে বড় কথা হুয়াওয়ে প্রতিষ্ঠাতা এবং চীন সরকারের বিশ্বস্ত বন্ধু রেন জেংফেই এর বড় মেয়ে তিনি। আর তার আটকের জন্য অনুরোধ করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই।

মেং

হুয়াওয়ে সিএফও মেং ওয়ানঝু (ছবি: গ্রাফিক ডট কম)

‘সে যখন গ্রেফতার হয়, বাবা হিসেবে আমি খুবই ভেঙে পড়ি’ কান্নাজড়িত কন্ঠে বিবিসিকে জানান রেন। ‘কিন্তু যা হবার তা হয়েই গিয়েছে। আমরা কেবল আইনের উপরই এখন নির্ভর করতে পারি’। কিন্তু সেটা ছিল হুয়াওয়ের প্রথম সমস্যা। দুইমাস পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুটি গুরুতর অভিযোগে হুয়াওয়ে এবং মেং ওয়ানঝুকে কে অভিযুক্ত করে। প্রথমটি, ইরানে নিজেদের ব্যবসা সম্পর্কে মার্কিন সরকার ও ব্যাংকের কাছে মেং ও হুয়াওয়ে এর মিথ্যাচার। আর ২য় অভিযোগ, আইন অবমাননা এবং বাণিজ্য চুক্তিতে গোপন নজরদারি। যদিও এর সবই অস্বীকার করেন আসামীপক্ষ।

তবে হুয়াওয়ে নিয়ে বিতর্ক সেটিই প্রথম না। এই শতাব্দীর শুরু থেকে সিসকো, নরটেল কিংবা মোটরোলার মত সব কোম্পানি গোপন নজরদারির জন্য চীনের কোম্পানি হুয়াওয়ের দিকে আঙ্গুল তাক করেছে। কিন্তু তা কখনোই খুব বেশি আলোর মুখ দেখেনি। যেমন দেখেনি মুন্ডে লা আফ্রিকার প্রতিবেদন। আফ্রিকান ইউনিয়নের বিবৃতির মত প্রতিবারই কিছু না কিছু ছিল হুয়াওয়ের পক্ষে। আর সেটা পুরোটাই চীন সরকারের কারণে।

কিন্তু এ দফায় বিতর্ক রঙ চড়িয়েছে আরো বেশি। চীন মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধের পাশাপাশি হুয়াওয়ে মার্কিন আগ্রাসনের শিকার আরেক বড় কারণে। সেটি ফাইভ জি প্রযুক্তি। মিত্র দেশ দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং আর নিজেদের অ্যাপলকে ফাইভ জি প্রযুক্তি নিয়ে এগিয়ে রাখতে ব্যাপকভাবে ব্যস্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যদিও নিজেদের পিছিয়ে রাখেনি হুয়াওয়ে। স্যামসাং আর অ্যাপলের আগেই বড় করে নিজেদের সামর্থ্য জানান দিয়েছে তারা।

ফোন

ফাইভ জি প্রশ্নে ৩ শক্তিধর প্রতিষ্ঠান (ছবি: কেআইপি)

আর এতেই বিপত্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। একের পর এক নিষেধাজ্ঞা, চড়া শুল্ক সব মিলিয়ে বেশ ঝামেলার মাঝেই আছে হুয়াওয়ে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে এখন বড় সমস্যা হুয়াওয়ে ঠিক কতটা পারবে নিজেদের গুছিয়ে নিতে। চীন সরকারের বিশ্বস্ত এই প্রতিষ্ঠান কি আরো একবার সরকারের সাহায্য পাবে নাকি এবারের লড়াইটায় ক্ষান্ত দিবে সব বিতর্কে হার মেনে নিয়ে? সে প্রশ্নের জবাব মিলতে বাকি আরো বেশ অনেকগুলো দিন।

ওডি/এএন

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড